এক
রকি বিচের যানবাহনের ভিড় কাটিয়ে এসে গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ধরল কিশোর। গাড়িতে ওর সঙ্গে রয়েছে ওর দুই বন্ধু ও সহকারী মুসা আর রবিন।
‘ওই যে ফোনে যা বললাম তোমাদেরকে,’ কিশোর বলল, ‘মিসেস কলিয়ার আমাদের জন্য একটা রহস্য জোগাড় করেছেন। ভূতের রহস্য।’
‘ভূত! সর্বনাশ!’ চমকে উঠল মুসা, ‘ফোনে তো ভূতের কথা বলনি! তাহলে আসতাম না।’
হাসল মুসার পাশে বসা রবিন। ‘সে জন্যই কিশোর তোমাকে বলেনি।’
ভুরু নাচাল মুসা। ‘মিসেস কলিয়ার কোথায় থাকেন? তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হলো কী করে, কিশোর?’
‘চাচার সঙ্গে মিসেস কলিয়ারের পরিচয়,’ কিশোর জানাল, ‘পুরোনো মাল কিনতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে বাস করেন তিনি। বয়স ষাট। কথায় কথায় চাচাকে ভূতটার কথা বলেছেন।’
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুসা, ‘কিশোর, সাবধান!’
বাতাস লাগানোর জন্য গাড়ির ছাদ, অর্থাৎ সান রুফটা খুলে রেখেছে কিশোর। সে কিছু করার আগেই একটা পাথর গাড়ির খোলা ছাদ দিয়ে ভেতরে এসে পড়ল। রবিনের পায়ের কাছে।
অবাক হয়ে ব্রেক কষল কিশোর। গাড়িটা রাস্তার পাশে নিয়ে এল। চেঁচিয়ে বলল, ‘কী ওটা?’
পাথরটা তুলে নিল রবিন। তাতে রবারের ব্যান্ড দিয়ে ভাঁজ করা কাগজটা লাগানো।
‘বাহ্, চিঠি পাঠানোর চমৎকার উপায়!’ ব্যান্ড খুলে কাগজটা মেলে ধরল ও। জোরে জোরে পড়ল, ‘রকি বিচে ফিরে যাও, নইলে খুন করে ফেলব!’
আঁকাবাঁকা অক্ষরে হাতে লেখা শব্দগুলোর দিকে তাকাল মুসা। ‘আমার একটুও ভালো লাগছে না। মনে হয় আমাদের ফিরেই যাওয়া উচিত।’
‘উহু,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল রবিন, ‘পাথর ছোড় আর যা-ই কর, ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াতে পারবে না।’
একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘চলো, নেমে দেখি, কোনো সূত্রটুত্র পাওয়া যায় কি না। বোঝার চেষ্টা করি, কে আমাদের মিসেস কলিয়ারের কাছে যেতে বাধা দিতে চায়।’
গাড়ি থেকে নামল কিশোর আর রবিন।
মুসা নামল অনিচ্ছা সত্ত্বে, তবে কোনো কথা না বলে নীরবে অন্য দুজনের পিছু নিল।
সামনে একটা ঝোপের ভেতরে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ শুনে সেদিকে দৌড় দিল ওরা।
‘এসো! এসো!’ তাগাদা দিল কিশোর।
ঝোপটার ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
লতাপাতায় এতই ঘন হয়ে আছে, দ্রুত এগোনো কঠিন।
হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল শব্দটা।
‘পালানোর জন্য তৈরিই হয়ে ছিল,’ হতাশ কণ্ঠে কিশোর বলল। আবার নিজেদের গাড়ির দিকে ফিরে চলল।
চলতে চলতে থেমে গেল রবিন। মাটি থেকে একটা জিনিস কুড়িয়ে নিল। ‘দেখো, দেখো!’
‘গুলতি!’ জিনিসটার দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, ‘গুলতির সাহাযে্য ওই পাথরটা ছুড়েছে লোকটা। যদি ‘‘লোক’’ হয়ে থাকে।’
মাথা ঝাঁকাল রবিন, ‘লোক না হলে মহিলা।’
‘আমি আসলে মানুষের কথা বলছি না।’ বিড়বিড় করল মুসা।
‘ভূতের কথা বলছ, তাই তো?’ মুসার কাঁধে হাত রাখল কিশোর। ‘ভয়ের কিছু নেই। এসো। এর চেয়ে খারাপ ভূতের সঙ্গেও টক্কর লেগেছে আমাদের। শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি ওগুলো।’
‘তা অবশ্য ঠিক,’ জোর করে মুখে হাসি ফোটাল মুসা, ‘চলো, মিসেস কলিয়ারের সঙ্গে দেখা করব।’
দুই
আধা ঘণ্টা পর লম্বা একটা ড্রাইভওয়ে দিয়ে বড়, সাদা রঙের একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওদের গাড়ি। জানালাগুলো কালো রং করা।
রাস্তা থেকে অনেক দূরে বাড়িটা, গাছপালায় ঘেরা।
লাল রং করা একটা গোলাঘর দেখা গেল।
একটা হাঁসের পুকুরও আছে। তাতে অনেক পদ্মফুল।
‘পুরোনো আমলের বাড়ি,’ মুসা বলল, ‘খুব সুন্দর!’
একজন গোলগাল মহিলা মিসেস কলিয়ার, কোঁকড়া চুল ধূসর হয়ে গেছে। ছেলেদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন পেছনের বারান্দায়। ‘তোমরা এসেছ, খুশি হয়েছি। তোমাদের জন্য লেমোনেড আর কিছু নাশতা বানিয়ে রেখেছি। আমি রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসছি, তোমরা আরাম করে বোসো।’
খাবারের কথা শুনে উজ্জ্বল হলো মুসার মুখ।
কয়েক মিনিট পর ফ্রুটকেক, আপেলের পাই, আর লেমোনেড খেতে খেতে ভূতটার গল্প শুনতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
‘ঘটনাটার শুরু দশ বছর আগে,’ মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘সে সময় আমার স্বামী এই বাড়িটা ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। রকি বিচে থাকতাম তখন আমরা, একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে। ওটা ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে উঠলাম। আমাদের কাছে কিছু দামি জিনিস ছিল, যেগুলো আমরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের মালপত্র সব এখানে পৌঁছে দিয়ে যায় যে লোকটা, তার নাম মিস্টার জোনস। মুভিং কোম্পানির ফোরম্যান ও।’
‘কী ধরনের দামি জিনিস?’ জানতে চাইল মুসা।
‘রুপার একটা টি-সেট—ব্রিটেনের রাজা সপ্তম জর্জের ব্যবহার করা জিনিস, খোদাই করা একটা থালা—মাঝখানে খোদাই করে ছবিটা এঁকেছিলেন আঠারো শ সালের বিখ্যাত ব্রিটিশ রৌপ্যকার র্যাম হেজউইন। জিনিসগুলোর অ্যান্টিক মূল্য অপরিসীম।’
‘দেখতে পারলে খুশি হতাম।’ রবিন বলল।
‘দেখবে কীভাবে, ওগুলো নেই,’ মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘জিনিসগুলো নিয়ে আসছিল মিস্টার জোনস। রাস্তায় হাইজ্যাকাররা ওর গাড়ি থামিয়ে সেগুলো কেড়ে নেয়। নিজেদের ভ্যানগাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়।’
‘ও নিজেও চুরি করে থাকতে পারে,’ রবিন বলল, ‘নিজে চুরি করে হাইজ্যাকারের নাম দিয়েছে।’
‘হতে পারে,’ মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘পুলিশও ওকে সন্দেহ করেছে, ওর আঙুলের ছাপ নিয়েছে। রেকর্ড ঘেঁটে দেখেছে, লোকটার বিরুদ্ধে সশস্ত্র ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। যদিও সেটা ভিন্ন ঘটনা। ডাকাতির কেসে জেলে ঢোকানো হয়েছে ওকে। বারবার পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে আমাদের জিনিসগুলো নেওয়ার কথা কিছুতেই স্বীকার করেনি ও।’
‘আমার চাচাকে একটা ভূতের কথা বলেছেন আপনি,’ কিশোর বলল, ‘সেটার কথা কিছু বলবেন?’
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা মলিন খাম বের করে কিশোরের হাতে দিলেন মিসেস কলিয়ার।
ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করল কিশোর।
কাগজে নীল চক দিয়ে কবিতার ঢঙে লেখা রয়েছে:
ভূতে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে
যে প্রবেশ পথটায়
সেটা নিয়ে যাবে
অন্ধকারের জগতে
লেখাটা পড়ে প্রশ্ন করল কিশোর, ‘মানে কী এর?’
‘আমি জানি না। একদিন চিলেকোঠা পরিষ্কার করতে গিয়ে এটা পেয়েছি। একটা পুরোনো ট্রাংকের তলায় পড়ে ছিল। আমরা এখানে আসার পর থেকে আর ট্রাংকটা সরানো হয়নি। আমার ধারণা, আমাদের অ্যান্টিকগুলোকেই এটাতে লেখা গুপ্তধন বোঝানো হয়েছে। তবে ভূতটা কোথায় আছে, কোথায় বসে অন্ধকারের জগতে যাওয়ার গেট পাহারা দিচ্ছে, আমি জানি না।’
‘জোনসও এটা ফেলে রেখে যেতে পারে,’ কাগজটা দেখিয়ে বলল কিশোর, ‘হয়তো অ্যান্টিকগুলো সে-ই লুকিয়ে রেখেছে, তারপর বলেছে চুরি হয়ে গেছে। এই কাগজটা হয়তো তার কোনো সহকারীকে জানানোর জন্যই লিখেছিল, কিন্তু ভুল করে চিলেকোঠায় ফেলে গেছে।’
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস কলিয়ার। ‘আমিও এ কথাই ভেবেছি। কিন্তু তুমি...’ কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন তিনি। কারণ লাফিয়ে উঠে দৌড় দিয়েছে তখন কিশোর। একছুটে বারান্দা পেরিয়ে গেল ও। একটা পাতাবাহারের ঝাড়ের ওপার থেকে একজন মানুষকে ওদের দিকে চোখ রাখতে দেখেছে। কিন্তু লোকটার কাছে পৌঁছানোর আগেই কিশোরকে দেখে আড়াল থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে পেছনের চত্বর পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল লোকটা।
পেছন পেছন দৌড়ে গেল কিশোর। কিন্তু লোকটাকে ধরতে পারল না। গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। বারান্দায় ফিরে এল আবার কিশোর।
‘আরও কেউ আপনার এই রহস্যের কথা শুনতে আগ্রহী,’ মিসেস কলিয়ারকে বলল ও, ‘ধরতে পারলাম না। তবে দেখতে কেমন, সেটা দেখে এসেছি।’
‘তোমার কি ধারণা, আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল কিশোর। ‘না। অনেক দূরে ছিল লোকটা। এত দূর থেকে আমাদের কথা ওর কানে যাওয়ার কথা নয়। তবে কথা শুনতেই হয়তো এসেছিল।’ রাস্তার কথাটা ভাবল ও। তবে সেটা আর মনে করিয়ে দিল না দুই সহকারীকে। মহিলার সামনে এসব বলে তাঁকেও আরও বেশি ঘাবড়ে দিতে চাইল না।
উঠে দাঁড়ালেন মিসেস কলিয়ার। একজন লোককে আসতে দেখা গেল। লোকটাকে দেখিয়ে মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘উনি মিস্টার মরিসন। আমাদের প্রতিবেশী। পাতাবাহারের ওই বেড়াটা আমাদের দুই বাড়ির সীমানা। আসুন, ভালোই হলো। এদিকে যে একজন দুষ্ট লোক ঘুরঘুর করছে, এটা তাঁকে জানানো দরকার।’
‘তিনিও হয়তো জানালা দিয়ে লোকটাকে দেখেছেন,’ কিশোর বলল, ‘সেটাই বলতে আসছেন হয়তো।’
তিন
কয়েক মিনিট পর সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এলেন গাট্টাগোট্টা একজন লোক। ছোট ছোট কুতকুতে বাদামি রঙের চোখ তাঁর। নাকের নিচে সুন্দর করে ছাঁটা কালো গোঁফ। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিসেস কলিয়ার।
আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসিমুখে সবার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি, ‘আমি হিউগ মরিসন।’
‘ভাবলাম এখানে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার,’ মিসেস কলিয়ারকে বললেন মিস্টার মরিসন, ‘যে লোকটার কথা বললেন, যাকে ঘুরঘুর করতে দেখা যায় এখানে, তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি আমি। কিসের জন্য আসে এখানে, বুঝতে পারছি না।’
‘ওকে দেখেছেন নাকি আপনি, মিস্টার মরিসন?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়লেন মরিসন। ‘না। তবে মনে হচ্ছে মিসেস কলিয়ারের ভূতটার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক আছে।’
অবাক হলো কিশোর। ভূতের কথা তাহলে মিস্টার মরিসনও জানেন। সবাইকেই বলে বেড়াচ্ছেন মিসেস কলিয়ার। আর কাকে কাকে বলেছেন, কে জানে, ভাবল কিশোর। যাই হোক, এ নিয়ে তাঁকে কোনো প্রশ্ন করল না কিশোর। মিসেস কলিয়ারের দিকে ফিরে বলল, ‘আপনার বাড়িটায় একবার ঘুরে দেখলে কোনো আপত্তি আছে, মিসেস কলিয়ার? হয়তো কোনো সূত্রটুত্র পেতেও পারি।’
‘না না, আপত্তি কিসের? যাও, দেখো।’ কিশোরকে বলে, এক গ্লাস লেমোনেড ঢেলে মিস্টার মরিসনকে দিলেন।
বাড়িটা ঘুরে দেখতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে চিলেকোঠায় এসে ঢুকল। মস্ত একটা ঘর। ধুলায় ভরা। এক কোণে স্তূপ করে রাখা বাক্স আর সুটকেস। এগুলোতে কোনো সূত্র পেল না। এরপর বাড়ির প্রতিটি ঘরে উঁকি দিয়ে শেষে বেজমেন্টে এসে নামল। পুরোনো আসবাবপত্র আর গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত ছোটখাটো যন্ত্রপাতি পড়ে আছে এখানে। বহু বছর ধরে এগুলোর কোনোটাতেই হাত দেওয়া হয়েছে বলে মনে হলো না।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এসব ভাঙা জিনিসপত্রের মধ্যে সূত্র খুঁজতে আরম্ভ করল দুই সহকারীকে নিয়ে। এমন কোনো সূত্র, যার সাহাযে্য অনুমান করতে পারে পুরোনো অ্যান্টিকগুলো কোথায় আছে।
‘ধুর, অকারণে ধুলো লাগিয়ে হাত নোংরা করছি!’ কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সেখানেও ময়লা লাগাল মুসা, ‘এখানে কিছুই পাওয়া যাবে না।’
‘যাবে না ভেবে কাজ বন্ধ রাখলে কখনোই পাওয়া যাবে না,’ মুসার দিকে তাকাল রবিন, ‘কাজ করো, খিদে পাবে, অনেক বেশি খেতে পারবে।’
মুখ বাঁকাল মুসা। ‘এদিকে এসো। এই বুককেসটা সরাতে সাহায্য করো আমাকে। কিশোর, তুমিও এসো। ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। তিনজনে ছাড়া পারব না।’
ভারী জিনিসটা ঠেলে একপাশে সরানো হলো। সিমেন্টের মেঝেতে একটা আয়তাকার দাগ চোখে পড়ল মুসার। লোহার একটা আংটাও লাগানো রয়েছে। ‘খাইছে! একটা ট্র্যাপডোর!’ চেঁচিয়ে উঠল ও। ‘দেখো!’
‘আহ্, দারুণ একটা আবিষ্কার করলে, মুসা,’ উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল। আংটাটা ধরে টান দিল ও। কিন্তু নড়ল না চারকোনা ঢাকনার মতো দরজাটা।
একটা শাবল খুঁজে নিয়ে এল রবিন। ‘এটা দিয়ে চেষ্টা করা যাক।’
আংটার ভেতর শাবলের এক মাথা ঢুকিয়ে দিল কিশোর। মাথাটা মেঝেতে ঠেকিয়ে পেছনটা তিনজনে মিলে চেপে ধরে টানতে লাগল। ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল ঢাকনাটা। বেরিয়ে পড়ল একসারি পাথরের ধাপ। সিঁড়িটা নিচের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
‘এ তো ভীষণ অন্ধকার,’ মুসা বলল, ‘ওখানে নামতে যাচ্ছি না আমরা, তাই না?’
পকেট থেকে একটা পেন্সিল টর্চ বের করল কিশোর। ‘হ্যাঁ, নামব। ভয় নেই, আমিই আগে থাকব।’
সাবধানে, এক ধাপ এক ধাপ করে, নিচের অন্ধকারে নেমে চলল ও। সিঁড়িগুলো সেঁতসেঁতে, পিচ্ছিল। যেকোনো মুহূর্তে পা পিছলাতে পারে। হঠাৎ একটা হাত এসে ওর কাঁধ চেপে ধরল।
অস্ফুট চিৎকার দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে তাকাতে গেল কিশোর।
‘সরি! আমি,’ রবিন বলল, ‘পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম।’
পাথরের সিঁড়ির নিচে একটা ছোট ঘর। ইটের তৈরি দেয়াল। শূন্য। যেদিক দিয়ে নেমেছে ওরা, সেদিকটা ছাড়া বেরোনোর আর কোনো পথ নেই।
‘এ ঘরটা কী জন্য বানিয়েছিল?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘যে জন্যই বানাক, অ্যান্টিকগুলো এখানে নেই।’ মুসা বলল।
‘ভূতও নেই।’ হাসল রবিন।
সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল মুসা। ‘চলো চলো, ফিরে যাই। মিসেস কলিয়ারকে এ ঘরটার কথা জিজ্ঞেস করি।’ বলে আর একটা মুহূর্তও দেরি না করে তাড়াহুড়া করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।
ফিরে এসে দেখল ওরা, এখনো বারান্দায় বসে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলছেন মিসেস কলিয়ার। গোপন ঘরটার কথা তাঁকে জানানো হলে ভ্রুকুটি করলেন তিনি। ‘তাই নাকি? এমন একটা ঘর আছে, তা তো জানতাম না। পুরোনো এই বাড়িটা সম্পর্কে বহু গল্প প্রচলিত আছে। কোনো একসময় নাকি চোরাচালানিরা থাকত এ বাড়িতে। ওদের সর্দার আমার স্বামীর পূর্বপুরুষ ছিল। হয়তো অবৈধ মাল কিংবা দলের লোকদের লুকানোর জন্য ওই ঘরটা বানিয়েছিল।’
‘প্রথমে আমাদের মনে হয়েছিল মেসেজে যে পথের কথা লেখা আছে,’ রবিন বলল, ‘সেই পবেশপথের সন্ধান পেয়েছি আমরা। অন্ধকারের জগতে, অর্থাৎ মাটির নিচের ঘরে নামতে যাচ্ছি আমরা। তবে এখন মনে হচ্ছে, মিথ্যা সূত্র দেওয়া হয়েছে ওই নোটে।’
‘মাটির নিচের ঘর,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করল কিশোর, ‘হয়তো ঠিক সূত্রই দিয়েছে। মিসেস কলিয়ার, রকি বিচ কবরস্থানে আপনাদের কোনো পারিবারিক ক্রিপ্ট আছে?’
ক্রিপ্ট মানে কবরে মাটির নিচের ঘর।
‘আছে, আছে,’ জবাব দিলেন মিসেস কলিয়ার, ‘কিন্তু গত বিশ বছরের মধ্যে ওটা খোলা হয়নি।’
‘ভাবছি, আপনার অ্যান্টিকগুলো ওখানে লুকানো রয়েছে কি না,’ কিশোর বলল, ‘ভূতে পাহারা দিচ্ছে বলে কবরস্থানের কথা বোঝানো হয়েছে, আর যে প্রবেশপথ নিয়ে যাবে অন্ধকারের জগতে বলে বোঝানো হয়েছে দরজাটার কথা।’
‘বাপ রে! ভয়ংকর! এডগার অ্যালান পোর গল্পের মতো মনে হচ্ছে,’ হাসিমুখে বললেন মিসেস কলিয়ার, ‘তবে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলে দেখতে পারো।’
রান্নাঘরে গিয়ে পুরোনো মরচে পড়া একটা চাবি নিয়ে এলেন তিনি। ‘নাও। ক্রিপ্টটা পাবে একেবারে শেষ মাথার বাঁ দিকে।’
‘মুসা, চাবিটা নাও।’ কিশোর বলল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাবিটা নিল মুসা। চাবিটার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল, যেন ঘিনঘিনে শুঁয়োপোকা, তারপর পকেটে ভরে রাখল। কবর, ভূত, এসব থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে ও। ‘চলো, যাই। গুপ্তধনগুলো আছে কি না, খুঁজে দেখি।’
সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। মিস্টার মরিসন তাঁর লেমোনেড শেষ করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। হাঁটতে লাগলেন পেছনের চত্বর ধরে, তাঁর বাড়ির দিকে।
গাড়িটা এখন চালাতে চাইল রবিন। আপত্তি করল না কিশোর। রবিনকে চাবিটা দিয়ে নিজে উঠে বসল পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে। পেছনে ফিরে মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্রিপ্টের চাবিটা দাও তো?’
চাবি বের করে দিল মুসা। দেখতে দেখতে কিশোর বলল, ‘অনেক পুরোনো। পেছনে লেখা রয়েছে, কলিয়ার ক্রিপ্ট, রকি বিচ গোরস্থান।’ চাবিটা ভালোমতো দেখে পকেটবুকের ভেতর রেখে দিল কিশোর। ‘অন্ধকার হয়ে আসছে,’ বলল ও, ‘আজ পূর্ণিমা, জ্যোৎস্না পাওয়া যাবে। রাতটা বেশ পরিষ্কারই হবে। অন্তত অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে না।’
গোরস্থানে যাওয়ার কথা ভেবে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে মুসা। তবে কিছু বলল না।
চার
গোরস্থানে যখন পৌঁছাল ওরা, গাছপালার ফাঁক দিয়ে তখন রুপালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে জ্যোৎস্না। একটা পেঁচার বিলাপের মতো ডাক গায়ে কাঁপুনি তুলল ওদের। তবে সাহস হারাল না ওরা। গাড়ি থেকে নেমে, মস্ত গেটটা দিয়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বিকেলের গরমকে তাড়িয়ে দিল ঠান্ডা বাতাস। গোরস্থানের বাগান থেকে ফুলের সুগন্ধ এসে লাগল ছেলেদের নাকে। বাতাসে দুলছে ওক গাছের ডাল। গাছগুলো কবরের ওপর বড় বড় কালো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন দানবীয় প্রেতের মতো।
‘এমন দেখাবে আগে জানলে আসতাম না,’ ফিসফিস করে বলল মুসা, ‘আমার মনে হয় অন্ধকারে আর না এগিয়ে কাল দিনের বেলায় ফিরে এলেই ভালো হবে।’
‘না, এখনই বরং ভালো,’ কিশোর বলল, ‘লোকজন নেই, আমাদের দেখতে পাবে না। কৌতূহলী হবে না।’
সাবধানে দুই সারি কবরের মাঝখানের পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। ভুতুড়ে নীরবতার মধ্যে খোয়া বিছানো পথে ওদের জুতার শব্দ অস্বাভাবিক জোরালো হয়ে কানে বাজছে। বেদিতে বসানো মূর্তিগুলোকে ভুতুড়ে আলোয় দেখে মনে হচ্ছে বাতাসে ডানা মেলে উড়ে যাবে।
হঠাৎ বিষণ্ন স্বরে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, ‘কিশোর পাশা! সাবধান! আমি মিস্টার কলিয়ার, কবর থেকে উঠে এসেছি তোমাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য! ভালো চাও তো এক্ষুনি এই বিপজ্জনক গোরস্থান ছেড়ে চলে যাও!’
পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল যেন তিনজনে।
‘কি-কি-ক্বিশোর!’ তোতলাতে শুরু করল মুসা, ‘চলো, পালাই!’
‘না!’ দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, ‘ওটা ভূত নয়। কোনো মানুষ আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।’
‘ও সফল হয়েছে,’ মুসা বলল, ‘ভয় আমি পেয়েছি। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, গিয়ে গাড়িতে বসে আমাদের অপেক্ষা করো,’ কিশোর বলল, ‘অস্বাভাবিক কিছু দেখলে হর্ন বাজিয়ে আমাদের সাবধান কোরো।’
কোনো কথা না বলে ঘুরে দ্রুত চলে গেল মুসা। কিশোর আর রবিন এগিয়ে চলল। বুঝতে পারছে ক্রিপ্টটা আর বেশি দূরে নেই। হঠাৎ রবিনের হাত চেপে ধরল কিশোর। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘শুনলে?’
‘হ্যাঁ। কেউ চিৎকার করছে। তবে শব্দটা চাপা,’ রবিন জবাব দিল, ‘মুসা হতে পারে। দেখে আসা দরকার।’
ফেরার জন্য ঘুরতে যাবে, এ সময় আবার কথা বলে উঠল সেই বিষণ্ন কণ্ঠটা, ‘কিশোর পাশা, এক্ষুণি বেরিয়ে যাও! নইলে আর প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারবে না।’
‘আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’ রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘গাড়িতে গিয়ে দেখা দরকার মুসা ঠিক আছে কি না।’
কিন্তু ফিরে এসে কোথাও মুসাকে দেখতে পেল না ওরা।
‘চাপা চিৎকারটা ওদিক থেকে এসেছে,’ কিশোর বলল। মুসাকে খুঁজতে শুরু করল দুজনে। আবার ফিরে এল কবরের সারির মাঝখানের রাস্তায়। সেখানেও মুসাকে খুঁজল।
‘মুসা?’ চেঁচিয়ে ডাকল রবিন। ‘কোথায় তুমি?’
কোনো জবাব এল না।
উদ্বেগে পেটের ভেতরে একধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কিশোরের। কী হলো মুসার? হঠাৎ ওদের বাঁয়ে একটা মূর্তির পেছনে নড়াচড়া দেখা গেল। ফিসফিস করে কিশোর বলল, ‘রবিন, ওখানে!’
সাবধানে মূর্তিটার কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে।
‘মুসা?’ আবার ডাকল কিশোর।
হঠাৎ ঠেলা লাগল পিঠে। ঝুঁকে গেল সামনের দিকে। পরমুহূর্তে উল্টে পড়ে গেল একটা গভীর কালো গর্তে।
ওদিকে চোখের কোণ দিয়ে কালো একটা মূর্তি দেখতে পেল রবিন। মুখোশ পরা। কিশোরকে ঠেলা দিচ্ছে। একটা কবরের কিনারে রয়েছে ওরা। লোকটা কিশোরের ক্ষতি করার আগেই আক্রমণ করে বসল রবিন। একটা কারাতের কোপ মেরে, নিজেকে পেছনে ছুড়ে দিয়ে, গড়ান দিয়ে, আবার লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। আবার লোকটাকে আক্রমণ করতে ছুটল। সুযোগ বুঝে কিশোরও আক্রমণ করে বসল।
লোকটা বুঝতে পারল, শক্ত প্রতিপক্ষ, লড়াই করে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাড়াতাড়ি রবিনের কাছ থেকে সরে গিয়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, গেট লক্ষ্য করে ছুটল।
লোকটা চলে যেতেই গর্তের দিকে ফিরে তাকাল রবিন। চেঁচিয়ে ডাকল, ‘কিশোর?’
‘এই যে এখানে।’ জবাব দিল কিশোর।
খোলা কবরটার দিকে তাকাল রবিন। চেঁচিয়ে উঠল, ‘মুসাও আছে?’
‘আছে,’ কিশোর জানাল, ‘ওর হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়েছে লোকটা। দেখি, ধরো, ওকে টেনে তুলি।’ মুসার বাঁধন খুলে ওকে ওপরের দিকে ঠেলে দিল কিশোর। মুসার হাত ধরে তাকে ওপরে ওঠতে সাহায্য করল রবিন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল মুসা। এক্কেবারে কাবু হয়ে গেছে বেচারা। কবরের দেয়ালে একটা খাঁজ খুঁজে বের করে, তাতে পায়ের ডগা বাঁধিয়ে দিয়ে ওপরের দিকে হাত তুলে দিল কিশোর। ওর হাত ধরে ওকে ওপরে তুলে আনল রবিন।
‘হুফ্’ করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। ‘কেউ আমাদের ওই ক্রিপ্টটা থেকে দূরে রাখতে চায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
ঠিক এই সময়, দূরে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। ‘ওই যে পালাচ্ছে,’ কিশোর বলল, ‘রবিন, ওকে ভাগালে কীভাবে?’
‘কারাতের মার,’ রবিন বলল, ‘মোটাসোটা লোক, ক্ষিপ্রতা কম, দুবার মারতেই হাল ছেড়ে দিয়ে পালাল। মুখে মুখোশ থাকায় চিনতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে পারবে না বুঝে মুখোশ খুলে ফেলার আগেই ভেগেছে।’
‘ভালো দেখিয়েছ।’ রবিনের হাত চেপে ধরল কিশোর।
‘এই খোঁজা কি চালিয়ে যাবে?’ ঘাসের ওপর উঠে বসল মুসা, ‘আমার অবস্থা কাহিল...’
‘তা তো হবেই,’ কিশোর বলল, ‘নিশ্চয় পেছন থেকে তোমার মাথায় বাড়ি মেরেছিল। যাই হোক, ও চলে গেছে। আর জ্বালাবে না। এটাই আমাদের খোঁজার সুযোগ। এসো।’
কিশোর আর রবিনের সঙ্গে কলিয়ারদের ক্রিপ্টের কাছে ভয়ে ভয়ে এল মুসা। যথেষ্ট বড় একটা ঘর। বারো ফুট দৈর্ঘ, বারো ফুট প্রস্থ, আর ছয় ফুট উঁচু। দরজার গায়ে কলিয়ারদের পারিবারিক নাম খোদাই করা।
পকেট থেকে চাবি বের করে তালায় ঢোকাল কিশোর। দরজায় ঠেলা দিল। মরচে পড়া কবজার কিচকিচ শব্দ তুলে ভেতর দিকে খুলে গেল দরজাটা।
ছাতলাপড়া গন্ধ এসে ধাক্কা দিল নাকে। টর্চ জ্বালল কিশোর। ভেতরে ঢুকল তিনজনে। মেঝেটা মার্বেল পাথরে তৈরি। দেয়াল ঘেঁষে রাখা কয়েকটা কফিন।
টর্চের আলোয় কফিনগুলো দেখতে লাগল কিশোর। একেবারে বাঁয়ের কফিনটার ওপর এসে স্থির হলো আলো। ডালাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।
‘কোথাও তো কোনো জিনিসপত্র দেখছি না,’ রবিন বলল, ‘শুধু মিসেস কলিয়ারের আত্মীয়দের কফিন ছাড়া।’
‘এক মিনিট,’ কিশোর বলল। একটা কফিনের গায়ে আলো নাচিয়ে বলল, ‘এই কফিনটা দেখছ? অন্যগুলোর মতো এটাতে কোনো নেমপ্লেট নেই। ডালাও লাগানো।’
‘ওটা খুলবে?’ মুসার প্রশ্ন, ‘মাথা খারাপ হয়নি তো তোমার?’
কিন্তু ততক্ষণে ডালাটা খুলতে শুরু করে দিয়েছে কিশোর। খোলার পর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওরা। ভেতরে কাপড়ে মোড়ানো কোন জিনিস রয়েছে।
কাপড়ের পঁুটুলিটা তুলে নিয়ে খুলল রবিন। মোড়ক খুলতেই একটা রুপার বাটি দেখা গেল।
‘কিশোর!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা, ‘মিসেস কলিয়ারের অ্যান্টিকগুলো পেয়ে গেছ তুমি।’
‘পেয়েছি। তবে তোমাদের সহায়তা ছাড়া পারতাম না,’ কিশোর বলল, ‘যদি...’
পেছনে জোরে একটা শব্দ হতেই থেমে গেল ও। পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল তিনজনে। ক্রিপ্টের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। মুহূর্ত পরেই অট্টহাসির শব্দ ভেসে এল। ‘হাহ্ হাহ্ হা! আমি তোমাদের সাবধান করেছিলাম। তোমরা আমার কথা শোননি। এখন তোমরা মরবে। কলিয়ারদের পূর্বপুরুষ আর চোরাচালানিদের মতো, যাদের বহু বছর আগে এই ক্রিপ্টে বন্দী করে মেরেছি আমি। গুড-বাই, কিশোর পাশা!’
‘ওই লোকটা তার মানে যায়নি,’ ফিসফিস করে বলল মুসা, ‘আমাদের এখানে তালা আটকে দিয়ে গেছে।’
‘ও চলে গেছে ভেবে এতটাই অসাবধান হয়েছি আমরা,’ রবিন বলল, ‘তালায় চাবিটা ঢুকিয়ে রেখেই চলে এসেছি। কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি।’
‘হুঁ,’ কিশোর বলল, ‘পুরোপুরি বোকা বানাল আমাদের।’
‘এখন কী করব?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা।
দরজায় আলো ফেলল কিশোর। ‘এপাশ থেকে দরজাটা খোলা সম্ভব নয়।’
‘তার মানে ফাঁদে পড়লাম আমরা?’ মুসা বলল।
‘চিন্তা কোরো না,’ সাহস জোগাল কিশোর, ‘বেরোনোর কোনো না কোনো উপায় করেই ফেলব। এ জায়গাটার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখব। হয়তো আলগা কোনো স্লাব কিংবা মার্বেল পাথর পেয়েও যেতে পারি, যেটা খুলে বেরোতে পারব আমরা।’
মরিয়া হয়ে খুঁজতে শুরু করল তিনজনে। কিন্তু কোথাও আলগা কিছু কিংবা দেয়ালের গায়ে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পেল না, যেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
‘কিছু নেই,’ হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন, ‘এতই নিখুঁত করে বানানো, একটা ইঁদুর বেরোনোরও জায়গা নেই।’
কেশে উঠল ও। বদ্ধ বাতাসে দম নেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।
মিসেস কলিয়ারের অ্যান্টিক রাখা কফিনটায় খুঁজল কিশোর।
‘কফিনের হাতলগুলো দেখো,’ বলল ও, ‘যদি এই সোজা হাতলটা ভেঙে নিতে পারি, এটাকে ছেনি বানিয়ে দরজার কবজা ভাঙার চেষ্টা করতে পারব। আর ভাঙতে পারলে বেরিয়ে যেতে পারব।’
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। ‘কিন্তু ছেনিটাকে পেটানোর জন্য একটা হাতুড়ি দরকার। সেটা পাব কোথায়? ভাঙার জন্যও কিছু একটা দরকার।’
‘তা ঠিক।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।
মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা, ‘এই যে এগুলো দিয়ে পেটানো যাবে।’ লোহার চারকোনা ইঁটের মতো জিনিস তৈরি করে তার ওপর রাখা হয়েছে কফিনগুলো। ইঁটগুলো আলগা।
‘দারুণ, দারুণ জিনিস আবিষ্কার করেছ!’ মুসাকে বলে কফিনের নিচ থেকে একটা ধাতব ইট বের করে আনল কিশোর। সেটা দিয়ে কফিনের হাতলে পেটাতে শুরু করল। খুলে এল হাতলটা। ‘হয়েছে। এটা দিয়ে এখন কবজা খোলার চেষ্টা করতে হবে।’
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। ‘মুসা, এদিকে এসো। হাতলের এক মাথা কবজার ওপর চেপে ধরো। অন্য মাথায় পেটাব আমি। রবিন, টর্চটা ধরো।’
কবজার ওপর টর্চের আলো ফেলে ধরে রাখল রবিন। কিশোর আর মুসা কবজা খোলার চেষ্টা শুরু করল। প্রথমে কিছুই হলো না। বরং কিশোরের হাতের ইঁটটা ছুটে গিয়ে আরেকটু হলেই মুসার হাত ছেঁচে দিচ্ছিল।
‘কিশোর! সাবধান!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
‘সরি!’ কিশোর বলল, ‘তুমি শক্ত করে ধরো। আবার চেষ্টা করি।’
অবশেষে কঠোর পরিশ্রম করার পর দরজার গা থেকে ছুটে গেল একটা কবজা।
‘কাজ হয়েছে!’ রবিন বলল, ‘কিন্তু তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতে না পারলে বেরোনো তো দূরের কথা, দম আটকেই মরব আমরা। বাতাসের অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে।’
‘আরেকটা কবজা ছোটাতে হবে।’ কিশোর বলল।
আবার পরিশ্রম শুরু করল কিশোর ও মুসা। মরচে ধরা পেরেকগুলো ছোটানো খুব সহজ হলো না। তবে শেষ পর্যন্ত কবজাগুলো ছুটিয়ে দরজাটা খুলে ফেলতে পারল ওরা। হুড়মুড় করে ভেতরে এসে ঢুকল তাজা বাতাস। উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল তিনজনে। দৌড়ে বেরিয়ে এল বদ্ধ চেম্বারটা থেকে। ঘাসের ওপর নেতিয়ে পড়ে হাঁ করে দম নিতে লাগল। বুক ভরে টেনে নিল রাতের ঠান্ডা বাতাস।
‘পুলিশকে জানাতে হবে,’ কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বলল কিশোর, ‘অ্যান্টিকগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। নইলে নকল ভূতটা এসে ওগুলো বের করে নিয়ে যেতে পারে।’
জিনিসগুলো বের করে আনল ওরা। গাড়িতে রাখল। তারপর রকি বিচ থানায় এল। ডিউটি সার্জেন্ট ওদের চেনা। এত রাতে এতগুলো অ্যান্টিকসহ ওদের দেখে অবাক হলেন। সব শোনার পর রেগে গিয়ে বললেন, ‘ওই ভূত ব্যাটাকে ধরে গারদে পোরা দরকার। লোকটা কে হতে পারে, কিছু অনুমান করতে পারো?’
মাথা নাড়ল তিন গোয়েন্দা।
‘তবে এটা ঠিক এমন কেউ, যে অ্যান্টিকগুলোর কথা জানে,’ কিশোর বলল, ‘এটা তাদের কেউ হতে পারে, যারা বহু বছর আগে কলিয়ারদের বাড়ি বদল করতে সহায়তা করেছে। হয়তো জেলখানায় জোনসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার কাছেই শুনেছে।’
‘এখন মিসেস কলিয়ারের বাড়িতে ফিরে যাওয়া দরকার,’ রবিন বলল, ‘নিশ্চয় আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।’
‘তাঁকে বোলো, তাঁর অ্যান্টিকগুলো নিরাপদেই রয়েছে,’ সার্জেন্ট বললেন, ‘আপাতত এগুলো আমি রেখে দিলাম। কাল যদি একবার এসে জিনিসগুলোকে শনাক্ত করে যান, তো ভালো হয়।’
ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। ছেলেদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস কলিয়ার। জিনিসগুলো খুঁজে পাওয়া গেছে শুনে খুবই খুশি হলেন। রাত কাটানোর জন্য তাঁর গেস্টরুমটা ছেলেদের দিয়ে দিলেন তিনি।
পাঁচ
পরদিন সকালে ওরা যখন নাশতা করছে, পাশের বাড়ির মিস্টার মরিসন এলেন দেখা করতে। ‘এই যে ছেলেরা,’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি, ‘তোমরা নিরাপদে ফিরে এসেছ দেখে খুশি হলাম।’
‘নিরাপদে?’ ভুরু কোঁচকাল কিশোর, ‘আপনি জানলেন কী করে আমরা বিপদে পড়েছিলাম?’
‘ও, ইয়ে...’ মনে হলো ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি, ‘কাল তোমরা গোরস্থানে গিয়েছিলে না? ভূতের ব্যাপারে কী যেন একটা বলছিলে?’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘হ্যাঁ, বলছিলাম।’
‘মিসেস কলিয়ারের অ্যান্টিকগুলো খুঁজে পেয়েছ?’ জানতে চাইলেন মরিসন।
‘পেয়েছি,’ রবিন জবাব দিল, ‘তবে সব জিনিস আছে কি না ওখানে, এখনো জানি না আমরা। মিসেস কলিয়ারই ভালো বলতে পারবেন, থানায় গিয়ে দেখে আসতে হবে তাঁকে।’
‘থানায়?’ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস্টার মরিসনের কণ্ঠ, ‘তুমি বলতে চাইছ, জিনিসগুলো এখানে আননি?’
‘অবশ্যই না!’ জোর দিয়ে বলল মুসা, ‘কী পেয়েছি, সেটা পুলিশকে জানানো দরকার ছিল আমাদের, আর পুলিশ ওগুলো রেখে দেবে প্রমাণ হিসেবে, যতক্ষণ না চোরটাকে ধরতে পারে।’
মিস্টার মরিসনের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ‘ও,’ ঢোক গিলে বললেন তিনি, ‘ইয়ে, আমার এখন বাড়ি যাওয়া দরকার। কিছু টুকিটাকি কাজ সারতে হবে।’
‘না, আপনি এখানে থাকুন!’ বলে উঠল কিশোর। হঠাৎ রহস্যময় প্রশ্নগুলোর জবাব পেয়ে গেছে ও। রবিনের দিকে ফিরে বলল, ‘জলদি যাও, পুলিশকে ফোন করো।’
অবাক হলো রবিন। তবে কোনো প্রশ্ন না করে উঠে চলে গেল। পাশের ঘরে ঢুকল। মিস্টার মরিসন তাকিয়ে রয়েছেন কিশোরের দিকে। কী বলবেন, যেন বুঝতে পারছেন না।
‘আমাকে কী দরকার তোমার?’ অবশেষে প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘আছে, কিছু ব্যাখ্যা,’ কিশোর বলল, ‘আসলে সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি আমি। শুনে বলুন, ঠিক ঠিক বলছি কি না। মিসেস কলিয়ারের অ্যান্টিকগুলোর কথা জানেন আপনি। কাল রাতে আমাদের অনুসরণ করে গোরস্থানে গিয়েছিলেন। আপনি ভেবেছিলেন চাবিটা রয়েছে মুসার কাছে, হয়তো ওকে পকেটে ঢোকাতে দেখেছিলেন। তাই ওকে ধাক্কা দিয়ে কবরের ভেতরে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওর পকেটে যখন চাবিটা পেলেন না, আমাকে ফেলে দিলেন তখন কবরে। তবে আপনার দুর্ভাগ্য, রবিনের আক্রমণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।’
‘তুমি কী বলছ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’ মিস্টার মরিসন বললেন।
‘কিশোর, তোমার কথা ঠিক না!’ মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘বহু বছর ধরে মিস্টার মরিসনকে চিনি আমি। সব সময় তিনি আমার একজন ভালো বন্ধু হয়ে আছেন।’
‘বন্ধু হওয়ার ভান করেছেন শুধু মিস্টার মরিসন,’ কিশোর বলল, ‘সব সময় আশায় আশায় ছিলেন, আপনি তাঁকে নোটটা দেখাবেন, তিনি গিয়ে গুপ্তধনগুলো উদ্ধার করে আনতে পারবেন। যখন তিনি জানলেন, আমাদের আপনি তদন্তের ভার দিয়েছেন, তখন থেকেই আমাদের সরানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা আসার সময় রাস্তায় আমাদের গাড়িতে পাথরের সাহাযে্য নোট ছুড়ে আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছেন।’
‘কী বলছ তুমি বুঝতে পারছ?’ কিশোরের কথায় চমকে গেছেন মিসেস কলিয়ার।
‘পারছি,’ দৃঢ়কণ্ঠে কিশোর বলল, ‘বিশ বছর আগে আপনারা এ বাড়িতে আসার সময় মিস্টার হিউগ মরিসনের সঙ্গে প্ল্যান করেছিলেন মিস্টার জোনস, আপনাদের অ্যান্টিকগুলো চুরি করবেন। আপনাদের পারিবারিক ক্রিপ্টের চাবি চুরি করে একটা নকল চাবি বানিয়ে নিয়েছিল মরিসন। আসল চাবিটা আবার আগের জায়গায় এনে রেখে দিয়েছিল।’
‘অসম্ভব!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার মরিসন, ‘এই ফালতু বকবকানি আর শুনতে চাই না আমি!’
লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোলেন তিনি। দরজা খুলে বেরোতেই দুজন সশস্ত্র পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি হলেন।
‘আমি লেফটেন্যান্ট ডিক,’ একজন অফিসার নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আর ও সার্জেন্ট হ্যারি,’ সঙ্গের অফিসারকে দেখালেন তিনি। জোনসের দিকে তাকালেন, ‘আপনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘ওকে ধরুন, অফিসার, ও একটা চোর!’ পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল কিশোর, ‘আমাদের কাছে প্রমাণ আছে!’ মরিসনকে আটকে ফেললেন দুই অফিসার।
যা যা ঘটেছে, সব পুলিশকে খুলে বলল কিশোর। তারপর বলল, ‘আমার ধারণা, মিস্টার জোনস আর মিস্টার মরিসন নিজেদেরকে একসঙ্গে দেখা যাক সেটা চাইতেন না। সাংকেতিক চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। জোনস একটা চিঠি লিখেছিলেন মরিসনের কাছে, যেটাতে তিনি বলতে চেয়েছে লুকানো অ্যান্টিকগুলো কোথায় আছে। তবে ভুল করে সেটা চিলেকোঠায় ফেলে যান। কোনোভাবে হয়তো পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি বদলানোর পর, অর্থাৎ কলিয়ারদের রকি বিচের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে জিনিসপত্রগুলো এ বাড়িতে এনে রেখে যাওয়ার পর নোটটা মরিসনের ডাকবাক্সে ফেলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর, কিন্তু নোটটা খুঁজে পাননি জোনস। আরেকটা নোট লেখার সময় পাননি, কারণ তাঁর লোকেরা সব কাজ সেরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। পরদিন ডাকাতির অপারধে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন জোনস।’
‘জেলে থাকতেই মরিসনকে জানাননি কেন জিনিসগুলো কোথায় আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন লেফটেন্যান্ট ডিক।
‘মরিসন হয়তো কখনোই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাননি,’ জবাব দিল কিশোর, ‘দুজনের মধ্যে যোগাযোগ আছে, পুলিশ এটা জেনে গেলে সন্দেহ করতে পারে এই ভয়ে। আর যদি জোনস জিনিসগুলোর কথা বলতেনও, বের করে আনতে পারতেন না মরিসন। কারণ তাঁর কাছে ক্রিপ্টের চাবি ছিল না।’
‘কী একখান গল্প বানিয়েছে!’ তিক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন মিস্টার মরিসন, ‘সব বানানো কথা। কোনো প্রমাণ নেই।’
তাঁর দিকে তাকাল মুসা। ‘আমি শিওর, গতকাল ঝোপের ভেতর লুকিয়ে আপনিই আড়ি পেতেছিলেন। আমরা কী বলি, শোনার চেষ্টা করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ, তাই তো।’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘তারপর আমাদের অনুসরণ করে গোরস্থানে গিয়েছিলেন,’ বলল রবিন, ‘ভূত সেজে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন। চাবিটার জন্য মুসাকে কবরে ফেলে দিয়েছেন।’
‘এবং তারপর যখন এগুলোতে কোনো লাভ হলো না,’ রবিনের কথার খেই ধরল কিশোর, ‘আমাদের ক্রিপ্টের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়েছিলেন।’
‘এগুলো তোমাদের বানানো গল্প,’ মিস্টার মরিসন বললেন, ‘আবারও বলছি, প্রমাণ করতে পারবে না।’ একটু থেমে বললেন, ‘মিসেস কলিয়ার জানতেন তোমরা ক্রিপ্টে গিয়েছ। তোমরা ফিরে না এলে পুলিশকে খবর দিতেন। পুলিশ গিয়ে তোমাদের উদ্ধার করত। অ্যান্টিকগুলো আমার হাতে আসত না।’
‘আমাদের আটকে রেখে আপনি লোক জোগাড় করতে গিয়েছিলেন,’ কিশোর বলল, ‘যারা আপনাকে আমাদের কাছ থেকে অ্যান্টিকগুলো কেড়ে নিতে সাহায্য করত। ভাগ্যিস, তার আগেই দরজা ভেঙে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম।’
মিসেস কলিয়ার বললেন, ‘কিশোর, এত কিছুর পরেও আমি মিস্টার মরিসনকে অবিশ্বাস করতে পারছি না। তাঁকে অপরাধী ভাবতে পারছি না। তুমিও এখনো সেটা প্রমাণ করতে পারনি।’
‘পারব,’ জোর দিয়ে বলল কিশোর, ‘আপনাদের বেজমেন্টের গোপন কক্ষটার কথা কয়জন লোকে জানে, যেটা কাল আমরা আবিষ্কার করেছি?’
‘কেউ না,’ জবাব দিলেন মিসেস কলিয়ার, ‘আমিও জানতাম না, তোমাদের কাছে শোনার আগে।’
‘আমরা ওটা খুঁজে বের করার সময় মিস্টার মরিসন এখানে ছিলেন,’ কিশোর বলল, ‘তিনি যখন গোরস্থানে ভূত সেজে অভিনয় করছিলেন, তখন বলেছেন, শিগগিরই আমরা মারা পড়ব, বহু বছর আগের সেই সব চোরাচালানির মতো, যাদের তিনি গুপ্তকক্ষে আটকে রেখে মেরেছিলেন।’
মিস্টার মরিসনের নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল, যখন বুঝতে পারলেন কী ভুলটা তিনি করেছেন। হঠাৎ দৌড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। তবে তৈরি ছিলেন ডিক আর হ্যারি। সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললেন মরিসনকে। চাপের মুখে সব কথা স্বীকার করলেন মরিসন।
‘হ্যাঁ, আমি জোনসের সঙ্গে মিলে কাজ করেছি,’ বললেন তিনি, ‘একজন চোরাই মালের কারবারিকে ঠিক করেছিলাম, যে আমাদের মালগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করে দিত। জোনসের বাড়িতে জোনসের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল ওর, কলিয়ারদের নতুন বাড়িটায় এসে এটা চিনে যেতে। অ্যান্টিকগুলো নিজের বাড়িতে নেওয়ার সাহস হয়নি জোনসের, পুলিশ যদি তল্লাশি চালাতে যায়, এই ভয়ে। কারণ আগে থেকেই পুলিশের খাতায় অপরাধী হিসেবে ওর নাম লেখা রয়েছে। তাই প্রথমে জিনিসগুলো বনের ভেতরে ফেলে যায় ও। তারপর কলিয়ারদের বাড়িতে ক্রিপ্টের চাবিটা দেখে, নকল চাবি বানিয়ে ক্রিপ্টে রেখে আসে।’
‘কিন্তু আপনার কাছে নোট লিখেছিলেন কেন জোনস?’ রবিন জানতে চাইল।
‘আমাকে জানানোর জন্য যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ও মনে করেছিল, একজন চোরাই মালের কারবারি ঠিক হয়ে গেলেই সবাই মিলে ক্রিপ্টে গিয়ে মালগুলো বের করে আনব।’
‘কিন্তু নোটটা আপনি জোনসের কাছে পৌঁছাতে পারেননি,’ মুসা বলল, ‘তারপর আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন।’
‘হ্যাঁ, তাই।’ বিষণ্ন কণ্ঠে জবাব দিলেন মরিসন।
‘তবে এখন ওর দেখা হবে আপনার সঙ্গে,’ সার্জেন্ট হ্যারি বললেন, ‘জেলখানায়।’
মরিসনকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ। মিসেস কলিয়ারের দিকে ফিরল তিন গোয়েন্দা। চমকের ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। ভাবতেই পারছেন না দশ বছর ধরে যে তাঁর প্রতিবেশী ছিল, যার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, সে একজন অপরাধী।
‘তাঁর জেলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না,’ অবশেষে বললেন তিনি, ‘তবে, কিশোর, একটা কাজের কাজই করলে তুমি, তাকে ধরিয়ে দিয়ে, সেই সঙ্গে আমাদের জিনিসগুলো উদ্ধার করে দিয়ে।’
‘গোরস্থানে যাওয়ার কথা মুসাই মনে করিয়ে দিয়েছিল আমাদের, মনে আছে?’ কিশোর বলল।
মুখ বাঁকাল মুসা। ‘অন্য কিছু করা উচিত ছিল আমাদের। নিজেরা না গিয়ে পুলিশকে পাঠানো উচিত ছিল। আরেকটু হলেই মারা পড়ছিলাম ভূতের হাতে।’
‘অবশ্যই নকল ভূত!’ হাসল রবিন। হাসিটা সংক্রমিত হলো সবার মধ্যে।
অলংকরণ: জুনায়েদ