দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর

অলংকরণ: তুলি

আমাদের রংপুর জিলা স্কুলে বাংলা পড়াতেন ফজলার রহমান স্যার। একদিন তিনি বললেন, লেখো, ‘ভালোবাসার জয়’ কবিতাটা পড়ে তুমি কী বুঝতে পারলে।

লিখে জমা দিলাম।

স্যার পড়ে লিখলেন, ভালো। পরে ভালোর আগে যুক্ত করলেন ‌‘খুব’।

‘ভালোবাসার জয়’ কবিতাটা আমার খুবই প্রিয় ছিল। এখনো মুখস্থ বলে দিতে পারব।

ভালবাসার জয়
যতীন্দ্র মোহন বাগচী

ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে—
গোলাগুলির গোলেতে নয়, গভীর ভালবেসে।
খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার,
কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার?
শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে—
ও তার স্বভাব সর্বনেশে।
ভালবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়—
সে যে সৃজন পরিচয়।

আমি তখন থেকেই বিশ্বাস করি, ভালোবাসা দিয়েই কেবল দুনিয়া জয় করা যায়। আঘাত ডেকে আনে প্রতিঘাত, হিংসা ডেকে আনে প্রতিহিংসা। ভালোবাসা ডেকে আনে ভালোবাসা।

কাজেই আমরা কাউকে আঘাত করব না। আমরা ভালোবাসা দিয়ে শত্রুকে জয় করার চেষ্টা করব। যুগে যুগে মহাজ্ঞানী–মহাজনেরা সেই পথই আমাদের দেখিয়ে গেছেন। ভালোবাসার পথ।

আমাদের ছোটবেলায় আরেকটা নিবন্ধ ছিল পাঠ্য। তাতে আমরা পড়েছিলাম, এক বুড়ি মহানবী (সা.)-এর চলার পথে রোজ কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। নবী (সা.)-কে পথের কাঁটা সরিয়ে পথ চলতে হতো। একদিন নবীজি (সা.) দেখলেন, পথে কোনো কাঁটা নেই। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই এই বৃদ্ধার কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে। তিনি বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন। বৃদ্ধা তো ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর সেবাযত্ন করলেন। তাঁকে সারিয়ে তুললেন। বৃদ্ধা মহানবীর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। নবীজি (সা.)-এর কাছে মাফ চাইলেন।

আমাদেরও চেষ্টা থাকবে ভালোবাসা দিয়ে, ভালো ব্যবহার দিয়ে সবার চিত্ত জয় করার।

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও আঘাত না লাগে। আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।

আমাদেরও চেষ্টা হবে, কাউকে দুঃখ না দেওয়া। আমরা মাটির বুকেও জোরে পা ফেলব না। আমরা একটা ঘাসফুলকেও কষ্ট দেব না, একটা পাখিকেও অকারণে কষ্ট দেব না।

আমরা প্রত্যেকে হব সুন্দর মানুষ। আমি যদি সুন্দর হই, দেশ সুন্দর হবে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে জাগলে মাগো রাত পোহাবে তবে।’

আমরা যদি জাগি, দেশ জাগবে।

আমরা যদি ভালো মানুষ হই, দেশও ভালো দেশ হবে।

আমরা যদি আলোকিত হই, দেশ আলোকিত হবে।

আমরা কখনো উগ্র হব না। আমরা হব শান্ত। আমরা কখনো অশান্তির পক্ষে থাকব না, আমরা থাকব শান্তির পক্ষে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।’

আমরাও পারলে মানুষের পথের কাঁটা দূর করে দেব, কিন্তু কারও পথেই কাঁটা বিছাব না। আমরা কারও ভুল প্ররোচনায় প্ররোচিত হব না। আমরা বলব, আমরা ভালোবাসব। আঘাত করব না।

আমরা শান্তির পক্ষে। আমরা হলাম শান্তিবাদী।

আমার নিজের জীবনে এটা আমি চেষ্টা করি। আমি কাউকে আঘাত করি না। উঁচু গলায় কথা না বলার চেষ্টা করি। আমি মৃদুভাবে চলার চেষ্টা করি। তাতে আমার জীবনে আমি যে ঠকেছি, তা তো নয়। আমি আস্তে কথা বলি বলে আমার কথা লোকে শোনে না, তা–ও কিন্তু নয়। আমার ধারণা, সুন্দরভাবে কথা বললে বরং লোকে তা শোনে।

একই কথা আমি বলব, ফেসবুকে বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসো আমরা সুন্দর কথা প্রচার করি। অসুন্দর কথা প্রচার করব না। লোকে যেন আমার স্ট্যাটাস পড়ে ভালো বলে। এসো আমরা হয়ে উঠি আলোর মশাল। আমরা যেন অন্ধকারের প্রচারক না হয়ে উঠি।