টুনটুনির গল্প

টুনটুনি পাখি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর খুব প্রিয় পাখি। টুনটুনিকে নিয়ে অনেক গল্প লিখেছেন তিনি। পাখিটাকে রূপকথার প্রাণীতে পরিণত করেছেন। আমি এমন একজন জনপ্রিয় লেখককে চিনি, উপেন্দ্রকিশোরের বই পড়ে বহুকাল পর্যন্ত যাঁর ধারণা ছিল টুনটুনি আসলেই রূপকথার পাখি। টুনটুনি বাস্তবে আছে, এই ঢাকা শহরেই আছে, শুনে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। আরও অনেক পক্ষীপ্রেমিকের মতোই টুনটুনি আমারও প্রিয় পাখি। নামটাও ভীষণ পছন্দ। এক চিমটি এই অতি খুদে পাখিটি যখন প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে ডাকে, তখন বিশ্বাসই হতে চায় না, শব্দটা ওর গলার ভেতর থেকে বেরোচ্ছে।

টুনটুনি নিয়ে নানা রকম মজার অভিজ্ঞতা আছে আমার। বয়েস তখন খুব কম। সম্ভবত থ্রি-ফোরে পড়ি, ঠিক মনে নেই। ফেনীতে থাকি। আমাদের বাসাটা যত বড়, সীমানা ছিল তার চেয়ে অনেক বড়। মূল বাড়ি আর রান্নাঘর বাদ দিলে দুই পাশের দেয়াল ঘেঁষে রীতিমতো জঙ্গল ছিল। নারকেল-সুপারি, আম-পেয়ারা তো ছিলই, ছিল আরও নানা জাতের বুনো ঝোপঝাড়। তাই পাখিরাও আসত প্রচুর। চিৎকার-চেঁচামেচি করত। বাসা বানাত। ডিম পাড়ত। বাচ্চা দিত। একধরনের বুনো গাছ আছে, স্থানীয় নাম ‘ডোংরা’ গাছ। তার বড় বড় পাতা। অসাধারণ দক্ষতায় ডোংরা গাছের পাতায় পাতাজুড়ে ছোট্ট বাসা বানায় টুনটুনি।

একদিন ডোংরা গাছে একটা টুনটুনির বাসা আমার নজরে পড়ে গেল। এক জোড়া পাখি সারাক্ষণ ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ বাসার কাছে আসে আর যায়, চেঁচামেচি করে, কখনো বাসার ওপর বসে, কখনো ছোট গোল দরজাটা দিয়ে ঢুকে যায়। কৌতূহল দমাতে না পেরে বাসার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখি, ডিম।

তারপর থেকে কড়া নজর রাখলাম বাসাটার ওপর। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর অপেক্ষায় রইলাম। একদিন মা-পাখিটার ঠোঁটে একটা মরা শুঁয়োপোকা ঝুলতে দেখে বুঝলাম, বাচ্চা বেরিয়েছে। বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য শুঁয়োপোকা ধরে এনেছে। তারপর বাসাটার ওপর নজর রাখা আরও বাড়িয়ে দিলাম। আমি জানি, বিড়াল আর বেজি টুনটুনির চরম শত্রু। সাপ তো ছোট জাতের পাখির বাচ্চার যম। কাকও সুযোগ পেলে ছাড়ে না। কিন্তু এমন জায়গাতেই বাসাটা বানিয়েছে আমার টুনটুনিরা, কাক ঢুকতে পারে না। যতক্ষণ পারি, পাখিগুলোকে দেখি, পাহারা দিই। বিড়াল দেখলে দূর দূর করে তাড়াই। বেজি দেখলে ঢিল ছুড়ি। সাপ অবশ্য বাসার আশেপাশে একটাও দেখিনি। তাই অনেকটাই স্বস্তি। রাতের বেলায়ও বোধ হয় আসে না। তাহলে পাখির বাসায় ঢুকে বাচ্চাগুলোকে সাবাড় করে দিত।

একসময় বাচ্চাগুলো বাসার বাইরে আসার মতো বড় হলো। একদিন একটাকে ধরে ফেললাম। হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে বাচ্চাটা। শিশুকণ্ঠে কুঁক কুঁক করে চিৎকার করে মাকে ডাকছে। কোথা থেকে ঝড়ের গতিতে উড়ে এল মা। আমার মাথার কাছে ডালে বসে তুমুল চিৎকার জুড়ে দিল। তার সাথে এসে যোগ দিল বাবা-পাখিটা। ওদের চিৎকারে কান ঝালাপালা। তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে আবার বাসার ভেতর রেখে দিয়ে রেহাই পেলাম।

এত মনোযোগ দিয়ে পাখিগুলোকে দেখছিলাম, হঠাৎ কানের কাছে কথা শুনে ভীষণ চমকে উঠলাম, ‘টুনটুনির বাচ্চা নাকি রে?’

ফিরে তাকালাম। আমার বন্ধু শওকত। গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলালাম, ‘হ্যাঁ, টুনটুনির বাচ্চা। আমার।’

‘বনের পাখি, বাচ্চার মালিক তুই হলি কী করে?’ মুখ বাঁকিয়ে হাসল শওকত।

মনে মনে রেগে গেলাম। ‘টুনটুনিরা বাসা বাঁধার পর থেকে পাহারা দিয়ে রেখেছি, ওগুলো আমার পাখি নয় তো কার?’

‘তুই তো একটা বাসা পাহারা দিয়েছিস। আরও যে লক্ষকোটি পাখির বাসা আছে ওগুলোকে কে পাহারা দেয়?’

আমি ওকে বোঝানোর চেষ্ট করলাম, ‘দেখ, আমিই মালিক, এই পরিবারটার। কেন মালিক, শোন। প্রথম কথা, আমাদের বাসার সীমানায় বাচ্চা দিয়েছে পাখিগুলো। তার ওপর সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখে বিড়াল আর বেজির হামলা থেকে বাঁচিয়েছি। তাহলে মালিকটা কে হলো?’

‘যত যুক্তিই দেখাস, বাচ্চাগুলোর মালিক তুই না। আসল মালিক হলো ওগুলোর বাবা-মা।’

আরও রেগে গেলাম। ‘দেখ শওকত, বিরক্ত করিস না। যা এখান থেকে। আমি এখন জরুরি কাজ করছি।’

‘জরুরি কাজটা কী, শুনি? বাচ্চাগুলোকে কষ্ট দেওয়া তো?’

‘কষ্ট কোথায় দিলাম। হাতে নিয়ে তো আদর করছিলাম।’

‘বাচ্চাগুলো তোকে বলেছে আদর করতে?’

‘বলুক আর না বলুক, ওগুলো আমার পাখি। আমার যা ইচ্ছে তা-ই করব।’

‘আচ্ছা, যাহ্‌, তুই-ই মালিক,’ বেশি তর্কাতর্কিতে গেল না শওকত। ‘সকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সময় কাটানোর কিছুই পাচ্ছি না। শেষে ভাবলাম, তোর সঙ্গে মারবেল খেলি। খেলবি?’

‘খেলে লাভ কী? আমার সঙ্গে তো পারিস না। হেরে ভূত হবি।’

‘তা-ও খেলব। আয় না, খেলি?’ অনুরোধের সুরে বলল শওকত।

স্কুল ছুটি। কাজকর্ম কিছু নেই, শুধু পাখি দেখা ছাড়া। রাজি হয়ে গেলাম।

খেলা চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শওকতের পকেটের সব মারবেল আমার পকেটে চলে এল। আমি জানতাম, এটাই ঘটবে। শওকতও জানত।

আমার কাছে কিছু মারবেল ধার চাইল।

কয়েকটা মারবেল দিলাম ওকে।

আবার হারল শওকত।

আবার দিলাম।

আবার হারল। এত দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলে মজা নেই। আর খেলতে রাজি হলাম না।

পকেট ঝাড়া দিয়ে পয়সার ঝনঝনানি শোনাল শওকত। বলল, ‘এই দেখ, আমার কাছে পয়সা আছে। মারবেল বেচবি?’

দোকানে গেলে এক আনায় চারটে মারবেল পাবে শওকত, তা ছাড়া যাওয়া-আসারও ঝামেলা আছে। দোকান অনেকটাই দূরে। কিনে আনতে আনতে খেলার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এক আনায় ছয়টা মারবেল বেচে দিলাম ওর কাছে। দোকানের চেয়ে দুটো বেশি। তাতে খুশিই হলো শওকত।

তবে আবারও হারল। আবার মারবেল কিনল আমার কাছ থেকে। এবং আবার হারল। এভাবে হারতে হারতে ওর পকেটের চার আনা পয়সাই আমার পকেটে চলে এল। শওকতের কাছে আর পয়সা নেই। হতাশ হয়ে চলে গেল সে। মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল আমার। মারবেল বিক্রি করে, খেলে, জিতে, শওকতের সব মারবেল আর পয়সা আমি নিয়ে নিয়েছি। কাজটা ঠিক হয়নি। ভাবলাম, আবার যখন দেখা হবে পয়সাগুলো ফেরত দিয়ে দেব। মারবেল দেব না, ওগুলো আমি খেলে জিতেছি।

পরের দিন। সকালে নাশতা খেয়েই টুনটুনির বাসার কাছে গেলাম। মা পাখিটাকে দেখলাম, বাসার কাছে ডোংরাগাছের ডালে বসে ঝিমোতে। ওর ভাবভঙ্গি ভালো লাগল না আমার। কাছে গেলাম, উড়ল না পাখিটা। হাত বাড়ালাম, তা-ও গেল না। ঢুলুঢুলু চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। ভয় পেয়ে গেলাম। কী ব্যাপার? অসুখ নাকি? না ধানখেতে পোকা খেতে গিয়ে পোকার ওষুধ খেয়ে এসেছে? মারাত্মক বিষ ওই পোকার ওষুধ।

মায়া হলো। পাখিটাকে ধরে নিয়ে এলাম সেবা করার জন্য। কিন্তু কী করে সেবা করব জানি না। আর কিছুই করতে না পেরে ওটাকে হাতের তালুতে নিয়ে, পিঠে আদর করে আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগলাম। এতটুকুন পাখি, হাত বোলানোর জায়গাও নেই।

বাইরের ঘরের সিঁড়িতে বসে পাখিটাকে আদর করছি, এই সময় এল শওকত। আমার হাতে জ্যান্ত টুনটুনি দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, ‘ধরলি কী করে?’

‘ডালে বসে ঝিমুচ্ছিল। মনে হয় পোকার ওষুধ খেয়েছে।’

‘আহারে! কী করা যায় বল তো?’

‘ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’

‘টুনটুনির ডাক্তার পাবি কোথায়? এক কাজ করি, চল, মাথায় পানি ঢালি।’

বুদ্ধিটা খারাপ না। মগে করে পানি এনে পাখিটার মাথায় একটু একটা করে ঢালতে শুরু করলাম। পাখিটা ডানা ঝাড়া দিল। কিছুটা চনমনে হয়ে উঠল বলে মনে হলো।

চওড়া হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল শওকতের। ‘দেখলি তো? আমার সেবায় কাজ হয়েছে।’

পাখিটাকে আবার গাছের ডালে বসিয়ে দিলাম। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে পালকগুলো। হঠাৎ মনে পড়ল শওকতের পয়সার কথা। পকেট থেকে বের করে দিলাম চার আনা। বললাম, ‘নে, নিয়ে যা। মারবেল খেলে জিতেছি। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মারবেল বেচে পয়সা নেওয়াটা আমার ভালো লাগছে না। ঠকিয়ে নেওয়ার মতো মনে হচ্ছে। তোর পয়সা তুই নিয়ে নে।’

কিছুটা অবাক হলেও হাত বাড়িয়ে পয়সাগুলো নিল শওকত। তাড়াতাড়ি গিয়ে দোকান থেকে লজেন্স-বিস্কুট কিনে আনল। ভাগাভাগি করে খেতে লাগলাম।

খেতে খেতে পাখিটাকে দেখছি। আবার ঝিমুতে শুরু করেছে পাখিটা। এখন আর চোখই মেলছে না।

হঠাৎ জোর একটা কাঁপুনি দিয়ে ঝপ করে পড়ে গেল মাটিতে।

তাড়াতাড়ি গিয়ে হাতে নিলাম।

আর নড়ছে না পাখিটা।

বুঝলাম, মরে গেছে।

এত দিন নাচানাচি করতে দেখেছি। তারস্বরে ওর চিৎকার শুনেছি। এত প্রাণবন্ত পাখিটা এখন নিথর হয়ে আছে। দেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ঠিক করলাম, আমার এত আদরের পাখিটাকে নিরাপদে রাখব। নইলে বিড়ালে ছিঁড়ে খাবে। কাকেও খেতে পারে। আমার ইচ্ছের কথা শওকতকে বলতেই সে লাফিয়ে উঠল। একটা পুরোনো ভোঁতা ছুরি দিয়ে গর্ত খুঁড়লাম। গর্তে পাখিটাকে রেখে তাতে মাটিচাপা দিলাম। আমাদের বেগুনখেতের বেড়ার কয়েকটা কঞ্চি ভেঙে এনে গর্তের চারপাশে বেড়া দিলাম। একটা গাঁদা ফুল ছিঁড়ে এনে রেখে দিলাম গর্তের ওপর। এত কিছু করার পরেও মনটা খারাপ হয়েই রইল আমাদের। মুখের লজেন্সটা থুহ্‌ করে ফেলে দিয়ে শওকত বলল, ‘ধুর, আর খেতে ইচ্ছে করছে না।’

বললাম, ‘চল, বাসার ভেতর ছানাগুলোকে দেখে আসি। কেমন আছে ওরা।’ মা-হারা বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে খুব কষ্ট লাগল।

কিন্তু বাসার ভেতর বাচ্চাগুলোকে পেলাম না। গেল কোথায় ওগুলো? নিশ্চয় রাতের বেলা বেজি কিংবা বিড়ালে ধরে খেয়েছে। বাপটাকেও হয়তো খেয়েছে। আর মা-টা তো গেল বিষ খেয়ে।

শওকত বলল, ‘পরিবারের শোকে আত্মহত্যা করেনি তো মা-পাখিটা?’

‘তোর মাথা! কী যে বলিস না! টুনটুনির কি মন আছে যে আত্মহত্যা করবে?’

‘থাকতেও তো পারে। মন আছে কি নেই আমরা জানব কী করে?’ শওকত তার আত্মহত্যার যুক্তিতে অটল রইল।

হঠাৎ মনে হলো আমার, বেজিতে বা অন্য কিছুতে খেলে তো বাসাটা ভাঙা থাকত।

আমার ভাবনার কথাটা জানালাম শওকতকে।

বাকি তিনটে পাখির কী হলো, এ নিয়ে আলোচনা করছি শওকতের সাথে, এই সময় মাথার ওপর পেয়ারাগাছের ডালে টুঁইক টুঁইক করে ডেকে উঠল একটা পাখি। তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিল আরেকটা।

চমকে চোখ তুলে তাকালাম আমি আর শওকত।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। দুটো বড় টুনটুনি আর দুটো ছানা। ছানাগুলো উড়তে শিখেছে। মা-বাবার সঙ্গে বোধ হয় বেড়াতে গিয়েছিল, কিংবা শিকার ধরতে। খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে।

ওগুলো ‘আমার’ পাখি!

পাখিগুলোকে দেখে এত ভালো লাগল, জীবনে এমন খুশি খুব কমই হয়েছি।

শওকতও খুশি। ‘তাহলে মরা পাখিটা কোনটা?’

জবাব দিলাম, ‘পোকার ওষুধ খেয়ে যেটা মরেছে সেটা অন্য পাখি। আমাদের পাখিগুলো বেঁচে আছে।’

‘আমাদের বললি কেন?’ শওকত অবাক। ‘সারাক্ষণ তো আমার পাখি আমার পাখি করিস।’

‘মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অতি আনন্দে। আসলে তো “আমাদের” পাখিই হওয়ার কথা। তুই ঠিকই বলেছিস, বনের পাখি কারও একলার নয়। সবার পাখি। আমার পাখি। তোর পাখি। সব মানুষের পাখি।’

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শওকত। ‘দাঁড়া। আসছি।’

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে। হাতে এক ঠোঙা বিস্কুট।

ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চার আনা তো তখনই খরচ করে ফেলেছিলি। আবার বিস্কুট আনলি কী দিয়ে?’

একগাল হেসে মাথা দুলিয়ে শওকত বলল, ‘হুঁ-হুঁ বাবা, আমার কাছে সব সময় পয়সা থাকে। এখন আয়, অহেতুক কথা না বাড়িয়ে বিস্কুট খেয়ে আমাদের টুনটুনিদের বেঁচে থাকাটাকে সেলিব্রেট করি।’

অলংকরণ: তুলি