বিজ্ঞানে বিবাদ

দুনিয়ার সবাই জানে রেডিওর উদ্ভাবক মার্কনি (বামে), কিন্তু যন্ত্রটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (ডানে)
দুনিয়ার সবাই জানে রেডিওর উদ্ভাবক মার্কনি (বামে), কিন্তু যন্ত্রটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (ডানে)

বিজ্ঞানীরাও মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো তাঁরাও মাঝেমধ্যে দ্বন্দ্বে মেতে ওঠেন। তাঁদের কাজ-কারবার বড় বড় আর বিজ্ঞান নিয়ে। তাঁদের দ্বন্দ্বের কারণও তাই বিজ্ঞানের বড় বড় বিষয়ে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম দ্বন্দ্বটা বাঁধে অ্যারিস্টোটলকে ঘিরে। পৃথিবী গোলাকার—এই ধারণা অ্যারিস্টোটলই প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং একে কেন্দ্র করে সূর্য, গ্রহ ও উপগ্রহগুলো ঘুরছে। সেই যুগে অ্যারিস্টোটলের প্রভাব ছিল অকল্পনীয় মাত্রায়। ক্ষমতার দাপট ঠিক নয়। জ্ঞান-গরিমায় সে সময়ে তাঁর সমতূল্য কেউ ছিলেন না। স্বয়ং সম্রাট পর্যন্ত অ্যারিস্টোটলের কথা অন্ধের মতো মেনে নিতেন। 

অ্যারিস্টোটলের মৃত্যুর ১২ বছর পর জন্ম আরেক গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাসের। তিনি অ্যারিস্টোটলের মতের বিরোধিতা করলেন। বললেন—পৃথিবী নয়, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। অনেক দার্শনিকই তখন অ্যারিস্টার্কাসের নতুন তত্ত্ব মেনে নিতে পারেননি। ক্লিনথেসের মতো বিখ্যাত দার্শনিকও তাঁকে ধিক্কার দিলেন। ১৩০ খ্রীষ্টাব্দে আরেক বিখ্যাত দার্শনিক টলেমি অ্যারিস্টার্কাসের ধারণা বাতিল করে দেন। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন অ্যারিস্টোটলের পৃথিবীকেন্দ্রীক মহাবিশ্বের ধারণা।

মধ্যযুগ পর্যন্ত গ্যালিলিও-টলেমির তত্ত্বকেই মেনে চলত সবাই। সে সময় অ্যারিস্টোটলের তত্ত্বে আবার আঘাত হানলেন পোল্যান্ডের গণিতবিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস। তিনি মত দিলেন, মহাবিশ্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টার্কাসের ধারণাই সঠিক। সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী আর গ্রহ-উপগ্রহগুলো ঘুরছে। এ নিয়ে বিস্তারিত একটা বইও লেখেন তিনি। কিন্তু সেই বই ছাপাতে সাহস করেননি। কারণ, সে সময় বেশ কয়েকটি ধর্মবিশ্বাসে মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা ছিল তা অ্যারিস্টোটলের ধারণার মতোই। তাই তাঁর নতুন মত ধর্মযাজকেরা ভালো চোখে নাও নিতে পারেন। কোপার্নিকাস ১৫৪৩ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে বইটা প্রকাশ করে যান। তখনই নিষিদ্ধ করা হয় কোপার্নিকাসের সেই বই।

পরবর্তী সময়ে কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রচার করার জন্য জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়। আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলিকে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেকটা বিখ্যাত বিবাদ বেঁধে ছিল ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়ে। বিরোধটা ছিল মহাবিজ্ঞানী নিউটন আর বিখ্যাত গণিতবিদ লিবনিজের মধ্যে। নিউটন ছোটবেলা থেকেই ভীতু টাইপের ছিলেন। কাউকে বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন তাঁর আবিষ্কারগুলো চুরি করার জন্য ওত পেতে আছেন বন্ধুরা। তাই কোনো আবিষ্কারের কথাই তিনি কাউকে বলতেন না। আর এ কারণেই ‘মহাকর্ষ সূত্র’ আবিষ্কারের ত্রিশ বছর পরেও কেউ জানত না ব্যাপারটা। ক্যালকুালস আবিষ্কার করেও তিনি কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু কত দিন আর চেপে রাখা যায়। তত দিনে বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ লিবনিজ ক্যালকুলাস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। একসময় নিউটনের কানেও পৌঁছে গেল কথাটি। নিউটন ভাবলেন, তাঁর কোনো বন্ধুর মাধ্যমে লিবনিজ তাঁর ফর্মুলাটি চুরি করেছেন। বেশ কয়েকজন বন্ধুকেও বললেন তাঁর সন্দেহের কথা। ধীরে ধীরে সে কথা ছড়িয়ে পড়ল বিজ্ঞানীদের মহলে। লিবনিজের কানেও পৌঁছে গেল এই কথা। তখন লিবনিজ উল্টো নিউটনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করলেন। শুরু হলো কাদা ছোড়াছুড়ি। শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতা করলেন নিউটন ও লিবনিজের বিজ্ঞানী বন্ধুরা। তাঁরা দুজনকেই বললেন ক্যালকুলাসের সূত্রগুলো সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রমাণ করতে হবে। যিনি পারবেন ধরে নেওয়া হবে তিনিই ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক। সেই পরীক্ষায় নিউটন-লিবনিজ দুজনই সফল। দুজনে শুধু সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে ক্যালকুলাসের সূত্র প্রমাণ করলেন। আর এর সঙ্গে প্রমাণ হলো তাঁরা কেউ কারও আবিষ্কার চুরি করেননি। দুজনকেই দেওয়া হলো ক্যাকুলাসের আবিষ্কারকের মর্যাদা।

বিজ্ঞানের এই বাদ-বিবাদের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নামও। তিনি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। বেতারযন্ত্রের আবিষ্কারকের নাম কী? আমরা সবাই জানি ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কোনির কথা। আসল সত্যি হলো মার্কোনির আগেই জগদীশ চন্দ্র বসু বেতারযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। তাঁর সেই যন্ত্রের কথা জানতেন ইউরোপের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও। জগদীশকে তাঁরা প্রশংসাও করেছেন এ জন্য। সে সময় ইউরোপের এক বিখ্যাত ইলেট্রনিকস কোম্পানি জগদীশ বসুর বেতার যন্ত্রের নকশাটি কিনতে চায়। কিন্তু তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি হননি। এর কিছুদিন পরেই মার্কোনিও বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। তখন সেই ইলেকট্রনিকস কোম্পানি মার্কোনির যন্ত্রের নকশাটা কিনে নেয়। ফলে মার্কোনির তৈরি বেতারযন্ত্রই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আবিষ্কারকের মর্যাদা তিনিই পেয়ে যান। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ বসুর মনে কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি মনে করতেন—বিজ্ঞান হলো সাধনা, ব্যবসার কিছু নয়।

শিক্ষক এডিংটন (বামে) বিবাদে জড়িয়েছিলেন তাঁর ছাত্র চন্দ্রশেখরের (ডানে) সঙ্গে
শিক্ষক এডিংটন (বামে) বিবাদে জড়িয়েছিলেন তাঁর ছাত্র চন্দ্রশেখরের (ডানে) সঙ্গে

বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিবাদটা বাঁধে চন্দ্রশেখর আর আর্থার এডিংটনের মধ্যে। ১৯৩০ সাল। চন্দ্রশেখর তখন একেবারেই তরুণ। সমুদ্রজাহাজে চেপে চলেছেন বিলেতে। জাহাজে চড়ে বিলেত যেতে তখন কয়েক মাস সময় লেগে যেত। বিজ্ঞানী মন বলে কথা। আর সবার মতো তিনি হইচই করে কাটালেন না জাহাজের দিনগুলো। ভাবতে বসলেন নক্ষত্রের মৃত্যু নিয়ে। সে সময় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয়ে একটা দৃঢ় ধারণা প্রচলিত ছিল। তাঁরা মনে করতেন সব নক্ষত্রই পুরোপুরি মৃত্যুর আগে শ্বেতবামনে পরিণত হবে।

নক্ষত্রগুলোর ভেতরে জ্বালানি একসময় ফুরিয়ে যায়। তখন এদের পরমাণুগুলো মহাকর্ষ বলের কারণে পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সবাই সবার কাছাকাছি আসতে চায়। এতে নক্ষত্র সংকুচিত হতে শুরু করে। একটা সময় গিয়ে পরমাণুগুলো গায়ে গায়ে লেগে যায়। তখন আর নক্ষত্র সংকুচিত হতে পারে না। নক্ষত্রের এই অবস্থাটিকেই বলা হয় শ্বেতবামন। 

জাহাজে বসে বসে অঙ্ক কষলেন চন্দ্রশেখর। তাঁর হিসাব থেকে বেরিয়ে এল, সব নক্ষত্রই শ্বেতবামনে পরিণত হবে না। কোনো নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের দেড় গুণের বেশি হলে সে নক্ষত্রটি আর শ্বেতবামনে পরিণত হবে না। সূর্যের ভরের এই দেড় গুণ সীমা পরে ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।

বিলেতে চন্দ্রশেখরের শিক্ষক ছিলেন জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন। তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের একটা প্রমাণ দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের মহলে তাঁর প্রভাব ব্যাপক। একদিন এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে চন্দ্রশেখর জাহাজে বসে যে হিসেব কষে ছিলেন সে কথা বললেন। তাঁর গাণিতিক তত্ত্বও দাখিল করলেন। অনেকেই তাঁর হিসাব মানতে পারলেন না। চন্দ্রশেখরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সূর্যের ভরের দেড়গুণের চেয়ে বেশি ভরের নক্ষত্র তাহলে কীভাবে মৃত্যুবরণ করবে?

চন্দ্রশেখর তাঁর জবাব দিতে পারেননি। তখন সবচেয়ে বড় আঘাতটা এল শিক্ষক এডিংটনের কাছ থেকেই। চন্দ্রশেখর লিমিটকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিলেন তিনি। মেজাজ হারিয়ে অনেক কটু কথাও শুনিয়ে দিলেন ছাত্রকে।

ক্ষোভে-দুঃখে চন্দ্রশেখর মহাকাশ-বিষয়ক গবেষণা ছেড়ে দেন। ব্রিটেন থেকে চলে যান আমেরিকায়। কিন্তু তাঁর তত্ত্ব মনে ধরেছিল বেশ কজন তরুণ বিজ্ঞানীর। কিন্তু এডিংটনের ভয়ে সেদিন কেউ মুখ খুলতে পারেননি। তাঁরা নীরবে চন্দ্রশেখর লিমিট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার ক্যালটেকের বিজ্ঞানী উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলার চন্দ্রশেখর লিমিটের যথার্থতা প্রমাণ করেন। তখন চন্দ্রশেখরও বেঁচে ছিলেন। তাই সে বছর ফাউলারের সঙ্গে চন্দ্রশেখরকেও নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলো ৫৩ বছর আগে আবিষ্কার করা এক তত্ত্বের জন্য। এডিংটন অনেক আগেই মারা গেছেন। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই অর্ধশতক বছর আগের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন!