নিয়ে নেব পড়ে থাকা মোবাইলটা?

গাছটার নাম জানে না রাজন। দেখতে অনেকটা ইউক্যালিপটাস গাছের মতো। লম্বা। ওই গাছটার গোড়ায় দিব্যি পড়ে আছে মোবাইল ফোন সেটটা। দূর থেকেও বোঝা যায়—একদম নতুন, দামি জিনিস।

বিকেলবেলা অঙ্ক স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়ার সময় একটু ঘুরপথে যায় রাজন। ঘুরপথে যাওয়ার একটি কারণ হলো ওই রাস্তায় ভিড়ভাট্টা বেশি বলে ফুটপাতে রাজ্যের হকার ভিড় করে বসে থাকে। হকারদের সাজানো হাজারো জিনিসপত্র দেখতে ভালো লাগে রাজনের। চার্জার টেবিল ল্যাম্প। ব্যথার মলম। সিডি। সানগ্লাস। রুমাল। পুরোনো জুতো। ইংরেজি পত্রিকা। কত-কী! কোনো কোনো দিন পকেটে টাকা থাকলে সস্তায় কিছু কিনেও ফেলে—যেমন গত মাসে কিনেছিল একটা ছোট্ট কলমদানি। ওর গায়ে আবার ডিজিটাল ঘড়ি বসানো।

এহেন ব্যস্ত ভিড়সর্বস্ব রাস্তার পাশে জলজ্যান্ত একটা নতুন ফোন পড়ে থাকবে, আর কারও চোখেই পড়বে না, এ আবার হয় নাকি? ভুল দেখছে নাকি রাজন? উঁহু, ওই তো দিব্যি দেখা যাচ্ছে—ঝকঝকে একটা ফোন পড়ে আছে ফুটপাতের একদম কোণ ঘেঁষে, গাছটার ঠিক গোড়ায়। লোকজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু কারোই এখনো নজর যায়নি ওই দিকে।

রাজন থমকে দাঁড়ায়। রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিস নিতে নেই, অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া যায় না—এমন সব ভালো কথা ভালোমতোই জানা আছে রাজনের। শুধু জানে না, মানারও চেষ্টা করে। কিন্তু পথে পড়ে থাকা ওই মোবাইল বড্ড টানছে রাজনকে। টুপ করে তুলে নিয়ে পকেটে পুরে ফেলবে নাকি?

আসলে অনেক দিন ধরেই একটা মোবাইলের তার বড্ড শখ। রাজনের প্রায় সব বন্ধুরই মোবাইল আছে। শিপলুর তো মোবাইল আছেই, এমনকি বেশ বড়সড় আট ইঞ্চি টাচস্ক্রিনের একটি ট্যাবও আছে। কী যে ঝকঝকে সব ছবি দেখা যায় ওতে! তাকিয়ে থাকতে হয় মুগ্ধ হয়ে। হাসানের আছে একটা লাখ টাকা দামের ব্র্যান্ড নিউ আইফোন।

আর, তার?

ঘোড়ার ডিম!

অন্যেরা যখন-তখন মোবাইলে সেলফি তুলে মুহূর্তেই দিয়ে দিচ্ছে ফেসবুকে; আর তার পরপরই সেই ছবিতে অন্যদের কত লাইক, কত কমেন্ট। আর রাজনের? তার কপাল মন্দ—মোবাইল ফোন তো নেই-ই, নেই একটা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত। এই যুগে ফেসবুক অ্যাকউন্ট ছাড়া বেঁচে থাকবার কোনো মানে হয়? তার বাবার কম্পিউটার সে ব্যবহার করতে পারে বটে, কিন্তু সেটা পড়ালেখা কিংবা সিনেমা দেখার কাজে। অথবা বড়দের ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে ছবি ডাউনলোড করার জন্য।

এমনিতে রাজনের বাবা লোকটা চমৎকার। শুধু তাঁর একটাই কথা—কলেজে যাওয়ার আগে নিজের মোবাইল নয়, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নয়! অথচ কথা হলো—রাজন পড়ে এখন মাত্র ক্লাস সেভেন। তার মানে, এইট, নাইন, টেন, আরও পাক্কা তিন বছর! মানে হয় কোনো? বন্ধুবান্ধবের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকে না। আড্ডায় বসলে—বাকি সবার বেশির ভাগ কথাই যেখানে মোবাইল আর ফেসবুক নিয়ে—সেখানে ক্যাবলার মতো বসে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি করবার থাকে না রাজনের! অসহ্য!

সেখানে পড়ে থাকা ওই মোবাইল ফোনটা যেন পড়ে আছে ঠিক রাজনের মনের দুঃখটুকু দূর করার জন্যই! দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড় টাচস্ক্রিনের স্মার্টফোন। অর্থাৎ, মোবাইল তো হলোই, সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ দিলেই হাতের মুঠোয় ফেসবুক। এমন সুযোগ হেলায় হারানো যায়?

দুরু দুরু বুকে সামনে এগোয় রাজন।

চারদিকে তাকায়। নাহ্‌, কেউ দেখছে না তাকে।

ঠিক পায়ের কাছে পড়ে আছে মোবাইল ফোনটা। ঝকঝকে। ওঠাবে রাজন?

ভয় ভয় লাগছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে এক ছো মেরে মোবাইলটাকে পকেটে পুরে ফেলার। আবার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ঠিক হবে কাজটা?

আচ্ছা, যদি ফোনটা তুলেই নেয় রাজন—বাসায় কী বলবে সে? যতই বোঝাবার চেষ্টা করুক—মা, বাবা কী বুঝবে? জেরা করতে করতে অস্থির করে ফেলবে না ওঁরা? ‘কোথায় পেলি এই মোবাইল?’ ‘বললেই হলো—বন্ধু দিয়েছে উপহার হিসেবে?’ ‘ঠিক আছে, বুঝলাম বন্ধু দিয়েছে—দে, ওই বন্ধুর নাম-ঠিকানা দে, আমরা কথা বলে আসি’—এসব কথার কী উত্তর দেবে রাজন?

আচ্ছা, এমন হচ্ছে না তো যে এভাবে মোবাইল ফোনটা ফেলে রেখে, কোথাও একটা ক্যামেরা চালু রেখেছে কেউ? তারপর ওই ভিডিওটা টেলিভিশনের কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখানো হবে—কীভাবে তাকে বোকা বানানো হলো! হতে পারে না এমন? হতেই তো পারে! তারপর, টেলিভিশনে তাকে দেখবে—মা, বাবা, বন্ধুরা, এমনকি স্কুলের টিচাররাও! কী লজ্জা! কী লজ্জা! আড়চোখে চারদিকে তাকায় রাজন—কোথাও কোনো লুকানো ক্যামেরার খোঁজ পাওয়া যায় কি না—সেই সন্ধানে। নাহ্‌, চোখে পড়ছে না অমন কিছু। তবে, চোখে পড়ার কথাও নয়—এমনভাবেই তো রাখা হয় ক্যামেরাগুলো, যেন কারও চোখে না পড়ে। তাহলে?

আচ্ছা, মা-বাবাকে নাহয় বোঝানো গেল; কোনো লুকানো টিভি ক্যামেরায় ভিডিও করে তাকে বোকাও বানানো হলো না—কিন্তু যখন ওই মোবাইল আসল মালিক ফোন করে বলবেন, ‘ভাই, আমার ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি। আপনি যদি দয়া করে ফেরত দেন, তাহলে খুব উপকার হয় আমার।’ তখন, এই কথার উত্তরে কী বলবে রাজন?

আর যদি ফোনের মালিক  নাছোড়বান্দা হন? যদি থানায় মামলাটামলা করেন পুলিশকে বলে? তার ঠিকানা খঁুজে বের করে বাসায় এসে হাজির হন পুলিশসহ! রাজন খবরের কাগজে পড়েছে যে এখন নাকি বাংলাদেশের পুলিশের কাছে অত্যাধুনিক সব যন্ত্র আছে। ওই যন্ত্র দিয়ে নাকি কোন মোবাইল কোথায় আছে, তা মুহূর্তেই বের করে ফেলা যায়। যদি তেমন হয়? বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির হলে, পুলিশ এসে যদি মাকে বলে, ‘আপনার ছেলে একটা মোবাইল চুরি করেছে’, তাহলে, পুলিশ তো পুলিশ—মাও তো রাজনকে আস্ত রাখবে না! নাকি?

তাহলে?

ধেৎ, এত ভয় পেলে চলে? সবার মোবাইল আছে, রাজনের নেই। এই একটা সুযোগ এসেছে হঠাৎ করে, সেটা হেলায় হারানো কি ঠিক হবে? নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয় রাজন, ‘এত ভয় পাচ্ছি কেন আমি? তুলেই নিই না ফোনটা! পরে কোনো ঝামেলার গন্ধ পেলেই না হয় আবার রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেব ফোনটা! আর ভাগ্য ভালো থাকলে যদি কোনো ঝামেলা না হয়, তাহলে তো একেবারে কেল্লাফতে!’

নাহ্‌, সাহস করে ফোনটা নেবে রাজন; পরে যদি আসল মালিকের খোঁজ পাওয়া যায় তখন না হয় মাফটাফ চেয়ে ফেরত দিয়ে দেবে সে। আর যদ্দিন না আসল মালিকের সন্ধান মিলছে, তদ্দিন না হয় ফোনটা তার কাছেই থাকুক! অন্তত ওই কটা দিন না হয় মনের সুখে সেলফি তোলা যাক, ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়া যাক, চুটিয়ে ফোন করা যাক—যত খুশি। যদি ব্যালেন্স না থাকে, কুছ পরোয়া নেহি, কত কত সস্তা প্যাকেজ পাওয়া যায় কিনতে—সুবিধামতো একটা নিয়ে নিলেই হবে। হুঁ হুঁ, খালি অন্যরাই ফেসবুক কাঁপাবে? এবার ফেসবুক কাঁপাতে আসছে রাজন!

আচ্ছা, এটা কোনো ফাঁদ নয় তো?

কত-কী হয় আজকাল। যদি এমন হয়, কেউ আসলে ফোনটার ভেতরকার সব কলকবজা খুলে সেখানে ভরে রেখেছে হেরোইন—আর, ওত পেতে বসে আছে আশপাশেই কোথাও। ও যেই না হাতে নেবে ফোনটা, হয়তো ছুটে এসে খপ করে ধরবে তাকে! তারপর বলবে, ‘তোমার বাবাকে বলো এক লাখ টাকা দিতে, নাহলে পুলিশে খবর দেব। আর খবর ছড়িয়ে দেব মিডিয়ায়—তখন আর মুখ দেখানোর জো থাকবে না।’ যদি এমন হয়?

আচ্ছা, ও এত সাত-পাঁচ ভাবছে কেন? ও না হয় নিল না ফোনটা। তাতে এমন কী লাভ হবে? কেউ না কেউ তো তুলে নেবেই ওটা। নেবে না?

এসব যখন ভাবছে রাজন, তখন হঠাৎ করেই বেজে ওঠে ফোনটা। ভারি মিষ্টি একটা গানের সুর বাজছে রিংটোন হিসেবে। গানটা চেনে রাজন—‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’।

গানের সুরটা শুনতে শুনতে ওখান থেকে সরে আসে রাজন। নাহ্‌, এভাবে ফোনের মালিক হওয়া পোষাবে না তার। কলেজে ওঠা পর্যন্ত, অর্থাৎ আরও তিন বছর—কমপক্ষে পাক্কা আরও এক হাজার পঁচানব্বই দিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নেই তার!

হোক গে।

সে যেমন আছে, তেমনই ভালো।

এই রে, অঙ্ক স্যারের বাসায় পৌঁছাতে আজ নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে! দৌড় লাগায় রাজন। মোবাইল পড়ে থাকে ওখানেই।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন