ভূ...ভূ...ভৃতেট!

স্টেডিয়ামের একেবারে কাছেই অবস্থিত ভুতুড়ে লামলি ক্যাসল
স্টেডিয়ামের একেবারে কাছেই অবস্থিত ভুতুড়ে লামলি ক্যাসল

‘আঁমিঁ আঁপনাঁর খুঁব ভঁক্ত। আঁমাকেঁ একঁটা অটোঁগ্রাফঁ দিঁবেনঁ!’

বিছানায় আরাম করে ঘুমোচ্ছিলেন হারিস সোহেল। পরদিন সাতসকালে অনুশীলন। ঘুমের ঘোরে হয়তো স্বপ্নও দেখছিলেন। এমন সময় ভেঙে গেল ঘুম। চোখ মেলে দেখলেন, সামনে তাঁর দিকে ঝুঁকে আছে এক ভক্ত। এক হাতে অটোগ্রাফের খাতা বাড়ানো। এক হাতে কলম। এক হাত মাথা চুলকোচ্ছে বিব্রত ভঙ্গিতে। এক হাত ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে তাঁকে...চার হাত!

ধবধবে সাদা পোশাক পরনে। অদ্ভুত এক আলো জ্বলছে। যে আলোয় অন্ধকার ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে ঘরের। চোখ দুটো জ্বলছে। দুটো চোখ? কপালে ওটা কী? সেকি, চোখ যে তিনটে!

হারিস চিত্কার করে উঠলেন। আশ্চর্য, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না! ধড়মড় করে উঠে বসতে চাইলেন। আশ্চর্য, শরীরে কোনো শক্তি নেই! যেন অদৃশ্য কোনো একটা চুম্বক বিছানায় লেপটে ধরে রেখেছে তাঁকে। শরীরের সবটুকু জোর একসঙ্গে করে সেই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করলেন হারিস।

অবশেষে ধুম করে উঠে বসতে পারলেন। শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। বুকে কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। হাঁফাচ্ছেন হারিস। সই শিকারি অদ্ভুতুড়ে সেই ভক্তও যেন হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

না, খুব বেশি দিন নয়, গত জানুয়ারিতেই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাকিস্তানের এই ক্রিকেটারের। বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল পাকিস্তান। তখন ক্রাইস্টচার্চের রিজেস হোটেলে ঘটে এই ঘটনা।

লামলি ক্যাসলে অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন আর ব্রেট লি
লামলি ক্যাসলে অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন আর ব্রেট লি

সে রাতে আসলেই কী হয়েছিল, হারিস অবশ্য তা খোলাসা করেননি। শুধু মাঝরাতে চিঁচিঁ গলায় দলের ম্যানেজারকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলেন ভয়ংকর বিপদে পড়েছেন। সবাই ছুটে আসেন হারিসের ঘরে। দেখেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তাঁর। ভয় থেকেই কাঁপুনি দিয়ে এসেছে জ্বর। পরে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় হারিসকে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছিল, ‘আমরা কোনো ভূতকে হোটেল ভাড়া দিই না।’

খেলার মাঠে নির্ভীক হলেও ভূতের ভয়ও পান আয়ারল্যান্ডের এডওয়ার্ড জয়েস
খেলার মাঠে নির্ভীক হলেও ভূতের ভয়ও পান আয়ারল্যান্ডের এডওয়ার্ড জয়েস

না দিলে বয়েই গেছে ভূতদের। তারা এসবের পরোয়াও করে না। ভূত হয়েছে বলে কি হোটেলে থাকার অধিকার তাদের নেই। ভূত হয়েছে বলে কি ক্রিকেট তারা উপভোগ করতে পারবে না? ভূত হয়েছে বলে কি কোনো ক্রিকেটারের ভক্ত হতে পারবে না তারা?

ভূতসমাজ যেমন স্টুয়ার্ট ব্রডের ভীষণ ভক্ত। অবশ্য তারা ভূত নাকি পেতনি, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সুদর্শন ব্রডের প্রেমে যদি কোনো শাকচুন্নি, চোরাচুন্নি বা প্যাঁচাপেঁচি পড়েই যায়; তাদের আর কী দোষ! ইংলিশ ফাস্ট বোলারকে প্রায়ই ভূতের মুখে পড়তে হয়। গত বছর জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্রড ভূতের ভয়ে কাতর হয়ে গিয়েছিল ল্যাংহাম হোটেলে থাকার সময়।

‘আমি রুমে ছিলাম। ঘুম আসছিল না। হঠাত্ কোনো কারণ ছাড়াই বাথরুমের ট্যাপ থেকে পানি পড়তে শুরু করল। আমি উঠে ঘরের লাইট জ্বালাতেই পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে এসে শুয়েছি, অমনি আবার শুরু হলো পানি পড়া!’ সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছিলেন ব্রড। রসিক ভূত বটে। নাকি দুষ্টু পেতনি!

লন্ডনের এই ল্যাংহাম হোটেলেই ভূতের পাল্লায় পড়ে কক্ষ পরিবর্তন করেছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রড
লন্ডনের এই ল্যাংহাম হোটেলেই ভূতের পাল্লায় পড়ে কক্ষ পরিবর্তন করেছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রড

লন্ডনের ল্যাংহাম হোটেলের ভূতদের গল্প বিখ্যাত হয়ে আছে মার্ক টোয়েন, অস্কার ওয়াইল্ড, আর্থার কোনান ডয়েলদের লেখায়। এঁরা এই হোটেলের আতিথ্য নিয়েছিলেন। ল্যাংহামের ওয়েবসাইটেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে ৩৩৩ নম্বর কক্ষটি ‘ভুতুড়ে’। ১৯৭৩ সালে এই কক্ষে ছিলেন বিবিসি রেডিওর অনুষ্ঠানঘোষক জেমস আলেকজান্ডার গর্ডন। এক রাতে ঘুম ভেঙে গর্ডন দেখলেন তাঁর ঘরে অদ্ভুত আলোর বর্ণচ্ছটা। সেই আলো একটি মানুষের অবয়ব নিল একসময়। তার পরনে ভিক্টোরিয়ান যুগের সন্ধ্যাকালীন পোশাক! গর্ডন দাঁতকপাটি লেগে পড়ে গেলেন মেঝেতে। রেডিও লোকদের সঙ্গেই এমন ঘটনা ঘটলে যা হয়। দ্রুতই ঘটনাটি রাষ্ট্র হয়ে গেল। তাতে অবশ্য ল্যাংহামের উপকারই হয়েছে।

ল্যাংহাম ছাড়াও ডারহামের লুমলে ক্যাসেল হোটেলও ভূতের জন্য বিখ্যাত। বহু প্রাচীন প্রাসাদ থেকে হোটেল বানানো হয়েছে এটিকে। যে প্রাসাদ নিয়ে আছে বেশ কিছু গল্প। ১৪ শতকে এর মালিককে নাকি পুড়িয়ে মেরেছিল ক্যাথলিক যাজকেরা। মেরে ফেলা হয়েছিল প্রাসাদের মালকিন লিলি লুমলেকেও, যাঁর নামেই এই হোটেলটির নামকরণ। এই হোটেলে সাতটি বিখ্যাত অপ-আত্মা ঘোরাফেরা করে বলে চাউর আছে। এঁদের মধ্যে আছেন এক জার্মান চিকিত্সক আর তাঁর স্ত্রীও। হানিমুন করতে এসে এই ডাক্তার সাহেব স্ত্রীকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেন। তাঁদের অতৃপ্ত আত্মাও ঘোরাঘুরি করছে!

এই সাহেব-মেম ভূতেরা ক্রিকেট খেলাটি পছন্দ, নাকি অপছন্দ করেন, বলা মুশকিল। তবে বেশ কিছু ক্রিকেটারকে এঁরা ভয় দেখিয়েছেন। ২০০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। পরে ব্রেট লির ঘরে ঘুমাতে যান। যেটি নিয়ে মাঠে করা ড্যারেন গফের একটি স্লেজিং বিখ্যাত হয়ে আছে। ওয়াটসনের দিকে ভূতের ভঙ্গি করে গফ বলেন, ‘ভয় পাস নে, আজ দরকার হলে আমার সঙ্গে ঘুমাবি।’

দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে নাকি বেশ কিছু অদ্ভুত, অশরীরী আত্মা বাস করে। স্থানীয় লোকজনের দাবি এ রকমটাই। এ মাঠে কিন্তু ক্রিকেটের ‘অদ্ভুতুড়ে ঘটনাগুলোর একটি ঘটেছিল। এক টেস্টে এক ইনিংসে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের সব কটিই নিয়েছিলেন একজন—অনিল কুম্বলে। এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার আর একটিই কীর্তি আছে, জিম লেকারের।

তুমি ভূতে অবিশ্বাসী হলে এসব ঘটনা মেনে না-ও নিতে পারো। প্রশ্ন তুলতে পারো, এসবের ব্যাখ্যা কী? সবকিছুরই কি আর ব্যাখ্যা থাকে? থাকে কার্যকারণ?

আচ্ছা, দুটি ঘটনার কথা বলি। একটা ১৯৯৭-৯৮ ফয়সালাবাদ টেস্টের ঘটনা। ব্যাট করছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্যাট সিমকক্স। বল করছিলেন পাকিস্তানের মুশতাশ আহমেদ। বল করলেন। সিমকক্স ব্যাট চালালেন। মিস করলেন লাইন। বল চলে গেল স্টাম্পের দিকে। গেল বটে, কিন্তু স্টাম্পও পড়ল না, বেলও না। বরং দুই স্টাম্পের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল বল!

ট্রেমলেটের বল আশরাফুলের উইকেটে সজোরে আঘাত করলেও বেলের কোন নড়নচড়ন নেই!
ট্রেমলেটের বল আশরাফুলের উইকেটে সজোরে আঘাত করলেও বেলের কোন নড়নচড়ন নেই!

আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে। ২০০৫ সালে নটিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলছিল বাংলাদেশ। অভিষিক্ত ইংলিশ পেসার ক্রিস ট্রেমলেটের পরপর দুই বলে ফিরে যান শাহরিয়ার নাফীস ও তুষার ইমরান। ওয়ানডে অভিষেকেই হ্যাটট্রিকের দারুণ সুযোগ ট্রেমলেটের সামনে। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে নামলেন আশরাফুল। ট্রেমলেটের শর্ট বলটা ঠেকালেন। নিখুঁত রক্ষণ হলো না। বল ব্যাটের কানায় লেগে ড্রপ খেয়ে গিয়ে পড়ল বেলের ওপর। হ্যাটট্রিক! না, কী আশ্চর্য, বেলই পড়ল না!

ট্রেমলেটের সেই দুঃখ বাড়িয়ে সেই ম্যাচে আশরাফুল খেললেন ৫২ বলে ৯৪ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস!