মৌমি ও সুমনের গল্প

কে  কাঁদছে? মেজোপা গরম পরোটার একটুখানি ছিঁড়ে মুখে দিল। নাজিরের বউ।

কেন?

ছেলে হারিয়ে গেছে।

মানে?

সেজোপা এক চামচ সুজির হালুয়া মুখে দিয়ে বলল, কী বোকার মতো কথা! দেশ গ্রাম থেকে ছোট ছেলেমেয়ে হারিয়ে যেতে পারে না?

ছোটপা হাসল। মৌমিটা একদম বোকা। মাথায় কিচ্ছু নেই। এত সহজ সহজ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে? ক্লাস সেভেনে পড়া একটা মেয়ে এত বোকা হয়? তাও খানবাড়ির মেয়ে!

আমরা চার বোন ডাইনিংরুমে নাশতা করতে বসেছি। সকাল সাড়ে আটটার মতো বাজে। অক্টোবরের শেষ দিক। সকালের দিকে মৃদু ঠান্ডা পড়ে। উঠোন সামান্য ভেজা। খালি পায়ে হাঁটলে গা শিরশির করে। খুব ভোরে একটুখানি কুয়াশাও দেখা যায়। তার মানে ধীরপায়ে শীত আসছে। সন্ধ্যার আগে আগে মাঠের ওদিকটায়ও কুয়াশা জমে।

পরোটা-হালুয়া মুখে দিয়ে উঠোনের দিকে তাকিয়েছি। রোদে ঝলমল করছে বিশাল উঠোন। বকুলগাছটার ওদিক দিয়ে আসছে নাজিরের বউয়ের কান্না। ওদিককার দেয়ালের পর কিছুটা খোলা জমি। তারপর নাজিরদের বাড়ি। বাড়িতে তিনটে টিনের ঘর। চারদিকে চটির বেড়া। কোনো কোনো দিককার পুরোনো বেড়া রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে গেছে। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতরটা পুরো দেখা যায়।

নাজির তেমন গরিব না। মোটামুটি সচ্ছল মানুষ। স্টেশনের ওদিকে তার রেস্টুরেন্ট আছে। লোকে বলে নাজিরের হোটেল। টিনের বড়সড় একটা ঘর। চা-নাশতা, ভাত-পরোটা, ডালপুরি, শিঙাড়া এসব বিক্রি করে। একপাশে মুদি দোকানের মতো সওদাপাতি রাখা। ফ্রিজ আছে। চাইলে ঠান্ডা কোক-পেপসিও পাওয়া যায়। স্টেশনের গরিব মধ্যবিত্ত যাত্রীরা কম খরচে খাওয়াদাওয়া করতে পারে নাজিরের হোটেলে। আয়রোজগার মন্দ না লোকটার। তবে সংসার বড়। মা-বাবা-ভাইবোন আছে, বউ আর একটা ছেলে। ওই রেস্টুরেন্টের আয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়।

নাজিরের বউয়ের নাম মায়মুনা। ছেলেটার বয়স বছর সাতেক হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। নাম সুমন। দুষ্টু ছেলে না। নরম নিরীহ টাইপ। আহা সেই ছেলেটা হারিয়ে গেছে!

ছোটপা আমাকে কনুই দিয়ে হালকা একটা গুঁতো দিল। কী রে, কী ভাবছিস?

আমি কথা বলার আগেই সেজোপা বলল, আর কী ভাববে? নাজিরের ছেলে হারিয়ে যাওয়ার মানে খুঁজছে।

বলেই খিলখিল হাসি। সঙ্গে অন্য দুবোনও।

আমার হাসি পেল না। নাজিরের বউয়ের কান্নার শব্দটা আসছেই। একজন মানুষ ছেলে হারাবার শোকে কাঁদছে আর আমার তিন বোন আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে, হাসছে। কী আশ্চর্য!

ডাইনিংয়ের পাশে কিচেন। বুয়াদের সঙ্গে মা ছিলেন কিচেনে। মেয়েদের হাসির শব্দে বেরিয়ে এলেন। খেতে বসে এত হাসি কিসের?

মেজোপা ঘটনা বলল। আমার বোকা বোকা প্রশ্নে মা কখনো অবাক হন না। ছোট মেয়েটিকে খুবই ভালোবাসেন তিনি। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ওকে নিয়ে এত হাসাহাসি করবি না তোরা। আমার পাঁচ মেয়ের মধ্যে মৌমিই সবচাইতে ভালো, সবচাইতে লক্ষ্মী। আজ এই যে মজা করে বাড়ির তৈরি ঘিয়ে পরোটা আর হালুয়া খাচ্ছিস, এটা ওর জন্যই। কাল রাতে আমাকে বলে রেখেছে, মা, সকালবেলা পরোটা-হালুয়া করে দিয়ো।

ছোটপা বলল, খুব মজা হয়েছে মা। জুলেখা বুয়া দারুণ পরোটা বানায়।

মেজোপা বলল, আর নূরজাহান বানায় হালুয়া। দুর্দান্ত।

সেজোপা বলল, আমাদের এই দুই বুয়াকে নিয়ে স্টেশনের ওদিকে একটা রেস্টুরেন্ট খুললে হয়। বিরাট বিজনেস হবে। নাজিরের হোটেল ফেইল।

বোনেরা আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। ওদের হাসি দেখে মাও হাসলেন। তবে নিঃশব্দে। কিন্তু আমি একদম হাসতে পারছি না। নাজিরের বউয়ের কান্নায় মন বিষণ্ন হয়ে আছে। এত স্বাদের পরোটা-হালুয়াও খেতে ইচ্ছে করছে না।

মেজোপা বলল, মা, তুমি যে বললে মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মৌমি, তাহলে ছেলেদের কথাটাও বলো! তোমার তিন ছেলের মধ্যে কে সবচাইতে ভালো?

আমার ছেলে একটাও খারাপ না। তিনটাই ভালো। বড়টা মেলবোর্নে পিএইচডি করছে। বউ পিএইচডি করছে। দুজনেই স্কলারশিপ নিয়ে গেছে। চাট্টিখানি কথা!

মার ‘চাট্টিখানি’ কথাটা নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করি। সেজোপা একটু বেশি দুষ্টু। খুবই সিরিয়াস মুখ করে বলল, না, চাট্টিখানি কথা না।

অন্য বোনেরা মুখ টিপে হাসল। মা খেয়াল করলেন না। বললেন, বড় মেয়ের এত ভালো বিয়ে হয়েছে। বর ব্যারিস্টার। মেজো ছেলে কত ভালো বিজনেস করছে। বউটা কী লক্ষ্মী! দুজনেই অফিসে বসে। তোর বাবাকে আর আমাকে অফিস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। দেখলে মনে হয় একদম বিদেশি অফিস। মাসে ইনকাম আট-দশ লাখ টাকা। চাট্টিখানি কথা!

সেজোপা আগের মতোই বলল, না, চাট্টিখানি কথা না। তোমার ছোট ছেলে জাপানে, মেজো মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে আমেরিকায় থাকা ছেলের সঙ্গে। চাট্টিখানি কথা!

এবার আর কেউ হাসি চেপে রাখতে পারল না। খিলখিল শব্দে হেসে উঠল। মাও হাসলেন। সেজোপার মাথায় আস্তে করে একটা চাটি মারলেন। আমার কথা নিয়ে হাসি! লিলি, মার খাবি কিন্তু।

এত কিছুর মধ্যেও আমার মন পড়ে আছে অন্যদিকে। নাজিরের বউয়ের কান্নার শব্দটা আসছেই। আহা কোথায় হারিয়ে গেছে ছেলেটা!

২.

বাড়ির এদিক-ওদিক সারাক্ষণ কাজ করে যে ছেলেটি তার নাম মজনু। বিশ-একুশ বছর বয়স হবে। তাগড়া জওয়ান বেশ চটপটে, বেশ কাজের।

সকালবেলা নাশতার টেবিলে বসে সেই যে নাজিরের বউয়ের কান্না শুনেছি, তারপর থেকে আমার মন ভালো নেই। বারবার ইচ্ছে করছে, যাই ওই বাড়িতে। একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি। কিন্তু খানবাড়ির মেয়েরা যখন তখন এলাকার কোনো বাড়িতে যায় না। তাদের বনেদিয়ানা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি মিলিয়ে ব্যাপারটা নাকি বেমানান। এসব মা-বাবা আমাদের বুঝিয়েছেন। আমরাও সেভাবেই চলি, সেভাবেই অভ্যস্ত।

আজ বাবা বাড়ি নেই। রাজবাড়ী শহরে গিয়েছেন। তাঁর তো কাজের অন্ত নেই। বোধ হয় জমিজমা-সংক্রান্ত কোনো মামলার ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। এলাকায় আমাদের প্রচুর জমিজমা। মাঠকে মাঠ জমি। শহরের একটু বাইরে, বিনোদপুরে আমাদের বাড়ি। বাড়ি মানে জমিদারবাড়ি। এক শ বছরের পুরোনো বাড়ি। মূল বিল্ডিংটা দোতলা। ওপর-নিচ মিলিয়ে আঠারোটা রুম। সামনের কাছারিঘরটা স্কুলঘরের মতো লম্বা। ওটাও পুরোনো, দাদা পরদাদার আমলের। বাড়ির ভেতর আরও দুটো বিল্ডিং আছে। ও দুটো একতলা। একটা কাজের লোকজনের আর একটায় আমাদের ডাইনিং কিচেন। বাড়িটা রাস্তার ধারে। প্রথমে অনেকখানি খোলা মাঠ, কাছারিঘর। মূল বাড়ির পুবে-পশ্চিমে দিঘির মতো দুটো পুকুর। বাড়ির পেছন দিকে গাছপালাভর্তি বিশাল বাগান। ওদিকটায় গেলে দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে।

কিন্তু আমি একা একা যাই। আমার ভালোই লাগে।

দুপুরের মুখে মুখে মজনু এসে মেজোপাকে বলল, নাজিরের বাড়িতে মজার কাণ্ড হইতাছে আপা।

মেজোপা গম্ভীর গলায় বলল, কী কাণ্ড?

ওঝা আসছে। 

সেজোপা বলল, ওঝা কেন? কাউকে সাপে কেটেছে নাকি? বিষ নামাবে?

আরে না। সাপের ওঝা না। নাজিরের ছেলে হারাইছে না, তারে খুঁইজা বাইর করার ওঝা।

ছোটপা বলল, কীভাবে খুঁজে বের করবে?

আয়নাপড়া দিব।

আমি বললাম, আয়নাপড়া জিনিসটা কী?

তুলারাশির মানুষ পাওয়া গেলে, সেই মানুষ নাকি ওঝার ওই আয়নায় দেখতে পাইবো, নাজিরের ছেলে কোথায় আছে।

ছেলেকে দেখা যাবে?

সেইটাই তো শুনলাম।

মেজোপা বলল, তুলারাশির কাউকে পাওয়া গেছে?

জি আপা, গেছে।

সেজোপা বলল, ছেলে না মেয়ে?

ছেলে। মোল্লাবাড়ির তালেব।

ছুটিছাটার দিনে আমরা চার বোন সারাক্ষণ একসঙ্গে। আজও তাই। বাড়ির উত্তর দিকে, বাগান ঘেঁষে মেয়েদের জন্য একটা পুকুর আছে। বাইরে থেকে চোখেই পড়ে না। বড় পুকুর। বাঁধানো ঘাটলা আছে। পানি এত পরিষ্কার, কী বলব!

ছুটির দিনে দুপুরবেলা আমরা চার বোন খুব মজা করে পুকুরে নেমে সাঁতার কাটি। আজও সেই প্ল্যানে আছি। একসময় মজনু এসে ওঝার কথা বলল। শুনে সেজোপা তাকাল মেজোপার দিকে। মেজোপা।

কী রে?

যাবি?

কোথায়?

নাজিরের বাড়ি।

মেজোপা লাফিয়ে উঠল। চল যাই। দেখি আয়নাপড়া জিনিসটা কী? কীভাবে বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করে? তুলারাশির তালেবই বা কী করে?

ছোটপা বলল, মা কি যেতে দেবে?

আমারও খুব ইচ্ছে করছে ব্যাপারটা দেখতে। ছেলেটাকে পাওয়া গেলে নাজিরের বউ আর কাঁদবে না। বললাম, বাবা বাড়ি নেই। সবাই মিলে মাকে বললে, মা না করবে না।

মেজোপা বলল, চল তাহলে যাই মার কাছে।

সেজোপা বলল, মা সবচাইতে ভালোবাসে মৌমিকে। ও-ই মাকে বলুক।

আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আচ্ছা বলব।

নিজের রুম থেকে বেরিয়ে মা যাচ্ছিলেন কিচেনের দিকে। আমরা চার বোন গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালাম। মা চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকালেন। মতলব কী?

ছোটপা কনুই দিয়ে আমাকে গুঁতো দিল। বল।

মা, নাজিরের বাড়ি যাব।

মা গম্ভীর। কেন?

ওঝার কথা বললাম। তুলারাশির তালেব, আয়নাপড়া, সব বললাম। শুনে মা বললেন, আচ্ছা যা।

আমরা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম। মা বললেন, তবে কথা আছে। বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারবি না। আমাদের সীমানা বরাবর ওদের বাড়ির বেড়া অনেকখানি ভাঙা। ওই বেড়ার ওখানে দাঁড়িয়ে দেখবি। খানবাড়ির মেয়েরা সব বাড়িতে যায় না। খান সাহেব শুনলে মাইন্ড করবেন।

বাবাকে ‘খান সাহেব’ ডাকেন মা।

আমরা একসঙ্গে মাথা নাড়লাম। ঠিক আছে মা।

তাড়াতাড়ি ফিরবি। দুপুর হয়ে গেছে।

আমরা বাড়ির পেছন দিককার গেট খুলে নাজিরের বাড়ির সেই ভাঙা বেড়ার দিকটায় এসে দাঁড়ালাম। সঙ্গে মজনুও আছে। সে চলে গেছে নাজিরের বাড়ির উঠোনে।

বাড়িভর্তি লোকজন। নাজির তার রেস্টুরেন্ট ফেলে বাড়িতেই বসে আছে। বউটা হাত-পা ভাঁজ করে অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে বারান্দায়। থেকে থেকে চোখ মুছছে আঁচলে। উঠোনে ওঝা লোকটার সামনে বসে আছে তালেব। মজনুর বয়সী ছেলে। হাবাগোবা টাইপের চেহারা। ময়লা নীল রঙের টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। ওঝা লোকটা বয়স্ক। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা। চুল-দাড়ি সব সাদা। চেহারায় শান্ত স্নিগ্ধ একটা ভাব। দেখে মনে হচ্ছে লোক ভালো। টাউট-বাটপার না।

বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আশপাশের বাড়িঘরের লোকজন কিছু আছে। ছেলে-বুড়ো, শিশু-মহিলা সবাই উত্সুক হয়ে তাকিয়ে আছে ওঝার দিকে। কেউ কোনো কথা বলছে না।

আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, সেখান থেকে উঠোন একেবারেই কাছে। কাছে বলা ঠিক হবে না। ভাঙা বেড়ার সঙ্গেই উঠোন। বাড়ির সবাই আমাদের দেখতেও পাচ্ছে। কিন্তু ভেতরে যে ডাকবে সেই  অবস্থা নেই কারও। অবশ্য ডাকলেও আমরা যাব না। মা যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই এখানে দাঁড়িয়ে দেখে চলে যাব।

মজনু গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওঝা আর তালেবের সামনে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে আমাদের দেখছে।

নাজির গম্ভীর মুখে বলল, কী হইলো মোসলেম মিয়া?

বুঝলাম ওঝা লোকটার নাম মোসলেম। নাজিরের কথার জবাব দিল না সে। তালেবের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি সত্যই তুলারাশির ছেলে?

তালেব সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। জি। সত্যই তুলারাশির।

তাইলে কাজ হইতাছে না ক্যান?

সেইটা আমি কেমনে বলুম?

দেখি আরেকবার মাটিতে হাত দাও তো।

তালেব তার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে শক্ত ভঙ্গিতে হাতের তালু চেপে ধরল মাটিতে। সেই হাতের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল মোসলেম মিয়া। তখন আমার শরীরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে লাগল। সত্যি অদ্ভুত অনুভূতি। এ রকম অনুভূতি জীবনে হয়নি। তিন বোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ডান হাতে ধরে রেখেছি ভাঙা বেড়ার একটা দিক। দেখি ডান হাতটা কিছুতেই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। বেড়া থেকে আপনাআপনি খসে যাচ্ছে হাত। কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না। শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি হাত সামলে রাখতে। পারছি না, কিছুতেই পারছি না। হাত চলে যেতে চাইছে উঠোনের দিকে। মোসলেম মিয়া আর তালেবের ওখানে। কোনোভাবেই সামলাতে পারছি না। হাত সামলাতে গিয়ে দেখি পুরো শরীর অন্য রকম হয়ে গেছে। এই শরীর যেন আমার শরীর না। অদৃশ্য কঠিন এক শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে উঠোনের দিকে। হাত লোহার মতো শক্ত এবং সোজা হয়ে আছে মোসলেম মিয়ার দিকে। চোখে পলক পড়ছে না। তাকিয়ে আছি মোসলেম মিয়ার দিকে।

প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি বোনেরা। যখন আমি একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছি ভাঙা বেড়ার ভেতর দিয়ে, তখন মেজোপা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। গলায় আতঙ্ক। কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?

মোসলেম মিয়া তখন চোখ তুলে তাকিয়েছে আমার দিকে। তার ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি। তালেবকে বলল, তুমি যাও বাবা। তোমাকে দিয়ে কাজ হবে না। যাকে দিয়ে কাজ হবে, তাকে আমি পেয়ে গেছি।

লোকটা উঠে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, মা, তোমার কি তুলারাশি?

তখন শরীরে সেই অনুভূতি নেই। একদমই স্বাভাবিক হয়ে গেছি। আমি কথা বলবার আগেই মেজোপা বলল, না ও তুলারাশির না। ও বৃশ্চিক রাশির। নভেম্বরের সতেরো তারিখে জন্ম।

এই মেয়েকে দেখে আমার সারা জীবনের হিসাবকিতাব গুলিয়ে গেছে। বৃশ্চিক রাশির মেয়ে এমন! তবে তোমাকে দিয়ে কাজ হবে মা।

সেজোপা বলল, আপনার ওই আয়নাপড়ার কাজ?

হ মা। আয়নাপড়ার কাজ এই মেয়েরে দিয়া হইব।

লোকটা অদ্ভুত। এই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে, এই আবার শুদ্ধর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কথ্য ভাষা।

মেজোপা বলল, না না আমার বোন আয়নাপড়া টড়ার মধ্যে নেই। মৌমি, চল চল।

আমরা ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি, নাজিরের বউ ছুটে এল। মেজোপার হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কুষ্টিয়া অঞ্চলের মেয়ে। ভাষা সুন্দর। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপা, আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছে। সন্তান হারানোর কষ্ট মা ছাড়া কেউ বুঝবে না। আপনারা এলাকার মানুষের এত উপকার করেন, খান সাহেব কত দয়ালু মানুষ! আপনারা আমাকে একটু দয়া করুন।

মোসলেম মিয়া বলল, কাজটা কিছুই না মা। শুধু আয়নার দিকে তাকায় থাকতে হইব। বেশি সমায় না। দুই-চাইর মিনিট।

মেজোপা রাজি না।

মায়মুনা তখন তার পা জড়িয়ে ধরতে গেল। মেজোপা থামাল। না না ঠিক আছে। আমরাও চাই তোমার ছেলে ফিরে আসুক। কিন্তু আমার বোনের যদি কোনো ক্ষতি হয়, বুঝতেই পারছ, খানবাড়ির মেয়ে! তুলকালাম হয়ে যাবে।

মোসলেম মিয়া হাসিমুখে বলল, কিছু হবে না মা। শুধু আয়নার দিকে তাকায়া থাকবো। হয়তো কিছু দেখতে পাইবো। অর্থাত্ নাজিরের ছেলেটারে দেখতে পাইবো। আর কিছু না। আমি দুয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, সেই কথার জবাব ধইরা বুঝতে পারবো, ছেলেটা আছে কোনদিকে। জীবিত আছে কিনা!

এবার কথা বললাম আমি। ঠিক আছে। চলুন।

ভাঙা বেড়ার ওদিক দিয়েই আমরা চার বোন নাজিরের উঠোনে চলে এলাম।

এলাকায় আমাদের বাড়ির মানুষদের সম্মান অন্য রকম। খানবাড়ির মেয়ে তালেবের মতো মাটিতে বসবে না। আমার জন্য একটা জলচৌকি আনা হলো। তালেব উঠে গেছে। সে তখন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার তুলারাশিতে কাজ হয়নি বলে মন একটু খারাপ। আমার ওসব খেয়াল করার সময় নেই। শরীরের ওই অবস্থার পর থেকে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। যদিও এখন আমি একদমই স্বাভাবিক। হঠাত্ হঠাত্ মনে পড়ছে হাত যেভাবে টেনে নিচ্ছিল অদৃশ্য শক্তি, সেই শক্তির ব্যাপারটা। নিজের ক্ষেত্রে যদি এই ঘটনা না ঘটত, যদি অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটত এবং আমাকে সেটা বলত, আমি বিশ্বাসই করতাম না। আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে এবং খানিক আগেই ঘটেছে, এখনই মাঝে মাঝে আমার সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না।

এমন ঘটনাও ঘটে!

তারপর যা ঘটল, সেই ঘটনাও কম অদ্ভুত না।

জলচৌকিতে আমি বসেছি পশ্চিম দিকে মুখ করে। মোসলেম মিয়া মাটিতে বসে আছে আমার পাশেই। ছোট্ট একটা আয়না ধরিয়ে দিল আমার হাতে। মুখ দেখার আয়না। দেশ গ্রামের গরিব বউঝিরা এই ধরনের আয়না ব্যবহার করে। আয়না বেশ পরিষ্কার। মুখের সামনে ধরতেই নিজের চেহারা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

বোনেরা দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। বাড়ির লোকজন, পাড়ার লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। নাজির আর তার বউ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের কোণে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আমাদের বাগানের ওদিক থেকে হাওয়া আসছে, ঘুঘুপাখির ডাক ভেসে আসছে। রোদ আছে কিন্তু গরম লাগছে না। অদ্ভুত এক নিঝুম ভাব।

মোসলেম মিয়া আস্তে করে বলল, কিছু দেখতে পাও, মা?

না। শুধু আমার মুখ দেখতে পাচ্ছি।

অন্য কিছু দেখো না?

না।

ভালো কইরা তাকাও তো মা!

ভালো করেই তাকিয়েছি।

তাকাইয়া থাকো।

জি তাকিয়ে আছি।

মোসলেম মিয়া চুপ করে রইল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। পিনপতন নীরবতা চারদিকে। এখন হাওয়ার শব্দও যেন পাওয়া যাচ্ছে না, ঘুঘুপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। রোদের আঁচও যেন নেই। আমি আয়নার দিকে তাকিয়েই আছি।

এ সময় দেখি আয়নায় আমার মুখটা নেই। মুখের সামনে ধরা আয়নায় মুখ নেই। খানিক আগেও ছিল। এখন নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, আয়না একদম পরিষ্কার।

মোসলেম মিয়া বলল, আয়না নাড়াইয়ো না মা। ধইরা রাখো। আয়নার দিকে তাকায়া থাকো।

আমি কথা না বলে তাকিয়ে রইলাম।

এবার ধীরে ধীরে আয়নার ভেতর অস্পষ্ট, হালকা ধরনের একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। গ্রামের একটা মাঠ। ফসলের মাঠ। মাঠের মাঝখানে আলপথ। সেই আলপথে দুজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। একজন মানুষ বয়স্ক। উঁচু, লম্বা। মাথায় টুপি। আরেকজন ছোট। যেন একটা শিশু। ছেলেশিশু।

গভীর আগ্রহে, অপলক চোখে দৃশ্যটা আমি দেখতে থাকি।

মোসলেম মিয়া বলল, কিছু দেখতে পাও মা?

জি দেখতে পাচ্ছি।

কী দেখতে পাও?

একদম পরিষ্কার না। অস্পষ্ট দেখছি দুজন মানুষ। বড় একজন মানুষের সঙ্গে ছোট একজন মানুষ।

শিশু? ছেলেশিশু?

জি। মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

ভালো কইরা দেখ মা, ভালো কইরা দেখ।

আরও কয়েক সেকেন্ড দৃশ্যটা আমি দেখলাম, তারপর আয়না পরিষ্কার হয়ে গেল। আগের মতো ফিরে এল আমার মুখ।

মোসলেম মিয়া বলল, এখন দেখা যায়?

না। এখন শুধু আমার মুখ।

ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।

হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে আয়নাটা নিল মোসলেম মিয়া। নাজির আর তার বউ ছুটে এল। তারা কথা বলার আগেই মোসলেম মিয়া বলল, ছেলের কোনো ক্ষতি হয় নাই। জীবিত আছে। মনে হয় বাড়িতে ফিরবো। কেউ তারে ফিরাইয়া দিয়া যাইবো।

৩.

দুপুরের পর আমি আর ছোটপা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ শুক্রবার। আমাদের কারোরই স্কুল-কলেজ নেই। সেজোপা এইচএসসির প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলেজে তেমন যেতে হয় না। মেজোপা অনার্স শেষ করে বসে আছে। চাইছে ঢাকায় গিয়ে মাস্টার্স করতে। হয়তো তাই হবে। এর মধ্যে তার বিয়ের কথা হচ্ছে। মেজোপার সোজা কথা, মাস্টার্স শেষ করার পর বিয়ে। পাত্রপক্ষ বেশি আগ্রহী হলে অপেক্ষা করতে হবে।

মা-বাবারও তাই ইচ্ছে। মাস্টার্স না করিয়ে তাঁদের কোনো মেয়েরই বিয়ে হবে না। পাত্র যত ভালোই হোক।

এই পাত্র অবশ্য খুবই ভালো। পুরো ফ্যামিলি লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকে। পাত্র ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। সাবজেক্ট হচ্ছে মার্কেটিং। মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বেশ অবস্থাপন্ন। বাবার পরিচিত। সেই সূত্রেই কথাবার্তা চলছে। মেজোপা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সে অপেক্ষা করছে অনার্সের রেজাল্টের জন্য। রেজাল্ট হলেই ঢাকায় গিয়ে মাস্টার্স করবে।

বিকেলটা আমরা চার বোন একসঙ্গে কাটাই। একসঙ্গে চা-নাশতা, গল্পগুজব-আড্ডা। পুকুরঘাটে গিয়ে বসে থাকা, বাগানের ওদিকটায় বেড়াতে যাওয়া। কখনো কখনো বড়পাকে ফোন করে একে একে কথা বলা। মেজোভাই আর ভাবির সঙ্গে কথা বলি। কোনো কোনো দিন অস্ট্রেলিয়ায় ফোন করে বড়ভাই ভাবির সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের ছেলেটির খবর নিই। ছেলের নাম আদনান। বয়স আড়াই বছর। বড়পার দুই মেয়ে। একটার বয়স পাঁচ, একটার দুই। নাম লতা-পাতা। টুকটুক করে কথা বলে। কী মিষ্টি গলার আওয়াজ।

জাপানে ফোন করে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি।

টেলিফোনে অনেকটা সময় কাটে আমাদের। তারপর কম্পিউটার আছে, ফেসবুক আছে। টিভি-ডিভিডি আছে। কখনো কখনো ঘণ্টা-দুঘণ্টা গান শুনে কাটাই। পুকুরঘাটে বসে নিজেরা যে যেটুকু পারি গান গাই। ভালো কাটে আমাদের সময়। ঢাকায় না থেকেও আমাদের জীবন ঢাকার গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডিতে থাকা বড়লোকদের জীবন।

আজ বিকেলের নাশতা শেষ করেছি। চার বোন পুকুরঘাটে গিয়ে বসব। মজনু ছুটে এসে বলল, কাজ হয়ে গেছে।

মেজোপা ভুরু কুঁচকে তাকাল। কী কাজ হয়ে গেছে?

নাজিরের ছেলে ফিরত আসছে।

আমরা সবাই একসঙ্গে চমকালাম। ফিরে আসছে? তার মানে সুমনকে পাওয়া গেছে?

জি।

কোথায় পাওয়া গেল?

একজন মাঝবয়সী লোক সুমনকে নিয়ে নাজিরদের বাড়িতে আইসা হাজির। এই তো কিছুক্ষণ আগে।

মেজোপা আমার দিকে তাকালেন। তার মানে মোসলেম মিয়ার আয়নায় তুই অস্পষ্টভাবে যা দেখেছিলি, সেটাই সত্য হলো!

হ্যাঁ। আমি ও রকমই একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। একজন লম্বা মানুষের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লোকটার মাথায় টুপি।

ঘটনা সেই রকমই আপা। যে লোকটা সুমনরে ফিরত লইয়া আইছে, তার মাথায় টুপি আছে। ভালো মানুষ।

মেজোপা বলল, চল তাহলে নাজিরদের বাড়ি যাই। ঘটনা শুনে আসি।

মজনু বলল, যাইতে পারেন। লোকটা এখনো আছে।

সেজোপা বলল মৌমি, মাকে গিয়ে বল।

আয়নায় যেমন দেখেছি, ঠিক তেমন ঘটনাই ঘটেছে শুনলে মাও অবাক হবেন। মোসলেম মিয়ার আয়না, আমার শরীরের ওই অবস্থা, হাত চলে যাচ্ছিল বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব মাকে বলেছি। শুনে মাও অবাক। বৃশ্চিক রাশির মানুষদের এমন হওয়ার কথা না। তুলারাশির ক্ষেত্রে নাকি এমন হয়। এ তো একেবারে উল্টো ব্যাপার।

মাত্র মাকে গিয়ে বলব সুমনের ফিরে আসার কথা, ঠিক তখনই পেছন দিককার দরজায় শব্দ। মজনু গিয়ে দরজা খুলল। নাজির, নাজিরের বউ সুমনকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ঢুকল। আনন্দে ফেটে পড়া মুখ। হারানো ছেলে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে! এসেছে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে।

মা ওদের বসালেন। চা-নাশতা দিলেন। সুমনকে দিলেন এক প্যাকেট চিপস। আমরা ঘটনা শোনার জন্য উদ্গ্রীব।

নাজির তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। মায়মুনা, ঘটনা বলো।

মায়মুনা সুন্দর করে, গুছিয়ে কথা বলে। সে বলতে লাগল...

দুপুরের পরপর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সুমন। বাবার হোটেলে যাবে। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে অনেক সময় বাবার হোটেলে যায়। বাবা হোটেল চালায়, সে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়।

গতকালের কথা।

স্টেশনে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। এত লোকজন ট্রেনে, ভাবা যায় না। বাচ্চা ছেলেপুলেও আছে অনেক। টোকাই টাইপ। কেউ ট্রেনের ছাদে চড়েছে, কেউ বগিতে। কেউ ট্রেনের দরজায় পা ঝুলিয়ে বসেছে।

এই ট্রেন কোথায় যায়, সুমন জানে না। তার খুব ইচ্ছে একদিন ট্রেনে চড়বে। বাবাকে অনেকবার বলেছে। বাবা সময়ই পায় না। সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত হোটেল নিয়ে ব্যস্ত। চাচাদের বলেছে, বুড়ো দাদাকেও বলেছে। কেউ পাত্তা দেয়নি সুমনের কথা।

তারপর থেকে সুমন ভেবেছে সুযোগ পেলে নিজে একা একাই একদিন ট্রেনে চড়বে। দূরের কোনো স্টেশনে গিয়ে নামবে, ফেরার ট্রেনে করে ফিরে আসবে। কাউকে সে কথা বলবে না। কেউ জানতেও পারবে না।

আজ সেই সুযোগটা সুমন পেয়ে গেল।

বাড়ির সবাই জানে সে নাজিরের হোটেলে গিয়েছে। নাজির জানে না ছেলে আজ তার ওখানে আসবে। স্টেশনেও দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। ভালো মওকা।

সুমন ট্রেনে চড়ে বসল।

একসময় হুইসেল বাজাল ট্রেন। কু ঝিক ঝিক শব্দে চলতে শুরু করল। গাদাগাদি ভিড়ের বগিতে দাঁড়িয়ে আছে সুমন। জানালা দিয়ে দেখছে কত মাঠ প্রান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। রেললাইনের ধারে কত ডোবা-নালা, কত ঘরবাড়ি। কত কত ফসলের মাঠ। দূরে নদীও দেখা যায়। চোখের পলকে শেষ হয়ে যাচ্ছে একেকটা দৃশ্য। বাইরে দুপুর ফুরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে কখন! সুমনের একটুও ভয় করছে না। বরং মজা লাগছে। খুব মজা। একা একা ট্রেনে চড়েছে। দূরে কোথায় চলে যাচ্ছে। সেই দূরে কোথায় থেকে অন্য ট্রেনে ফিরে আসবে, কেউ টেরও পাবে না। কী মজা!

এসব ট্রেনে সুমনের বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে ভাড়া চায় না টিটি। সুমনের কাছেও চায়নি। বিকেলবেলা ট্রেন এসে থামল এক স্টেশনে। হুড়মুড় করে লোক নামছে। সুমনও নামল। একেবারে অচেনা স্টেশন। একজনও চেনা মানুষ নেই। স্টেশনটা ময়লা নোংরা, লোকজনের গাদাগাদি ভিড়। মফস্বল এলাকার রেলস্টেশন যেমন হয়, তেমন। স্টেশনের নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে, সেই গন্ধটা আছে। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে নামছে লোকজন। এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। সুমন কোথায় যাবে! তার তো কোথাও যাওয়ার কথা না। সে ফিরতি ট্রেনে ফিরে যাবে। এই ফাঁকে যদি একটু ঘুরে বেড়ানো যায়!

স্টেশন থেকে বেরোল সুমন। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াল। সন্ধ্যার দিকে আবার এসে ঢুকল স্টেশনে। এখন ফেরার ট্রেনে চড়বে। ফিরতে রাত হয়ে যাবে। হোক। স্টেশন থেকে বাড়ি তো চেনা। একা যেতে ভয় লাগলে বাবার হোটেলে যাবে। বাবাকে গিয়ে বলে ফেলবে সব। বাবা যদি দু-একটা চড়-থাপ্পড় মারে, মারবে। তাতে কী! ট্রেনে চড়ার আশা পূরণ হয়েছে এ জন্য দু-একটা চড়-থাপ্পড় খাওয়াই যায়!

স্টেশনে লোকজন একদমই নেই। ফাঁকা স্টেশন। সুমন এদিক যায়, ওদিক যায়। কোনো লোকজনই চোখে পড়ে না। দু-একজন টোকাই, দু-একজন ভিখিরি। সুমন কিছুই বুঝতে পারছে না। আস্তে ধীরে হেঁটে স্টেশন থেকে বেরোল।

স্টেশনের বাইরে অনেক দোকানপাট। যেন একটা বাজার। রাস্তায়ও নানা রকম জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে দোকানিরা। জামাকাপড়, খেলনাপাতি, মুখরোচক খাবার এমনকি মাছ-তরকারি। নাজিরের রেস্টুরেন্টের মতো রেস্টুরেন্ট আছে। চা-পান-সিগারেটের দোকান। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আলো জ্বলছে দোকানে দোকানে।

নতুন অচেনা জায়গা। তবু ভয় লাগছে না সুমনের। ট্রেনে চড়ে কোথায় কত দূরে চলে এসেছে জানে না। কখন বাড়ি ফেরার ট্রেনে চড়বে তাও জানে না। তারপরও ভয় করছে না। এদিক ঘুরছে, ওদিক ঘুরছে। সুমনের খিদে কম। দুপুরে ভাত খেয়েছে, তারপর আর কিছুই খাওয়া হয়নি। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। তবু একদম খিদে লাগছে না।

মফস্বল শহরের ভাঙাচোরা রাস্তার দুপাশে বাজার, দোকানপাট। রিকশা-টেম্পো, লোকজনের হইচই এসবের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। এদিক-ওদিক তাকায় আর হাঁটে। তাদের বিনোদপুর এলাকার সঙ্গে একদমই মিল নেই জায়গাটার। তাদের এলাকা একটু নিরিবিলি। আর এই জায়গায় অনেক লোক, অনেক হৈ চৈ।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এল সুমন। খুব মজা লাগছে। এভাবে একা একা এতদূর চলে এসেছে! একা একা ঘুরছে! কেউ শাসন করার নেই। কে শাসন করবে? একজনও তো চেনা লোক নেই। ভারি মজা।

কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কী হবে? রাত হয়ে গেছে। এখন ফেরার ট্রেনে চড়লে বাড়ি যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। দশটা-এগারোটা। হোক গিয়ে। মা বকবে। বাবা হয়তো চড়-থাপ্পড় মারবে। মারুক। এত মজার পর ওইটুকু মার খেলে কিছু হবে না। বাবার চড়-থাপ্পড় গায়েই লাগবে না।

সুমন স্টেশনে ফিরে এল। স্টেশন অন্ধকার। লোকজন নেই। টোকাই আর ভিখিরি টাইপের যারা ছিল তাদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। বেশির ভাগই শুয়ে পড়েছে স্টেশনের মেঝেতে। নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। কেউ কেউ জেগে বসে গল্প করছে, বিড়ি সিগারেট খাচ্ছে। স্টেশনের নিজস্ব গন্ধটা আছেই।

কী ব্যাপার? এখানে তো দেখি রাত দুপুর হয়ে গেছে! ফেরার ট্রেন কখন আসবে?

একটু ফাঁকা জায়গায় একজন লোক দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। খুক খুক করে কাশছে। শীতের খবর নেই কিন্তু গায়ে একটা চাদর জড়ানো।

সুমন গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। আংকেল।

স্টেশনের বাইরে থেকে একটু আলো এসে পড়েছে এদিকটায়। সেই আলোয় সুমনের দিকে তাকাল লোকটা। কী কইলা?

না কিছু বলিনি।

আমি যে শুনলাম। আংকেল না কী জানি বললা?

জি আংকেল বলেছি।

ডাকটা ভালো। ভদ্রঘরের ছেলে মনে হইতাছে। বলো কী বলবা?

আমি বাড়ি যাব।

যাও। যাইতে কেউ না করছে?

জি না।

বাড়ি কোথায়?

বিনোদপুর।

বিনোদপুর? সেইটা আবার কোন জায়গায়?

আপনি চেনেন না?

না।

রাজবাড়ী।

লোকটা যেন চমকালো। রাজবাড়ী বিনোদপুর?

জি।

আরে সেইটা তো অনেক দূর। তুমি একলা যাইবা?

জি।

এত রাত্রে গোয়ালন্দ থিকা তুমি একলা যাইবা বিনোদপুর? কেমনে যাইবা?

ট্রেনে।

লোকটা হতভম্ব। তোমার ঘটনা কী কও তো?

ঘটনা বলল সুমন। শুনে লোকটা উঠে দাঁড়াল। খুক খুক করে কাশল। এবার তাকে খেয়াল করে দেখল সুমন। দাদার বয়সী না হলেও কাছাকাছি হবে বয়স। মুখে দাড়িগোঁফ। মাথায় টুপি আছে। পরনে লুঙ্গি আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। পাশে একটা বোঁচকা। দিশেহারা গলায় বলল, করছো কী তুমি? একলা একলা ট্রেনে চইড়া রাজবাড়ী থিকা গোয়ালন্দ চইলা আসছো? বাড়ির লোকে চিন্তায় অস্থির হইয়া যাইবো! এখন ফিরবা কেমনে?

সুমন তবু ভয় পেল না। ট্রেনে ফিরবো আংকেল।

রাত্রে ট্রেন নাই। কাইলও ট্রেন থাকবো না। এই দিককার রেললাইনে মেরামতের কাজ চলতাছে।

এবার ভয় পেল সুমন। ট্রেন নেই? তাহলে আমি ফিরবো কেমন করে?

আমি তো সেইটাই বলতেছি। ফিরবা কেমনে?

লোকটা একেবারেই রাস্তার লোক কিংবা ভিখিরি না। ভাষাও মোটামুটি ভালো। বলল, বাসে যাইতে পারবা। তবে রাত্র হইয়া গেছে। এখন ওই দিকে যাওয়ার বাসও নাই। টাকাপয়সা আছে তোমার কাছে?

সুমনের ততক্ষণে গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে কান্না পাচ্ছে। ঢোঁক গিলে কোনোরকমে বলল, না।

সর্বনাশ! তোমার দেখি বিরাট বিপদ। ভাড়া না দিলে বাসেও চড়তে পারবা না। রাত্রে খাইবা কী? থাকবা কোথায়?

এবার কেঁদে ফেলল সুমন। আমি এখন কী করব আংকেল? আমার ভয় করছে। আমি বাড়ি যাব।

লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে তার কাঁধে হাত দিল। মায়াবী গলায় বলল, ভয় পাইয়ো না। কান্নাকাটি কইরো না। ব্যবস্থা কিছু একটা হইব। তোমার বাবার মোবাইল ফোন আছে?

জি আছে।

এই তো কাজ হইয়া গেছে। চলো আমার সঙ্গে।

কোথায়?

মোবাইল ফোনের দোকানে। তোমার বাবারে ফোনে সব জানাইয়া দেই।

নাম্বার যে আমার মুখস্থ নেই আংকেল।

লোকটা যেন একেবারেই নিভে গেল। নম্বর মুখস্থ নাই?

জি না।

অন্য কেউর মোবাইল নম্বর মুখস্থ আছে?  পরিচিত কেউর?

জি না।

তুমি তো আজিব পোলা! এখনকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবার মোবাইল নম্বর মুখস্থ রাখে না, এইটা শুনি নাই। আহা, নম্বর জানা থাকলে তোমার বাবারে ফোনে জানাইয়া দিতাম এই কারবার করছো তুমি। আইজ রাত্রে না হোক, কাইল দিনের বেলা সে আইসা তোমারে নিয়া যাইতো।

সুমনের চোখে আবার পানি এল। আমি এখন কী করব আংকেল?

লোকটা চুপচাপ কী ভাবল। দুইটা কাজ করতে হইব।

কী কী?

প্রথমে ভয় পাওয়া ছাইড়া দেও, কান্নাকাটি বন্ধ করো।

সুমন চোখ মুছল। জি আচ্ছা আংকেল।

দুই হইল, আমারে এই যে আংকেল আংকেল ডাকতাছো, এই ডাকটা ছাইড়া দেও।

তাহলে আপনাকে কী ডাকব, আংকেল?

লোকটা ফিক করে হেসে ফেলল। আবার আংকেল!

এই বয়সেও লোকটার দাঁতগুলো খুব সুন্দর। হাসলে ভালো লাগে। তার হাসি দেখে সুমনও হাসল।

লোকটা বলল, আমার নাম তোতা মিয়া। আমার নাতি-নাতনিরা তোমার চেয়ে বড়। দু-একটা অবশ্য তোমার সমানও আছে। তবে কেউ আপন না। আমি বিবাহ করি নাই। নিজের সংসার নাই। ভাই বোনের ছেলেমেয়েরা আছে। তারা থাকে ঢাকায়। সবাই গরিব। আমি দেশে দেশে ঘুইরা বেড়াই। মুসাফির মানুষ। যেখানে রাইত সেখানে কাইত। ফরিদপুর টাউনে এক সাহেবের বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করতাম। কয়েক বছর করার পর দেখি ভালো লাগে না। ছাইড়া দিছি কিছুদিন আগে। এখন কোনো কাজ নাই। টাকাপয়সা হাতে কিছু আছে। ওই দিয়া চলি। এই জেলা ওই জেলায় ঘুইরা বেড়াই। টাকাপয়সা শেষ হইয়া গেলে আবার কোনো কাজে ঢুইকা যামু। ব্যস, দিন চইলা যাইবো। হা হা। তয় কথা হইল তুমি আমারে দাদু ডাকো। তোতা দাদু। হা হা।

তোতা দাদুর সঙ্গে ভালো রকম বন্ধুত্ব হয়ে গেল সুমনের। তিনি ওকে সাহস দিচ্ছেন।

এখন আর ভয়ের কিছু নাই। রাতটা কাটুক। কাইল আমি তোমারে বাড়িতে দিয়া আসবো।

রাতে থাকব কোথায়?

এইটা একটা সমস্যা। আমি একেক দিন একেক জায়গায় থাকি। ওই যে বললাম, যেখানে রাইত সেখানে কাইত। আইজ থাকবো ইস্টিশানে। তুমিও থাকবা আমার সঙ্গে।

কোথায়? স্টেশনে?

তবে আর কোথায়!

বিছানা পাব কোথায়?

হা হা। বিছানা? হা হা। বিছানা হইল ইস্টিশানের এই মেঝে। ওই যে দেখো অনেকে ঘুমাইতাছে। এইভাবে আমার পাশে শুইয়া ঘুমাইয়া যাইবা। হা হা। পারবা না?

জি পারবো।

একটাই রাইত। একটু কষ্ট করো।

সুমন মন খারাপ করল। আমার মা আমার জন্য খুব কাঁদবে। বাবা অস্থির হবে। বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।

তা তো করবোই। কারবারটা তুমি ভালো করো নাই। ঠিক আছে, ওইসব লইয়া এখন আর চিন্তা কইরো না। বাচ্চা মানুষ, ভুল কইরা ফালাইছো। আমি তোমার মা-বাপরে বুঝাইয়া বলবো। তবে আল্লাহপাকের অশেষ রহমত, তুমি কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ো নাই। তাইলে বিরাট বিপদ হইতো।

কী রকম বিপদ?

শুনলে ভয় পাইবা।

তাও আমি শুনতে চাই।

তোমারে অন্য দেশে পাচার কইরা দিতো। তোমারে আটকাইয়া রাইখা তোমার বাবার কাছে লাখ লাখ টাকা চাইতো। টাকা না দিলে তোমারে মাইরা নদীতে জঙ্গলে ফালাইয়া দিতো।

শুনে ভয়ে গলা আবার শুকাল সুমনের।

তোতা মিয়া হাসলেন। শুইনা ভয় পাইছো না?

জি দাদু। খুব ভয় পেয়েছি।

আরেকটা ভয়ের কথা শোনবা?

বলুন।

কিছু খারাপ লোক আছে। তারা তোমার মতন বাচ্চা ছেলেমেয়ে ধইরা নিয়া যায়। ওরা হইল ছেলেধরা। নিয়া কী করে জানো?

না, কী করে?

হাত-পাও ভাইঙ্গা ফালায়। চোখ অন্ধ কইরা দেয়। তারপর সেই ছেলেমেয়ে দিয়া ভিক্ষা করায়।

এবার গা শিউরে উঠল সুমনের। শুকনো গলায় ঢোঁক গিলল। মুখটা শুকিয়ে গেছে।

তোতা মিয়া হাসলেন। আমার হাতে পড়ছো, ভয়ের কিছু নাই। সম্ভব হইলে আইজ রাত্রেই তোমারে আমি বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতাম। একটা রাইত কষ্ট করো, কাইল পৌঁছায়া দিমু। এখন চলো।

কোথায় যাব?

রাত্র হইয়া গেছে। খিদা লাগে নাই তোমার? খাইবা না কিছু?

না দাদু, আমার খিদে পায়নি।

কও কী? খিদা লাগবো না কেন? ট্রেনে কিছু খাইছো?

না। দুপুরে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি।

তাইলে খিদা লাগবো না ক্যান? অবশ্যই খিদা লাগছে। ভয়ে খিদা টের পাইতাছো না। চলো।

ওরা স্টেশন থেকে বেরোল।

তোতা মিয়া বললেন, কও কী খাইবা?

আপনি যা খান।

আমি রাত্রে ভাত খাই না। রুটি আর সবজি খাই। তুমি ওই জিনিস খাইতে পারবা না। লও ভাত খাওয়াই তোমারে। গরুর গোশত দিয়া ভাত খাও। এখানকার হোটেলে ভাত-গরুর মাংস ভালো পাওয়া যায়। আমি রুটি-সবজি খাই, তুমি ভাত-গোশত খাও।

না আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।

তাইলে?

কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে।

বললাম না, বাড়ির চিন্তা বাদ দাও। কাইল আমি তোমারে বাড়িতে নিয়া যাবো। আইচ্ছা শোনো, একটা কাজ করি। পাউরুটি আর সবরিকলা কিনি। এক বোতল পানি কিনি। পাউরুটি আর সবরিকলা আমিও পছন্দ করি। ওইটাই খাই দুইজনে।

পাউরুটি-কলা সুমনেরও পছন্দ। বলল, ঠিক আছে।

পাউরুটি কলা কিনে ওরা স্টেশনে ফিরে এল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে খেল দুজনে। অনেক গল্প করল। রাত দশটার দিকে ঘন ঘন হাই তুলতে লাগল সুমন।

তোতা মিয়া বললেন, ঘুম আসতেছে?

জি।

তাহলে শুইয়া পড়ো। আমি তোমারে বিছানা কইরা দিতাছি।

বোঁচকা থেকে পুরোনো লুঙ্গি বের করে মেঝেতে বিছালেন তোতা মিয়া। পুরোনো পাঞ্জাবি আর একটা ছেঁড়া তোয়ালে ছিল বোঁচকায়। ওই দিয়ে বালিশের মতো বানিয়ে দিলেন। এইবার শুইয়া পড়ো।

সুমন গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। খোলা স্টেশন। হু হু করে হাওয়া আসছে। শীত শীত লাগছে। তোতা মিয়া গভীর মমতায় তার চাদরটা সুমনের গায়ে দিয়ে দিলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমে ডুবে গেল সুমন।  

একটানা ঘুমের স্বভাব সুমনের। রাতে তার সাড়াই থাকে না। সকাল সাতটার দিকে ঘুম ভাঙে। আজও ভেঙেছে। প্রথমে বুঝতেই পারেনি কোথায় শুয়ে আছে। কাল দুপুরের পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনেই ছিল না। চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘুম আসলে ভাঙেনি। সে একটা অচেনা স্টেশনের স্বপ্ন দেখছে।

ঘুম ভাঙল?

এবার তোতা মিয়াকে দেখতে পেল সুমন। পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন।

সুমন উঠে বসল। ঘটনা মনে পড়ল তার। বুকটা ধক কর উঠল। একটা রাত এভাবে কেটে গেছে! বাড়িতে কী জানি কী হচ্ছে তাকে নিয়ে! মা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বাবা-চাচারা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। দাদা ছোটাছুটি করছেন। মাকে ঘিরে বসে কান্নাকাটি করছেন দাদি-ফুফুরা। পাড়ার লোকে জেনে গেছে, সুমনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী কাণ্ড করে ফেলেছে সে!

তারপরই মনে হলো, তোতা দাদু বলেছেন, আজই বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। সকাল হয়ে গেছে, এখন রওনা দিলেই হবে। ইশ্, বাড়ি ফেরার পর যে কী হবে।

তোতা মিয়ার দিকে তাকাল সুমন। বাড়ি যাব কখন?

মেঝেতে বিছানো লুঙ্গি, বালিশ বানানো পাঞ্জাবি আর পুরোনো তোয়ালেটা গুছিয়ে বোঁচকায় রাখলেন তোতা মিয়া। হাসিমুখে বললেন, অস্থির হইয়ো না। মাত্র ঘুম থেকে উঠছো, সকালবেলার কাজগুলি সারো। ইস্টিশানে কল আছে। কলের পানি দিয়া হাতমুখ ধোও। তার বাদে চলো নাশতা-পানি করি। তোমাদের ওই দিককার বাস কখন ছাড়ে আমি জানি না। খোঁজখবর লইয়া বাসে চড়ুম।

সুমন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। মা আমার জন্য খুব কাঁদবে।

সেইটা আমি জানি।

সুমনের কাঁধে হাত দিলেন তোতা মিয়া। এখন আর কান্নাকাটি কইরা লাভ নাই মিয়াভাই। যা হওয়ার হইয়া গেছে। চলো আগে হাতমুখ ধুইয়া আসি। তুমি ওঠো নাই দেইখা আমিও কলঘরের ওই দিকে যাইতে পারি নাই।

কেন? আমি ঘুমিয়ে ছিলাম সেই ফাঁকে যেতেন।

না মিয়াভাই। সেইটা হয় না।

কেন হবে না?

ঘুম ভাঙার পর তুমি যদি আমারে না দেখো, ভয় পাইয়া যাইতে পারো। অন্য কোনো দিকে চইলা যাইতে পারো। আমারে খুঁজতেই হয়তো গেলা। আমারে না পাইয়া হারায়া গেলা। তখন বিরাট বিপদ হইব। আমি তোমারে খুঁইজা পামু না, তুমি খুঁইজা পাইবা না আমারে! সেইটা অন্য রকম বিপদ মিয়াভাই।

কলঘরের দিকে যেতে যেতে সুমন বলল, আপনি আমাকে মিয়াভাই বলছেন কেন?

হাতের বোঁচকা কাঁধে নিয়ে তোতা মিয়া হাসলেন। তোমার বয়সী আমার যেসব নাতি আছে, তাগো সবাইরে আমি মিয়াভাই ডাকি। ডাকটা আদরের। ক্যান, মিয়াভাই শোনতে তোমার ভালো লাগতাছে না?

জি লাগছে।

তাহলে ঠিক আছে।

হাতমুখ ধুয়ে স্টেশন থেকে বেরোল ওরা। তোতা মিয়ার কাঁধে ঝোলানো বোঁচকা, হাতে ধরা সুমনের হাত।

কী নাশতা করবা?

নাশতা করবো না।

ক্যান মিয়াভাই? নাশতা করবা না ক্যান?

বলেছি না, আমার খিদে পায় না।

তোমার বয়সী এখনকার ছেলেপেলেরা খাইতেই চায় না। তাগো খিদা লাগে কম। এইটা বললে চলবো না, খাইতে হইব। কী খাইবা বলো?

বাড়িতে মা আমাকে গুড়মুড়ি দেয়। দুধ পাউরুটি দেয়। কোনো কোনো দিন পরোটা হালুয়া দেয়।

এই তো ভালো জিনিসের নাম বলছো। এখানকার একটা দোকানে ভালো পরোটা-হালুয়া পাওয়া যায়। চলো ওই জিনিসই খাওয়াই তোমারে।

ঠিক আছে।

গোয়ালন্দ থেকে রাজবাড়ীর বাস ছাড়ে তিন ঘণ্টা পরপর। নাশতা সেরে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখা গেল প্রথম বাস ছেড়ে গেছে। পরের বাস ছাড়বে সাড়ে দশটায়। এতক্ষণ কী করা যায়?

তোতা মিয়ার সঙ্গে এদিক ঘুরল সুমন, ওদিক ঘুরল। তারপরও সময় কাটে না। তার শুধু মনে পড়ে বাড়ির কথা। শুধু মনে পড়ে মায়ের কথা। বাবার চেয়ে মা তাকে বেশি ভালোবাসে। বাবাও ভালোবাসে, তবে মায়ের চেয়ে একটু কম।

আসলে কি সুমনকে তার বাবা কম ভালোবাসে?

আজ সুমনের মনে হলো, না, বাবাও কম ভালোবাসে না। সকালবেলা সুমন ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবা চলে যায় তার হোটেলে। ফেরে অনেকটা রাত করে। তখন ঘুমিয়ে পড়ে সুমন। বাবার সঙ্গে দেখা হয় কম। এ জন্য সুমন তার হোটেলে গেলেই দুহাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা। মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে। অনেক সময় কোলে নিয়ে বসে থাকে। সুমন যা খেতে চায় তাই খেতে দেয়। বেলুন কিনে দেয়, চকলেট-চিপস দেয়। না, বাবাও সুমনকে কম ভালোবাসে না!

এখন বাবার জন্যও মন খারাপ লাগছে সুমনের।

তোতা মিয়ার সঙ্গে বাসে চড়ল সুমন। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস। তাও লোকজনে গাদাগাদি। আগেভাগে চড়ার ফলে সিট পেয়েছে তারা। অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সবাই গরিব ধরনের মানুষ। এসব মানুষই এই ধরনের বাসে বেশি চড়ে।

বাস চলছে। সুমন ভাবছে বাড়ির কথা। ফেরার পর তাকে পেয়ে কেমন করবে মা? বাবা কি হোটেলে গেছে? নাকি ছেলের জন্য বাড়িতে বসে আছে! সে কেমন করবে সুমনকে পেয়ে? চড়-থাপ্পড় মারবে? দাদা-দাদি, চাচা-ফুফুরা কী করবে?

তোতা মিয়া বললেন, কী ভাবো, মিয়াভাই?

বাড়ির কথা।

সেইটা আমি জানি। ভয় পাইতেছো?

জি।

ক্যান? বাবা মারবো?

সুমন কথা বলল না।

তোতা মিয়া তার মাথায় হাত দিলেন। না মারবো না। ভয় পাইয়ো না। তারা খুশি হইবো। খুশিতে কান্নাকাটি করবো। হারানো ছেলে ফিরত পাইলে মা-বাবার আনন্দের সীমা থাকে না।

এইসব কথাবার্তা চলছে, হঠাত্ থেমে গেল বাস। এটা বাস থামার জায়গা না, তবু থামল। কী ঘটনা?

হেলপার বলল, বাস নষ্ট হইয়া গেছে।

ড্রাইভার-হেলপার বাস থেকে নামল। ইঞ্জিনের দিককার ডালা তুলে দেখতে লাগল। এটা পরীক্ষা করে, ওটা পরীক্ষা করে। ডালা তোলার পর ধোঁয়া বেরোচ্ছে ইঞ্জিন থেকে। বিরক্ত মুখে ড্রাইভার চেষ্টা চলাচ্ছে। এক-দু মিনিট করে সময় যাচ্ছে। যাত্রীরা সবাই নেমে গেছে বাস থেকে। তোতা মিয়ার সঙ্গে সুমনও নেমেছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে। বাস যদি ঠিক না হয় তাহলে কী হবে?

তোতা মিয়া বললেন, ভয় পাইয়ো না। বাস ঠিক হইয়া যাইবো।

জায়গাটা একেবারেই খোলামেলা। রাস্তার দুপাশে ফসলের মাঠ। দূরে দূরে গাছপালাঘেরা গ্রাম। যাত্রীরা নানা রকমের কথাবার্তা বলছে। এই দিকে অন্য বাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাস ঠিক না হলে কী হবে?

ঘণ্টা খানেক পর হতাশ গলায় ড্রাইভার বলল, বাস একদম নষ্ট হইয়া গেছে। ঠিক হইব না।

যাত্রীরা হৈ চৈ লাগিয়ে দিল।   

ড্রাইভার নরম গলায় বলল, যন্ত্রপাতির ব্যাপার। আমার কিছু করার নাই। ভাড়া ফিরত দিতাছি। আর কী করুম, কন?

মহিলা যাত্রী আছে তিনজন, তাদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা। কী আর করা! ভাড়া ফেরত নিয়ে যে যার মতো হাঁটতে শুরু করল।

এই প্রথম চিন্তিত হলেন তোতা মিয়া। ভালো বিপদ হইলো তো?

সুমন ভয় পাওয়া গলায় বলল, এখন কী হবে?

তুমি ভয় পাইয়ো না। ব্যবস্থা আমি করতাছি। তবে তোমার খুব কষ্ট হইব।

আমরা কী হেঁটে যাবো?

হ, সেইটা ছাড়া উপায় নাই।

এখান থেকে কত দূর আমাদের বাড়ি?

জানি না। দাঁড়াও, ড্রাইভার সাবরে জিজ্ঞাসা কইরা আসি।

ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে এলেন তোতা মিয়া। পাঁচ কিলোমিটার হইব। রাস্তা দেখাইয়া দিছে। পশ্চিম দিককার মাঠের ভিতর দিয়া যাইতে হইব। চলো হাঁটা দেই।

চলুন।

পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারবা মিয়াভাই?

জি পারব।

তোতা মিয়ার সঙ্গে মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল সুমন। মাঠভর্তি রোদ, হাওয়া। গরম লাগছিল। নানা রকম গল্পে কথায় সুমনকে ভুলিয়ে রাখছিলেন তোতা মিয়া। কিলোমিটার খানেক হাঁটার পরই গাছের ছায়ায় বসছিল। বাজারমতো একটা জায়গায় এসে ঢুকেছিল মিষ্টির দোকানে। দোকানের রসগোল্লা খুব ভালো। তিনটা রসগোল্লা খাইয়েছেন সুমনকে। নিজে মিষ্টি তেমন খান না তোতা মিয়া। তিনি খেলেন চা-শিঙাড়া।

বিনোদপুর এলাকা চেনেন না তোতা মিয়া। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে বিকেলের দিকে এসে পৌঁছালেন। নিজেদের গ্রামে এসে আনন্দের আর সীমা নেই সুমনের। তোতা মিয়ার আগে আগে প্রায় দৌড়ে ঢুকল বাড়িতে। এতদূর হাঁটার ক্লান্তিতে মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে।

৪.  

সুমনকে প্রথম দেখল তার ছোট ফুফু কাজল। বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই। যে যেদিকে পারে খুঁজতে বেরিয়েছে সুমনকে। আচমকা দৌড়ে বাড়ি ঢুকছে সুমন, এই দৃশ্য দেখে কাজল একটা চিত্কার দিল। ভাবী, ও ভাবী, সুমন আইসা পড়ছে!

বারান্দায় অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছিল মায়মুনা। কাজলের চিত্কার শুনে পাগলের মতো দৌড়ে উঠোনে এল। বাইরের দিক থেকে ছুটে এসে সুমন তার গলা জড়িয়ে ধরল।

মায়মুনা তখন ছেলে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। তুই কোথায় চলে গিয়েছিলি বাবা? আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলি?

নাজিরের বাড়িতে তো সাড়া পড়লই, পুরো পাড়াতেই সাড়া পড়ে গেল। দেখতে দেখতে বাড়ি ভরে গেল লোকে। খবর পেয়ে নাজির ছুটে এল, নাজিরের ভাইয়েরা এল। বুড়ো বাবাও ছিলেন বাইরে। নাতিকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। বুড়ো মানুষটাও এলেন প্রায় ছুটতে ছুটতে।

তোতা মিয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন উঠোনের এক কোণে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না, কথা বলছে না। সবাই সুমনকে নিয়ে ব্যস্ত। তোতা মিয়া স্নিগ্ধ মুখে মায়মুনার দিকে তাকিয়ে আছেন। হারানো ছেলে ফিরে পাওয়ার আনন্দে কান্না থামছেই না মায়ের। এমন দৃশ্য তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে কোনো দিনও দেখেননি তোতা মিয়া।

নাজির দৌড়ে এসে মায়মুনার কোল থেকে ছিনিয়ে নিল সুমনকে। ছেলে বুকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে লাগল। তুই কোথায় চইলা গেছিলি বাবা? তোরে না পাইলে তোর মায় মইরা যাইতো, আমি মইরা যাইতাম। আমার সোনা, আমার মানিক, কোথায় চইলা গেছিলা তুমি?

এবার তোতা মিয়া এসে সামনে দাঁড়ালেন। বাবার কোল থেকেই তাকে দেখতে পেল সুমন। বাড়িতে ঢোকার আগে তার একটু একটু ভয়ও করছিল। মা কিছু বলবে না, বাবা হয়তো চড়-থাপ্পড় মারবে। তেমন কিছু ঘটেনি দেখে সে খুব খুশি। তার ওপর এত আদর, কান্নাকাটি! এতটা সে ভাবেনি, বুঝতেও পারেনি। ফেরার ট্রেন না পেয়ে যে ভয় চেপেছিল কাল সন্ধ্যা থেকে, সেটা একদম কেটে গেছে। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ট্রেনে চড়ে আমি গোয়ালন্দ চলে গিয়েছিলাম বাবা। এই দাদু আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

এবার তোতা মিয়ার দিকে তাকাল সবাই।

নাজিরের বাবা এসে হাত ধরলেন তোতা মিয়ার। আপনে আমার নাতিরে ফিরাইয়া আনছেন! আসেন ভাই, আসেন। বসেন। ও কাজল, ভাইরে একটা চেয়ার দে।

তোতা মিয়ার কাছ থেকেই পুরো ঘটনা জানল নাজিরের পরিবার।

মায়মুনা তখন বারান্দায় বসে ছেলেকে ভাত খাওয়াচ্ছে। আহা রে, আমার সোনার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে! কিন্তু এটা তুমি কী করেছিলে, বাবা? এইটুকু ছেলে একা একা এভাবে ট্রেনে চড়ে? যদি কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়তে? যদি অন্য দেশে পাচার করে দিত তোমাকে?

নাজিরের ছোট ভাইয়ের নাম মালেক। মোসলেম মিয়াকে খুঁজে বের করেছিল সে। রাজবাড়ী শহরের লোক। মোবাইল ফোনে ঘটনা তাকে জানাল মালেক। শুনে সে বলল, ছেলে ফিরত আসছে এইটা খুবই খুশির কথা। আমার চেষ্টা কাজে লাগছে ভাইবা ভালো লাগতেছে। তবে খানবাড়ির ওই মেয়েটাকে না পাইলে কাজ হইতো না। সে তুলারাশির মেয়ে না। তবে তার ভিতর কিছু একটা আছে। তারে ধন্যবাদ দিয়ো।

তারপরই সুমনকে নিয়ে নাজির মায়মুনা ওরা এসেছে আমাদের বাড়িতে।

সব শুনে আমরা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।

তুলারাশি, আয়নাপড়া এসব বুজরুকি আমরা কখনো বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজ যা ঘটল তা সত্যি বিস্ময়কর। আমার শরীরের ওই অবস্থা হলো, আয়নায় একজন লোকের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলেকে মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখলাম। লোকটার মাথায় টুপি। যা যা দেখেছি সুমনের ক্ষেত্রে হুবহু তাই ঘটেছে। ওভাবেই মাঠের ভেতর দিয়ে তোতা মিয়ার সঙ্গে হেঁটে এসেছে সে।

পৃথিবীতে যে কত অদ্ভুত ঘটনা  ঘটে! *

অলংকরণ: জুনায়েদ