বন বাতাসে

দমকাটা হঠাত্ সবাইকে চমকে দিয়ে বনের জলার ধারের হিজলগাছটায় খুব জড়িয়ে গেল।

দমকার কাণ্ডে আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত বাকিরা খুব বিরক্ত হলো।

হুহু বলল, ‘দমকা, তুই বড্ড বেখেয়াল, হিজলগাছে চট করে জড়িয়ে গেলি, দেখছিস না এখানে আমাদের সম্মানিত থমথমে বসে আছে। উনি যে তোকে একদমই সইতে পারেন না, সেটা জানিস না?’

দমকা দম ফেলে বলল, ‘দুঃখিত জনাব, আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না, আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন?’

থমথমে বলল, ‘ব্যথা পাব কেন? বাজে কথা বোলো না। তবে আমার আশপাশে তুমি থাকলে আমি একটু অস্থির বোধ করি, সামান্য পালপিটিশন হয়। যাক, এসে যখন পড়েছ, তখন বসো। যতই অস্থির লাগুক না কেন, তুমি তো আমাদেরই লোক।’

বাকিরাও সম্মত হলো, ‘হ্যাঁ, ও তো আমাদেরই লোক।’

হুহু বলল, ‘দমকা, আমরা এখানে একটি জরুরি ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিলাম। যদিও তুমি দেরিতে এসেছ, তারপরও আমার মনে হয় ব্যাপারটা তোমাকে জানানো উচিত। আমাদের সামনে একটি বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে।’

দমকা চমকে গিয়ে বলল, ‘বিপদ! কী বলছ! কী সর্বনাশ, এখন কী হবে?’

সমীরণ দমকাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘হোস না এত উতলা, আগে তো হোক বিপদখানা বলা!’

সমীরণ সব সময় কাব্য করে কথা বলে, এ জন্য কবিদের কাছে সে খুব প্রিয়।

হুহু বলল, ‘বিপদটা আসলেই সর্বনেশে, আমাদের ছোট্ট লিলুয়া আজ সকালে বনের সীমানায় বসে ছিল। মহাদুষ্ট ঘূর্ণি সে সময়ে বনের পাশের মাঠ দিয়ে যাচ্ছিল। ওকে দেখতে পেয়ে বলেছে, দেখি আর তোরা কত বাহাদুরি করতে পারিস, আজ রাতে দেখা যাবে।’

ছোট্ট আর নরম মনের লিলুয়া সে কথার সমর্থনে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই বলেছে।’

দমকা চট করে হিজলগাছের ডাল থেকে নেমে নলখাগড়ার ঝোপে সরে এসে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ রাতে কি দেখা যাবে?’

দখিনা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এর মানে হলো, ঘূর্ণি আমাদের হুমকি দিয়েছে, সে আমাদের বনে হামলা করবার চিন্তা করছে।’

লু রেগে বলল, ‘হামলা করে দেখুক না, ওকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছ।’ লু-এর মাথা সব সময় গরম থাকে।

থমথমে বলল, ‘লু ঠান্ডা মাথায় ভেবে কথা বলো। ঘূর্ণি একবার বনে ঢুকে গেলে সব লন্ডভন্ড করে দেবে। ওর যা শক্তি, তাতে আমরা কেউ টিকে থাকতে পারব না। ওর দেহটা বিশাল, খাঁইও বেশি, সবকিছু গিলে ফেলতে চায়। ওর সাথে মারামারিতে আমরা খুব সহজেই হেরে যাব।’

কনকনে এক কোণে বসে অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। এতক্ষণে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘কিন্তু...কিন্তু ঘূর্ণিটা তো আগেও অনেকবার আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, পারেনি তো।’

‘হ্যাঁ, পারেনি,’ হুহু বলল, ‘কারণ, আমাদের বনের তিনপাশে আছে ঘন বাঁশঝাড়, বুনো লতা আর বঁইচির প্রাচীর। ওসব দিক দিয়ে ও পা মাড়ায় না, একবার চেষ্টা করে বাঁশঝাড়ে কেটে-ছিঁড়ে গেছিল, তারপর থেকে আর চেষ্টা করেনি। আর বাকি এই দখিন দিকটা জুড়ে ছিল জলা আর হিজলের প্রাচীর। তাই এদিক দিয়েও আসতে পারত না। কিন্তু আমাদের থমথমে গতকাল দুটো লোককে এই দিকে আসতে দেখে নৌকা করে। ওরা চুরি করে বনের গাছ বেচে দেয়। ওরা নাকি হিজলগাছগুলো কেটে ফেলার কথা বলছিল।’

ব্যাপারটা শুনে সবাই শিউরে উঠল।

‘তাহলে তো আমাদের প্রাচীর নষ্ট হয়ে যাবে, কী ভয়ংকর!’ দমকা আঁতকে ওঠে।

‘হ্যাঁ, ভয়ংকর তো বটেই। এবং ওদের কথায় মনে হয়েছে কাজটা ওরা আজ রাতেই করবে। ব্যাপারটা ঘূর্ণিও টের পেয়েছে। তাই এখন সুযোগ খুঁজছে আমাদের বনে ঢোকার!’

‘তাহলে এখন আমরা কী করব?’ লিলুয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।

‘সেটা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে! তারপরে সবাই মিলে ঠিক করতে হবে কী করা যায়!’

অনেক ভেবেও ওরা কোনো উপায় খুঁজে পেল না, শেষমেশ ওরা মন খারাপ করে হিজলের প্রাচীরে বসে রইল।

একসময় রাত হলো, চারপাশে ধবধবে সাদা রং গুলে দিয়ে চাঁদ উঠল বনের মাথায়। হিজল ফুলে গন্ধ ছড়াল, অন্য দিন হলে লিলুয়া এ মন-মাতানো গন্ধটা বনে ছড়িয়ে দিত ওর সাথে করে নিয়ে। কিন্তু আজ আর ওর সে ইচ্ছা হলো না।

গভীর রাতে সত্যি সত্যিই চোর রঘু আর তার ভাগনে ভুলু একটা ছোট্ট নায়ে চেপে বনে এসে হাজির হলো। সাথে ওদের গাছ কাটার করাত। হুহুরা দেখল বনের ওপারে মাঠের মাঝখানে তখন মহাদুষ্ট ঘূর্ণিটা ওত পেতে আছে। কখন প্রাচীর ভেঙে যায় আর ও ভেতরে ঢুকে সব কটাকে গিলে খাবে।

রঘু করাতটা কাঁধে নিয়ে নৌকা থেকে নামে। ভুলুও এসে কোন হিজলটা কাটবে, সেটার মাপজোখ করা শুরু করে।

পুরো ব্যাপারটা লু অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছিল। শেষমেশ ওর মেজাজটা খুব গরম হয়ে গেল, মাথা ঠান্ডা রাখা ওর ধাতে নেই। খেপে গিয়ে ও সামনে থাকা ভুলুর গায়ে গোত্তা মারা শুরু করল।

লু-এর গোত্তা খেয়ে ভুলুর এই বসন্তের শীত শীত রাতেও গরমে গা পুড়ে যেতে থাকল।

ও রঘুকে বলল, ‘মামা, গরম লাগতেছে।’

রঘু বলল, ‘দিকদারি করিছ না, কাম করতে আইছোস, গরম তো একটু লাগবোই।’

লু-এর দেখাদেখি খানিক পরেই কনকনেও ভুলুুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কনকনের শীতল পরশে ভুলুর হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

ভুলু এবার চমকে উঠে ওর মামাকে জানাল, ‘মামা, শীত করে এখন!’

রঘু একটা ভেংচি কেটে ধমক দিয়ে বলল, ‘মশকরা করোছ, এই গরম, এই শীত, কামে ফাঁকি দিবার ফন্দি, না?’

দখিনাও তারপরে এগিয়ে যায়। ও সুড়সুড়ি দিতে ওস্তাদ। তাই হাসতে মানা এমন প্রাণীরা ওকে খুব ভয় পায়, তাদের ভয় নিয়ে এক বাঙালি ছড়াকার লিখেছেন—

‘যায় না বনের কাছে, কিংবা গাছে গাছে

দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে হাসিয়ে ফেলে পাছে!’

দখিনা আচ্ছামতো সুড়সুড়ি দিতেই ভুলুু হিহি করে নিশ্চুপ বন কাঁপিয়ে কেমন এক বেধারা হাসি দিল। এই হাসিতেই ওর রঘুর মনটা হঠাত্ মচকে গেল, ভুলুুকে শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোরে আবার ওনারা ধইরল না তো।’

‘ওনারা?’ ভুলুু হাসি থামিয়ে অবাক হয়।

‘ওই যে শুলুকপুরের ওঝারে ডাকা লাগে যেগুলা ভর করলে, ওইগুলা?’

ভুলু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ভূত নাকি মামা?’

রঘু ধমকে উঠে বলে, ‘এই নাম মুখে আনতে আছে? বেকুব কোনহানকার!’

খানিক পরে মামা রঘুরও হঠাত্ গরম লাগে, তারপর আবার ঠান্ডা আর তারপরেই হিহি করে হেসে ওঠে। ওদের আর বুঝতে বাকি থাকে না।

থমথমে আর হুহু কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না, তবে ওরাও চাচ্ছিল কিছু একটা করতে। থমথমে গিয়ে হঠাত্ ওদের ঘিরে ধরে, আর হুহু হিজলের প্রাচীরে অস্থির হয়ে বইতে থাকে কী করবে বুঝতে না পেরে।

সে কারণে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়, রঘু আর ভুলুু খেয়াল করে, ওদের চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ। কিন্তু গাছপালাগুলোর ডালগুলো কেমন নড়ছে, মনে হচ্ছে কেউ ডাল ধরে খুব ঝাঁকাচ্ছে। ওরা নিশ্চিত হলো এই বনে দোষ আছে।

এমন সময় দমকা হঠাত্ ওদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে ওদের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়, শহুরে জানলাগুলোতে প্রায়ই যেভাবে ও আঘাত হানে, তেমন করেই আরকি। ওরা তাতে ভীষণ শিউরে উঠে করাত ফেলে পড়িমরি করে নৌকার দিকে দৌড়ে যায়।

এবার ওদের পিছু পিছু সমীরণও ছুটে যায়, অন্য দিন হলে রাতে ও চাঁদের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, কিন্তু আজকে সবার মতো ওরও কিছু করা উচিত, এটা ওর মনে হয়। অবশ্য জলার ধারে ওদের গায়ে পড়তে গিয়ে ও ওদের নৌকায় গিয়ে পড়ে। জ্যোত্স্না রাতে সমীরণ ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে না, এটা অবশ্য সবার জানা, ওর তাল বেঠিক হবেই। কবিগুরুও ব্যাপারটা বলেছেন ওনার এক গানে—

আজ জ্যোত্স্না রাতে সবাই গেছে বনে

আজ বসন্তেরই মাতাল সমীরণে!

সমীরণ নৌকায় পড়তেই নৌকাটা একটা গোত্তা খেয়ে ঘুরে যায়।

সেটা চোখের সামনে দেখে রঘু আর ভুলুুর চেহারা আরও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ওরা নৌকা ফেলেই নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, সাঁতরে নদী পার হয়ে যায় কোনোমতে। তারপর হাঁসফাঁস করে ওপারে উঠেই ‘বাবা গো, খাইয়া ফেলল গো!’ বলে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে যায়।

আর এতক্ষণ বনের সীমানার বাইরে বসে অপেক্ষারত দুষ্ট ঘূর্ণিটা ব্যাপারগুলো দেখে রেগেমেগে খুব ঘুরতে থাকে। তারপর রাগ ঝাড়তে রঘুদেরই পিছু নেয়।

বনে আবার আনন্দ ফিরে আসে।

বনময় দখিনা আর হুহু ঘুরে বেড়ায় ফুর্তির আমেজে, দমকাকে পাশে নিয়েই থমথমে পা ঝুলিয়ে বসে, লিলুয়া ফুলের সৌরভ নিয়ে নেচে বেড়ায়, লুয়ের মাথাও ঠান্ডা হয়ে আসে, কনকনের সঙ্গে মিলে হাসতে থাকে গল্প করে করে।

আর খানিক পর সমীরণ একটা গান ধরে জ্বলজ্বলে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে, মাত্রই ও গানটা বেঁধেছে।

বনের সবাই মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনতে থাকে।

অলংকরণ: স্বপন চারুশি