স্মৃতিতে হৃদয়

খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাবের বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহমুদুল হাসান পড়তো খুলনা পাবলিক কলেজে। সবাই ওকে হৃদয় নামেই ডাকতো। বই পড়তে খুব ভালোবাসতো। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তার প্রিয় লেখক। বুক ক্লাবে সবার কাছে জনপ্রিয় ছিল সে। একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় জাতীয় পর্যায়ে বিতর্কে চ্যাম্পিয়নও হয়ে ছিল। গত ১৯ এপ্রিল শুক্রবার দুপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে এই মেধাবী কিশোর। তার অকাল মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ করেছে খুলনা কিআ বুক ক্লাবের সদস্যরা ও সহকর্মীরা।

পিচ্চি বলে আর কেউ ডাকবে না

মাহমুদুল হাসান হৃদয়। আমার কাছে সে হৃদু ভাই। প্রথম যেদিন বুক ক্লাবে গেলাম, পরিচিতি পর্বে চিকন সুরে একজন বলে উঠল মাহমুদুল হাসান হৃদয়, এসএসসি পরীক্ষার্থী, খুলনা পাবলিক কলেজ।

কে যেন বলেছিল কাল তো ভাইয়ের পরীক্ষা শেষ, দেখেন তো ভাইয়ের পেছনে পাখা গজাল না তো? বুক ক্লাবের মে মাসের সভায়, ভাই আবার তোরা কিপটে হ বইটি রিভিউ করেন। ভাইয়ার বুক রিভিউ সত্যি অসাধারণ ছিল। যে বইটা ভাইয়া রিভিউ করতেন সেই বইটা পড়ার প্রতি নেশা ধরে যেত। খুলনা কিআ বুক ক্লাবের এক বছর পূর্তি উৎসবে একসঙ্গে কাজ করা, হাসি-তামাশা মজা সবই এখন স্মৃতি। আমাকে ভাইয়া পিচ্চি পৃথাপু বলে ডাকতেন। আমি তাঁর কাছে প্রেরণা পাই অ্যাম্বিগ্রাম করার। প্রথমবার তাঁর কাছে সাহায্য চাই। সব সময় ভাইয়া হাসি মুখ নিয়ে থাকতেন। জীবনটাকে নতুনভাবে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন ভাইয়া। ভাইয়াকে খুব জ্বালাতন করতাম। ভাইয়া এটা দেখিয়ে দেন, পারি না। ভাই, আপনি আজ আমাদের বোঝালেন, মানুষ বাঁচে তার কর্মের মাধ্যমে, বয়সের মাধ্যমে নয়। ভাইয়া আমার জন্মদিনের চকলেটটা তো আপনাকে আর দেওয়া হলো না। ছবি তোলা হলো না। ইচ্ছে ছিল পত্রিকায় আপনার সাফল্যের ছবি দেখিয়ে বলব, দেখো, এই যে আমাদের হৃদু ভাই। ভাইয়া অনেক কিছু শিখেছিলাম আপনার কাছে। আরও যে বাকি ছিল! আমাদের এবারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উৎসবে একসঙ্গে কাজও করা হলো না। পিচ্চি বলে আর কেউ ডাকবে না। ওপারে ভালো থেকো ভাইয়া!

রওনক জাহান

সদস্য, খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব

মিস করব অনেক!  

আমি প্রথম যখন খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাবের সভায় যাই তখন আমার হৃদয় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। ভাই আমাকে ক্লাবের সদস্য হতে সাহায্য করেছিল, ভাইয়ের সদ্ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এরপর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হতো কিন্তু এখন আর দেখতে পাব না ভাইয়ের সেই সুন্দর হাসিটা!

মো. তরিকুল ইসলাম

সদস্য, খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব

আমাদের হৃদয় ভাইয়া

আর হয়তো কোনো দিন জ্বালানো হবে না হৃদয় ভাইয়াকে। বলা হবে না ‘ভাইয়া, এখন কোন বইটা পড়ব’। বইটা পড়া শেষ করলে ভাইয়াও বলবে না ‘কী জেবা, কেমন লাগল?’ আমার এখনো মনে আছে প্রথম যখন খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাবের সভায় গেলাম তখন ভাইয়াটা আমাকে চকলেট দিয়েছিল। এরপর একদিন হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বই পড়ার ইচ্ছা হলো, সবাই বলল, আরে, আমাদের হৃদয়ের কাছে জিজ্ঞেস করো। ও ভালো বলতে পারবে। সেই থেকেই শুরু। এপ্রিল মাসের সভায় গিয়ে শুনলাম হৃদয় ভাইয়া হাসপাতালে ভর্তি। সভা শেষে বাসায় এলাম। আরেক ভাইয়া বলল, জেবা, হৃদয় আমাদের মধ্যে আর নেই। আমি যখন মেসেজটা পড়লাম, আমার হাতটা কাঁপছিল আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে যাচ্ছিল। যে মানুষটার সঙ্গে রাত ১১.৩২ মিনিটেও কথা হলো, আজ আর সে আমাদের মধ্যে নেই। এটা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আর কাউকে হয়তো বলা হবে না আমাদের এক ভাইয়া আছে যে হুমায়ূন আহমেদের অনেক বড় ভক্ত৷ ভালো থেকো ভাইয়া। যেখানেই থাকো না কেন আমাদের সবার হৃদয়ে একটা ছিদ্র করে দিয়ে চলে গেলে তুমি। তোমার আর আমার আর সেই ফিচলে মার্কা হাসিটা দেওয়া হবে না একসঙ্গে। তবে সারা জীবন মনে রাখব, হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে ছিল সেই অনন্য প্রতিভাবান এক ভাইয়া। আমাদের হৃদয় ভাইয়া।

ফাতেহা বিনতে ওলি

সদস্য, খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব

তরুণ বিতার্কিক হৃদয়

মাহমুদুল হাসান। সদা হাস্য, তরুণ বিতার্কিক, দক্ষ সংগঠক এবং শুধু সৃজনশীল ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী মানুষের পরও তাঁর একটি পরিচয় ছিল। তা হলো ভাই! দেখা হলে বুকে জড়িয়ে নেওয়াটা ছিল তাঁর এক অভ্যাস। সেদিনের কথাটা খুব মনে পড়ে। খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাবের ১৯তম সভায় চেয়ার আনতে গিয়েছিলাম। এক রিকশায় ২ জন আর সঙ্গে ৪০টি চেয়ার। ভাবা যায়? কিন্তু ভাইয়া এক নিমেষে মুঠোফোনটা বের করে কয়েকটা সেলফি নিলেন। সেই অমায়িক হাসি। বলেছিলেন পোস্ট করবেন। তবে তা পোস্ট করা হয়নি। ভাইয়ার প্রিয় দল আর্জেন্টিনার খেলা ছিল সেদিন। সেবারের সভায় আমি ভাইয়ের জার্সিটা পরি। সেই ছবিও আছে কিআ তে। এক পাশে আমি অন্য পাশে ভাইয়া। দিনটা মন খারাপের ছিল। ভাইয়ার এক কথায় মনটা ভালো হয়ে যায়। ‘মন খারাপ হলে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়বা, দেখবা মনটা ভালো হয়ে যাবে। প্রতিউত্তরে বলেছিলাম, একটু হাসেন, তাহলেই আমার মন ভালো হবে। ভাইয়া বলেন, তোমার হাসি আরও জোস। আর কেউ এভাবে মন ভালো করাবে না। বিশ্বকাপ আবার আসবে, তবে জার্সিটা নিজের কিনতে হবে। বিতর্কে কেউ আর সাহায্য করবে না। দিন শেষে বলতে হয়, হয়তো আবার দেখা হবে, চেনা কোনো গানের সুরে, হুমায়ূনের কোনো উপন্যাসে, হয়তো কারও বাঁকা হাসিতে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে!

আহসান হাবিব

বিভাগীয় সমন্বয়ক, খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব  

স্মৃতিগুলো থেকে যাবে মনের অন্তরালে

ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় খুলনা পাবলিক কলেজের মাঠে। তারপর থেকে প্রায়ই আমার সঙ্গে কলেজে আসার সময় দেখা হতো কিংবা কলেজের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আমি ওকে বেশির ভাগ সময় বলতাম, ‘দোস্ত, তুই খুব সুন্দর বিতর্ক করিস।’ আমাকে একটু নিবি তোর সঙ্গে। ও আমাকে বলত, ‘তুই তো আছিস আমার সঙ্গে, তোকে দিয়ে আসলেই হবে, তুই ভয় পাস না দোস্ত।’ আমার সঙ্গে ওর সব থেকে বেশি কথা হতো হুমায়ূন এর বই পড়া নিয়ে। আমাকে বই পড়া নিয়ে ও অনেক সাহায্য করত। আমাকে সব সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর সঙ্গে থাকতে বলত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হয়েছিলাম ওর হাত ধরেই। ওর আর আমার ওই জায়গা থেকেই হুমায়ূন–এর বই বেশি পড়া হতো। ওর হাত ধরেই আমি অনেকগুলো ক্লাব ও অনেকগুলো প্রতিযোগিতায় গিয়েছি। আমার ‘খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব’–এ প্রবেশ ওর মাধ্যমে। আমার মনে পড়ে প্রথম দিনের কথা, যেদিন আমি প্রথমে ক্লাবে ঢুকে ওর পাশে বসি ও তখন হুমায়ূন আহমেদের ১৯৭১ বইটা পড়ছে, আমি ওকে বললাম, দোস্ত কী পড়িস? ও বলল, ১৯৭১ বইটা রিভিউ করতে হবে। আমাকে বলল, ‘তুই বইটা পড়ে রিভিউ কর, তোরও তো হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে।’ আমি রাজি হইনি। ও হাসল আর আমাকে বলেছিল তুই ভয় পাইস। ওর সঙ্গে আমার দাবা খেলা নিয়ে অনেক কথা হতো। যেন প্রতিযোগিতায় ওকে নিয়ে যাই সে কথা বলত। আজ সবকিছুই স্মৃতি! স্মৃতিগুলো থেকে যাবে আমার মনের অন্তরালে। শুধু এই কথাই বলব, ভালো থাকিস ওপারে।

আল মুকিত অন্তর

সদস্য, খুলনা কিআ বুক ক্লাব

সেদিনের রিভিউয়ের মধ্যে কী একটা জাদু ছিল

একদিন ঐশী আমাকে ফোনে বলল, ‘জানিস নিসা, খুলনায়ও কিআ বুক ক্লাব খুলেছে। চল, আমরা যাই।’ আমি বললাম, ‘চল যাই।’ ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ আমরা প্রথম খুলনা কিআ বুক ক্লাবে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে সবাই আমাদের থেকে ছোট। তখন থেকেই রিয়াসাত, হাবিব, ওয়াসিউল সবার সঙ্গে পরিচয়। ওদের মধ্যে একটা ছেলে বুক রিভিউ করত। চিকন, লম্বা, হাসিখুশি একটা ছেলে। নাম হৃদয়। হ্যাঁ, সেই হৃদয় যে গত ১৯ এপ্রিল আমাদের সবাইকে রেখে চলে গেছে। আমার এখনও মনে পড়ে কোনো এক সভায় হৃদয় ‘টাইমমেশিন’ বইটার রিভিউ করেছিল। সেদিনের রিভিউয়ের মধ্যে কী একটা জাদু ছিল। সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম। আমার কাছে ওই বুক রিভিউটা হৃদয়ের সব থেকে সুন্দর বুক রিভিউ ছিল। সেই হৃদয়কে সৃষ্টিকর্তা এভাবে নিয়ে গেলেন? আচ্ছা, এখন আমাদের সভায় হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বইগুলোর রিভিউ কে করবে? বইয়ের কলি খেলার সময় যখন কেউ হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বইয়ের নাম বলবে, আমরা কার কাছে শুনব যে এই নামে সত্যি কোনো বই আছে কি না? হৃদয়, হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অনেক বড় ভক্ত ছিল। স্যারের মৃত্যুর তারিখ ১৯, কাকতালীয়ভাবে হৃদয়ও আমাদের ছেড়ে ১৯ তারিখই চলে গেল।

তাবাসসুম তাহিরা

সদস্য, খুলনা কিআ বুক ক্লাব

হুমায়ূন আহমেদের প্রতি তার ভীষণ ভালোলাগা আর ভালোবাসা

৮ জুন, ২০১৬। আমার তৃতীয় কিআ সভা। গরমে বসে, হঠাৎ ফিনিফিনে শরীরের একটা ছেলে তাম্বি হাউসে ঢুকল। হাস্যোজ্জ্বল একটা ছেলে, প্রথম দেখা এটাই। সভার মাঝে হাবিব বলল, আজ একজন বই রিভিউ করবে, সে মাহমুদুল হাসান হৃদয়। ওমা! দেখি ফিনফিনে শরীরের এই ছেলেটাই হৃদয়, হুমায়ুন আহমেদের বই এর কি চমৎকার রিভিউ। আগ্রহ নিয়ে কথা বলা। বেশ সাধারণভাবে পরিচয় এই অসাধারণ মানুষটার সঙ্গে। একের পর এক দারুণ রিভিউ দিয়ে সভায় সবার মন জয় করে। জানতে বাকি ছিল না হুমায়ুন আহমেদের প্রতি তার ভীষণ ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা। তার এই ভালোলাগার সঙ্গে আমার মিল ছিল বলেই আমাদের অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়। বড় হওয়ায় অনেক শ্রদ্ধা করত। কত গল্প শুধু হুমায়ুন আহমেদ ও তাঁর বই নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের মারা যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে ওর গলা ধরে যাচ্ছিল, বলছিল ‘আপু জানেন, উনি যেদিন মারা যায়, আমি খুব কাঁদছিলাম।’ ওর এই কথাটাই খুব মনে পড়ছে। আজ হৃদয়ও নেই। ওর জন্যও আজ সবাই খুব কাঁদবে। ১৯ এপ্রিল আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যায় ও। অবাক হই হুমায়ুন আহমেদও ১৯ জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে যান! কাকতালীয় ব্যাপার! দোয়া করি ও নতুন জগতে অনেক ভালো থাকুক। হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে অবশেষে ওর থাকা হবে, তিনিও হয়তো খুশি হবেন এমন অসাধারণ ছেলেকে তাঁর জগতে পেয়ে। মনে হয় সভায় গেলে হয়তো ও রিভিউ দিতে আসবে আর আমি অবাক হয়ে শুনব। আর প্রতিবারের মতো বলব ‘ঔ মি. হিমু সাহেব এবার তো বইটা দাও আর কত অপেক্ষা করাবা? ও হাসতে হাসতে মাথায় হাত দিয়ে বলবে, ‘হায় হায় আজকেও আনতে ভুলে গেছি আপু, পরের সভায় পাক্বা’, কপট রাগ হয়ে আমি বলব, আজকেও?

আনিকা আনান

সদস্য , খুলনা কিআ  বুক ক্লাব

একটা ছেলে এটুক বয়সে এত কিছু সুন্দরভাবে করে কীভাবে!

২০১৭ সালের মার্চ মাসের কথা। কিআ সভা থেকে বের হয়েছি! এক ভাইয়া হাত বাড়িয়ে বলল ‘তোমার নাম তৃপ্ত না?’ আমি হৃদয়। মাহমুদুল হৃদয়। হৃদয় ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হলো! ভাইয়ার সম্পর্কে যত জানছিলাম তত আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম! ভাইয়া দেশের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অন্ধ ভক্ত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গভীরভাবে জানতেন, প্রচুর বই পড়তেন, তুখোড় বিতার্কিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, মেসি–ভক্ত ছিলেন, তার বুক রিভিউগুলো আমরা অবাক হয়ে শুনতাম! তার মতো হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত আমি খুব কমই দেখেছি! হ্যাঁ, অনেকেই বলতে পারেন, এমন অলরাউন্ডার তো  আমাদের মধ্যেও আছে! কিন্তু না! আমি হলফ করে বলতে পারি ভাইয়ার মতো সব সময় হাসিখুশি আর শান্তিপ্রিয় মানুষ পাওয়া খুবই দুষ্কর! দেখা হলেই হাসিমুখে জড়িয়ে ধরতেন ভাইয়া! অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করত যে একটা ছেলে এটুক বয়সে এত কিছু সুন্দরভাবে করে কীভাবে! ভাইয়ার সঙ্গে শেষ কথা যখন হয়েছিল ভাইয়া তখন বলেছিলেন, তোমাকে নিয়ে একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখছি।’ কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! শুক্রবার শুনি আমাদের হৃদ ভাই আর আমাদের মাঝে নেই! শেষ কবে এত কষ্ট পেয়েছি মনে নেই! তাকে পছন্দ করত না এমন কোনো মানুষ আমি দেখিনি! ভাইয়াকে যারা সেভাবে চিনত না তারাও সেদিন কেঁদেছে! ভাইয়াকে আমরা অসম্ভব ভালোবাসতাম, এখনো বাসি! হৃদয় ভাই থেকে যাবেন আমাদের হৃদয়ে, সারা জীবন হাসিমুখের প্রতিচ্ছবি হয়ে! ভালো থাকো হৃদয় ভাইয়া!

বেঁচে থাকো শত হাসি মুখের মধ্যে, থেকে যাও শত মানুষের হৃদয়ে!

মুস্তাভি মনসুর

সদস্য, খুলনা কিআ বুক ক্লাব

তিনি খালি পায়ে হেঁটেও ফিরতে পারতেন!

কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। হৃদয় ভাইয়া এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে সেটা কখনো ভাবতে পারিনি। তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সব সময় আস্তে আস্তে কথা বলতেন। তাঁর কথা শোনার জন্য বারবার বলা লাগত, ‘আরেকবার বলেন, শুনতে পাইনি।’ ভাইয়া হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন। আমিও হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা অনেক বই পড়ি। তাই যখন আমাদের দেখা হতো তখন আমাদের দুজনের কথা বলার অন্যতম প্রধান প্রসঙ্গ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ স্যার ও তাঁর লেখা বইগুলো। কে স্যারের লেখা কোন বইটা পড়েছি, কোন বইটা কেমন ইত্যাদি। ভাইয়া আমাকে বেশ কিছু বই পড়ার পরামর্শও দিতেন। তিনি আমাকে সর্বশেষ যে বইটি পড়তে বলেছিলেন সেটি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা মাতাল হাওয়া এবং বলেছিলেন, ‘তুমি এই বইটা পড়। বইটা অনেক সুন্দর।’ আমি পড়ে পুরো শক খেয়েছি। এক রাত ঘুম হয়নি। আর দুঃখের কথা হচ্ছে ভাইয়া বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মারা গেলেন। আমি প্রতিটি বই পড়ে শেষ করার পর ভাইয়াকে বলি, কিন্তু এই বইটি পড়ার পর ভাইয়ার সঙ্গে আমার আর দেখা হলো না। ভাইয়া মারা যাওয়ার পর আমরা যখন ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম তখনো আমার কাছে মাতাল হাওয়া বইটি ছিল। বইটি রয়ে গেল কিন্তু ভাইয়া আর থাকলেন না।

খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাবের ফেব্রুয়ারি মাসের সভায় কাজের অংশ হিসেবে ভাইয়া একজন লেখকের রিভিউ করতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কথা বলা শুরু করে দিয়েছিলেন। হৃদয় ভাইয়াকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কথা আসবেই। কারণ, ভাইয়ার জীবনে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের প্রভাব খুব বেশিই ছিল। হৃদয় ভাইয়া হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা চরিত্র ‘হিমু’ কে খুব অনুসরণ করতেন। পাঞ্জাবি পড়তেন, শাল গায়ে দিতেন, খালি পায়ে হাঁটতেন। কিন্তু তিনি মারা গেলেন একটা জুতা তুলতে গিয়ে। তিনি তো খালি পায়ে হাঁটতেন, তাহলে সেদিন জুমার নামাজ শেষে যখন জুতা পাচ্ছিলেন না তখন তো তিনি খালি পায়ে হেঁটেও ফিরতে পারতেন।

কাকতালীয় ব্যাপার হলো, হুমায়ূন আহমেদ স্যার মারা গেলেন জুলাই মাসের ১৯ তারিখ এবং হৃদয় ভাইয়া মারা গেলেন এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ। অনেক আকাঙ্ক্ষা, অনেক স্বপ্ন ফেলে হৃদয় ভাইয়া আজ পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাআলা যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।

লুবাবা মাহজাবীন

শিক্ষানবিশ সমন্বয়ক, খুলনা কিআ বুক ক্লাব

বর্ষা আর শীত ওর প্রিয় ঋতু

প্রিয় মানুষগুলো হয়তো পৃথিবীতে বেশি দিন বেঁচে থাকে না। হৃদ, বয়সে আমার বড়। কিন্তু ও ছিল আমার সবচেয়ে ভালো একজন বন্ধু। ২০১৯ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ হৃদের সঙ্গে প্রথমবার কথা বলি। ও মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারত। তাই তো অল্প দিনের পরিচয়েই আমরা হয়ে উঠেছিলাম ভালো বন্ধু। আমার বই পড়তে ভালো লাগত। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বই তেমন একটা পড়া হতো না। ওর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই আমিও হয়ে উঠি হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত। ও প্রায়ই ওর বইগুলো অন্যদের পড়তে দিত। ও বলতো, কাউকে বই পড়তে দেখলে ওর খুব বেশি ভালো লাগে। কোন বইয়ের পর কোন বইটা পড়ব, কোন লেখকের কোন বইটা সুন্দর, সবকিছু নিয়েই আমাদের কথা হতো। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষই আছে যারা হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। কিন্তু তাঁকে মনের মাঝে ধারণ করে এমন মানুষ খুব কম। হৃদ, হুমায়ূন আহমেদকে মনেপ্রাণে ধারণ করত।

হৃদ ছিল একজন অসাধারণ মেধাবী বিতার্কিক। যেকোনো বিষয়ে ওর থাকত নিজস্ব মতামত, চিন্তাভাবনা আর যুক্তি। কখনো মন খারাপ থাকলে মন ভালো করার উপায় শিখিয়ে দিত। ও সব সময় আমাকে বলত, প্রতিযোগিতা নিয়ে বেশি সিরিয়াস হবা না। উপভোগ করবা সবকিছু। সবকিছুতেই আনন্দ আছে। হৃদ অ্যাম্বিগ্রাম আঁকতে পারত, দারুণ দারুণ গল্প আর কবিতা লিখত। প্রায়ই গল্প লিখে বলত, দেখো তো, কেমন হয়েছে? হৃদ বলেছিল, বর্ষা আর শীত ওর প্রিয় ঋতু। ও জোছনা দেখতে ভালোবাসত। কারও মৃত্যু আমাকে এভাবে কাঁদায়নি। কারও চলে যাওয়া আমাকে এতটা কষ্ট দেয়নি। কেন চলে গেছ, হৃদ? তুমি কখনো হারিয়ে যাবে না। তোমার কাজের মাঝেই তুমি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। কিন্তু তবুও পৃথিবীতে ফিনিক ফোঁটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অপূর্ব সংগীত শোনার জন্য তুমি নেই? সত্যি? কোনো মানে হয়?     

খাদিজা আক্তার সায়মা

শিক্ষানবিশ সমন্বয়ক, সিলেট কিআ বুক ক্লাব

দুজনেই হাঁটতে অনেক পছন্দ করতাম

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের বুক ক্লাবের সভায় নতুন এক সদস্যর কাছে জানতে চাওয়া হলো তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? ছেলেটা বলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই! আমার ইচ্ছের সঙ্গে মিল থাকায় কথা বলতে গেলাম তার সঙ্গে। গায়ে পাঞ্জাবির ওপর চাদর। হাসি মুখে বেশ সাবলীলভাবেই কথা বলল। বয়সে ১ বছর বড় হলেও খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে যাই। সে হয়ে যায় আমার ‘হৃদা’। দুজনেই হাঁটতে অনেক পছন্দ করতাম। তাই খুলনার অলিগলি সব ছিল আমাদের নখদর্পণে। একটু পর থেমে থেমে চা খাওয়া ছিল নিয়মিত কাজ। সব সময় মুখে একটা হাসি লেগে থাকত ওর। আমার মঞ্চভীতি ছিল। ভাই আমাকে শিখাত কীভাবে মঞ্চে কথা বলতে হয়। হুমায়ূন আহমেদকে তার মতো করে কেউ ব্যাখ্যা করতে পারত না। তার খুব ইচ্ছে ছিল হুমায়ূন আহমেদের বই পড়বে । আর ১০-১২টা বই পড়লেই সব শেষ হয়ে যেত। তার খুব আফসোস ছিল হুমায়ূন আহমেদকে কেন সামনাসামনি দেখতে পারল না। কেন সে এত দ্রুত মারা গেল। হয়তো ভাই আর দেখার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিল না। তাই আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেল হুমায়ূন আহমেদের কাছে।

রাশেদ শেখ

কার্যনির্বাহী সমন্বয়ক, খুলনা কিশোর আলো বুক ক্লাব

ভালো থেকো হৃদয় ভাইয়া!

ভাইয়ের সঙ্গে আলাপের প্রথম কথা এখনো মনে আছে,

- আপনার হুমায়ূন আহমেদকে এত পছন্দ কেন?

- তিনি পছন্দ করার মতোই মানুষ তাই পছন্দ করি।

তারপর থেকে প্রায় নিয়মিতই তার সঙ্গে কথা হতো। কখনো বই নিয়ে আলোচনা, কখনো বা ক্যারিয়ার নিয়ে কথাবার্তা। ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের ছিল না, দু-তিন মাস হবে। কিন্তু তার মিশুক স্বভাবের জন্য তাকে অনেক কাছের পরিচিত কেউ মনে হতো। তার হঠাৎ চলে যাওয়া অন্য সবার মতো আমার কাছেও অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়েছিল। ভালো থেকো হৃদয় ভাইয়া!

রাফসান ফারদিন

সদস্য, খুলনা কিআ বুক ক্লাব