একটুখানি পাশ দিয়ে

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা,

ভালো আছ তো তোমরা?

(জি, স্যার!)

তোমাদের জন্য কেন আমরা বইপড়ার আয়োজন করে থাকি সে কথাটাই প্রথমে বলে নিই। তোমরা স্কুল-কলেজে পাঠ্যবই তো পড়ো! শুধু পড়ো না, এতই পড়ো যে তোমরা আসলে তোমরা না তোমাদের পাঠ্যপুস্তক, সেটাই খুঁজে বের করা কঠিন হয়। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় হোজ্জার সেই কথাটার কাছাকাছি: তোমরা যদি তোমরা হও, তো পাঠ্যপুস্তক কোথায় আর তোমরা যদি পাঠ্যপুস্তক হও, তো তোমরা কোথায়? এখন বলো, পাঠ্যবই পড়া ভালো না খারাপ?

(ছাত্রছাত্রীরা: ভালো।)

ঠিক বলেছ। জীবনে দাঁড়াতে হলে, আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে পাঠ্যবই পড়তেই হবে। ‘লেখাপড়া করে যেই/ গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’। গাড়িঘোড়া চড়তে হলে পাঠ্যবই লাগবেই। কিন্তু অসুবিধাটা বাধিয়ে দেয় আমাদের পরীক্ষাব্যবস্থা। একদিকে পাঠ্যবইগুলো আদৌ আনন্দদায়ক নয়, তার ওপর তোমাদের ওগুলো পড়ানো হয় অমানুষিক কষ্ট দিয়ে। কল্পনা বা স্বপ্ন-আনন্দহীনভাবে দিনরাত ঘ্যানর ঘ্যানর শব্দে নোট মুখস্থ করে তোমাদের তরুণ বয়সটাই বিনষ্ট আর অন্ধকার হয়ে যায়।

পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ততই ধরা পড়তে থাকে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে তোমাদের প্রণয় কত গভীর। সারা দিন টেবিলে বসে শুধু ন্যা-ন্যা-ন্যা...ন্যা-ন্যা-ন্যা—ন্যা-ন্যা-ন্যা করতে থাকো। এই আওয়াজ যত বাড়ে, ততই খাওয়া কমে আসে, স্বাস্থ্য অ্যায়সা খারাপ হয় যে মুখ শুকিয়ে থুতনি লম্বা হয়ে যায়। পড়তে পড়তে চোখ গর্তে বসে যায়। বসতে বসতে এমন হয় যে সামনের দিক থেকে অদৃশ্য হয়ে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের হতে চেষ্টা করে। পরীক্ষা যত কাছে আসতে থাকে, ততই ঈশ্বরপ্রেম বাড়ে, দিনরাত নামাজ আর সেজদায় পৃথিবী ধুন্দুমার হয়ে যায়। এমনই ন্যা-ন্যা—ন্যা-ন্যা-ন্যা করতে থাকো যে থুতনি থেকে থেকেই টেবিলের সঙ্গে চটাস করে বাড়ি খায় আর নিজের আর্তনাদ আর কাতরানিতে নিজেই কাতরাও। স্বাস্থ্যের লাবণ্য শুকিয়ে ওঠে, দরকারের ওই জাঁতাকল তোমার সমস্ত আনন্দ নিংড়ে নেয়।

এসবই কিন্তু হয় মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাব্যবস্থার জন্য। এই পরীক্ষা জিনিসটা আমাদের জীবনকে এত কষ্ট দেয়, এত নির্যাতন করে যে একেক সময় কেবল পাঠ্য নয়, পাঠ্য-অপাঠ্য সব বইয়ের ওপরেই আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি; বইয়ের ব্যাপারে আমাদের ভালোবাসা চলে যায়। বই দেখলে আঁতকে উঠি। বই থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে চেষ্টা করি। আগেই বলেছি, এটা বইয়ের দোষ নয়, দোষ ওই খারাপ শিক্ষাব্যবস্থার, পরীক্ষাব্যবস্থার। যাহোক, ব্যাপারটা এত নিষ্ঠুর আর কুিসত যে বই জিনিসটা ছেলেবেলা থেকেই আমাদের কাছে একটা বিভীষিকা হয়ে যায়। এই দুর্বিষহ কষ্টের স্মৃতিটাকে সারা জীবন আমরা আর তাড়াতে পারি না।

অনেক দিন আগের কথা। একটা জরুরি কাজ থাকায় আমার এক বন্ধুর বিয়েতে সময়মতো যেতে পারিনি। বিয়ের কয়েক দিন পর এক প্যাকেট বই উপহার নিয়ে গেছি ওর বাসায়। প্যাকেট দেখে তো ওর চোখমুখ উদ্ভাসিত। কী যেন এনেছে আমার জন্য! বলল, দেখি দেখি কী এনেছিস। কিন্তু এরপরেই দেখলাম, যতই প্যাকেট খুলছে, ততই ওর মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে উঠছে। ভাবলাম, উপহার দেখে তো ওর খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু এ রকম হচ্ছে কেন? তখন বুঝলাম, বইগুলোই হয়তো এর কারণ। ওগুলো দেখে হয়তো ওর ছাত্রজীবনের দুঃসহ কষ্টের কথা মনে পড়েছে। হয়তো ভেবেছে ওগুলো আবার কেন? আবার পরীক্ষা দিতে হবে নাকি।

তোমাদের ইশকুলগুলোর মতো আমাদের কেন্দ্রও কিন্তু একটা ইশকুল।

ওই ইশকুলগুলোর মতো আমরাও ছাত্রদের অনেক বই পড়তে দিই। কিন্তু এই বই কষ্ট আর নির্যাতনের বই নয়, খুশি আর স্বপ্নের বই। তাই আমাদের ইশকুল আনন্দের ইশকুল, আলোর ইশকুল।

কেন পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আমরা এসব সুন্দর বই তোমাদের পড়তে দিই এবার তা বলছি।

ধরো, তোমাকে কেউ তার বাড়িতে নুনভাত খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে।

বলেছে বটে নুনভাতের দাওয়াত কিন্তু আসলে সেটা কী তুমি তো জানো!

(একজন ছাত্রী: স্যার, পোলাও-কোরমা খাওয়ার দাওয়াত।)

এই তো শুনেই বুঝে ফেলেছ। এ রকম দাওয়াত পাও বুঝি মাঝেমধ্যে। তো ধরো, তুমি আশায় আশায় দাওয়াতে গিয়েছ। মনে আশা, এক এক করে আসতে থাকবে পোলাও-কোরমা, কালিয়া, কোফতা আর তুমি সাধ মিটিয়ে খেয়ে যাবে। আসতেও শুরু হলো খাবার। প্রথমে এল পোলাও, খিদেয় তখন পেট চোঁ চোঁ করছে। দেরি না করে লোভীর মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে। মনে ভাবনা: এরপর আসবে রোস্ট, আসবে টিকিয়া, আসবে কোরমা, রেজালা, আচার, চাটনি, ফিরনি, দই—কত কী।

কিছুক্ষণ পর আবার এল। কিন্তু এ কী! এবারও যে সেই পোলাওই। তুমি বিরক্ত: শুধু শুধু পোলাও খাওয়া যায় নাকি এত। অন্য সব জিনিস কই? সত্যি, এরপর আবারও খাবার এল। কিন্তু না, এবারও অন্য কিছু নয়। সেই পোলাওই! তুমি খেপে উঠলে: ‘কী পেয়েছেন সাহেব আপনারা। শুধু ফিরে ফিরে পোলাও? এভাবে শুধু পোলাও খাওয়া যায় নাকি?’

তোমার কথা ঠিক। পোলাও কোনো খারাপ খাবার নয়। যথেষ্ট মজা ওতে। পোলাও না হলে ভোজও হয় না, কিন্তু শুধু পোলাও দিয়েও ভোজ হয় না। পোলাওয়ের সঙ্গে লাগে টিকিয়া, লাগে রোস্ট, লাগে রেজালা, লাগে চাটনি, আচার, দই, ফিরনি—কত কিছু। সবকিছু পুরোপুরি থাকলে তবেই না সত্যিকারের খাওয়া।

হ্যাঁ, পাঠ্যবই আমাদের দরকার। খুবই দরকার। কিন্তু শুধু পাঠ্যবই দিয়ে কি পরিপূর্ণ সুন্দর আর বিকশিত জীবন পাওয়া সম্ভব? তার সঙ্গে যদি এসব সুন্দর স্বপ্নেভরা বই না থাকে—গান, নাটক, চিত্রকলা, নৃত্যকলা, দেশভ্রমণ; অনবদ্য জ্ঞানের জগত্ না থাকে; হাজারো রকমের মজার জিনিস না থাকে—তবে পাঠ্যবইয়ের ডোজ বেশি হয়ে তা ওই পোলাওয়ের মতো হয়ে যাবে যে!

এসো আরও খুলে বলি, কেন আমরা তোমাদের এসব বই পড়ার জন্য ডেকে এনেছি, এসব অর্থহীন ‘আউট বই’।

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। গল্পটা একটু জটিল কিন্তু বুঝলে মজা পাবে।

গল্পটা এ রকম:

এক ছেলে বলছে, ‘আমার আব্বা এত জোরে নাক ডাকেন যে নিজের নাক ডাকার শব্দে নিজেই সারা রাত ঘুমোতে পারেন না।’ (সবার হাসি)

এবার বলো তো, ঘুমের মধ্যে নিজের নাক ডাকার শব্দে নিজে ঘুমোতে পারে না, এমন কেউ কি আছে? (কয়েকজন ছাত্র: না।)

সত্যি থাকা সম্ভব নয়। কারণ নাক ডাকা ব্যাপারটাই এমন যে কেউ যখন নাক ডাকে, তখন দুনিয়ার আর সবাই তা শোনে, কেবল নিজে ছাড়া। কোনো নাক ডাকা লোককে তুমি একবার বলে দেখো, ‘ঘুমের মধ্যে আপনি তো খুব নাক ডাকেন সাহেব।’ দেখো কীভাবে সে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘কে বলে আমি নাক ডাকি? ইয়ার্কির জায়গা পান না! নাক ডাকেন আপনি আর নাম দেন আমার!’

থাক, গল্পটায় ফিরে যাই। ছেলেটা বলে চলেছে, তো, না ঘুমাতে ঘুমাতে আব্বার অবস্থা এমন হলো যে তিনি একসময় মৃত্যুর দুয়ারে উপস্থিত হলেন। বহু ডাক্তার বহু রকম চেষ্টা করল। কিছুতেই ভালো হলো না। ঠিক সেই সময় হঠাত্ এক অদ্ভুত ডাক্তারের সঙ্গে আব্বার দেখা। সব শুনে তিনি বললেন, ‘এটা আবার একটা রোগ নাকি? কোনো চিন্তা করবেন না। শুধু একটা কাজ করবেন। রাতে নাক ডাকার শব্দ যখন প্রচণ্ড হয়ে উঠবে, তখন চুপ করে, লুকিয়ে, আস্তে করে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বেন। দেখবেন ঘুম কাকে বলে।’ তাঁর কথামতো আব্বা সেদিন থেকে ও রকমই করতে লাগলেন। অবাক ব্যাপার, ও রকম করতে করতে তিনি একসময় পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেন। রাতে বিছানায় শুয়ে আব্বার নাক ডাকার শব্দ যখন প্রচণ্ড হয়ে উঠত, ঠিক তখনই লুকিয়ে আব্বা পাশের ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়তেন। ফলে পাশের ঘরে তিনি শান্তিতে ঘুমোতেন। আর আগের ঘরে, তার ফেলে-যাওয়া নাকডাকার শব্দটা তখন প্রচণ্ড বিক্রমে গর্জন করে চলত।

জোকটা একটু সূক্ষ্ম। বুঝতে পারছি তোমাদের কারও কারও বুঝতে হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। তবে বোঝো আর না বোঝো, এই জোকটার মধ্যে ওই যে পাশের ঘরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, জীবনের জন্য ওই ‘পাশের ঘরটা’ কিন্তু খুবই জরুরি। কেন, তা বুঝিয়ে বলছি।

জীবনে বড় কিছু করতে চাইলে একসময় না-একসময় ওই পাশের ঘরে আমাদের যেতেই হয়। বলো তো, হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মেছিলেন কোন শহরে?

(কয়েকজন ছাত্র: মক্কায়।)

সেখানে কি তিনি ঠিকমতো ধর্মপ্রচার করতে পেরেছিলেন?

না।

কোথায় পেরেছিলেন?

(একজন ছাত্র: মদিনায়।)

ঠিক বলেছ: একটু পাশের শহরে, তা-ই না?

গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন কোথায়? রাজপ্রাসাদে। কিন্তু রাজপ্রাসাদে কি তিনি তাঁর ধর্মপ্রচার করেছিলেন?

(একজন ছাত্র: না।)

কোথায় করেছিলেন: ‘একটু পাশে’, গ্রামে। তাই না?

(ছাত্ররা: হ্যাঁ)

তুমি যদি ফুটবল খেলায় গোল দিতে চাও—ধরো, বল নিয়ে সবাইকে কাটিয়ে গোলকিপারের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছ, এখন বলটাকে গোলের মধ্যে গড়িয়ে দিতে পারলেই গোল, তখন কোন দিকে বলটাকে মারবে? গোলকিপারের দিকে?

না।

তাহলে কোন দিকে? তাকে কাটিয়ে, ‘একটু পাশ’ দিয়ে, তাই না?

(ছাত্রেরা: হ্যাঁ)

মাঠে ব্যাট করতে নেমেছ, রান করতে চাও। কী করতে হবে? জানো তো, ক্রিকেট মাঠে ১১ জন প্লেয়ার ব্যাটসম্যানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। তো, তুমি যদি রান করতে চাও, তবে বলটাকে কি সেই ১১ জনের কারও দিকে মারবে, নাকি অন্য কোনো দিকে?

(একজন ছাত্র: একটু পাশ দিয়ে।)

এই তো বুঝে ফেলেছ। হ্যাঁ, জীবনে সফল হতে হলে এই ‘একটু পাশে’ আমাদের যেতেই হবে। এবার আমার শেষ প্রশ্নটার উত্তর দাও: পরীক্ষায় পাস করতে হলে, ভালো ফল করতে হলে, কী বই পড়তে হবে আমাদের? (ছাত্রেরা: পাঠ্যবই।)

কিন্তু জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হলে, মনের জানালাগুলোকে খুলতে হলে, জীবনকে আনন্দময় আর বিকশিত করতে হলে কোথায় যেতে হবে?

(ছাত্রেরা: একটু পাশে!)

এই তো ঠিক বলেছ। হ্যাঁ, আমাদের এই বইগুলোর কাছে। কী বই এগুলো? তোমাদের মন আর বয়সের উপযোগী সেরা বই। কাদের লেখা? আমাদের সাহিত্যের, বিশ্বসাহিত্যের বড় বড় লেখকদের। সৌন্দর্যময়, ঐশ্বর্যময়, আলোময় বই এগুলো। এগুলো পড়লে কী হয়? আমরা আমাদের চেয়ে সুন্দর হই, বড় হই, ঐশ্বর্যময় হই। আগেই বলেছি, পাঠ্যবই তো পড়তেই হবে। সেই পড়া আমাদের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু এই বইগুলোর কাছে এসে, ‘একটু পাশে’ যদি আমরা এসব সুন্দর ঐশ্বর্যময় বইগুলো পড়ি, তবে আমরা পরিপূর্ণ হব। আমাদের মানবজন্ম ফুলে-ফলে ভরে উঠবে।

তোমাদের সবাইকে শুভেচ্ছা।

একাদশ শ্রেণির বইপড়া কর্মসূচির উদ্বোধনী বক্তৃতা, ঢাকা: ১৯৯০

অলংকরণ: রাকিব