টেসলা বনাম এডিসন

অবশেষে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো ২৮ বছর বয়সী হাতিটিকে। টপসি নামের এই মেয়েহাতির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তার অপরাধ, বিগত তিন বছরে তিনজন মানুষকে হত্যা করেছে সে। নতুন কোনো দুর্ঘটনার আগেই তাই টপসির মৃত্যু নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লাগল শহর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কীভাবে কার্যকর করা হবে সেটি? অনেক সলাপরামর্শের পর ঠিক হলো, গাজরের সঙ্গে বিষাক্ত সায়ানাইড মিশিয়ে খাইয়ে বিশালদেহী হাতিটিকে মেরে ফেলা হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করা হলো শিগগিরই। কিন্তু ৪৬০ গ্রাম সায়ানাইড মেশানো গাজর গোগ্রাসে গিলেও দিব্যি বহাল তবিয়তে রয়ে গেল টপসি।

এবার আঙুলটা আরও একটু বাঁকা করার সিদ্ধান্ত নিল কনি আইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। তাকে জনসমক্ষে ফাঁসির দড়িতেই ঝোলানো হবে বলে ঠিক হলো। কিন্তু গোল বাধল যখন বেঁকে বসলেন সেখানকার প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ সমিতির সদস্যরা। তাঁরা রীতিমতো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মিছিলও করলেন। তাতে ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই পেল একসময়ের সার্কাসের জনপ্রিয় হাতি টপসি। কিন্তু এখন উপায়? অনেকে বলেন, উপায় বাতলাতে দৃশ্যপটে হাজির হলেন টমাস আলভা এডিসন। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের অন্যতম এই সেরা উদ্ভাবকের নামটি বোধ হয় কারও অজানা নয়।

সে সময় কনি আইল্যান্ডে বেশ বড় আর শক্তিশালী এক বিদ্যুত্ প্ল্যান্ট ছিল। সেখানে এসি বিদ্যুত্ বা অল্টারনেটিং কারেন্ট দিয়ে টপসিকে হত্যার নীলনকশা প্রস্তুত হলো। এর পেছনে এডিসন ছিলেন বলেই দাবি করেন অনেকে। কারণ, একে বিশাল এক সুযোগ হিসেবেই দেখতে পেয়েছিলেন তিনি (এ ঘটনায় পরে আসছি)। প্রস্তাবটি লুফে নিল কর্তৃপক্ষও। টপসির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য হলো ৪ জানুয়ারি, ১৯০৩। তার আগেই ঘটনার প্রচারাভিযান চালানো হলো। তাই সেদিন লোক ভেঙে পড়ল ছোট্ট দ্বীপে। টপসি হত্যায় সহযোগিতা এমনকি সে ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে এডিসন নিজের প্রতিষ্ঠানের লোক পাঠিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন অনেকে। (ভিডিওটি দেখতে এই লিংকে যাও যঃঃঢ়ং://মড়ড়.মষ/৩নুযভশ)।

যাহোক, নির্ধারিত দিনে লোহার শিকল পরিয়ে এক টাওয়ারের কাছে আনা হলো বিশালদেহী হাতিটিকে। তার চার পায়ে লোহার পাত আটকে দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত আছে বিদ্যুতের তার। নির্ধারিত সংকেত পেয়েই বিদ্যুতের সুইচ টিপে দেওয়া হলো। মুহূর্তেই ৬৬০০ ভোল্ট এসি কারেন্ট গ্রাস করল টপসিকে। মাত্র ১০ সেকেন্ড কোনোমতে টিকে প্রায় দেড় হাজার লোকের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল এককালের ভীষণ একগুঁয়ে আর অবাধ্য টপসি।

তবে এ ঘটনার সঙ্গে এডিসনের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলেও দাবি অনেক বিশেষজ্ঞের। এই হাতি হত্যায় এডিসন জড়িত ছিলেন কি না, সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এডিসন যে এর আগে জনসমক্ষে বেশ কয়েকটি কুকুর, বিড়াল, ঘোড়াও মেরেছেন—সেটি নিয়ে কিন্তু কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কেন? আসলে এর পেছনে ছিল এডিসনের যুদ্ধংদেহী ব্যবসায়িক মনোভাব আর তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের ইচ্ছা। তাঁর প্রতিপক্ষ আরেক কিংবদন্তি উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা। তাঁদের দুজনের মধ্যেই তখন চলছিল ভীষণ এক বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ, যা ইতিহাসে বিদ্যুতের লড়াই নামে আলোচিত। খুলেই বলা যাক ঘটনাটা।

টপসির মৃত্যুর প্রায় দুই দশক আগেই শুরু হয়েছিল এই বিদ্যুতের লড়াই। একদিকে টমাস আলভা এডিসন। তিনি ছিলেন ডিসি বা ডাইরেক্ট কারেন্টের পক্ষে। অন্যদিকে জর্জ ওয়েস্টিংহাউস ছিলেন এসি বা অল্টারনেটিং কারেন্টের পক্ষে। আর ওয়েস্টিংহাউসের সহযোগী ছিলেন নিকোলা টেসলা। এডিসন ডিসি জেনারেটর বসিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়িতে বাড়িতে ১১০ ভোল্টের বিদ্যুত্ পৌঁছে দিতেন। কিন্তু সে জন্য ব্যবহূত হতো মোটা তামার তার। তাতে লাইনের খরচ পড়ত অনেক বেশি। আবার বিদ্যুত্ উত্পাদনের জায়গা থেকে ডিসি কারেন্ট এক মাইলের বেশি দূরে সরবরাহ করাও যেত না। তাই জনবহুল এলাকাতেই বিদ্যুতের জেনারেটর বসাতে হতো। সবচেয়ে বড় অসুবিধা, ডিসি কারেন্ট সে সময় কমানো বা বাড়ানো যেত না। তাই একেক যন্ত্রপাতির জন্য একেক ধরনের ভোল্টেজ প্রয়োজন হওয়ায় বিদ্যুতের লাইনও লাগত আলাদা। ফলে কোনো গ্রাহক বাতি জ্বালাতেন এক লাইন দিয়ে আর অন্য কোনো যন্ত্র চালাতেন আরেক লাইন দিয়ে। অন্যদিকে প্রথমত এসির সরবরাহ খরচ কম। আবার ট্রান্সফরমার ব্যবহার করেই এসির ভোল্টেজের মান সহজে বাড়ানো বা কমানো যায়। অর্থাত্, তিন হাজার ৩০০ ভোল্টের বিদ্যুত্ও ট্রান্সফরমার দিয়ে ২২০ ভোল্টে রূপান্তরিত করা যায়। আবার ২২০ ভোল্টকে বানানো যায় ৩ হাজার ৩০০। আবার এতে লাইন লসও কম।

কিন্তু তারপরও তখন পর্যন্ত ডিসিই ছিল সেরা। কারণ কার্যকর কোনো এসি মোটর তখনো বানানো সম্ভব হয়নি। তাই এসির সুফল সত্ত্বেও ডিসির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছিল এসি। ১৮৮৭ সালের দিকে এসির জন্য ইন্ডাকশন মোটর বানাতে সক্ষম হন টেসলা। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর পেটেন্টও পেলেন তিনি। অন্যদিকে ওয়েস্টিংহাউসের ইঞ্জিনিয়ার আলিভার বি শ্যালেনবার্গারও বানিয়ে ফেললেন ইন্ডাকশন মোটর। তাতে বাড়িতে বাড়িতে এসি বিদ্যুত্ সহজে পৌঁছে দেওয়ার বাধা দূর হলো। উন্মোচিত হলো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। এসি নিয়ে জোট বেঁধে মাঠে নামলেন ওয়েস্টিংহাউস আর টেসলা। কিন্তু তা দেখে ভয় পেলেন এডিসন। এসিকে ঠেকাতে তিনিও উঠেপড়ে লাগলেন।

বলে রাখা ভালো, একসময় এডিসনের কোম্পানিতেই কাজ করতেন টেসলা। সে সময় এডিসনকে বারবার এসির গুরুত্ব আর সম্ভাবনা বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে অবজ্ঞা করে ডিসি নিয়েই মেতে থাকলেন এডিসন। একপর্যায়ে দুজনের মতবিরোধ চরমে পৌঁছালে এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে দেন টেসলা। তাই প্রতিপক্ষ শিবিরে টেসলাকে দেখে এডিসন ভয় পাবেন, সেটিই স্বাভাবিক। এসি কারেন্টকে খারাপ প্রমাণ করতেই তিনি কিছু বুদ্ধি আঁটলেন। এর মধ্যে বিভিন্ন জীবজন্তু এসি কারেন্ট দিয়ে হত্যা করতেও দ্বিধা করলেন না তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে কুকুর, বিড়াল বা ঘোড়াকে বিদ্যুতায়িত করে মেরে এসি কারেন্টের ভয়াবহতা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন এডিসন। অনেকের দাবি, টপসি হত্যা ছিল সেই ধারাবাহিকতারই একটি উদাহরণ।

এডিসনবিরোধীদের মতে, তিনি ভেবেছিলেন, টপসির মতো বিশালদেহী হাতিকে এসি কারেন্ট দিয়ে হত্যা করতে পারলে মানুষ এই পদ্ধতিকে ভয় পাবে। মানুষ ভাববে, এসি কারেন্ট এতই ভয়ংকর যে বিশালদেহী হাতিও মারা যায়, আর মানুষ তো কোন ছার। কিন্তু এ ঘটনা পুরোটাই বুমেরাং হয়েছিল তাঁর জন্য। বিশালদেহী হাতিকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখে সেদিন মানুষ আসলে এসিকে শক্তিশালী হিসেবে জেনেছিল। জেনেছিল, এই বিদ্যুত্প্রবাহ দিয়ে অনেক বড় কাজ করা সম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত এ পথেও ব্যর্থ হলেন তিনি। আবার জননিরাপত্তাকে কারণ দেখিয়ে ৮০০ ভোল্টের বেশি বিদ্যুত্ সরবরাহের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করলেন এডিসন। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হলেন। পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নতুন পদ্ধতি হিসেবে এসি কারেন্ট দিয়ে ইলেকট্রিক চেয়ার বানিয়ে দিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, এসির প্রতি জনমনে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। কিন্তু সেখানেও সফলতা পেলেন না তিনি। উল্টো নিজেই বিতর্কের মুখে পড়লেন।

বিদ্যুতায়িত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে টপসির
বিদ্যুতায়িত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে টপসির

এডিসনের প্রতিপক্ষরাও কিন্তু থেমে রইল না। টেসলার ইন্ডাকশন মোটর ও জেনারেটর ব্যবহার করে ১৮৯১ সালে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে এসি বিদ্যুত্ পাঠানো হলো। ৩ হাজার ভোল্ট, ১৩৩ হার্জ, সিঙ্গল ফেজ এসির জন্য সে সময় খরচ হলো ৭০০ মার্কিন ডলার, যা কিনা সে সময়ের ডিসির খরচের মাত্র ১ শতাংশ। আবার ট্রান্সমিশন লসও হলো ডিসির তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ। দুই বছর পর কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্তি পালিত হবে ধুমধামে। অনুষ্ঠানে হাজার হাজার বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হবে। তাই এক টেন্ডার আহ্বান করল মার্কিন সরকার। এবারও প্রতিদ্বন্দ্বী এডিসন আর ওয়েস্টিংহাউসের কোম্পানি। তবে এডিসনের কোম্পানিকে হারিয়ে টেন্ডার পেল ওয়েস্টিংহাউস। ১৮৯৩ সালে শিকাগো শহরে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লেভল্যান্ড বোতাম টিপতেই জ্বলে উঠল হাজারো বাতি। এই সাফল্যের পর নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদনের কাজ পেল ওয়েস্টিংহাউসের কোম্পানি। সেখানে টেসলার ডিজাইনে পলিফেজ জেনারেটর বসানো হলো। ১৮৯৬ সালের শেষের দিকে নায়াগ্রার উত্পাদিত বিদ্যুত্ পৌঁছাল যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরে। তাতেই এডিসনের সাধের ডিসির কফিনে ঠুকে দেওয়া হলো শেষ পেরেক। নিন্দুকেরা বলেন, মরিয়া হয়ে নাকি টপসি নামের হাতিটিকে শেষ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন এডিসন। বলাই বাহুল্য, এডিসন ব্যর্থ। শেষ হলো বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। একে একে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ডিসি থেকে এসির গ্রাহক বাড়তে লাগল। যুদ্ধে হেরে গিয়ে একসময় বাধ্য হয়ে শত্রুপক্ষের এসি মেশিন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন এডিসন। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই এসি কারেন্ট ব্যবহার করা হয়। যেমন আমাদের দেশে বাসাবাড়িতে ২২০ ভোল্টের এসি কারেন্ট ব্যবহূত হয়। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোতে ২২০-২৪০ ভোল্ট আর যুক্তরাষ্ট্রে ১১০ ভোল্ট।

তবে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে বিদ্যুত্ এসি লাইনে সরবরাহ করা হলেও আমাদের দৈনন্দিন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কিন্তু চলে এডিসনের সেই ডিসি কারেন্টে। আসলে সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রেই একটি কনভার্টার থাকে। এখানেই মেইন লাইনের এসি কারেন্ট রূপান্তরিত হয় ডিসিতে। ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, টিভি, ফ্রিজ সব কটাতেই ডিসি বিদ্যুত্ ব্যবহার করা হয়। আবার ডিসিকে উচ্চ বা নিম্ন ভোল্টেজে রূপান্তরের সেই কাঙ্ক্ষিত প্রযুক্তিও এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। বর্তমানে অনেক হিসাব করে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা দেখিয়েছে, বিদ্যুত্ গ্রিড ব্যবস্থা ডিসি হলে খরচ ১০-২০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এ ছাড়া আরও একগুচ্ছ সুবিধা দেখা যাচ্ছে ডিসিতে। তাই ডিসিতে ফিরে যাওয়ার ডাক দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাহলে কি এডিসনই সঠিক আর দূরদর্শী ছিলেন? অচিরেই কি আরেকটি বিদ্যুতের লড়াই বাধতে যাচ্ছে? এবার পক্ষ-প্রতিপক্ষ কারা? বিজয়মুকুট এবার কার ঝুলিতে জমা হবে—সেটাই বা কে জানে!