ভয় কী মরণে

সূর্য সেন

দ্রিম দ্রিম আওয়াজে কেঁপে উঠল পাহাড়। চমকে উঠল দূর গাঁয়ের লোকেরা। ভেবেই পেল না কী থেকে কী হয়ে গেল। ওদিকে পাহাড়ে তখন শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। যুদ্ধটা ইংরেজ সরকারের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের। দলটা ছোট, কিন্তু সাহস তাদের অফুরান। দলের নেতার নাম সূর্য সেন।

ঘটনাটা প্রায় শতবর্ষ আগেকার। ১৯২৩ সালের। চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাটে সেকালে একটা পোড়োবাড়ি ছিল, নাম ‘সুলুক বাহার’। সেই বাড়িতে ছিল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী বিপ্লবীদের গোপন আড্ডা। সেখান থেকেই পরিকল্পনা করা হতো নানান অভিযানের। তেমনি এক পরিকল্পনা ছিল বিপ্লবীদের। অস্ত্র সংগ্রহের খরচ মেটানোর জন্য দিনের বেলায় প্রকাশ্যে রেল কর্মচারীদের বেতনের ১৭ হাজার টাকা লুট করলেন অনন্ত সিংহ, দেবেন দে ও নির্মল সেন। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে সক্রিয় হয়ে উঠল পুলিশ। খুঁজতে খুঁজতে তারা হাজির হলো ‘সুলুক বাহার’ পর্যন্ত। দলনেতা সূর্য সেন বুঝলেন, আর থাকা চলবে না এখানে। সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গন্তব্য দূরের পাহাড়ঘেরা জঙ্গল। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পুলিশের সঙ্গে বেধে গেল যুদ্ধ। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল সবাই। স্বল্প শক্তি দিয়ে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না পুলিশ বাহিনীকে। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী সূর্য সেন ধরা দেবেন না। তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষপান করলেন সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী। তবে বিষে তাঁদের মৃত্যু হলো না। অচেতন অবস্থায় তাঁদের গ্রেপ্তার করল পুলিশ।

কিন্তু আটকে রাখা গেল না তাঁদের। আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় মুক্তি পেলেন তাঁরা। এরপর আবারও যুক্ত হলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। আসলে সূয সেনের রক্তে মিশে গিয়েছিল বিপ্লবের নেশা। এই নেশা তাঁর মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী। এই কলেজ থেকেই সূর্য সেন বিএ পাস করেছিলেন। তার আগে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও নন্দনকাননের ন্যাশনাল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন সূর্য সেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম, ১৮৯৪ সালে। বিএ পাস করার পর অন্য সব চাকরির সুযোগ ছুড়ে ফেলে সূর্য সেন শিক্ষকতার চাকরি নেন উমাতারা বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের কাছে যেমন, তেমনি প্রিয় ছিলেন বিপ্লবীদের কাছেও। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সূর্য সেন তাই সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠলেন মাস্টারদা নামে। ইংরেজদের কাছ থেকে দেশকে স্বাধীন করাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের ব্রত। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের তা ভালোই জানা ছিল। তাই ১৯২৪ সালে সূর্য সেনের চট্টগ্রামের আবাসস্থলে হানা দিল পুলিশ। কোনো রকমে পালিয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন মাস্টারদা। কিন্তু বিপ্লব থামে না কখনো। কলকাতার শোভাবাজারের একটি বাড়িতে লুকিয়ে কাজ চালাতে লাগলেন। সেই বাড়িতেও হানা দিল পুলিশ। চাকরের ছদ্মবেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিলেন মাস্টারদা।

বছরখানেক পর তিনি সত্যি সত্যিই ধরা পড়ে গেলেন, কলকাতায়। ভারতের মুম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে আটক রাখা হলো তাঁকে। এরই মধ্যে মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা। সূর্য সেন মুক্তি পেলেন ১৯২৮ সালের শেষ দিকে। মুক্তির পর তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সাংঘাতিক এক ঘটনা ঘটানোর। তাঁরা ঠিক করলেন, খুবই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামকে মুক্ত ও স্বাধীন করবেন। এই কাজ করার জন্য প্রয়োজনে ইংরেজদের প্রধান কেন্দ্রগুলো দখল করা হবে এবং ইংরেজদের সাহায্যে যেন বাইরের জেলা থেকে কেউ চট্টগ্রামে আসতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে।

চট্টগ্রামে তখন পাহাড়ের ওপরে পুলিশের অস্ত্রাগার। রাইফেল, মেশিনগানসহ অনেক অস্ত্র ছিল সেখানে। বিপ্লবীরা ঠিক করলেন ওই অস্ত্রাগার এবং টেলিফোন, টেলিগ্রাফ অফিস দখল করবেন। হামলা করবেন ইংরেজদের জমায়েতের স্থানে। তাঁরা জানতেন যে চট্টগ্রাম স্বাধীন হলেই পুরো ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে না। কিন্তু জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে এই পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। একটাই উদ্দেশ্য, গোটা ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনকে নাড়া দেওয়া।

১৮ এপ্রিল, ১৯৩০। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত সাড়ে ১০টায় সামরিক পোশাকে বিপ্লবীদের ছোট একটা দল হাজির হলো অস্ত্রাগারে। পাহারাদারেরা ভাবল এঁরা সামরিক বাহিনীর অফিসার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিপ্লবীরা ফাঁকা গুলি ছুড়লেন। ভয় পেয়ে সরে গেল পাহারাদারেরা। ফলে বেশ সহজেই অস্ত্রাগারের দখল নিলেন তাঁরা। ওদিকে সাত বিপ্লবীর আরেকটি দল গিয়ে দখল করল পাহাড়তলীর ফৌজি অস্ত্রাগার। একই সময় ছয় বিপ্লবীর অন্য একটি দল ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দখল করল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস। ইউরোপীয় ক্লাব দখলের পরিকল্পনাও তাঁদের ছিল। কিন্তু সেদিন ধর্মীয় পরব থাকায় ক্লাবে যায়নি ইংরেজরা, ফলে সেটা দখল করতে যাওয়া দল ফিলে এল। সব কর্মযজ্ঞ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারে এসে জড়ো হলেন বিপ্লবীরা। রাতেই অস্ত্রাগার ময়দানে তোলা হলো জাতীয় পতাকা। পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে তিনবার আকাশে ছোড়া হলো গুলি। সম্মান জানানো হলো জাতীয় পতাকাকে। বিদ্রোহের নেতা সূর্য সেন চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার কথা ঘোষণা করে জানালেন যে পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলা হয়েছে। একটি স্বাধীন এবং সামরিক বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করলেন তিনি। স্বাধীন এই সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষিত হলো একটি নাম—সূর্য সেন।

প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার

এই বিরাট ঘটনার খবর কলকাতার ইংরেজদের কানে যায় দ্রুতই। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে নোঙর করা এক জাহাজের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর পায় ইংরেজ শাসকেরা। বিপ্লবীরা ঘাঁটি গাড়লেন চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে। ওদিকে বিপ্লবীদের পরাস্ত করতে বিরাট বাহিনী ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইংরেজরা ২২ এপ্রিল ঘেরাও করল জালালাবাদ পাহাড়। মাস্টারদা সূর্য সেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলো। ইংরেজদের মেশিনগানের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অস্ত্রের অসম লড়াই! কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের কাছে হার মানতে হলো ইংরেজদের। মারা গেল ৮০ জন ইংরেজ সৈন্য। শহীদ হলেন ১২ জন বিপ্লবী। তবু এই যুদ্ধের পর এই পাহাড়ে থাকাকে নিরাপদ বলে ভাবলেন না বিপ্লবীরা। কয়েকটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন তাঁরা। কেউ কেউ কলকাতার দিকে চলে যাওয়ারও চেষ্টা করলেন।

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২।

পাল্টা আঘাত হানার নির্দেশ দেন সূর্য সেন। সাতজন বিপ্লবীর একটি দল হামলা চালায় চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবে। নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। সফল আক্রমণ। ধরাশায়ী হলো ইংরেজরা। কিন্তু বেরিয়ে আসার পথে ইংরেজ সেনাদের সামনে পড়ে গেলেন প্রীতিলতা। অন্য সাথিরা পালাতে পারলেও তিনি পারলেন না। কিন্তু ইংরেজদের কাছে ধরা দেবেন না কিছুতেই। শাসকদের হাতে ধরা পড়ার গ্লানির চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। এই ভেবে বিষপানে আত্মহত্যা করলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা।

ভারতীয় ডাকটিকেটে সূর্য সেন
ভারতীয় ডাকটিকেটে সূর্য সেন

বিপ্লব তবু থামল না। ১৯৩৩ সালের কথা। চট্টগ্রামের পটিয়ার গৈরালা নামের গ্রামে ক্ষীরোদাপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে কয়েকজন সঙ্গীসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন সূর্য সেন। ইংরেজরা তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। সেই টাকার লোভে ক্ষীরোদাপ্রভার এক আত্মীয় বিশ্বাসঘাতকতা করে সূর্য সেনের খবর পৌঁছে দিল ইংরেজদের কাছে। রাতের বেলায় বিরাট সেনাবাহিনী এল। কারফিউ জারি করে ঘেরাও করল সেই বাড়ি। ব্যাপক গোলাগুলি হলো। এবার আর আত্মরক্ষা করতে পারলেন না সূর্য সেন। ধরা পড়ে গেলেন ইংরেজদের হাতে।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি দেওয়া হলো তাঁকে। মৃত্যুর আগেও তিনি চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে সবাই যাতে এগিয়ে আসে। তাঁর আত্মদান বৃথা যায়নি। ইংরেজরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বিদায় নিয়েছে পাকিস্তানিরাও। বাংলাদেশও হয়েছে স্বাধীন।