মৃতদের নগরীতে !

রাশিয়ার উত্তর অসিশার পাহাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক গ্রাম, নাম দারগাভস। রাশিয়ার এদিকটায় বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। তারই এক উপত্যকায় গড়ে উঠেছে গ্রামটা। যাত্রাপথ বেশ দুর্গম। উঁচু–নিচু পাহাড়ি রাস্তা আর বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছাতে হবে। মখমলের মতো সবুজ ঘাস বিছানো পাহাড়টা দূর থেকেই সুন্দর লাগে। তার ওপর মাথা তোলা ছোট ছোট পাথুরে বাড়ির মাথাগুলো দেখতে একদম ছবির মতো। অথচ গ্রামে পৌঁছানোর পর তোমাকে অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই! দূর থেকে দেখা বাড়িঘর সবই ফাঁকা পড়ে আছে। কৌতূহলবশত ভেতরে উঁকি মারতে গেলে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাবে। মরা মানুষের হাড়গোড় আর মাথার খুলি পড়ে আছে বাড়ির যত্রতত্র। এক বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য বাড়িতে যাবে, সেখানেও একই অবস্থা। মৃতরাই যেন এখানের বাসিন্দা! আসলেও তা–ই। এই শহরে কেউই থাকে না। প্রায় এক শর মতো পাথরে তৈরি ভবন আছে, যেগুলোর প্রতিটিতেই মৃত মানুষের অজস্র কঙ্কাল পাওয়া যাবে। অত ঘুরিয়ে না বলি, সোজা কথায় ভবনগুলোই সমাধিসৌধ।


অসিশা রাশিয়ার মধ্যযুগীয় জনপদগুলোর মধ্যে একটি। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬ ও ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে সেখানে প্লেগের সংক্রমণ ঘটে। একের পর এক ঘরবাড়ি উজাড় হতে থাকে। তখনকার দিনে প্লেগ মহামারি হিসেবে ছড়াত। এর কোনো চিকিৎসাও ছিল না। তাই বাসিন্দারা জনপদ উজাড় হওয়া ঠেকাতে তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের দারগাভসে নিয়ে আসত। তাদের প্রয়োজনেই নির্মাণ করা হয় ভবনগুলো। পাথরের দেয়াল আর পিরামিডাকৃতির ছাদ দেওয়া হয় তাতে। আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে দেওয়া হতো খাবারদাবারসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু। রোগে ভুগতে ভুগতে ধীরে ধীরে মৃত্যু টেনে নিত তাদের। খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিল সে মৃত্যু। তারা মারা যাওয়ার পর ভবনগুলোই হতে থাকল সমাধিস্তম্ভ।
কোনো কোনো ভবন একতলাবিশিষ্ট, আবার কোনোটায় ভূগর্ভস্থ তিন-চারতলাও আছে। ধারণা করা হয়, একেকটা ভবন একেকটা পরিবারের সমাধিসৌধ। আর পরিবারের কতগুলো প্রজন্ম সেখানে ছিল, সেটার ওপরতলার হিসাব করা হতো। কিছু ভবন ছিল সাধারণদের জন্য, যাদের পরিবার ছিল না কিংবা আগন্তুক ছিল।


প্রতিটি সমাধি ভবনের সামনে একটা করে কুয়ো আছে। কাছে গেলে দেখা যাবে অজস্র কয়েন পড়ে রয়েছে। এখানে আসা মানুষের মৃত্যুর পর তাদের স্বজনেরা কুয়োর কাছে এসে কয়েন ছুড়ে মারত। যদি কোনো পাথরে আঘাত করে কয়েনের ঝনঝন শব্দ পাওয়া যেত, তাহলে ধরে নেওয়া হতো মৃত ব্যক্তি স্বর্গে গমন করতে পেরেছে। এটি অসিশা অঞ্চলের প্রাচীন বিশ্বাসের অংশ।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, কোনো কোনো সমাধিতে লাশগুলোকে কাঠের তৈরি নৌকাকৃতির কফিনে শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। কোনোটায় আবার লাশের সঙ্গে বইঠাও মেলে। এসবই অসিশিয়ানদের পরকাল নিয়ে বিশ্বাসের অন্তর্গত। তারা মনে করত স্বর্গে যেতে নদী পার হতে হয়, তাই মৃতদের নৌকার মতো কফিনে সমাধিস্থ করত। প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমীয়দের মধ্যেও এমন বিশ্বাস দেখা যেত।
এমন মৃত শহর অসিশা অঞ্চলে আরও আছে। তবে দারগাভসের মতো সুসজ্জিত সমাধিসৌধ আর একটিও নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ইতিহাসবিদদের কাছে এই শহর এখনো রহস্যময়। এখানকার বাসিন্দাদের মতে, সেখানে গেলে কেউ আর বেঁচে ফেরে না। সে কারণে পরিত্যক্ত আর ফাঁকাই পড়ে রয়েছে দারগাভস। তবে মাঝেমধ্যে পর্যটক দেখতে পাওয়া যায়। মূলত বিপৎসংকুল যোগাযোগব্যবস্থার কারণেই এখনো ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি এই মৃতদের নগরী।