ধূসর কুয়াশা

শীতের রাত।  জমাট বাঁধা কুয়াশার চাদর কেটে ছুটছে লক্কড়মার্কা গাড়িটা। আকাশে হলদে চাঁদ।

স্টিয়ারিং হুইল ধরে আপন মনে গজগজ করছেন ডেভিড হুইটম্যান। পেশায় ডাক্তার তিনি। শহরের বাইরে একটা ‘কল’ সেরে ফিরছেন।

রাত্রি এখন তিনটা। শীত জেঁকে বসেছে ভালোভাবেই। গায়ে পুরু কোট-মাফলার থাকা সত্ত্বেও ঠকঠক করে কাঁপছেন তিনি।

নির্জন রাস্তা। দুই ধারে চেস্টনাটগাছ। ন্যাড়া। মাঝে মাঝে ফাঁকা অসমতল মাঠ।

আশপাশে দু-তিন মাইলের মধ্যে জনবসতি নেই।

চলন্ত গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সামনের পথের খানিকটা দেখা যাচ্ছে শুধু।

শীতে কষ্ট পেলেও ডাক্তার মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত। শহর প্রায় এসেই গেছে। আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে লেপের তলায় ঢুকতে পারবেন। এখন কোনোরকমে সময়টুকু কাটলেই হয়!

ক্যাঁ-অ্যাঁ-চ্-চ্! কিঁ-ইঁ-চ্-চ!

চমকে উঠলেন ডাক্তার। ধাতব গোঙানির আওয়াজ আসছে গাড়ির ভেতর থেকে।

হুইটম্যানের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। এখন যদি গাড়িটা বিগড়ে যায়, কী হবে তাহলে? এখনো তো প্রায় তিন মাইল পথ বাকি। জোর করে ভাবনাটা তাড়িয়ে দিলেন মন থেকে।

কিন্তু অদৃষ্টদেবী বোধ হয় তাঁর ওপরে নাখোশ ছিলেন।

হঠাত্ করে আর্তনাদ বেড়ে গেল গাড়ির। গতিও হয়ে এল মন্থর। সাধ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে গতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন হুইটম্যান।

লাভ হলো না কোনো।

ধুঁকতে ধুঁকতে কিছু দূর এগিয়ে রাস্তার মাঝখানে অচল হয়ে গেল গাড়ি। নড়ার নাম নেই।

চেষ্টার ত্রুটি করলেন না ডাক্তার। কিন্তু অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়া আর কোনো সাড়া দিল না ‘বেয়াদ্দপ’ গাড়িটা।

দারুণ শীতের মধ্যেও টের পেলেন তিনি, ঘামে ভিজে উঠেছে সারা শরীর। গাড়ি ফেলে রেখে এই জনমানবহীন পথে পাক্কা তিন মাইল পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা করে গায়ে কাঁটা দিল তাঁর। রাতটা গাড়িতে পার করাও অসম্ভব। ঘুম আসবে না কিছুতেই।

ভয়ে, দুর্ভাবনায় হুইটম্যানের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। মাথাটা কাজ করছে না। সঙ্গে করে লোক না আনার জন্য আফসোস হলো ভীষণ। সঙ্গে লোক থাকলে তা-ও ভরসা পাওয়া যেত।

‘ডক্টর!’

লাফ দিয়ে হূিপণ্ডটা যেন গলার কাছে চলে এল ডাক্তারের। ‘...ক্...ক্...কে?’

‘ডক্টর! ডক্টর!’

তীক্ষ দৃষ্টিতে বাইরে তাকালেন ডাক্তার। আবিষ্কার করলেন একজনকে। লম্বা, শীর্ণ। অন্ধকারে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শুধু কালো অবয়ব চোখে পড়ছে।

গাড়ির কাচে নাক চেপে ধরল লোকটা। বুকে পানি পেলেন যেন হুইটম্যান। যাক, কাউকে তো পাওয়া গেল! গলায় সবটুকু জোর ঢেলে বললেন, ‘কে আপনি?’

‘আমাকে চিনবেন না আপনি।’

চিনবার জন্য ব্যস্ত ননও হুইটম্যান। তাঁর প্রয়োজন একটু সাহায্য। সে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছেন, লোকটা বলে উঠল, ‘আপনাকে একটু আসতে হবে, ডক্টর। পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ।’

হতভম্ব হয়ে পড়লেন হুইটম্যান। এখানেও রোগী! আর তিনি যে ডাক্তার, বুঝল কী করে লোকটা? বোধ হয় আন্দাজে...চেহারাসুরত দেখে অনুমান করেছে।

‘ঈশ্বরের অসীম দয়া! আপনাকে যে এ সময় এখানে পেয়ে যাব, কল্পনাও করিনি। অথচ না পেলে...’

এসব কথাবার্তা ভালো লাগছিল না ডাক্তারের। একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘কোথায় আপনার পেশেন্ট?’

নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে অন্ধকারে একটা দিকে দেখাল আগন্তুক। গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিলেন ডাক্তার। দূরে এক জায়গায় আলো দেখা যাচ্ছে। এই নির্জন প্রান্তরের মধ্যে বাড়ি এল কোত্থেকে?

এ রকম নির্জন এক জায়গায় অপরিচিত কারও সঙ্গে কোথাও যাওয়া একটু বিপজ্জনক। লোকটার মনে খারাপ কোনো অভিসন্ধি নেই, কে বলতে পারে!

আগন্তুক যেন তাঁর মনের কথা টের পেয়েই বলল, ‘না করতে পারবেন না, ডাক্তার! যেতে আপনাকে হবেই।’

এরপর তো আর না গিয়ে উপায় নেই। দেখা যাক, কী আছে কপালে। বললেন তিনি, ‘ঠিক আছে, চলুন।’

মাঠের ওপর দিয়ে পথ। বোঝা যায়, কিছুদিন আগে ফসল তোলা হয়েছে। মাঠজুড়ে ছড়ানো খড়।

অন্ধকারে মসৃণ আল ধরে লোকটার পিছে পিছে এগোতে লাগলেন ডাক্তার।

মিনিট পাঁচেক পর এক বাড়ির উঠোনে এসে পৌঁছালেন দুজনে। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে। সেদিক দেখিয়ে বলল লোকটা, ‘যান, ভেতরে যান। এক্ষুনি আসছি আমি।’

অন্ধকারেও বুঝতে পারলেন ডাক্তার, একতলা বাড়িটা অনেক পুরোনো। জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে দেয়াল। ফাঁকে-ফোকরে গজিয়ে উঠেছে লতাগুল্ম।

ভেতরে ঢুকলেন তিনি।

প্রথম ঘরটাই ড্রয়িংরুম।

কামরাটা বেশ বড়। সে তুলনায় আসবাব নেই বললেই চলে। পুরো ঘরে একটিমাত্র জানালা। দরজার মুখোমুখি জানালাটার ধারে মৃদু দুলছে একটা রকিং চেয়ার। তাতে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ। মুখ-মাথা মাফলারে ঢাকা।

একটা লণ্ঠন জ্বলছে ঘরে। বাতিটার আলো তির্যকভাবে এসে পড়েছে বৃদ্ধের মুখে। হাঁ করে ছাদের দিকে চেয়ে আছে বৃদ্ধ।

ঘাড় সামান্য কাত করল। ‘এসেছেন, ডাক্তার!’ বলল ক্ষীণ স্বরে। ‘আহ্...বসুন।’

এদিক-ওদিক তাকিয়ে দরজার বাঁ দিকে একটা বেতের চেয়ার দেখতে পেলেন ডাক্তার। সেটাই টেনে রকিং চেয়ারটার পাশে এনে বসলেন।

কেশে গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে নিল বৃদ্ধ। ‘বেশ। এবার তাহলে আমার রোগের কথা বলি। তার আগে বলুন, আমার রোগটা কি সারাতে পারবেন আপনি?’

চিলতে এক হাসি খেলে গেল ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে। ‘সেই চেষ্টা করাই তো আমাদের কাজ।’

‘হুম।’ শীতল হাসির শব্দ শোনা গেল রকিং চেয়ার থেকে। ‘আচ্ছা, ধরুন, এই মুহূর্তে যদি মারা যাই আমি, কী করবেন আপনি? ফি দেবে কে আপনার? আমার তো নিজের বলতে কেউ নেই।’

বিব্রত হলেন ডাক্তার। বিরক্তও। বললেন, ‘আমরা সব সময় ফির জন্যই ডাক্তারি করি না।’

‘বাহ্! ভালো লাগল শুনে। তবে, আপনার ফি আপনি পেয়ে যাবেন।’

‘এবার কি আমি দেখতে পারি?’ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন হুইটম্যান। অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের জন্য রীতিমতো উসখুস করছেন তিনি।

‘দেখুন।’

চেয়ার ছাড়লেন হুইটম্যান। হাত বাড়ালেন রোগীর বাঁ হাতটা তুলে নেওয়ার জন্য। পালস পরীক্ষা করবেন।

কিন্তু এ কী!

কবজি স্পর্শ করতেই ধড়াস করে লাফ মারল হুইটম্যানের হূিপণ্ড। তাঁর হাতে ধরা হাতটা কোনো মানুষের হাত নয়! ওটা একটা কঙ্কাল!

জান্তব চিত্কার দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিলেন ডাক্তার। বুকের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ছুটন্ত ঘোড়ার টগবগ-টগবগ।

বিকারগ্রস্তের মতো নিজের ডান হাতটা শার্টে ঘষতে লাগলেন তিনি। মুছে ফেলতে চাইছেন কঙ্কালের স্পর্শ।

ভয় পেয়েছেন ডাক্তার—প্রচণ্ড ভয়! ঘুরে দাঁড়ালেন দৌড় দেওয়ার জন্য। কপাল খারাপ। চেয়ারে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝের ওপরে।

ঘরের ভেতরে আলোটা নেচে উঠল বার কয়েক। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ডাক্তার, নিবুনিবু হয়ে এসেছে লণ্ঠনটা। বুড়োটাও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার ছেড়ে।

পড়িমরি করে উঠে দাঁড়ালেন হুইটম্যান। পালাতে হবে এই পিশাচের ডেরা থেকে!

আবার দৌড় দিতে গিয়েও পারলেন না। পৈশাচিক থাবায় আঁকড়ে ধরল বুড়ো ডাক্তারের কাঁধ।

‘আহ্!’ অসহ্য ব্যথায় চিত্কার করে উঠলেন হুইটম্যান। আঙুলের হাড় ওঁর কাঁধের মাংসে দাঁত বসিয়েছে।

হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন ডাক্তার। পিশাচের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য পাগলের মতো তড়পাতে লাগলেন।

আচমকা হাতে ঠেকল ডাক্তারি ব্যাগটা। তুলে নিয়েই ধাঁই করে মেরে বসলেন বুড়োর মুখে। আকস্মিক আঘাতে টলে উঠল ভূতটা। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কাঁধ।

এই সুযোগে ঝেড়ে দরজার দিকে দৌড় দিলেন হুইটম্যান। পেছনে দপ করে নিভে গেল লণ্ঠনটা। শোনা গেল অমানুষিক আর্তনাদ...

কীভাবে যে ছুটতে ছুটতে গাড়িতে এসে উঠলেন, বলতে পারবেন না ডাক্তার। মাথার মধ্যে তখন জান বাঁচানোর চিন্তা।

কী আশ্চর্য! গাড়িটা যেন স্টার্ট নিল জাদুমন্ত্রের বলে!

হাঁফ ছাড়লেন হুইটম্যান। গাড়ি ছোটালেন বাড়ির দিকে। হলদে চাঁদ সঙ্গী হলো তাঁর।

পেছনে পড়ে রইল কিছু অভিশপ্ত স্মৃতি।

বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী