একটি ফুটবল ম্যাচ

অলংকরণ : রাজীব
অলংকরণ : রাজীব

কাছে আসছে ওরা। এক পা দুপা করে। চারপাশ থেকে।

আবার চেঁচিয়ে উঠল একজন, ‘এবার তোর বল দেওয়ার পালা। বলটা দে!’

অবিন বলল, ‘কিন্তু আমার কাছে তো বল নেই।’

‘নেই? তোর ঘাড়ের ওপর গোলাকার ওই বস্তুটি তাহলে কী?’

অবিন মুচকি হেসে বলল, ‘আরে! ওটা তো আমার মাথা। বল নয়।’

‘ওটাই দে না হয়। ওটাকেই বল বানিয়ে খেলি!’

ঘাবড়ে গেল অবিন। ভয়ও পেল ভীষণ। কী করবে বুঝতে পারছে না। দৌড়ে পালাবে? কিন্তু ওরা যে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ওকে। ওদের কাছ থেকে এখন পালাতে পারবে না। দলেও ওরা ভারী। সাতজন। এখন উপায়!

অবিন গিয়েছিল খালপারের হাটে। মামার সঙ্গে। মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে তিন দিন আগে। স্কুলের মিডটার্ম পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। ছুটিও আছে কয়েক দিন। বাসায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। মাকে বলে-কয়ে বাবাকে রাজি করিয়েছে—দিন তিনেকের জন্য মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে অবিন।

বর্ষার এই সময়টায় মামার বাড়ি বেড়াতে ওর দারুণ লাগে। বৃষ্টি দেখতে চাইলে গ্রামে যেতেই হবে। শহরে বসে বৃষ্টি দেখায় কোনো মজা নেই।

আজ ছিল হাটবার। মামাও যাচ্ছেন হাটে। যাওয়ার আগে অবিনকে বলেছিলেন, ‘হাটে যাবে অবিন?’

‘যাব।’

এর আগেও বেশ কয়েকবার হাটে গিয়েছিল ও। খুব মজা হাটে। কত রকম মানুষ আসে! সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ত মানুষ দেখতে বেশ লাগে ওর।

ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত হাটে থাকবে। কিন্তু হাট থেকেই কোথায় যেন যাবেন মামা। ফিরতে অনেক রাত হবে। তাই বিকেল হতেই অবিনকে বললেন, ‘তুমি বাড়ি চলে যাও।’

‘এখনই?’

‘হুঁ। এখনই রওনা না দিলে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারবে না। একা যেতে পারবে না?’

মাথা নাড়িয়ে অবিন বলল, ‘পারব। ঢাকা থেকে একা আসতে পেরেছি, আর এটুকু বুঝি যেতে পারব না?’

মামা বললেন, ‘সে জন্য নয় অবিন। পথে একটা বিটকেলে জায়গা আছে। ওখানে একটু সাবধানে যেয়ো। চেনো তো জায়গাটা?’

মামার কথার আগামাথা বুঝতে পারেনি অবিন। জানতে চাইল, ‘বিটকেলে মানে? চোর-ছ্যাঁচড়?’

মামা মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে তো ভালোই হতো। সে যা-ই হোক। তুমি এখনই চলে যাও বাড়িতে। কোথাও থামবে না। তাহলেই হবে।’

হাট থেকে মামার বাড়ি প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ। সবটুকুই হাঁটাপথ। আর এই বর্ষার সময় শর্টকাট রাস্তাও নেই। সব পানিতে থই থই। বড় রাস্তা ধরেই যেতে হয়। এ জন্য সময়টা এত বেশি লাগে।

ফিরতি পথ ধরে হাঁটতে লাগল অবিন। ওর হাতে এক ঠোঙা মুরালি। মুরালি ওর দারুণ লাগে। ঠোঙা থেকে একটা করে মুরালি বের করছে আর মুখে পুরছে। আর হাঁটছে।

কিছুদূর এগিয়েছে, অমনি আকাশটা কালো হয়ে গেল হঠাত্। একেবারে নিকষ কালো। মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। ভালোই হলো। বৃষ্টিতে ভেজাও হয়ে যাবে। গ্রামে এসে বর্ষাকালের বৃষ্টিতে না ভিজলে কি চলে?

বলতে না বলতেই বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি। হাতে থাকা ঠোঙাটা ভিজে গেছে ততক্ষণে। সবটুকু মুরালিও খেয়ে শেষ করতে পারেনি অবিন।

আরে! ওই মাঠে কারা যেন ফুটবল খেলছে! বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুটবল খেলার মজাই অন্য রকম। আবছা আলোয় দেখতে পেল অবিন। ওরা সাতজন। একটা বল নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সারা মাঠ। দেখে এত লোভ হলো ওর! মাঠের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমায় খেলতে নেবে?’

কেউ কোনো কথা বলল না। একজন শুধু হাতের ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ল অবিন। পায়ের স্যান্ডেলটা খুলে রেখে দিল মাঠের পাশে।

এবার দুই দলে সমান সমান খেলোয়াড়। এদিকে চারজন, ওদিকে চারজন। সবার গা খালি। নেংটি পরে আছে প্রত্যেকে।

হঠাত্ বলটা ছুটে এল অবিনের দিকে। ধড়াম করে বলে লাথি হাঁকাল ও। আর অবাক হয়ে গেল। বলটা এত ভারী কেন? পরক্ষণেই বাদ দিল চিন্তাটা। কাদা মাঠে বল তো একটু ভারী হবেই। তা ছাড়া যা বৃষ্টি হচ্ছে! আকাশের দিকে তাকাল অবিন। এখনো অন্ধকার। তুমুল বৃষ্টির জন্য সবকিছু ঠিকমতো ঠাওর করাও যাচ্ছে না।

আবার বল পেল অবিন। ওই তো বিপক্ষ দলের গোলপোস্ট। ঠিকমতো লাথি হাঁকাতে পারলে গোল নিশ্চিত। লাথি হাঁকানোর জন্য ডান পা খানিকটা পেছনে নিল অবিন। লাথি হাঁকাতে যাবে, তখনই বলটা বলে উঠল, ‘খবরদার! এত জোরে মারবি না। জোরে মারলে ব্যথা পাই তো!’

হঠাত্ থমকে গেল অবিন। বলটা কথা বলল! উঁহু। ও তাহলে ভুল শুনেছে। এবার বলটাকে উঁচু করে মারল। আর অমনি কারও মাথায় গিয়ে আটকে গেল বল। সঙ্গে সঙ্গে খিক খিক করে হেসে উঠল সবাই। অবিন ছাড়া। অবিন আশ্চর্য হয়ে ভাবল, এখানে হাসির কী আছে? আর বলটাই বা কোথায়। মাঠে তো বল দেখতে পাচ্ছে না ও।

এবার পেছন দিক থেকে বলটা এল। বলের পেছনে ছুটল অবিন।

মাঠের এখানে-ওখানে পানি জমে গিয়েছে। বল মারলেও পানিতে আটকে যায়। এমন পানি জমা মাঠে কী করে ফুটবল খেলতে হয় জানে অবিন। আলতো করে বল তুলে দিতে হয়। আবারও বল পেয়ে আলতো করে তুলে দিল ও। কিন্তু এবারও?

অবিন দেখল, বলটা তুলে দেওয়ামাত্রই একজন এগিয়ে এল। হেড দেওয়ার বল ছিল ওটা। এবং হেডও হয়েছিল। কিন্তু হেড হওয়ার পর বলটা হাওয়া। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে, বলটা মাথার সঙ্গে আটকে গেছে। নাকি বলটাই মাথা হয়ে গেছে? নাহ্! ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতেই হয়। এরপর হাত দিয়ে বল ধরে দেখবে।

খানিক পর বল এল ওর সামনে। চট করে বলটা তুলে নিল দুই হাত দিয়ে। কিন্তু এ কী!

অবিন অবাক হয়ে দেখল, ‘ওটা বল নয়। একটা মাথা। জলজ্যান্ত মাথা। মাথাভরা চুল। সিল্কি সিল্কি। চোখ দুটো লালচে। ঠোঁট দুটো কুচকুচে কালো। আর...’

আর ভালোমতো দেখতে পারেনি অবিন। সব কটি দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি দিল বলটা। দাঁতগুলো কী ধারালো! এটুকু দেখেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। চট করে বলটা ফেলে দিল হাত থেকে। কিন্তু আরে! বলটা একটা ড্রপ খেয়েই ছুটে গেল কারও দিকে। আর ছুটে গিয়েই একজনের ঘাড়ের ওপর চেপে বসল মাথা হয়ে। অমনি খিক খিক করে একরাশ হাসির শব্দ শুনতে পেল ও। আশপাশে তাকাল অবিন। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর হাসতে হাসতেই ওর কাছে চলে এল সবাই। তখনই একজন বলল, ‘আমরা সবাই একবার করে আমাদের বল দিয়েছি। এবার তোর বল দেওয়ার পালা। বলটা দে!’

তার মানে, এতক্ষণ সত্যি সত্যি ওরা ওদের মাথাটাকেই বল বানিয়ে খেলছিল! তবে কী...

বাকিটা ভাবতে পারল না। তার আগেই আরেকজন বলল, ‘কী দিবি না? এতক্ষণ তো ঠিকই নিজের মাথা বাঁচিয়ে খেলেছিস। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের মাথা খুলে দিয়েছি। পরের মাথা দিয়ে খেলতে খুব মজা না! দে তোর মাথা!’

পালানোরও পথ নেই। আকাশের দিকে তাকাল অবিন। আগের মতোই অন্ধকার। কোনোরকমে বলল, ‘কিন্তু আমার মাথা তো দেওয়া যাবে না।’

‘কেন, ওটা কি সোনায় মোড়ানো?’

আবার খিক খিক হাসির শব্দ। কোরাস হাসি।

অবিন বলল, ‘না মানে। আমার মাথাটা আসলে খোলা যাবে না।’

‘কেন? খোলা যাবে না কেন? বল্টুগুলো খুব বেশি টাইট করে দিয়েছিস নাকি?’

আরেকজন বলল, ‘আরে বুঝিসনি? ও তো মানুষ।’

বাকিরাও চমকে উঠল, ‘মানুষ!’

সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল সবাই। ওরা সাতজন। অবিনও তাকাল ওদের চোখের দিকে। প্রথমে ওদের চোখে অবাক দৃষ্টি দেখতে পেল। তারপর সেই অবাক চাহনি বদলে হয়ে গেল হিংস্র চাহনি। সবাই তাকিয়ে আছে ওর মাথার দিকে।

আরেকজন বলল, ‘মাথাটা দেখেছিস। কী বড়!’

আরেকজন বলল, ‘শুধু বড়? কী গোলগাল দেখেছিস? ওই মাথা দিয়ে ফুটবল খেলতে যা লাগবে না।’

আবারও হুংকার, ‘দে। জলদি তোর মাথা দে। ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে। নইলে ছিনিয়ে নেব।’

ভয়ে, আতঙ্কে এই বৃষ্টির মধ্যেও ঘামতে শুরু করল অবিন। ওর মেরুদণ্ড বেয়ে কী যেন নেমে যাচ্ছে। ঠান্ডা একটা স্রোত অনুভব করছে ও পিঠে। এখন উপায়?

ততক্ষণে ওর কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। ওকে ধরে ফেলল প্রায়। আর ঠিক তখনই...

হঠাত্ আঁধার কেটে গেল। চোখের পলকে ফরসা হয়ে গেল চারপাশ। আর চোখের পলকে সাতজনই হাওয়া হয়ে গেল। হাওয়া হয়ে কোথায় গেল ওরা?

চারপাশে তাকাল অবিন। নাহ্। ওদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

মাঠের দিকে তাকাল ও। দেখলেই বোঝা যায়, খানিক আগেই এ মাঠে ফুটবল খেলা হয়েছিল।