সামসুল, সুমন ও তার স্যারের বাড়ি ফেরা

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী
অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

বসের তুমুল ঝাড়ি খাওয়ার পর ন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির জুনিয়র অফিসার আজিজুল বাশার সুমনের ইচ্ছে হলো, চাকরিটা আজকেই ছেড়ে দিতে। চাকরি ছাড়তে গেলে সবাই রিজাইন লেটার দেয়। সুমনের ইচ্ছে হলো চিঠিফিঠি না দিয়েই চলে যেতে।

—স্যার, ছুটি লাগবে। বাড়ি যাই না অনেক দিন।

—ছুটি গাছে ধরে? অবশ্যই গাছে ধরে। গাছটা আছে আফ্রিকার আমাজন জঙ্গলে। আগে তুমি আফ্রিকা যাও। তারপর ছুটির গাছ ধরে ঝাঁকি দাও। টপটপ ছুটি পড়বে।

—স্যার, আমাজন তো আফ্রিকায় না...।

—নো ছুটিফুটি! এক ঘণ্টার মধ্যে মতিঝিল শাখায় যাও। ওয়াজেদ সাহেবের কাছ থেকে ওয়ার্ক অর্ডারটা নিয়ে আসো। না পারলে আর অফিসে ঢোকার দরকার নেই। আউট।

আজিজুল বাশারের ডাকনাম সুমন। খুব সাধারণ নাম। মানুষটাও সাধাসিধা। চাকরিতে ঢুকেছে বেশি দিন হয়নি। বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। বিয়ে করেনি। মেসে থাকে। বেতন যা পায় তা দিয়ে কোনোমতে নিজে চলে আর গ্রামে মা-বাবাকে টাকা পাঠায়। ছোট বোন আছে। ক্লাস এইটে পড়ে। তার নাকি কম্পিউটার লাগবে। চাকরি ছাড়ার চিন্তার পর সুমনের মাথায় এসব চিন্তা আসে। এরপর সে আবার চাকরি ছাড়ার বিষয়টা ভুলে যায়।

—এই রিকশা! বাসস্ট্যান্ড যাবেন?

—ওঠেন।

এক লাফে রিকশায় চড়ে সুমন। বৈশাখের আগুন-ঝরা গরমে দুজনই ঘামছে দর দর করে। ঠা ঠা রোদে গরম পিচঢালা রাস্তায় গাড়ির জটলার দিকে তাকিয়ে আছে সুমন। গাড়ির তাপ এসে গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে যাচ্ছে।

—এবার বেদিশা গরম পড়ছে।

জ্যামে পড়তেই রিকশাচালকের সঙ্গে টুকটাক আলাপ জুড়ে দেয় সুমন। তার নাম সামসুল হক। বাড়ি সুমনের দুই গ্রাম পরেই। সুমনের বাড়ি ফুলপুরে আর সামসুল হকের আনন্দপুরে। জ্যাম ছাড়তেই গাড়িগুলো শোঁ শোঁ ছুটে চলে। সামনের রাস্তা মুহূর্তে ফাঁকা। আর কিছু দূরেই বাসস্ট্যান্ড। মতিঝিলের বাস দেখে রিকশাচালককে তাগাদা দেয় সুমন।

—জলদি টানেন, বাস ধরতে হইব।

জোরে প্যাডেল দাবায় সামসুল হক। দ্রুত গতি ওঠে। কানে বাড়ি খায় বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। আরও জোরে! এক চিলতে জায়গা নেই দাঁড়ানোর। তাও সুমনের মনে হলো এই বুঝি ফসকে যাচ্ছে বাসটা।

আচমকা ঝপাং ঝপ! বুদ বুদ বুদ বুদ। হতভম্বের মতো হাত-পা ছড়িয়ে আছে সুমন। চারপাশে পানি! ডুবে যাচ্ছে সে! রিকশাটা মাটিতে ঠেকেছে কিন্তু সে ভেসে উঠছে। সামনে সামসুল হককে দেখছে অবলীলায় হাত-পা ছুড়ে ওপরের দিকে উঠতে। সুমনও তার দেখাদেখি হাত-পা ছুড়ল। এত পানি এল কোথা থেকে! রাস্তা তো একদম পাকা। কোনো গর্তটর্ত নেই। হুসসসস হুসসস। দুটো মাথা ভেসে উঠল। সুমন আর রিকশাচালক সামসুল হক একে অন্যের দিকে তাকাল। চারদিকে পানি আর পানি। আকাশে কালো মেঘ। দূরে আবার পাড়ও দেখা যায়। গাড়ি, বাস, যানজট মুহূর্তে সব গায়েব। নেই পিচঢালা রাস্তার উত্তাপ। এটা নদী নাকি! কোন নদী! একটু দূরে আবার নৌকাও দেখা যাচ্ছে। নৌকার মাঝি ও তার ছোট ছেলেটা সুমন ও সামসুল হকের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সুমনের পরনে অফিসের পোশাক। পানিতে ভারী হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো সে সাঁতার পারে। কিন্তু গরম পিচঢালা ঢাকার জ্যামে ভরা রাস্তা থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ল কী করে তারা!

—স্যার, আমারে ধরেন।

—তোমার রিকশা?

—আরে ফালাইয়া থোন। আগে পাড়ে ওঠেন। নয়তো ডুইবা মরবেন।

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী
অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

কোনোমতে হাবুডুবু খেতে খেতে পাড়ে উঠে এল দুজন। পাড়ে বসে জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। পকেট থেকে জিনিসপত্র বের করে রাখল নদীর পাড়ে। কেউ কোনো কথা বলছে না। সুমন ভাবছে, ব্যাপারটা স্বপ্ন বা বিভ্রম হতে পারে না। তার সঙ্গে সামসুল হকও নদীর পানিতে হাবুডুবু খেয়েছে। তবে সামসুল হককে খুব একটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। বরং একটু পর তার মুখে হাসি চওড়া হলো।

—কী তাইজ্জব ব্যাপার!

—আবার কী ঘটল?

—আরে দেহেন স্যার, এইটা তো আমার গেরাম! এই যে আমগো কুরুশ নদী। কত্ত মাছ ধরছি।

—বলো কী! তার মানে আমার ফুলপুর তো পাশেই। হুম। চেনা চেনা লাগে। আহারে কত্ত বছর পর আসলাম! কিন্তু এখান থেকে এখন ফুলপুর যামু কেমনে?

—আরে আয়া পড়ছেন যহন ব্যবস্থা একটা হইবই।

ক্রিং ক্রিং। পানিতে ভিজলেও কল এল সুমনের ফোনে। সামসুল তাকে ইশারায় বসতে বলে আবার নদীতে ঝাঁপ দিল। একটা নৌকার মাঝিকে কাছে ডাকল ইশারায়। ডুবে যাওয়া রিকশাটাকে তোলার একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।

—হ্যালো, স্লামালেকুম স্যার।

—তুমি এখনো পৌঁছাওনি!

—স্যার, একটা আজব ঘটনা ঘটে গেছে।

—কোনো ঘটনা-ফটনা বুঝি না। ওয়াজেদ সাহেবের সঙ্গে...।

—স্যার, আমি গ্রামে চলে এসেছি। রাস্তা দিয়ে রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলাম। আচমকা নদীতে পড়ে গেছি, স্যার বিশ্বাস...।

অপর প্রান্তে নীরবতা।

—আর এক ঘণ্টা সময় আছে হাতে। আমি বাসায় যাচ্ছি, লাঞ্চের আগেই আমি রেজাল্ট চাই।

কেটে গেল লাইন। কেন যেন টেনশন লাগছে না সুমনের। ফুরফুরে মেজাজে আছে সে। আকাশে মেঘ,  সূর্যের তেজ নেই। ভেজা বাতাস। সোমবারের এই কঠিন অফিস টাইমে সে বসে আছে কুরুশ নদীর তীরে। আর দুই গ্রাম পরেই তার বাড়ি। বাড়ির লোকজন আচমকা তাকে দেখে না জানি কত খুশি হবে। কিন্তু ঘটনাটা যে কী ঘটে গেল ভেবে পেল না সে। ভেজা জামাকাপড়েই নদীর পাড়ে বসে সামসুল হকের রিকশা উদ্ধার অভিযান দেখতে লাগল আপাতত।

রিকশাটা তোলা হলো। ততক্ষণে গায়ের জামাকাপড়ও শুকিয়ে এসেছে প্রায়। সামসুল রিকশা টেনে হাঁটছে। সঙ্গে সুমন। হাঁটতে হাঁটতে খিদে পেয়ে গেল দুজনের।

—আমার বাড়িত চলেন। দেখি বউ কী রানছে।

—জি চলেন। আমার বাড়ি যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে। এদিকে তো ভ্যান ছাড়া আর কিছু চলে না।

—আরে আমার রিকশা আছে না! খাওনের পর একটু জিরাইয়া পরে আমিই আপনারে দিয়া আসব। কিন্তুক স্যার, কামডা হইল কেমনে? বাস, ট্রাক, লঞ্চ কোনো কিছুর টিকিট কাটন লাগল না, ঝপ্পাত্ কইরা এক্কেরে গেরামে।

—ঘটনা আমিও জানি না সামসুল ভাই। ঘটনা বড়ই সিরিয়াস।

নদীর পাড় ধরে এগোচ্ছে দুজন। মোড়ের দোকানে টিভি চলতে দেখে দাঁড়াল। টিভিতে খবর চলছে। হাঁ করে খবরটা বোঝার চেষ্টা করছে দুজন। তাদের এই ঘটনা নিয়ে কিছু বলে কি না সেটা দেখার জন্য।

‘...এদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন এই স্পেস-কার্ভ ওয়ার্মআপ, দুঃখিত আমি আবার পড়ছি, এই স্পেস-কার্ভ ওয়ার্মহোল যেকোনো জায়গায় যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এই ওয়ার্মহোল তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়াবিদেরা এ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছেন।’

—হুমম। স্যার, ঘটনা তাইলে এই।

—হুম সামসুল। আমরা ওয়ার্মহোল নামের একটা কিছুর শিকার।

—বিষয়টা কী? ভূত-জিন টাইপ কিছু?

—আমি তো সায়েন্সে পড়ি নাই। আমার এক পাগলা বন্ধু আছে, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি।

সুমন ফোন দিল তার বন্ধুকে। ঘটনা শুনে বন্ধু উত্তেজনায় এলোমেলো বকল কিছুক্ষণ।

—তোত তো তো তোরা গ্রামে! ওয়ার্মহোল ব্রিজ... ও মাই গড! ইন্টারেস্টিং। ঢাকা থেকে সোজা ফুলপুর।

—না এখনো আনন্দপুরে আছি। ফুলপুর যেতে আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। তুই বিষয়টা বুঝিয়ে বল।

—আরে এটা বুঝতে হলে তোকে আগে অনেক পড়াশোনা করতে হবে রে।

—ভূত-জিনের কারবার না তো?

—আরে ভূত-জিনের চেয়েও ব্যাপারটা আরও কমপ্লেক্স, মানে জটিল। অনেক অনেক সূত্র আর আইনস্টাইন পড়তে হবে তোকে। শোন ঘটনাটা সহজে বলি, ধর, এই যে জায়গা...এত এত জায়গা...খালি জায়গা...শূন্য স্থান, এটা একটা চাদর। লম্বা ছড়ানো চাদর।

—জায়গা মানে তো জমি।

—আরে নারে গাধা। জমি তো হলো মাটি, ইট, বালু এইসব। এখানে জায়গা মানে জায়গা। খালি হোক বাতাস না থাকুক, জমি না থাকুক। ধর কিছুই নাই। তাহলে যা থাকে সেটাই হইল জায়গা, মানে স্থান। ইংরেজিতে যাকে বলে স্পেস। আকাশের মতো।

—এখন হইছেটা কী?

—আমি নিউজ দেখলাম। গোটা দুনিয়ায় কিছু ওয়ার্মহোল তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও আছে কিছু। তো এটার কাজ হলো জায়গাকে বাঁকিয়ে দেওয়া। ধর, চাদরের এক মাথায় ঢাকা, আরেক মাথায় ফুলপুর। এখন চাদরটাকে কেউ ভাঁজ করে ফেললে কী হবে? ফুলপুর আর ঢাকা পাশাপাশি চলে আসবে। কিন্তু এটা খালি চোখে দেখবি না। কারণ, জায়গা যদি বেঁকে যায় তো আলোও বাঁকা পথে আসবে, সব বেঁকে যাবে।

—কিন্তু চাদর ভাঁজ হইল বুঝলাম। আমি আর সামসুল হক মানে আমি যার রিকশায় ছিলাম, আমরা দুইজন চাদরের ওই মাথায় গেলাম কেমনে?

—ঠিক ধরেছিস। ওই চাদরে ফুটো হয়েছে। ফুটোটাই হলো ওয়ার্মহোল। তোরা দুজন ওই ফুটো গলে বের হয়ে গেছিস।

—হ, ঠিক। আমাদের অফিসের সামনের রাস্তায় তাইলে একটা ফুটা আছে।

—তোর তো তাও ভাগ্য যে তুই দেশেই আছিস।

এমন সময় আবারও ফোন। বসের ফোন। অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না ভেবে ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে ফেলল সুমন। ওপাশ থেকে চিঁ চিঁ খিঁচ খিঁচ শব্দই আসছে কেবল।

—হ্যালো...! স্যার জোরে বলেন কিছু শুনি না!

—সুম..ন। সুম..ন।

মনে হলো অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে কথাটা।

—জি স্যার, শুনছি।

—সুমন আমাকে বাঁচাও। বান্দরের দল আমাকে ঘিরে ধরছে।

—বান্দর! স্যার আপনি কোথায়!

—জানি না! আমি জানি না! একপাল বান্দরের মধ্যে আয়া পড়ছি। জঙ্গলে।

স্যার বিপদে আছে দেখে সুমন কিছুটা সাহস ফিরে পেল।

—রাস্তায় গাড়ি চলতে চলতে আচমকা দেখি জঙ্গল। এত বান্দর, এদিকে আবার সাপ, জোঁক... ও মাগো! এটা কিসের ডাক।

বাঘের গর্জন কানে এল সুমনের। স্যারও নিশ্চয়ই ওয়ার্মহোলের খপ্পরে পড়েছে। কোন দেশের কোন জঙ্গলে আছে কে জানে।

—স্যার, আপনার গাড়ি কোথায়?

—আরে বারিধারার রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়ি গিয়ে পড়ল খালের মধ্যে। এরপর দেখি বান্দর আর ক্যাঙারু। না না, ওইটা মনে হয় খরগোশ। যাই হোক, আমার জন্য গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করো। নাহয় বিমান পাঠাও।

—আমারও একই অবস্থা স্যার। আমি আছি আমার গ্রামে।

—মানে কি! তুমি ওয়াজেদ সাহেবের কাছে যাও নাই!

—স্যার! হ্যালো হ্যালো!

লাইন কেটে গেল। আবার হাঁটা দিল সুমন আর সামসুল হক। সামসুল হকের বাসায় ঢুকতেই হইচই পড়ে গেল। দৌড়ে এসে বাবার কাঁধে চড়ে বসল তার ছোট মেয়েটা। ছেলে চিত্কার করে বলছে, আব্বা আমারে রিকশায় চড়াইতে হইব। তার স্ত্রী গামছা নিয়ে এল এক দৌড়ে।

—ময়নার মা, কেমন আছো তোমরা?

—আপনে আচমকা? আইবার আগে একটা ফোন দিলেও তো পারতেন। রান্নাবান্না বসাইতাম। তাও আবার শহরের মেহমান লিয়ে আসছেন।

বিস্তারিত ঘটনা শোনার পর কিছু বলল না সামসুল হকের স্ত্রী। সে বোধ হয় এক বর্ণও বিশ্বাস করেনি। মেহমানের জন্য মুরগি রান্না করবে বলে নিজের খামার থেকে সবচেয়ে বড় মুরগিটা বের করে আনল।

দুপুরের খাওয়া শেষে চিন্তায় পড়ে গেল সুমন। ঢাকা থেকে এক লাফে বাড়িতে এসেছে ঠিকই। কিন্তু এরপর কী করবে? চাকরি থাকবে তো তার? বস যদি...। বসের কথা ভাবতেই আবার ফোন। এবার আর বানর নয়। বস নিজেই চিঁ চিঁ করে কথা বলছেন।

—ও সুমনরে! জঙ্গলে ঘুইরা আমি শেষ। মনে হয় আফ্রিকার আমাজন জঙ্গলে চলে এসেছি। দুপুরের খাওয়া হয় নাই। কী একটা কাঁটাওয়ালা ফল খেয়েছি, এরপর থেকে শুধু পেটব্যথা।

—স্যার, আমাজন জঙ্গল আফ্রিকায় না। ব্রাজিল, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার আরও কিছু দেশে...।

—ও খোদা! আমারে আগে বলো আমি বাড়ি যাব কী করে!

—বাড়ি কেন স্যার, অফিসে আসবেন না আজকে? বিকেলে মিটিং।

—রাখো তোমার অফিস! আমি ঢাকায় আসবার চাই। আমার মাইয়াডা, পোলাডা...।

স্যার ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছেন। সুমনের মন খারাপ হয়ে গেল। আর এক গ্রাম পেরোলেই তার গ্রাম। মা আছে, বাবা আছে, বোন আছে। এদিকে... আহারে বেচারা স্যার। এখন উপায়?

—স্যার, আপনি কাইন্দেন না। আমি ব্যবস্থা করতেছি। বাড়িতে ফোন দেন।

—সত্যি! করো করো! জলদি! তোমার প্রমোশন-ছুটি সব দিয়া দিমু। আমারে আগে ঢাকায় আনো। আর বাড়িতে কিছু জানাইবা না খবরদার। ওরা টেনশনে দৌড়াদৌড়ি শুরু করব।

—দেখি স্যার কী করতে পারি।

সামসুল হকের রিকশায় চেপে সন্ধ্যার আগে আগেই বাড়িতে হাজির সুমন। গ্রামের লোকজন ওয়ার্মহোলের সংবাদ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। সব কাজকর্ম স্বাভাবিক। কাউকে সাবধানে চলাফেরা করতে দেখা গেল না। সুমনকে দেখে উত্সব নেমে এল বাড়িতে। সামসুল হককে রাতে না খেয়ে যেতে দেবেন না বলে পণ করলেন সুমনের মা। সুমনের বাবা কিছুক্ষণ ওয়ার্মহোল ও স্থান বাঁকা হয়ে যাওয়ার বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। ছোট বোন বিলকিস একটু পরপর খোঁচা দিচ্ছে, ভাইজান আমার কম্পিউটারের কথা মনে আছে তো? আর তোমার না আমারে একটা পেনড্রাইভ দেওয়ার কথা।

পেনড্রাইভের কথা মনে পড়তেই সুমনের মনে পড়ল নদীর পাড়ে সে পকেটের জিনিসপত্র রেখেছিল। পরে আর নিতে মনে নেই। রাতের খাওয়া শেষ করে সামসুল হক বাড়ির পথ ধরল। জিনিসগুলোর আশায় সুমনও চড়ে বসল তার রিকশায়। চাঁদের আলোয় সুনসান গ্রামের রাস্তায় বনবাদাড় পেরিয়ে দুজন ছুটে চলল কুরুশ নদীর পাড়ে। পাড়ে এসেই জিনিসগুলোর দেখা পেল সুমন। নদীতে নেমে গোসল করবে ঠিক করল সামসুল হক। সুমন তাকাল সামনে। যেখানে তারা এসে ঝপাং করে পড়েছিল সেখানে কেমন যেন পানি ঘুরপাক খাচ্ছে। সামসুল হক চিত্কার করে বলল, ‘ঘূর্ণি জমছেরে! হগ্গলটি পানি এহন ডুইবা যাইব।’

সুমন ভাবছে অন্য কিছু। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। স্যারকে বিপদ থেকে বাঁচানোর রাস্তা পেয়ে গেছে। ফোনে কল যাবে কি না তার ঠিক নেই। কয়েকবার ডায়াল দিতেই রিং বাজল অপর প্রান্তে।

—হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যালো! সুমন। ভাই তুমি কিছু হদিস পেলে? তুমি আমার ভাই...।

—স্যার, আপনার গাড়ি যেখানে পড়ছিল, সেখানে যান। জলদি যান।

—অ্যাঁ, আচ্ছা দাঁড়াও। বেশি দূরে যাইনি। তুমি লাইন কেটো না।

পাঁচ-দশ মিনিট পর আবার শোনা গেল স্যারের গলা।

—গাড়িটা সামনে। খালের মধ্যে। খালে সম্ভবত দুইটা কুমির আছে। ওরা ঘুমাইতেছে।

—গাড়ির চাকার দাগ খোঁজেন। ঠিক যেখানে দেখবেন চাকার দাগ গায়েব, সেই পথে হাঁটা দেন।

—আচ্ছা। দাঁড়াও দেখি!

 সুমনের স্যার গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছেন। কুমিরের পেছনে আসতেই তাঁর শরীর কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। তবে আশা ছাড়লেন না। একটা কুমির পেছনে তাকাতেই ঝেড়ে দৌড় লাগালেন। এক দৌড়ে গাড়ি পেরিয়ে শুকনো জঙ্গলে। গাড়ির চাকার দাগ ধরে এগোতে লাগলেন। বিশ কদম এগোতেই চলে এলেন জায়গামতো। ঠিক যেখানে গাড়ির চাকার দাগ শুরু,  হেঁটে গেলেন সেখানে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেতেন একটা অটোরিকশার সঙ্গে। পায়ের নিচে কংক্রিটের রাস্তা দেখে চোখ চিকচিক করে উঠল তাঁর। প্রাণভরে দেখে নিলেন আশপাশে উঁচু উঁচু ভবন, রাস্তার পাশের লাইট, বড় বিলবোর্ড। স্যারের গলায় খুশির চিত্কার শুনে লাইন কেটে দিল সুমন। হাসছে সেও। তবে স্যারের মতো শর্টকাটে আপাতত ঢাকায় যাওয়ার চিন্তা করছে না সে। মায়ের কাছে কয়টা দিন থেকে যাবে। অন্যকিছু নিয়ে তার আর কোনো ভাবনা নেই তার।