বুবলি আর বাবুলের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কার বাছুর বেশি মোটাতাজা হবে সেটা নিয়ে। বুবলির বাছুরটার রং সাদা। আর বাবুলের বাছুরটার রং লাল।
দুজনকে দুটো বাছুর কিনে দিয়েছেন বাবা। তাদের ভীষণ গরু পালার শখ।
বুবলি তার বাছুরের নাম দিয়েছে হোয়াইটনি। গায়ের রং সাদা, তাই এই নামকরণ। হোয়াইটনি একটা বকনা বাছুর। তাই হোয়াইটের সঙ্গে নি যোগ করা হয়েছে।
বাবুল তার বাছুরের নাম দিয়েছে রেড বুল।
এঁড়ে বাছুর। লাল রং। তাই এই নাম বেছে নেওয়াটা সহজই ছিল।
বুবলি আর বাবুল। বুবলি পড়ে ক্লাস সিক্সে আর বাবুল পড়ে ক্লাস ফোরে। রংপুর মেডিকেল কলেজের পেছনে তাদের বাড়ি। তাদের বাবা আলমগীর সাহেব ওষুধের ব্যবসা করেন। দুটো ওষুধের দোকান আছে তাদের। বিভিন্ন হাসপাতালেও ওষুধ সরবরাহ করে তারা। বুবলি-বাবুলের মা আসমা আক্তার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি।
আলমগীর সাহেব দুই বছর বয়সী দুটো বাছুর কিনে এনেছেন নিসপেতগঞ্জ হাট থেকে।
বুবলি আর বাবলু, এই নাও তোমাদের পেট। এ দুটোকে তোমরা আদর-যত্ন দিয়ে বড় করো। দেখি কারটা বেশি মোটাতাজা হয়। যে ফার্স্ট হবে, তার জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। আলমগীর সাহেব বলেছেন।
শুনে বুবলি বলল, বাবা, তোমার আকর্ষণীয় পুরস্কারটা কী, এটা তো কখনো বলো না। সব সময় সবকিছুতে একটা করে পুরস্কার ঘোষণা করো। যে আগে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে, তার জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি কত ঘুমিয়ে পড়েছি, কই, কোনো পুরস্কার তো দাও না।
দিয়েছি মা। তুই ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তোর কপালে চুমু দিয়েছি।
না না হবে না, ভালো কিছু পুরস্কার দিতে হবে, বুবলি বলে।
শুনে মা হাসেন। বলেন, এই চুমু কি ভালো পুরস্কার না?
বাবুল বলে, না, কোনো জিনিস দিতে হবে।
বাবা বলেন, আচ্ছা, গরু মোটাতাজা করার প্রতিযোগিতায় যে ফার্স্ট হবে, সে পাবে একটা সাইকেল।
আচ্ছা কথা যেন ঠিক থাকে, উত্সাহিত হয়ে বলে বুবলি।
এরপর থেকে বাবুল আর বুবলি দুজনেই বাছুর দুটোর যত্ন নেওয়া শুরু করে।
স্কুল থেকে এসে বাবলু আর বুবলি বাছুর দুটোকে ভাতের মাড় খেতে দেয়। পানি দেয়। মাড়ের সঙ্গে দেয় চালের গুঁড়ো।
তাদের বাড়ির পেছনে একটা ঘাসের বাগান আছে। তিনটা প্লট ফাঁকা। সেই প্লট তিনটায় বড় বড় দূর্বাঘাস। বাবুল আর বুবলি সেই প্লটে বাছুর দুটোকে ছেড়ে দেয়। বাছুর দুটো গোগ্রাসে ঘাস গিলে।
গোগ্রাস মানে হলো, গরুর গ্রাস। মা বলেন। তাঁর চোখে থাকে চশমা। তিনি যে স্কুলটিচার, তা তিনি কখনো ভোলেন না।
মা আরও বলেন, গরু সামনে খাবার পেলে চিবোয় না, আগে হাপুসহুপুস করে খায়। পরে অবসর সময়ে আবার পেটের খাবার মুখে এনে চিবোয়। এটাকে বলে রোমন্থন বা জাবরকাটা।
বাছুর দুটো বড় হচ্ছে।
কোনটা বেশি বড় হলো?
বাবুল বলে, রেড বুল বেশি বড় হয়েছে।
বুবলি বলে, কক্ষনো না। আমার হোয়াইটনি বেশি বড় হচ্ছে।
এর মধ্য এসে যায় কোরবানির ঈদ। গরু দুটোকে হাটে তোলা হবে। দেখা যাক কোনটার দাম বেশি হয়।
দুই ভাইবোন খুবই উত্তেজিত। প্রতিযোগিতায় কে জিতবে দেখা যাক।
হাটবারে বাবার দোকান থেকে আনসার চাচা এলেন। গরু দুটোকে নিয়ে হাটে যাবেন তিনি।
স্কুল বন্ধ। দুপুরবেলা এসেছেন আনসার চাচা। গরু দুটোকে রাখা হয়েছে বাসার সামনে কাঁঠালগাছের ছায়ায়।
বাবুল আর বুবলি গরু দুটোর গলায় কাগজের মালা পরিয়ে দিল।
আনসার চাচা বললেন, স্যার, তাইলে আল্লাহর নামে যাই হাটত।
বাবা বললেন, যাও।
আনসার চাচা আর তাঁর সঙ্গে আরেকজন দুই গরুর দড়ি হাতে নিয়ে চলতে শুরু করলেন।
বাবুলের মনের মধ্যে মেঘ জমছে। বুবলিরও। গরু দুটোকে আদর-যত্ন করে খাইয়ে বড় করেছে তারা। এখন এ দুটোকে হাটে পাঠাতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাদের। তারা দুজনে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা, বাবা, গরু দুটোকে বেচো না। আমরা এই দুটোকে পালব। আমাদের প্রতিযোগিতার দরকার নেই। আমাদের পুরস্কার লাগবে না।
বাবা বললেন, কী বিপদ! বকনা বাছুরটাকে তবু রেখে দেওয়া যায়। আরেকটু বড় হলে দুধ দেবে। এঁড়েটাকে রেখে কী করব? ওটাকে তো বেচতেই হবে।
বাবলু বলল, না না, আমি রেড বুলকে বেচতে দেব না।
মা বললেন, আচ্ছা বাচ্চারা যখন কাঁদছে, থাকুক। আরেকটু বড় হোক। পরে দেখা যাবে।
বাবা বললেন, আচ্ছা থাক তাহলে আজকে।
এর মধ্যে বাবা যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। বাবার গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না, শুধু দাদার কবর আছে। দাদি থাকেন ঢাকায়, বড় চাচার সঙ্গে।
বাবলু আর বুবলি বলল, বাবা, আমরাও তোমার সঙ্গে যাব। গ্রাম দেখব।
বাবা বললেন, চলো।
বাসে উঠে তারা রওনা হলো গ্রামের বাড়ির দিকে। ভোরবেলা। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসবে তারা।
বাস থেকে নেমে তারা উঠল রিকশাভ্যানে।
নয়টার সময় পৌঁছাল একটা নদীর ধারে। নদীর ওই পারে দাদার গ্রাম।
ইঞ্জিন নৌকায় উঠে নদী পার হলো তারা। ১০টার মধ্যেই বুবলি বাবুলরা পৌঁছে গেল শান্তিপুর গ্রামে।
দাদার বাড়িতে বাড়ির মালিকদের কেউ থাকে না। দুজন লোক রাখা আছে, তারা বিনে পয়সায় থাকে আর ঘরদোর পাহারা দেয়।
বুবলি বাবুল আর তাদের বাবা গ্রামে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে গেল। ছোট ছোট বাচ্চারা এসে উঠানে ভিড় করে ঘিরে ধরল তাদের।
বাবা একজনকে বললেন, এই, এই দিকে আসো। তোমার নাম কী?
ফয়সল।
ফয়সল মিয়া সকালে কী খাইছ?
কিছু খাই নাই।
কিছুই খাও নাই? দুপুরে কী খাবা?
ভাত।
কী দিয়ে?
কেউ বলল শাক দিয়ে, কেউ বলল নুন দিয়ে, কেউ বলল ডাল দিয়ে, কেউ বলল মাছ দিয়ে। কেউ বলল শুধু ভাত।
বাবা বললেন, মাংস দিয়ে কেউ ভাত খাও না?
ছেলেমেয়েরা দাঁত বের করে হাসছে। তারা বলল, মাংস কোটে পামো?
তোমরা গত এক মাসে কেউ মাংস খেয়েছ?
২০ জন বাচ্চাকাচ্চার মধ্যে মাত্র একজন হাত তুলল। আমি খাইছিলাম। ফুফা আসছিল। মা মুরগি পাক করছিল।
তোমরা কখনো গরুর মাংস, খাসির মাংস খাও না?
ওরা বলে, না, খাই না। একজন বলল, কোরবানির ঈদে খাই। গ্রামে কেউ যদি কোরবানি দেয়, তাইলে বাপজান গোশত কাটার কাম করে। হাড্ডি কাটার কাম করে। তখন গোশত দেয়। হামরা খাই।
এ ছাড়া সারা বছর আর তোমরা গরুর মাংস, খাসির মাংস খাও না?
না। মাংস কোটে পামো?
রংপুরে বাসায় ফিরে এসে রাতে বাবুল আর বুবলি এই নিয়ে কথা বলল। খুব মন খারাপ হলো তাদের।
সকালে তারা বাবা আর মাকে বলল, বাবা, মা, শোনো, আমাদের রেড বুলকে আমরা কোরবানি দেব। তবে এখানে নয়। দাদার বাড়িতে। ওখানকার ছেলেমেয়েরা তাহলে মাংস পাবে।
বাবা বললেন, ভালো বলেছ।
মা বললেন, তাহলে একটা খাসিও কিনে নাও। একটা খাসি আর এই গরু। দুটোই আমরা এবার কোরবানি দেব গ্রামের বাড়িতে।
আনসার চাচা লোক ঠিক করেছেন। গরু যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। গরুকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ২৫ মাইল হাঁটবে গরুটা।
বাবুল বলল, বাবা, এত দূর হাঁটতে পারবে রেড বুল?
বাবা বললেন, তুমি একে মোটাতাজা করেছ। নিশ্চয়ই পারবে।
রেড বুল হাঁটছে না তো, দৌড়াচ্ছে। বাবুল আর বুবলি কাঁঠালগাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে রেড বুলের চলে যাওয়া দেখছে।
বাবুলের মন খারাপ। সে আস্তে আস্তে বলল, আমার কোনো কষ্ট নেই। দাদার বাড়ির ছেলেমেয়েরা যদি এক বেলাও আরাম করে মাংস খায়, ওদের যদি ভালো লাগে, তাহলেই আমি খুশি। বুবলি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
ঈদের পরে একটা সাইকেল কিনে আনলেন বাবা। বললেন, দুই ভাইবোনই জিতেছ প্রতিযোগিতায়। তোমরা দুজনেই এই সাইকেল চালাবে।
খুশিতে লাফিয়ে উঠল বাবুল আর বুবলি।
বুবলি লম্বায় বড়। সাইকেল চালানো শিখতে তার সময় লাগল না। বাবুল ছোট। সে সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে বারবার পড়ে গেল। তার হাঁটু আর কনুই ছিলে গেল।
তবে শিখেও ফেলল সে দ্রুতই। দুজনে মিলে সাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে রেড বুলের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয় বুবলি আর বাবুলের। কিন্তু পরক্ষণেই তারা যখন গ্রামের সেই শিশুগুলোর কথা ভাবে, তখন তারা সান্ত্বনা পায়।