দ্য প্ল্যান

‘বেশ, বেশ। সবকিছু পরিকল্পনামাফিকই এগোচ্ছে।’

‘ইয়ে, মানে তৃতীয় পর্যায় শুরু করতে আমাদের কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইছি।’

‘বেশ, সময়ের চেয়ে এগিয়েই আছি আমরা। ২৫ বছরের কম বয়সী সবাই আসলে ওদের খুদে ইন্দ্রিয় জগত্ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। মানে, এই দৃশ্য দেখতে বলছি তোমাকে।’

পর্দায় একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। একটা নেচার পার্কে বেশ কিছু লোক হাঁটাহাঁটি করছে। ওয়াল্ডেন পন্ড নামে একটা বন ঘিরে চলে গেছে রাস্তাটা। কয়েক ডজন মানুষের ভেতর মাত্র দুজন স্মার্টফোন বের করেনি বা কানে ইয়ারবাড গুঁজে রাখেনি। এই দুজনের একজন আবার কোনো দিকে না তাকিয়েই ছুটছে, অন্যজন একটা ধীবরের বাসা দেখতে থমকে দাঁড়াচ্ছে।

‘জানি। এমনকি প্রকৃতির কাছে আসার পরও ব্যাপারটা ওদের কাছে অপ্রাকৃতিকই থেকে যায়। স্মার্টফোনে জুুম করতে পারলে কোন দুঃখে ভালো করে একটা গাছের দিকে তাকাতে যাবে? এভাবে তো চোখের চেয়ে কেবল ভালোভাবে দেখছেই না, বরং অনায়াসে গোটা গ্রহ, ধীবর, কিংবা শাপলা ফুল সম্পর্কে সব তথ্যও “জানতে” পারছে।’

‘সেটাই কি পরিকল্পনার একটা অংশ ছিল না? প্রথমে তথ্য আর জ্ঞান এবং তারপর জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা একই ভাবতে উসকানি দেওয়া, যাতে শেষ পর্যন্ত তথ্য, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার কোনোটাই ওদের না থাকে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের মডেল বলেছিল অন্য লোকজন, সমাজ বা পরিবার নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ হতে কয়েক শতাব্দী লাগবে। এই মুহূর্তে টেক্সটিংই সবার পছন্দের কায়দা। মুখোমুখি হওয়ার মানে স্রেফ কয়েক মিনিটের জন্য ফোন থেকে চোখ সরানো, ব্যস। সেলফ ড্রাইভিং কারগুলো দুর্দান্ত প্রযুক্তি বলে ধারণা হয়েছে ওদের। ওদের জানা নেই যে ওরা এত বেশি সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে যে কয়েক সেকেন্ডের বেশি গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগই দিতে পারবে না। গাড়ি চালাতে গিয়ে টেক্সটিং করায় কয়েক মিলিয়ন লোক অক্কা পেয়েছে। কিন্তু সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি নাগালে আসার পর দুর্ঘটনার হার নেমে গেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়, কিন্তু এখন ওরা চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চোখই ফেরায় না। জানালার বদলে বসানো পর্দাই পছন্দ।’

‘সংযোগহীন। হ্যাঁ। এটা নির্ধারিত সময়ের ঢের আগে ঘটেছে। অচিরেই বাড়িতে বসে স্রেফ টেক্সটই করবে ওরা। খারাপ আবহাওয়ায় বাড়ির বাইরে পা রাখার কী দরকার? স্রেফ ফোন করলেই চলবে। বেড়াতে যেতে হবে না। আর বেড়াতে গেলেও নেটফ্লিক্স চালিয়ে দাও, নয়তো ফোন হাতেই খেতে বসো টেবিলে...কোনো খবর দেখতে হতে পারে, কিংবা ধারেকাছে নেই এমন কারও কাছে থেকে টেক্সট আসতে পারে—যাতে যারা তোমার সঙ্গে আছে, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা এড়াতে পারো। ওরা এমনভাবে সংযুক্ত যে আলো, শব্দ, আর স্বাদের ছোট্ট বর্ণালির বাস্তব পৃথিবীর কোনো দরকারই নেই ওদের।’

‘দারুণ। উন্নত দেশে এখন বাচ্চাকাচ্চা বিরল। স্রেফ বোতাম চেপেই সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়া যায়। বাইরে ঝড়ের কবলে পড়ার বদলে বরং পর্দায় ঝড়ের দৃশ্য দেখবে। বৃষ্টি কিংবা সাগরের আওয়াজের মতো শব্দগুলো বাস্তব জীবনে ছাদের বৃষ্টির ফোঁটার শব্দের মতো নাগালে থাকলেও নিজেদের পছন্দের শব্দে সেগুলো চাপা দিচ্ছে।’

‘জানি। সে জন্যই, তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলছি, এরই ভেতর তৃতীয় পর্যায় শুরু করে দিয়েছি আমরা। এত বেশি ভুয়া খবর, বেখাপ্পা কথাবার্তা ঢুকিয়ে দিয়েছি এবং ধনী ও বাকি জনগণের ভেতর ফারাক এত  বাড়িয়ে দিয়েছি, কী ঘটছে সেদিকে কারও নজরই নেই। আমরা এমনকি গ্রীষ্মেই ৪ নম্বর পর্ব শুরু করে দিতে পারি।’

তীক্ষ্ণ শ্বাস টানার শব্দ হলো।

‘বলতে চাইছ, এই শতকেই পৃথিবীর বুকে হাঁটতে পারব আমরা?’

‘তাই তো মালুম হচ্ছে। চমত্কার একটা গ্রহ আছে ওদের, কিন্তু ওরা একটা নিরাপদ, সহজ আর আরামদায়ক দুনিয়া চায়। প্রযুক্তি মারফত সেটা তাদের জুগিয়েছি আমরা। নিজেদের মাথায় ভিআর জুড়ে দেওয়ার পর আমাদের এখানে আসার কথা টেরই পাবে না ওরা। বাস্তবসংগত কারণেই পৃথিবী আমাদের হয়ে যাবে।’ মৃদু হাসি শোনা গেল দুজনের।

‘ভাবতে পারো? শিশির জড়ানো সবে ছাঁটা ঘাসে হাঁটছি। মুখ ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়ার সুবাস নিচ্ছি? তোমার হাত ধরে থাকা কারও স্পর্শ পাওয়া? রংধনু, প্রজাপতি কিংবা কোনো পাখির দিকে তাকিয়ে থাকা? ঠান্ডা ঠান্ডা বোধ হলে বা সামান্য উষ্ণতায় স্রেফ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকা?

‘হ্যাঁ, পারি। শিগগিরই আর কল্পনা থাকবে না এটা। ভালো কথা...আমাদের মন ভরে দিতে শরীরগুলো ফাঁকা করার কতটা কাছাকাছি তুমি?’

‘একদম কাছে। মানুষরা ওদের শারীরিক ইনপুট আর চিন্তাভাবনা হাতছাড়া করলেই আমাদের শরীর খোদ পৃথিবীর বুকে নামতে তৈরি হয়ে যাবে।’

‘এখনই দু-একজনকে পাঠাও, পাখির মতো দেখায় যেন। মানুষগুলো খেয়ালই করবে না। ওরা যে নজরদারি করছে, নির্ঘাত তা-ও বুঝবে না...হাজার হোক, পাখি আর কি-ই-বা জানতে পারে?’

প্রসেসরগুলো চলতে শুরু করার পরও দীর্ঘক্ষণ রয়ে গেল হাসির রেশ।

অলংকরণ: মাহাতাব রশীদ