বাংলা সাহিত্যের চেনা কজন

কিছু গল্প বা উপন্যাস আমাদের মনে ছাপ ফেলে। ভালো লেগে যায় অজান্তেই। বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক গল্প, উপন্যাস রয়েছে, যেগুলোর কিছু চরিত্র বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পাঠকদের কাছে। নিখুঁত বর্ণনা পড়ে চরিত্রগুলোর ভক্ত বনে গেছে সবাই।

চট করে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কোনো চরিত্র ভাবতে গেলে অধিকাংশ লোকের মাথায় একটা নাম সবার প্রথমে আসবে—তিনি ফেলুদা। আসল নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্তির। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সাতাশ বছর বয়সী এই যুবক পেশায় গোয়েন্দা। অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়েই রহস্য সমাধান করেন। নিজের মগজকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন বলে একে বলেন ‘মগজাস্ত্র’। মার্শাল আর্টে দক্ষ হলেও সঙ্গে রাখেন পয়েন্ট থ্রি টু কোল্টের রিভলবার। ১৯৩৭ সালে ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পে ফেলু মিত্তিরের প্রথম আবির্ভাব হয়। এরপর বিভিন্ন গল্প, উপন্যাসে ফেলুদাকে দেখা যায় পুরো ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চৌকসভাবে অনেক জটিল রহস্য সমাধান করতে। ফেলুদাকে বাঙালি গোয়েন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বলা যায়।

গোয়েন্দাদের জীবন রহস্যে ও রোমাঞ্চে ভরপুর থাকবে, তা–ই স্বাভাবিক। কিন্তু সদ্য পাস করা গ্রামে বড় হওয়া বাঙালি ছেলে কী করে আফ্রিকার গহিন অরণ্য জয় করে ফেরে, তার বর্ণনা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় উপন্যাসে। উপন্যাসের মূল চরিত্র শংকর রায় চৌধুরী বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী এক বাঙালি ছেলে। হীরক খনির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে আফ্রিকার গহিন অরণ্যে। তার আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান, ভয়ংকর প্রাণীর সঙ্গে লড়াই, নরখাদকদের হাত থেকে বেঁচে ফেরার বর্ণনা যেকোনো বাঙালিকে রোমাঞ্চে উদ্বুদ্ধ করবে। ইচ্ছে হবে এক্ষুনি পৃথিবী জয়ে বেরিয়ে পড়তে। উপন্যাসে শংকরের চোখ দিয়ে অনেকে উপলব্ধি করতে পারে গহীন অরণ্যে নিঝুম রাতের জ্যোৎস্না, সূর্যাস্তের রঙের কাছে অর্থ, গুপ্তধন—সবই মিথ্যা। 

ফেলুদা কিংবা শংকর তো সত্যিকারের অভিযানেই যায়৷ কিন্তু কলকাতার বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের একটি মেসবাড়ির ঘনশ্যাম দাশ মেসবাড়ির বাসিন্দাদের আড্ডায় শোনান দুঃসাহসিক অভিযানের বানোয়াট গল্প, যেগুলোর বেশির ভাগটারই নায়ক থাকেন তিনি নিজে। ঘনশ্যামকে মেসবাড়ির সবাই ঘনাদা বলেই চেনে। উপস্থিত বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী প্রতিভা দিয়ে কাল্পনিক ও বিভিন্ন রোমাঞ্চকর অভিযানের ঐতিহাসিক গল্প বলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ঘনাদা। প্রেমেন্দ্র মিত্র সৃষ্ট এই কাল্পনিক চরিত্রটির আত্মপ্রকাশ ‘মশা’ গল্পের মাধ্যমে হলেও পরে ঘনাদাকে নাটক, উপন্যাস ও কমিকসেও স্থান করে নিতে দেখা যায়।

বাংলা সাহিত্যের আরেক জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী। ধারালো নাক, লম্বাটে চেহারা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়েই তিনি সমাধান করেন জটিল সব রহস্য। অন্য গোয়েন্দাদের চেয়ে ব্যোমকেশ আলাদা, কারণ তিনি পুরোদস্তুর সংসারী লোক। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে তার প্রথম আবির্ভাব। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গোয়েন্দার মতো নন ব্যোমকেশ। সমাজের সমস্যা, রহস্য উদ্‌ঘাটনেই মূলত দেখা যায় এই গোয়েন্দাকে। কিন্তু তবু গল্পের কোনো অংশে রোমাঞ্চের কমতি হয় না। তার একমাত্র কারণ হলো ব্যোমকেশের রহস্য সমাধানের অভিনব কৌশল। ব্যোমকেশ বক্সীর আসল নাম যে অতুলচন্দ্র মিত্র, তা জানা যায় ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের শেষে। ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা নয়, সত্যান্বেষী বলতেই বেশি পছন্দ করেন।

আবার মধ্যবয়সী অবসরপ্রাপ্ত, শারীরিক প্রতিবন্ধী রাজা রায় চৌধুরী। ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তার এক বন্ধুকে দুর্ঘটনার কবল থেকে বাঁচাতে গিয়ে এক পা পঙ্গু হয়। তারপর থেকে ক্রাচে ভর করেই হাঁটাচলা করেন। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও রয়েছে অদম্য সাহস। এই সাহস ও নানা বিষয়ে অগাধ জ্ঞান থাকায় তিনি সহজেই সমাধান করতে পারেন জটিল সমস্যার। রাজা রায় চৌধুরী পেশাদার গোয়েন্দা নন, তিনি বিভিন্ন জায়গায় রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে সেই রহস্যের সমাধান তাকেই করতে হয়। তার দুঃসাহসিক সব অভিযানের সঙ্গী হয় ভাইপো সন্তু। সন্তুর কাকাবাবু হওয়ায় এই গোয়ন্দাকে সবাই কাকাবাবু বলেই চেনে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট এই চরিত্রকে প্রথম দেখা যায় ‘ভয়ংকর সুন্দর’ গল্পে। শুধু তরুণ গোয়েন্দা নয়, মধ্যবয়স্ক গোয়েন্দা চরিত্র যে বাংলা সাহিত্যে সমাদৃত, তা বোঝা যায় কাকাবাবুর জনপ্রিয়তা দেখে।

মাঝবয়েসী আরেক চরিত্র মিসির আলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাবনরমাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তিনি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। লম্বাটে মুখ আর উষ্কখুষ্ক চুলদাড়ি দেখে প্রথমে ভবঘুরে মনে হয়। কিছুটা আত্মভোলা, শিশুসুলভ মনোভাব তাঁর। মানুষের মন, স্বপ্ন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহের কারণে এগুলো নিয়েই গবেষণা করতে পছন্দ করেন। মিসির আলী কোনো গোয়েন্দা নন, তবে তিনি বিভিন্ন রহস্য সমাধান করেন বিজ্ঞাননির্ভর ও মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে। একাকী এই আধবয়সী লোককে প্রথম দেখা যায় বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দেবী বইটিতে।

বুড়ো চরিত্রদের নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তাহলে জেনে নেওয়া যাক এক বুড়ো বিজ্ঞানীর কথা। তিনি ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। প্রফেসর শঙ্কু বলেই চেনে সবাই। নির্লোভ, সৎ একজন বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক। মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের সব শাখায় তার অবাধ বিচরণ। পাশাপাশি তিনি একজন অভিযাত্রিকও বটে। আফ্রিকার গহিন জঙ্গল, সাগরের তলদেশ, সাহারা মরুভূমি এমনকি মঙ্গলেও পা পড়েছে এই বিজ্ঞানীর। চমৎকার সব আবিষ্কার ও দুঃসাহসিক অভিযান দিয়ে প্রফেসর শঙ্কু বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে প্রথম আবির্ভাব হয় বুড়ো এই বিজ্ঞানীর।

শুধু যে বুড়ো চরিত্রই বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়, তা নয়। কিছু খুদে চরিত্রও বেশ জনপ্রিয়। তাদের মধ্যে একজন হলো ডানপিটে দাশু। গোল গোল দুটি চোখ, কানগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বড়, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। পাগলামি আর হাস্যকর আচরণের জন্য স্কুলে সবার পরিচিত মুখ। আজ এই কাণ্ড তো কাল সেই কাণ্ড করে বেড়ানোই তার কাজ। স্কুলে পাগলা দাশু বললে চেনে না, এমন কেউ নেই। ১৯৪০ সালে সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু বইয়ে দাশুর এই সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গাত্মক কীর্তিগুলোর বর্ণনা পাওয়া যায়। দাশু সুকুমার রায়ের সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র হলেও দাশুর গল্পগুলো পড়লে সবাই তাদের স্কুলের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলেটির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলবে ঠিক।

দাশুর মতো অত না হলেও বাংলা সাহিত্যে দুটি ভাইবোন আছে বেশ ডানপিটে। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বাংলার গ্রামে বেড়ে ওঠা দুই ভাইবোন। দুর্গা বড়, অপু ছোট। কিন্তু দুজনায় বেশ ভাব। ছোট্ট অপু আর দুর্গার দুরন্তপনাই তাদের চরিত্রকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তেল দিয়ে আমের কুশি খাওয়া, আমের আঁটি দিয়ে বাঁশি বানানো, মিঠাইওয়ালার পেছনে ছোটা, কাশবনের ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়ে দূরের রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রকৃতির ছায়ায় বেড়ে উঠছিল অপু আর দুর্গা। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসের ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পরিচ্ছদে মূলত অপু ও দুর্গার দুরন্ত শৈশবের বর্ণনা পাওয়া যায়।

বাংলা সাহিত্যে রূপকথার গল্পের সমাদর ধরে রেখেছে যে দুটি চরিত্র, তারা হলো গুপি গাইন ও বাঘা বাইন৷ গুপি ও বাঘা দুজন থাকে দুই গ্রামে। দুজনই সংগীতপ্রিয় হলেও এই বিষয়ে অদক্ষ। গুপি গান গায় আর বাঘা ঢোলক বাজায়। দুজনের সংগীতপ্রীতিই তাদের একত্র করে। ভূতের বর পেয়ে তারা হয়ে ওঠে বড় সংগীতজ্ঞ। একসঙ্গে তারা গুপি গাইন ও বাঘা বাইন। যোগ দেয় শুণ্ডী রাজার সভাগায়ক হিসেবে। ভূতের বরে গান শুনিয়ে লোককে অবশ করে দেওয়ার ক্ষমতা পায় তারা। আর এই ক্ষমতাবলেই দুই রাজ্যের মধ্যকার যুদ্ধ থামিয়ে দেয় গুপি-বাঘা। গুপি ও বাঘা চরিত্র দুটি কথাসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রূপকথার গল্প ‘গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’-এ প্রথম দেখা যায়। কল্পিত চরিত্র হিসেবে গুপি ও বাঘা বাংলা সাহিত্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


বাংলা সাহিত্যে আরও অনেক জনপ্রিয় চরিত্র রয়েছে। কোনো চরিত্র পাঠকে হাসায়, কোন চরিত্র কাঁদায়। অনেকে আবার নিজেদের খুঁজে পায় কোনো একটি চরিত্রের মধ্যে।