বড়দিনের উপহার

সান্তা ক্লজ। প্রতীকী ছবি
সান্তা ক্লজ। প্রতীকী ছবি

সকাল থেকেই তাদের এই ব্যস্ততা। ফোনে জলির পাড় থেকে ওরা বলছে, এবারই কেক ও চকলেট-লজেন্সের বেশি ছড়াছড়ি। আত্মীয়স্বজনের আনাগোনাও বেশি। কান্তার এসব গল্পে মনুর মন খারাপ হয়ে যায়। গত বছরও দিনটি তার আনন্দে কেটেছে। অথচ এই প্রবাসে দিনটি তার কাছে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। কেউ এখানে তার জন্য কোনো উপহার আনেনি। যতটুকু যা, তা তার মা-বাবার কেবল। বড়দিনের রাতটা তার কাছে নিরর্থক মনে হয়। মনের কষ্ট রাখার জায়গা পায় না মনু।
রাতে তোরা কি তখন ঘুমিয়ে ছিলি? মনুর ঠোঁটটা কাঁপছে। উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে, বিছানার পাশে ওরা কি সে সব সাজিয়ে রেখে গেছে?
একেবারেই ঢিপি দেওয়া। কান্তার কণ্ঠে কোনো ওঠানামা নেই। যেন উই পোকার গড়া সমান পাহাড়। গল্পের বর্ণনার মতোই গা ছেড়ে বলে যায় সে।
আর সান্তা ক্লজ এখন আরও স্মার্ট! কণ্ঠেই যেন তার বিস্ময়।
তা কেমন?
আগে ছিল আলখাল্লা ধরনের সাধু সন্ত।
আর এখন?
একেবারে হাস্যমুখর সাদা দাঁড়ির ব্যক্তি। সাদা কলারের লাল কোট, লাল ট্রাউজার, কালো চামড়ার বেল্ট আর বুট জুতো। সবই তার চকচক করে। কান্তা দম নেয়। তারপর আবার বলে। এখন তার বহর অনেক বড়। খুব দ্রুত কাজ করে তারা।
বেশ তো!
হ্যাঁ। আসতেও সময় লাগে না বেশি। নিজের স্ত্রী সঙ্গে থাকে। এ ছাড়া আছে অনেক অনেক পরি কন্যা। তারপর ৮-৯টা উড়ন্ত বলগা হরিণ। ওরাই—যে পরি কন্যারা তার কারখানায় কাজ করে। আর বলগা হরিণ ধরে নেয় শূন্যের গাড়িগুলো। তাড়াতাড়ি এসেই তারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে যায়।

এ সব কে বলেছে তোকে?
কেন বিপুল কাকা।
বিমানে খাদ্য পরিবেশনের মতোই বুঝি।
হ্যাঁ, তাতো জানিসই। বিমানের ধারণা কান্তার নেই। তারপরও মনুর কথায় সে মাথা ঝুলিয়ে যায়।
মনু। এবারই আবুধাবিতে এসেছে। ও আর ওর মা। বাবা অনেক দিন ধরে এখানে চাকরি করে। তবে ওরা ছিল দেশে গোপালগঞ্জের গ্রামে। ওখানে ওদের যৌথ পরিবার। বিশাল বাড়ির বড় সংসারে একই বয়সের ওরা পাঁচ-ছয় ভাইবোন। প্রতি বছর ওখানে বড়দিন উদ্‌যাপন করা হয়। ওরা এ দিনের অনুষ্ঠানে অনেক মজা করে।
পাশের গ্রামই কালিয়ার চর। সেখানে আছে বিখ্যাত এক গির্জা। অনেক মানুষ আসে চারপাশের এলাকা থেকে। তারা আলোচনা করে যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে। ছোটদের জন্যও বসে গানের আসর। ওরা গান গায়। কখনো সমবেত কণ্ঠে, কখনো বা এককভাবে।
খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্ট জন্ম নেন ২৫ ডিসেম্বর। ফিলিস্তিনের বেথলেহেম এ জন্যই তীর্থস্থান। তার ব্রত ছিল সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রচার করা। মানব জাতিকে সত্য আর ন্যায়ের পথে পরিচালনা করতে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন। সেই সবই ছিল তাদের গানের কথায়। আর মনু যে নাচটি করে সেটা এই মহাপুরুষ যিশুকে স্বাগত জানাতে। অনুষ্ঠানে আরও ছিল বাংলার মাটি, জল ও প্রকৃতি পুণ্যময় হোক—এই প্রার্থনা।
ক্রিসমাস ট্রিটা বেশ সাজিয়েছিলি না? মনু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে।
অনেক বড় একটা ট্রি আনা হয়েছে গির্জায়। অন্যদিকে আমাদের বাড়িরটাও কম সুন্দর না! ওপারে কান্তা ফোনে অনেক মনোযোগী তখন।

বলগা হরিণ। প্রতীকী ছবি
বলগা হরিণ। প্রতীকী ছবি


বিদ্যুতের আলোতে জ্বলজ্বল করছিল, না? মনু যেন সেই ছবি দেখতে পায় সামনে। আলপনাটাও জীবন্ত মনে হচ্ছিল। সাজু, বেনু—ওরাও এসেছে।
খেলার সাথিদের কে না জানতে চায়! যেন পুরো বাংলাদেশের খবর জানা হয়ে যায় মনুর। এখন আমার কান্না পাচ্ছে। মনু আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
মন খারাপ করিস না। কান্তা সান্ত্বনা দিতে চায়।
কিরে কি হলো? টেলিফোনের সংলাপে মনু আর কান্তার মাঝে এসে যায় বিপুল কাকা।
কাকা! দুঃখ ও শঙ্কা মনুর কণ্ঠে।
নারে বাবা, কষ্টের কিছু নেই। বিপুল কাকা এমন আদরমাখা কথাই বলেন। তোমার জন্য সুখবর। আগামী ৬ জানুয়ারিতে তুমি তোমার বড় দিনের উপহার পেয়ে যাচ্ছ।
কীভাবে?
গ্রিকদের বেলায় ওটাই বড়দিন।
সত্যি বলছ তো?
গ্রিসে আমি কেবলই কথা বললাম। সান্তা ক্লজ আবুধাবিতে তোমার ঠিকানা জানত না। তোমার লিপু কাকা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা এখন ওখানকার পার্বত্য অঞ্চলে থাকে।
তাহলে এবার একটা ক্রিসমাস ট্রি করব। মনুর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।
সারা বিশ্বের দুষ্টু ও লক্ষ্মী ছেলেমেয়েদের তালিকা নিয়েও কথা হয়েছে তার। তোমার নাম লক্ষ্মী মেয়েদের দলে। একটু ধৈর্য ধর। আর কয়টা দিনই বা! বিপুল কাকা থামে।
মনুর চোখেমুখে তখন আলোর হাসি।
কাকা! আবুধাবির পাড় থেকে আনন্দে চিৎকার করে সে। সে আনন্দ বড় দিনের উপহার পাওয়ার।
(লেখক সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিপ্রবাসী)