মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা

Logo Madak ke na Final 01 Outline copy
Logo Madak ke na Final 01 Outline copy

প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের উদ্যোগে গত ২১ ডিসেম্বর বিকেল চারটায় মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তার ১১২তম আয়োজনটি হয় ঢাকার ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে। এতে মাদকাসক্ত রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মোহিত কামাল, শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. জোবায়ের মিয়া ও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি পুনর্বাসনকেন্দ্রের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ফেরদৌস ফয়সাল। সে অনুষ্ঠানের প্রশ্ন ও উত্তরের কিছু অংশ এখানে ছাপা হলো। সামাজিক কারণে প্রশ্নকর্তার নাম ও পরিচয় এখানে ছাপা হলো না।

প্রশ্ন: আমার ছেলে প্রায় সাত বছর ধরে ফেনসিডিল পান করে। কীভাবে এ নেশা থেকে মুক্ত করতে পারব?

সে একা ফেনসিডিল ছাড়তে পারবে না। কেউ দীর্ঘদিন কোনো মাদক নিতে থাকলে নিজে নিজে ছাড়তে সমস্যা হয়। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে আনতে হবে। তার শরীরের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক ওষুধ দেবেন। শারীরিক-মানসিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করবেন। চিকিৎসকের নির্দেশমতো চললে দ্রুত ভালো হবে। সরকারি হাসপাতাল বা কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি পুনর্বাসনকেন্দ্রে যেতে পারেন। জাতীয় মানসিক হাসপাতালে এলে আমরা তার চিকিৎসা করতে পারব। খরচও বেশি হবে না। মাত্র ১০ টাকায় টিকিট করে বহির্বিভাগে দেখাতে পারেন।

প্রশ্ন: আমার ছেলে ফেনসিডিল পান করে। কী কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: ফেনসিডিল পানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। ১. শারীরিক, ২. মানসিক, ৩. সামাজিক ও ৪. মূল্যবোধের সমস্যা। ফেনসিডিলের মধ্যে একধরনের রাসায়নিক এজেন্ট থাকে। এটা শরীরকে অসাড় করে দেয়। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ তৈরি করে। রক্তের চাপকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিশোরদের ক্ষেত্রে ফেনসিডিল চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের প্রজননক্ষমতার বিকাশকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যৌন দুর্বলতা দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। নারীদের সন্তান উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। গর্ভবতী মায়েদের বাচ্চার ক্ষতি হয়। নারীদের অন্যান্য স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়। ফেনসিডিলে কিডনির ক্ষতি হয়। যারা ফেনসিডিল গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হয়। সন্দেহপ্রবণতা বাড়ে। সন্দেহের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়। মাদক গ্রহণ করলে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়। ঘুমের সমস্যা হয়। খাবারের প্রতি রুচি নষ্ট হয়। দিন দিন শরীর দুর্বল হতে থাকে। তাদের কোনো নীতি বা নৈতিকতা থাকে না। সামাজিক মূল্যবোধ থাকে না। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা নষ্ট হয়। ফলে কোনো অবস্থাতে ফেনসিডিলসহ কোনো প্রকার মাদক গ্রহণ করা যাবে না।

প্রশ্ন: আমার ছেলে প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। দিনে ঘুমায়। সে অনেক বছর ধরে মাদক নিচ্ছে। প্রচুর বমি করে। মনে হয় ঘুমের বড়ি খায়। বয়স ২৪। এ ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ কী?

উত্তর: মাদকাসক্তির সঙ্গে তাঁর মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। অনেকের এ দুটি সমস্যা একসঙ্গে থাকে। এমন ক্ষেত্রে প্রথমে মনোরোগের চিকিৎসা করতে হবে। পরে মাদকের চিকিৎসা। কালক্ষেপণ না করে তাঁকে কোনো ভালো চিকিৎসকের কাছে আনুন। নিজেরা চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন না। কারও যখন কোনো বড় অসুখ হয়, তখন নিশ্চয়ই নিজে চিকিৎসা করি না। কোনো না কোনো ভালো চিকিৎসকের কাছে যাই। অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে আনুন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ যেকোনো সরকারি হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যান।

প্রশ্ন: আমার ভাইয়ের বয়স ৩২ বছর। সীমান্ত এলাকায় থাকেন। সব ধরনের মাদক গ্রহণ করেন। তাঁকে দুই বছর আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁর জন্য কী করতে পারি?

উত্তর: সীমান্ত জেলায় ও এর আশপাশের এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। প্রায় সব ধরনের মাদক সেখানে পাওয়া যায়। কেউ একবার মাদকের ওপর নির্ভরশীল হলে নিজ থেকে ভালো হওয়া কঠিন। তাঁকে কোনো নিরাময়কেন্দ্রে আনতে হয়। ঘরে বন্দী করে রাখা ঠিক হয়নি। কাউকে বন্দী করে রাখা কোনো সমাধান নয়।

তাঁকে যখন কোনোভাবেই মাদক থেকে ফেরানো যাচ্ছে না, তখন ভালো হতো কোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করালে। ঘরে থাকার জন্য তাঁর শরীর ও মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তাঁর মনমানসিকতা বিষণ্ন থাকবে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন হবে। চিকিৎসক পরামর্শ দিলে তাঁকে নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করতে হবে। তাঁর পরিপূর্ণ চিকিৎসা করতে হবে। অনেকে চিকিৎসা শেষ না করে মাঝপথে চলে যান। যে কারণে আবার মাদকাসক্ত হন। চিকিৎসার পর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে তিনি মাদকমুক্ত হবেন। তিনি যেহেতু দুই বছর ঘরে বন্দী আছেন। তাই তাঁর মানসিক সমস্যা আছে বলে মনে হয়। তাঁকে মনোরোগ চিকিৎসকও দেখাতে হবে।

প্রশ্ন: আমার ছেলে ১২ বছর ধরে গাঁজা খায়। এখন অনেকটা সেরে উঠেছে। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু মনে রাখতে পারছে না। তা ছাড়া কোনো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ নেই।

উত্তর: গাঁজার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান আছে। গাঁজার ধোঁয়া প্রথমে ফুসফুসে যায়। এরপর রক্ত ও মাথার মধ্য দিয়ে কোষে ঢোকে। গাঁজার মধ্যে এমন একটি বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য আছে, এটা একবার স্নায়ুকোষের মধ্যে ঢুকলে প্রায় এক বছর থাকে এবং বিভিন্নভাবে শরীরের ক্ষতি করতে থাকে। ঘুম হয় না। মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। কোনো কিছুতে একাগ্রতা নষ্ট হয়। কোনো কিছু মনে থাকে না। যেকোনো বিষয় একটু পরে ভুলে যায়। যৌন সমস্যা দেখা দেয়। আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। স্ত্রী ও অন্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সন্দেহপ্রবণতা বাড়তে থাকে। গাঁজাকে কোনোভাবে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য গাঁজা থেকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। শরীরকে গাঁজার প্রতিক্রিয়ামুক্ত করতে হবে। তাই গাঁজা একটি বিপজ্জনক মাদক। গাঁজা সেবন থেকে মুক্ত থাকার চিকিৎসা আছে। দ্রুত কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন: আমার ছেলে অনেক বছর ধরে মাদকাসক্ত। চিকিৎসা করা হয়েছে। এখন ভালো আছে। কিন্তু ঘুম হয় না। কী করতে পারি?

উত্তর: আপনার ছেলের মধ্যে এখনো মাদকের প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তাঁকে কোনো মাদক বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। শরীরের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে হয় খুব বেশি সমস্যা তাঁর নেই। ঘুম হচ্ছে না। চিকিৎসক তাঁকে দেখে কিছু ওষুধপথ্য দেবেন। সেটা খেলে আশা করা যায় ঠিক হবেন। আপনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আপনার সন্তানকে আনতে পারেন। এখানে বহির্বিভাগে ১০ টাকায় টিকিট নিয়ে দেখানো যায়।

প্রশ্ন: আমার সন্তানের বয়স ১৬ বছর। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাদক গ্রহণ করে। বন্ধুদের বাসায় ডেকে আনে। তাদের নিয়ে বাসায় মাদক গ্রহণ করে। এ অবস্থায় কী করতে পারি?

উত্তর: আপনার সন্তানের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। তার প্রশ্নে ইতিবাচক উত্তর দিন। সে হয়তো বলবে মাদক খাই না। তার সঙ্গে তর্কে যাওয়া যাবে না। তাকে তার কথা বলতে দিতে হবে। মাদক গ্রহণের কথা সে কখনো স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু যদি তার সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যেতে পারেন, তার বন্ধু হতে পারেন, ভালোভাবে বোঝাতে পারেন, তাহলে মাদক খাওয়ার কথা স্বীকার করবে। স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। চিকিৎসক তার অবস্থা বুঝে ভর্তি হতে বলবেন। অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে ওষুধ দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে বলবেন। অবস্থা যা–ই হোক, আর দেরি করা যাবে না। তাকে এখনই ভালো কোনো চিকিৎসকের কাছে আনুন।
তা না হলে সে আরও বিপদের দিকে চলে যাবে।

গ্রন্থনা: শিফা আকতার

প্রিন্ট সংস্করণে (অধুনা) ছাপা ১৫ জানুয়ারি, ২০২০