ইতিহাসের উত্তাল পথ পরিক্রমার ছবি

ছবির দৃশ্য
ছবির দৃশ্য

ইন্দো-কানাডীয় নির্মাতা দীপা মেহ্তার চলচ্চিত্র মিডনাইটস চিলড্রেন প্রদর্শিত হলো টরন্টোতে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা (৮ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর) রেট্রোস্পেকটিভ হ্যাভেন অন আর্থের সর্বশেষ দিন। টিফ সিনেমাথেকের এই আয়োজনে পরিচালক দীপা মেহ্তার ৯টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া বিশেষ সম্মানজনক স্যালুট প্রদান করা হয় তাকে।
মিডনাইটস চিলড্রেনের প্রিমিয়ার হয় ২০১২ সালের টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের গালা প্রেজেন্টেশনে। এ ছাড়াও এটি লন্ডন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও ভ্যাঙ্কুভার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়।
মিডনাইটস চিলড্রেন চলচ্চিত্রটি নানান কারণে আলোচনায় আসে। এটি বহুল আলোচিত লেখক সালমান রুশদির বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত জাদু-বাস্তব এপিকধর্মী উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন অবলম্বনে নির্মিত। চিত্রনাট্যকার সালমান রুশদি নিজে। দীপা মেহ্তার এলিমেন্টস ট্রিলজির সর্বশেষ চলচ্চিত্র ওয়াটারের শুটিং হিন্দু মৌলবাদীদের প্রতিরোধের মুখে মাঝপথে ভারতের বেনারস থেকে গুটিয়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে করতে হয়। এই ম্যুভিটির শুটিংও ভারতের মুম্বাইতে করলে হিন্দু মৌলবাদী ও পাকিস্তানে করলে মুসলিম মৌলবাদীদের প্রতিরোধের আশঙ্কায় শ্রীলঙ্কায় সম্পন্ন হয়। ওয়াটারের মতোই ভিন্ন নামে ও অনেক ধরনের সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করতে হয়। মাঝে ইরানের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আপত্তি উত্থাপিত হলে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপে সম্ভব হয় শুটিং শেষ করা।

ছবির দৃশ্য
ছবির দৃশ্য

চলচ্চিত্র ও উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেনে তুলে ধরা হয়েছে ৬০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী ভারত-পাকিস্তানের প্রচণ্ড উত্তাল ও অশান্ত ইতিহাসকে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে ৭০ দশকের শেষার্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালের জরুরি অবস্থা জারি পর্যন্ত ইতিহাসের নানান বাঁক তুলে ধরা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়কাল কাশ্মীর, আগ্রা, মুম্বাই ও করাচিতে ছড়িয়ে থাকা একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম বংশের পাঁচটি প্রজন্মকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে সেটিও উঠে এসেছে। মিডনাইটস চিলড্রেনে আমরা একসঙ্গে পেয়ে যাই ডিকেন্স, কিপলিং ও শেক্‌সপিয়ারকে; খ্রিষ্ট, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মকে; কমেডি, ট্র্যাজেডি ও প্রহসনকে। আর সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে পাই মুসলমানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৪৭-এর ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ভারত-পাকিস্তান ভাগকে। উপন্যাসের মতো চলচ্চিত্রটিতেও নানান সীমানা, জেনারেশন, যুদ্ধ ও শান্তির গল্প আবর্তিত হয়েছে ভারতের ইতিহাসের উত্তাল পথ পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে।
মিডনাইটস চিলড্রেনের মূল গল্প আবর্তিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ব্রিটেনের কাছে থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মুহূর্তে জন্ম নেওয়া দুই সন্তানের ভাগ্য বা নিয়তিকে ঘিরে।

ছবির পোস্টার
ছবির পোস্টার

জাদু-বাস্তব এই উপন্যাসে নিজ দেশের স্বাধীন হওয়ার রাতে জন্ম নেওয়া এই শিশুরা নানান অতিলৌকিক বিশেষত্ব সম্পন্ন হয়, তাদের কেউ কেউ উড়তে পারে, অদৃশ্য থাকতে পারে, জাদু করার ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কিংবা রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর যে শিশুরা একেবারে মধ্যরাতের ক্ষণে জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে এই ক্ষমতা আরও বেশি থাকে। মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালের নার্স স্বাধীনতার ক্ষণে জন্ম নেওয়া এক জোড়া শিশুকে বদলে দেয় তাদের বাবা মায়ের কাছে। ধনীর ঘরের সন্তানকে বদলে তার পিতামাতাকে দেওয়া হয় অতি দরিদ্র ঘরের সন্তানকে। আর দরিদ্র সন্তানটিকে দেওয়া হয় ধনী পিতামাতার কাছে। পরবর্তীতে টেলিপ্যাথিক ও অতিলৌকিক যোগে এই দুই শিশুর জীবন নানাভাবে একের সঙ্গে অন্যের যুক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই না, এই দুই শিশুই আবার নানানভাবে জড়িয়ে পড়ে তাদের নিজ নিজ দেশের (ভারত ও পাকিস্তান) বিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে।
চলচ্চিত্র সমালোচক লিন্ডা বার্নার্ড বলেছেন, দীপা মেহ্তা একটি এপিক নির্মাণ করেছেন যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। এর বুননে আছে রাজনীতি, বর্ণিল দ্যুতি, রোম্যান্টিক ভালোবাসা ও জাদু। এটিই তার অদ্যাবধি নির্মিত সব থেকে উচ্চাভিলাষী চলচ্চিত্র। তবে মিডনাইটস চিলড্রেন নিয়ে একটি সাধারণ ক্রিটিক হচ্ছে, দীপা মেহ্তার কাজটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হলেও শেষ বিচারে এটি পুরো গল্পটিকে একটি সংগতিপূর্ণ ও সমন্বিত রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতের ইতিহাসের পথ পরিক্রমার একপর্যায়ে অনিবার্যভাবেই চলে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও। একাত্তরে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, স্লোগানরত জনতা, মিত্রবাহিনী, পোস্টার-ব্যানারে জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে দেখতে পাওয়া যেন দর্শক হিসেবে আমার জন্য ছিল বিশেষ পাওয়া।