ওয়ার্ক পারমিট ভিসার নামে প্রতারণার শিকার অনেক বাংলাদেশি

প্রতিবছরই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ইউরোপে পাড়ি জমান। মূলত উন্নত জীবনের আশায় এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অভিবাসনের লক্ষ্যে ইউরোপকে অগ্রাধিকার দেন। তবে আমরা সাধারণভাবে ইউরোপকে যেভাবে বিবেচনা করি, বাস্তবতা তার তুলনায় একেবারে আলাদা।

আমাদের কখনো ভুলে গেলে চলবে না ইউরোপের সীমানা কেবল জার্মানি, ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন,  নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম কিংবা লুক্সেমবার্গের মতো কয়েকটি উন্নত দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একবিংশ শতাব্দীর এ যুগেও ইউরোপে এমন  অনেক দেশ রয়েছে যেগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এমনকি সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও সেসব দেশ বেশ পশ্চাৎপদ।

পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় জীবনযাত্রার মান ও গড় আয়ের দিক থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অনেক পিছিয়ে। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের মধ্যে সীমারেখা টানা হয় গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিরাজমান সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে।

ইউরোপের পূর্ব প্রান্তের দেশগুলোতে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল।

অন্যদিকে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতি-নির্ভর শাসন কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও ভৌগোলিকভাবে গ্রিস দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ, তবুও গ্রিসকে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ হিসেবে গণ্য করা হয় না। কেননা, গ্রিসে কখনো সমাজতান্ত্রিক শাসন ছিল না।

বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া ভৌগোলিকভাবে পূর্ব-ইউরোপের দেশ না হলেও একসময় এসব দেশ প্রত্যক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনে থাকায় এ দেশগুলোকে পূর্ব ইউরোপের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এখনো সেভাবে আমাদের দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পায়নি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখানকার দেশগুলোতে ওয়ার্ক পারমিট ক্যাটাগরিতে ভিসার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি ও কিছু এজেন্সি। একই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ফেক ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু।

অনেকের অভিযোগ, ওয়ার্ক পারমিটের কথা বলে কিছু এজেন্সি যে ধরনের ডকুমেন্ট তাদের দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দূতাবাসে ফাইল জমা দেওয়ার পর সেসব ডকুমেন্ট ভুয়া হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। ফলে তাঁদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, একই ধরনের ওয়ার্ক পারমিটের ডকুমেন্টে নাম ও অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে একাধিক ব্যক্তির কাছে দেয় বিভিন্ন এজেন্সি।

কারও কারও অভিযোগ, অনেক সময় দেখা যায় কাগজে-কলমে বা ওয়েবসাইটে কিছু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভিসা পাওয়ার পর শ্রমিকেরা যখন এসব দেশে যাচ্ছেন, তখন অনেক ক্ষেত্রে সেসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই পরবর্তী সময়ে টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিটের আবেদন করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন অনেকে। বৈধ ভিসা নিয়ে ইউরোপে এলেও অনেকে পরে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন।

কারও আবার অভিযোগ, এজেন্সিগুলো তাঁদের যে ধরনের বেতনকাঠামোর কথা এসব দেশে পাঠাচ্ছে, কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, তাঁদের কাজের বেতন আরও কম। এ ছাড়া ট্যাক্সের একটি বিষয় রয়েছে, মূল বেতন থেকে ট্যাক্সের অংশ কর্তন করার পর তাঁদের কাছে যে বেতন জমা হচ্ছে, তা পরিমাণগত দিক থেকে বেশ কম। তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কেও অনেকে আগে থেকেই খুব একটা ওয়াকিবহাল নন।
গড় হিসাবে পূর্ব ইউরোপের এসব দেশের সাধারণ মানুষের আয় প্রতি মাসে ২৫০ থেকে ৪৫০ ইউরোর কাছাকাছি। কোনো কোনো দেশে সাধারণ মানুষের আয় ২০০ ইউরোরও নিচে। কোনো কোনো দেশে অবশ্য মাসিক ৫০০ ইউরোর ওপরে বেতনকাঠামো রয়েছে।

সঠিক তথ্যের অভাবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অনেক সময় নানা ধরনের বিভ্রান্তির শিকার হন। অথচ আগে থেকে যদি কারও এ বিষয়ে যথার্থ ধারণা থাকে, তাহলে এসব সমস্যা থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সত্যিকার অর্থে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) বাইরের দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য কাজের সুযোগ কতটুকু? এমন প্রশ্নের উত্তরে হাঙ্গেরির ইউনিভার্সিটি অব পেচের জিওগ্রাফি শিক্ষক ড. আন্দ্রাস ট্রচসচায়ানি জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে মজুরির পরিমাণ অনেক বেশি। আন্দ্রাস বলেন, হাঙ্গেরি তথা পূর্ব ইউরোপের একটি দেশে কোনো কাজের জন্য যে পরিমাণ বেতন দেওয়া হয়, জার্মানি কিংবা অস্ট্রিয়াসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে ওই একই কাজ করলে কমপক্ষে দ্বিগুণ বেতন পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। তবে আয় অনুপাতে এসব দেশে ব্যয়ের পরিমাণ দিনে দিনে বেড় যাচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অতি রক্ষণশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ। এ কারণে আমরা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় বিশাল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ছি—উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, সার্বিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে প্রতিবছর অনেকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স, ইতালিসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমান। ফলে এসব দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাঁর মতে, ‘বিশেষ করে নির্মাণ বা কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। এসব কাজের ক্ষেত্রে তেমন একটা দক্ষতার প্রয়োজন নেই, শুধু শারীরিক শক্তির প্রয়োজন।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ নিজ দেশে এসব কাজে আগ্রহ দেখান না, অথচ আমাদের দেশ থেকে যখন তাঁরা যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমান, তাঁদের অনেকে এসব কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ কারণে আপনি দেখবেন পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে কাজ করা অদক্ষ শ্রমিকদের বেশির ভাগ রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপের দেশের নাগরিক। যেসব কাজে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আগ্রহ দেখান না, যেমন নির্মাণকাজ বা কৃষিকাজ অথবা একেবারে সাধারণ মানের যেসব কাজ রয়েছে, সে সব কাজের জন্য ইইউর বাইরের দেশগুলো থেকে জনশক্তি আমদানি করে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি। এসব কাজে বেতনও তেমন বেশি নয়। অন্য যেকোনো কাজের তুলনায় এসব কাজে বেতনের পরিমাণ খুবই কম।

সাইপ্রাসপ্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মাহাফুজুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘অতীতে বাংলাদেশ থেকে অনেকে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় সাইপ্রাসে এসেছেন। মূলত কৃষি খামার এবং একই সঙ্গে বাসাবাড়ির কাজের জন্যও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সাইপ্রাসে এসেছিলেন। এসব কাজে শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ইউরোপিয়ান বা আফ্রিকানদের মতো আমরা শারীরিকভাবে তেমন একটা শক্তিশালী নই। তাই খুব বেশি বাংলাদেশি এসব কাজে বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এজেন্সিগুলো যে ধরনের ওয়ার্ক পারমিটের কথা বলে সেগুলোর বেশির ভাগই নামেমাত্র ওয়ার্ক পারমিট। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলো কৃষি খামারের মালিকদের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করে যে তাদের কিছু লোক ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় সাইপ্রাসে আসবেন এবং সেখানে পৌঁছানোর পরে তাঁরা মালিকের কাছ থেকে রিলিজ নিয়ে নেবেন।’

তাঁর মতে, এ ধরনের চুক্তির জন্য এজেন্সিগুলো কৃষি খামারের মালিকদের প্রায় দুই থেকে তিন হাজার ইউরো দেন। অথচ এজেন্সিগুলো তাদের ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট ভিসার কথা বলে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। তিনি জানিয়েছেন, সাইপ্রাসে আসার পর প্রথম এক বছরের মধ্যে যদি কেউ অন্য কোনো মালিকের সন্ধান পান, তখন তিনি তাঁর মাধ্যমে ভিসা ট্রান্সফার করতে পারেন। তবে এই এক বছর তাঁকে ১৬০০ ইউরোর ইনস্যুরেন্স চালাতে হয়। আর যদি কোনো কারণে তিনি মালিক খুঁজে না পান কিংবা এ ১৬০০ ইউরোর ইনস্যুরেন্স চালাতে না পারেন, তাহলে তিনি নতুন করে রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারেন না। তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হয়। যদিও বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন সাইপ্রাসের আদালতে তেমন একটা গৃহীত হয় না। সাইপ্রাসে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় এসে ভিসা কনটিনিউ রাখতে পেরেছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা পুরো সাইপ্রাসে ৫০ জনও পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন শিক্ষার্থী মাহাফুজুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তাই আমি এ ধরনের নামমাত্র ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় কাউকে সাইপ্রাসে না আসার জন্য অনুরোধ করছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি জানিয়েছেন, তিনি কয়েক মাস আগে ঢাকার এক এজেন্সির মাধ্যমে সার্বিয়ায় ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন। এজেন্সি থেকে তাঁকে জানানো হয়, সার্বিয়াতে পৌঁছানোর পর আরব আমিরাতের মতো ভিসার ক্যাটাগরি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। এজেন্সি মূলত সার্বিয়ার একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানি থেকে ইনভাইটেশন লেটার নিয়ে তাঁকে ডি ক্যাটাগরিতে তাঁর জন্য ভিসার আবেদন করেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ভিসা নিয়ে বাইরে ফ্লাই করার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে, এমনকি এ ধরনের ভিসায় সহজে ম্যানপাওয়ারের জন্য আবেদন করা যায় না। এজেন্সিগুলো এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে সার্বিয়াতে ফ্লাই করায়। তিনি আরও বলেন, ‘এজেন্সি আমাকে বলেছিল সার্বিয়াতে পৌঁছানোর পর তারা আমার জন্য সে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে, সেখানে প্রতি মাসে আমার বেতন হবে ৫৭০ ইউরো। কিন্তু এখানে আসার পর দেখি বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি সার্বিয়া যে ইইউভুক্ত দেশ নয়, সেটাও আমি আগে জানতাম না। তাই এখন চিন্তা করছি অবৈধ পথে প্রথমে রোমানিয়া যাব এবং সেখান থেকে হাঙ্গেরির সীমানা পাড়ি দিয়ে চেষ্টা করব ইতালি বা ফ্রান্সের দিকে চলে যেতে।’

ক্রোয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি উল্লাহ আহম্মেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ক্রোয়েশিয়া সরকারের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ফলে আমাদের দেশ থেকে সম্প্রতি অনেকে কন্সট্রাকশনসহ বেশ কিছু খাতে এ দেশে আসার সুযোগ পেয়েছেন। তবে আশানুরূপভাবে কর্মদক্ষতা না থাকায় অনেক কোম্পানি তাঁদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বাংলাদেশি সেনজেনভুক্ত কোনো দেশে অনুপ্রবেশের রুট হিসেবে ক্রোয়েশিয়াকে বেছে নিচ্ছেন। তাই ক্রোয়েশিয়াতে আসতে না আসতে তাঁদের সবার লক্ষ্য হয়ে ওঠে কীভাবে সীমানা পাড়ি দিয়ে স্লোভেনিয়া কিংবা হাঙ্গেরির ভেতর দিয়ে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন কিংবা পর্তুগালে চলে যাওয়া যায়। অনেকে এ যাত্রায় সফল হন, অনেকে আবার পুলিশের হাতে আটক হন’, যোগ করেন তিনি। তাঁর মতে, ‘আমাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা থাকলে ক্রোয়েশিয়ায় আমাদের সব সম্ভাবনার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।’

রোমানিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আরফান হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে অনেকে কাজের ভিসায় রোমানিয়াতে এসেছেন। মূলত কৃষি খামার বা নির্মাণকাজের শ্রমিক হিসেবে তাঁরা রোমানিয়ায় এসেছেন। এ ছাড়া ওয়েলডিং থেকে শুরু করে প্লাম্বিং কিংবা ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য রোমানিয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করার জন্য রোমানিয়ার সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছে। তবে আমাদের দেশের মানুষ এসব কাজে তেমন একটা দক্ষ নন। তাই রোমানিয়াতে আসতে না আসতে কয়েক মাসের মধ্যে তাঁদের অনেকে এসব কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়াও অনেকে সেনজেনভুক্ত কোনো দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের রুট হিসেবে রোমানিয়াকে বেছে নিচ্ছেন। তাই রোমানিয়াতে আসার পর অনেকের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে কোনোভাবে সীমানা পাড়ি দিয়ে হাঙ্গেরিতে যাওয়া এবং সেখান থেকে সেনজেনভুক্ত অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়া। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে তিমিশোয়ারা কিংবা আরাদের চেক পয়েন্টে অনেক বাংলাদেশি রোমানিয়া কিংবা হাঙ্গেরির পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

অনুপম দেব কানুনগো, একজন সাংবাদিক যিনি বর্তমানে ডয়েচে ভেলেতে কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ইউরোপের বাজারে ইইউর বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদের এখন আর কাজের সুযোগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা, অভিজ্ঞতা বা উচ্চশিক্ষা থাকলে বৈধ পথে দক্ষ কর্মীরা পশ্চিম ইউরোপের নানা দেশে বেশ সহজেই আসতে পারেন। বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিকদের বেশির ভাগই এই তথ্য জানেন না। তাঁরা তথ্য পেয়ে থাকেন দালালদের মাধ্যমে এবং স্বপ্ন দেখে থাকেন অতীতে ইউরোপে যাওয়া স্থানীয় এবং স্বজনদের মাধ্যমে। ফলে তাঁদের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয় যে অবৈধ পথে কোনোভাবে ইউরোপ পৌঁছাতে পারলেই তাঁদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে যাবে। কিন্তু এ ধারণা যে কতটা ভুল, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দেশ যেমন বসনিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, লিবিয়া, মরক্কো প্রভৃতিতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। মাসের পর মাস জঙ্গলে-পাহাড়ে পুলিশের তাড়া খেয়ে কাটিয়ে তাঁরা ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। ‘গেম মারার’ সময় সীমান্ত পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, এমন অনেকের সঙ্গেও দেখা হয়েছে।

অথচ এই কষ্টের রাস্তাতেই তাঁদের খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এই টাকা খরচ করে দেশেই আয় করা সম্ভব। এমনকি কারিগরি দক্ষতা অর্জন করে বৈধ পথে আসার চেষ্টাও সম্ভব। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন কাজ করে এখন ইউরোপ ঢোকার চেষ্টা করছেন। সেটিও সেই ইউরোপের ‘অলীক স্বপ্নের’ কারণেই। যাঁরা আটকা পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন যে কতটা ভুল তাঁরা করেছেন। কিন্তু এত টাকা খরচ করার পর খালি হাতে দেশে ফিরলে তাঁদের পরিবারকে পথে বসতে হতে পারে। ফলে এটা একটা দুষ্ট চক্রে পরিণত হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও লন্ডন ১৯৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা উজ্জ্বল দাশ বলেছেন, ‘পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে এসব দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকারের উচিত এসব দেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার মতো জিটুজি পদ্ধতি অনুসরণ করা। জিটুজি পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে অনেকটা স্বচ্ছভাবে এসব দেশে শ্রমিক রপ্তানি করা সম্ভব হবে এবং এজেন্সিসহ বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ম্যও কমে আসবে। এ ছাড়া সেনজেনভুক্ত কোনো দেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের জন্য অনেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছেন এ ধরনের যে অভিযোগ রয়েছে সেটাও অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে, যদি আমাদের সরকার ও দূতাবাস এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক ও ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ আল আমিন বলেছেন, ‘বাইরের দেশগুলোতে যত অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৈধ উপায়ে আমাদের বিদেশ গমনের পথ তত সংকুচিত হয়ে পড়বে। ড. আল আমিন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইতালি, ফ্রান্স কিংবা স্পেনসহ ইউরোপের অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে অনেকে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকাও খরচ করেন। এ বিশাল অঙ্কের টাকা বাংলাদেশে চাইলে যে কেউ কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন। উন্নত জীবনের আশায় তাঁরা ইউরোপে পাড়ি জমান কিন্তু সেই জীবনকে পরবর্তী সময়ে আর উপভোগ্য করে তোলা সম্ভব হয় না। তাঁর সব স্বপ্ন বেদনার নীল রঙে আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। ইউরোপে আসার পর তাঁর জীবনের প্রথম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে বৈধতা অর্জন করা কিন্তু সে বৈধতা অর্জন করতে অনেক ক্ষেত্রে একজন মানুষের কয়েক বছর লেগে যায়। এমন অনেককে আমি দেখেছি, যাঁরা একটানা ১০ থেকে ১২ বছর সে দেশে বসবাস করার পরেও বৈধতা লাভ করতে পারেননি।’ তিনি বলেন, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একটা দেশে এত লম্বা সময় বসবাস করাটা একটি বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অনেকে মানসিক চাপে পর্যুদস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো রাস্তাও বেছে নেন কোনো কোনো সময়। তাই তিনি সবাইকে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশে যাওয়ার পথ পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।’

আল আমিন বলেন, ‘এখন ইন্টারনেটের যুগ, আপনি চাইলে নিজের থেকে একটু কষ্ট করে খোঁজাখুঁজির মাধ্যমে বের করতে পারবেন আপনার প্রয়োজনীয় যেকোনো তথ্য। কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, সে বিষয়েও একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবেন। কোনো এজেন্সির পরিবর্তে সরাসরি ই-মেইলের মাধ্যমে আপনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার ওয়ার্ক পারমিট সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন।’ পাশাপাশি তিনি কারিগরি ও প্রশিক্ষণমূলক কাজ এবং ইংরেজিসহ জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, চায়নিজ, জাপানিজ, রুশ কিংবা কোরিয়ান ভাষার মধ্য থেকে যেকোনো একটি বিদেশি ভাষা চর্চার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যাতে দক্ষতার ভিত্তিতে বৈধভাবে আমাদের দেশ থেকে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করার সুযোগ প্রসারিত হয়।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।