জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক

জাপানের সমুদ্রবন্দর কোবে শহরে রবীন্দ্রনাথ (১৯১৬)
জাপানের সমুদ্রবন্দর কোবে শহরে রবীন্দ্রনাথ (১৯১৬)

জাপান ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক শতবর্ষ পুরোনো। জাপান-বাংলা-ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এই শতবর্ষী মর্যাদাসম্পন্ন ইতিহাসটি পূর্ণাঙ্গরূপে কোনো ভাষাতেই লিখিত হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়া। এমনকি কোনো উচ্চ বিদ্যাপীঠেই এই ইতিহাসটি পড়ানো হয় না। অথচ সুসভ্য ও সুসংস্কৃতিধারক জাপানের সঙ্গে পিছিয়ে থাকা বাংলা অঞ্চলের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু গবেষক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ কেউই এই তিন দেশের পাঠ্যগ্রন্থে এই ইতিহাসকে পাঠ্যসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেননি। এটা এক অজানা রহস্যই বলা চলে! অথচ এমন একটি ইতিহাস বিশ্বের আর কোনো দেশেই পরিলক্ষিত হয় না, নোবেল বিজয়ী বিশ্বমাপের ব্যক্তিত্ব তথা কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে।

জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ
জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ

বিগত শতবর্ষে বহু তথ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে নানা কারণে। তবুও এই পর্যন্ত যা পাওয়া গিয়েছে বা আবিষ্কৃত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আমি গ্রন্থ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করি গত শতকের নব্বই দশকের শেষদিক থেকে, জাপান শীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার উৎসাহে। ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের শার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে জাপানের বিবেকবার্তা পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক পি আর প্ল্যাসিড আমার লিখিত রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করে আমাকে বাধিত করেন। একই সালে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন-জাপান সংস্থা গ্রন্থটি ইংরেজিতে প্রকাশ করে Rabindranath Tagore: India-Japan Cooperation Perspective নামে। দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ঢাকা থেকে জাপানে রবীন্দ্রনাথ নামে আরও একটি গ্রন্থ—বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক মোস্তফা হোসাইনের সহযোগিতায়।
এই পর্যন্ত যত তথ্য ও দলিলপত্র পাওয়া গেছে সেগুলো গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে লিখিত হলে ২০০০ পৃষ্ঠার একটি ইতিহাস গ্রন্থ হয়ে যাবে। যাকে বলা যেতে পারে ইতিহাস আছে, ইতিহাসে নেই: জাপানে রবীন্দ্রচিহ্নের সন্ধানে এ রকম নামে। পৃথিবীর অন্য যেকোনো জাতির চেয়ে জাপানিরা যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি করেছেন সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে! বিপুল প্রকাশনা তাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে বিগত শতবর্ষে এবং আজও অব্যাহত। এমন বিরল ঘটনা রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান ভারতবর্ষেও পরিলক্ষিত হয় না।
উপরিলিস্নখিত সেই ইতিহাসের একটি ধারণা বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের জন্য তুলে ধরার প্রয়াসে এই নিবন্ধ।

ওসাকা মহানগরে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের অন্যতম একটি অনুষ্ঠানসূচি
ওসাকা মহানগরে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের অন্যতম একটি অনুষ্ঠানসূচি

১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশি শিষ্যা মার্কিন নাগরিক মিস জোসেফিন ম্যাকলিউড (Josephine MacLeod—জয়া) জাপানে আগমন করেন ও মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিনের কাছে চারুকলা বিষয়ক শিক্ষালাভ করেন। সম্ভবত তারই প্ররোচনা বা আগ্রহে আগ্রহী হয়ে ওকাকুরা মিস ম্যাকলিউডের সঙ্গে কলকাতার দিকে যাত্রা করেন বছরের শেষ দিকে। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন ওকাকুরার শিষ্য তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু হোরি শিতোকু। তারা ১৯০২ সালে কলকাতা বন্দরে পৌঁছান।
ভারতে ওকাকুরা প্রায় ১০ মাসের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন রাজধানী কলকাতায়। তখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে স্বামী বিবেকানন্দ, তার শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা, ওলে বুল (ধীরামাতা), রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, খগেন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসু প্রমুখের সঙ্গে। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাইপো বিপ্লবী সুরেন্দ্র নাথ ঠাকুরের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এখানেই তিনি তার বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ যথাক্রমে The ideals of the East ও The Awakening of the East-এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তাকে সহযোগিতা করেন ভগিনী নিবেদিতা।
১৯০৩ সালে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ওকাকুরা তার প্রধান দুজন শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওকে ভারতে প্রেরণ করেন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপ্রাসাদ অলংকরণের কাজে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার কারণে সেই কাজ করতে পারেননি তারা। প্রায় তিন মাস কলকাতায় অবস্থানকালে অবনীন্দ্রনাথদের সঙ্গে শিল্পকলা বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তারা জাপানি চিত্রকলার ওয়াশ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। তখন তারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
১৯০৫ সালে ওকাকুরার আরেকজন শিষ্য চিত্রশিল্পী কাৎসুতা শোওকিন কলকাতায় যান। তিনি শান্তিনিকেতনে জাপানি চিত্রকলা শিক্ষা দেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তারও।
১৯১২ সালে ইউরোপ থেকে ফেরার পথে ওকাকুরা ভারতে অবতরণ করেন। পুনরায় কলকাতায় যান। সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে পূর্ববাংলার পাবনায় জন্ম ও কলকাতায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত নারী কবি প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং দ্রুতই দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রণয়ে আবদ্ধ হন।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার বোস্টন শহরে গেলে পরে ওকাকুরার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটে। ওকাকুরা তখন বোস্টন জাপানি জাদুঘরের পরিচালক ছিলেন। এই সালেই অসুস্থ হয়ে ওকাকুরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর রবীন্দ্রনাথ এশিয়ায় প্রথম সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। যা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই সংবাদ জাপানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়। এশিয়া মহাদেশের প্রথম ও একমাত্র শিল্পোন্নত দেশ জাপান ভেবেছিল কোনো জাপানি কবি বা সাহিত্যিক অথবা গবেষক এই পুরস্কার অর্জনে সক্ষম হবেন! কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। ১৯৬৮ সালে সাহিত্যিক কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
কাজেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পেলেন তখন তাকে দেখা ও জানার জন্য সাধারণ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জাপানিদের মধ্যে কৌতূহল প্রবল গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও বা আরও আগেই জাপানি শিক্ষা ও সংস্কৃতিমহলে রবীন্দ্রনাথ পরিচিতি লাভ করেন ওকাকুরা তেনশিন, য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, কাৎসুতা শোওকিন ও বৌদ্ধপণ্ডিত কাওয়াগুচি একাই প্রমুখের কল্যাণে।
ওকাকুরার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ জাপান সফরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না দেশটি ভ্রমণের। নোবেল পুরস্কার তাকে সেই সোনালি সুযোগ এনে দেয়। ১৯১৫ সালেই জাপানের আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি জাপানে যেতে পারেননি। পরের বছর ১৯১৬ সালে আসেন মে মাসে, সমুদ্রবন্দর কোবে শহরে প্রথম পা রাখেন। আগামী বছর তার জাপান ভ্রমণের শতবর্ষ পূরণ হবে। সেই প্রথম ভ্রমণেই তিনি জাপানের বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচিত হন। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন। টোকিও ইমপিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতা দিয়ে জাতীয়তাবাদপন্থী বুদ্ধিজীবী কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও গবেষকদের রোষানলে পড়েন সমরবাদী জাপানের ভূমিকার সমালোচনা করে। অবশ্য পরবর্তীতে মর্যাদাসম্পন্ন কেইও গিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি বক্তৃতায় জাপানের সৃজনশীল মানস ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ভূয়সীর প্রশংসা করে অনেকটা শীতলতা দূর করতে সক্ষম হন। প্রথম ভ্রমণের সময় য়োকোহামা বন্দর নগরে অবস্থিত বিখ্যাত সানকেইএন বাগানবাড়িতে প্রায় তিন মাস অবস্থান করেন। এ সময় তিনি জাপানকে গভীরভাবে দেখা ও অনুধাবনের সুযোগ পান। ফলে বিপুলভাবে প্রভাবিত হন হাজার বছরের প্রাচীন ও স্বতন্ত্র সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি। এই সালেই ওকাকুরার অনুসারী খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ পেয়ে কলকাতায় যান। দুই বছরের বেশি সময় বিচিত্রা ভবনে জাপানি চিত্রকলা শিক্ষা দেন।
১৯১৭ সালেও রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে জাপানে অবতরণ করেন। এটা তার দ্বিতীয় জাপান ভ্রমণ।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ভক্ত বিশিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক, লেখক ও আন্তর্জাতিক নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী মাদাম তোমি কোরার আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণ শেষে জাপানে আগমন করেন। বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেন। এটা তার তৃতীয় জাপান সফর।
১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ কানাডা যাওয়ার পথে জাপানে অবতরণ করেন। ফেরার পথেও যুক্তরাষ্ট্রে পাসপোর্ট-হারানোকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একটি দুঃখজনক ঘটনার শিকার হয়ে জাপানে বিশ্রাম নেবার জন্য আবার অবতরণ করেন। এটা ছিল তার যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চমবার জাপান সফর। সর্বমোট তিনি পাঁচবার জাপানে আসেন। প্রতিবারই তিনি জাপান দ্বারা প্রভূত প্রভাবিত হন। জাপানিরাও তার প্রভাব গ্রহণ করেন। প্রচুর ভক্ত তার এই দেশে সৃষ্টি হয়। সুযোগমতো জাপানিদের প্রশংসার পাশাপাশি তিনি জাপানের অতিরিক্ত পাশ্চাত্যানুকরণ ও অতি জাতীয়তাবাদী সামরিক কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জাপানে গবেষণা:

নাগাসাকি টেগোর রিসার্চ সোসাইটির একটি বুলেটিন
নাগাসাকি টেগোর রিসার্চ সোসাইটির একটি বুলেটিন

জাপানে বিগত শতবর্ষ ধরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি-গবেষণা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তাকে নিয়ে বিভিন্নভাবে কথা বলেছেন, চিন্তা ও গবেষণা করেছেন এমন প্রথিতযশা ব্যক্তিরা হচ্ছেন; শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন, চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান, চিত্রশিল্পী কাৎসুতা শোওকিন, চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই, শিল্পপতি ও আধুনিক জাপানের অন্যতম প্রধান কারিগর শিবুসাওয়া এইইচি, লেখক ও অনুবাদক গেনজিরোও য়োশিদা, সংগীতজ্ঞ গেনজিরোও মাসু, জুদো প্রশিক্ষক ও লেখক জিননোসুকে সানো, জুদো প্রশিক্ষক শিনজোও তাকাগাকি, সিল্ক বণিক ও জাপানি শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও, গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু, বৌদ্ধপণ্ডিত, গবেষক ও অধ্যাপক তাকাকুসু জুনজিরোও, শিক্ষাবিদ ও জাপানের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. নারুসে জিনজোও, শিল্পপতি ও আধ্যাত্মিক গবেষক ড. কুনিহিকো ওওকুরা, মনস্তাত্ত্বিক, লেখক ও আন্তর্জাতিক নারীমুক্তি আন্দোলনের নেত্রী মাদাম তোমি কোরা, বৌদ্ধপণ্ডিত অধ্যাপক ৎসুশো বিয়োদো, ওকাকুরা তেনশিনের প্রপৌত্র অধ্যাপক ওকাকুরা কোশিরোও, শিল্পকলার সমালোচক ইউকিয়ো ইয়াশিরোও, সংগীতজ্ঞ আয়াসুজি কিয়োসে, অধ্যাপক ইয়ামাগুচি কিয়োসে, অধ্যাপক ও গবেষক কিজোও ইনাজু, ফরাসি সাহিত্যবিশারদ অধ্যাপক কাতায়ামা তোশিহিকো, অধ্যাপক শিনইয়া কাসুগাই, অধ্যাপক তোকুমাৎসু সাকামোতো, গীতাঞ্জলির অন্যতম অনুবাদক অধ্যাপক মোরিমোতো তাৎসুও, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী সানেয়াৎসু মুশাকোজি, অধ্যাপক জুন ওওরুই, জাপান শীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা, অধ্যাপিকা কেইকো আজুমা, অধ্যাপক ও ভাষাগবেষক ড. ৎসুয়োশি নারা, অধ্যাপক, রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদক ড. উসুদা মাসাইউকি, অধ্যাপিকা ও গবেষিকা ড. নিওয়া কিয়োকো, অধ্যাপক ও গবেষক ওনিশি মাসাইউকি, শিল্পী ও অনুবাদক নিশিওকা নাওকি, অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি, চিত্রশিল্পী ফুকু আকিনো, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদ্বয় তোমোকো কাম্বে ও ওকুদা ইউকাসহ আরও একাধিক।
তাদের মধ্যে অধ্যাপক কাজুও আজুমা, ২০১১ বছরের জুলাই মাসের ২৮ তারিখে ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জাপানে রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে তার অবদান অপরিসীম। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার কাছে আরাধ্য দেবতার মতো। তিনি ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত বিশ্বভারতীর জাপানি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭১ সালে জাপানে প্রতিষ্ঠা করেন জাপান টেগোর সমিতি পরবর্তীকালে জাপান-ভারত রবীন্দ্র সংস্থা। এই সংস্থা থেকে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত নির্বাচিত রবীন্দ্র রচনাবলি। জাপানি অনুবাদের উদ্যোক্তা ও রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন নিপ্পনভবন ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে তিনি গুরুদেবের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন শ্রীনিকতেনে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতায় ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন। তিনি ২০০০ সালে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদত্ত রবীন্দ্র পুরস্কার ও ২০০৮ সালে জাপান সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার জুইহোওশোওসহ অনেক পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার বিস্তর প্রবন্ধ রয়েছে জাপান ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত। রয়েছে একাধিক গ্রন্থ জাপানি ও বাংলা ভাষায়।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬১ সালে মহাঘটা করে জাপানে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হয়েছিল টোকিও ও ওসাকা মহানগরে। রাজধানী টোকিওতে কবি গুরুর শেষ ভ্রমণের সময়ে ঘনিষ্ঠ হওয়া বন্ধু শিল্পপতি ও আধ্যাত্মিক গবেষক তোওয়োও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ড. কুনিহিকো ওওকুরা ১৯৫৭ সালেই দীর্ঘ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে। এমন ঘটনা একেবারেই বিরল বলা যায়।
এই পর্যন্ত তথ্যাদি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানের শতবর্ষী যে অমস্নমধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত।

(জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক)