পাঠশালার আসরে অভিধানপ্রণেতা জামিল চৌধুরী

বক্তব্য দিচ্ছেন জামিল চৌধুরী
বক্তব্য দিচ্ছেন জামিল চৌধুরী

কানাডার টরন্টোয় চিন্তক ও মননশীলদের প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার এবারের আসরে আলোচক ছিলেন বাংলা অভিধানপ্রণেতা ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব জামিল চৌধুরী। মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পাঠশালার এ আসর বসেছিল টরন্টোর এগলিনটন স্কয়ার পাবলিক লাইব্রেরিতে ২১ ফেব্রুয়ারি।

এবারের আসর সাজানো হয় সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতা পর্ব দিয়ে। আলোচক জামিল চৌধুরীর সঙ্গে এতে পাঠশালার পক্ষে অংশ নেন ফারহানা আজিম শিউলী। আলোচনা প্রমিত বাংলা ভাষাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও আলোচনায় উঠে আসে তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের নানা বাঁক ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে প্রমিত বাংলার পাশাপাশি বাংলা ভাষার ও ইতিহাসের নানা দিকও।

বক্তব্য দিচ্ছেন জামিল চৌধুরী
বক্তব্য দিচ্ছেন জামিল চৌধুরী

শুরুতে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণকারীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি।

১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষী জামিল চৌধুরী বলেন, দাঙ্গা কোনো সুখকর ব্যাপার নয় এবং সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে না করাই বরং স্বস্তির। দাঙ্গার জন্য জিন্নাহ অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন তিনি। ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট বেশ কিছু সিনিয়র ছাত্র দেখা করতে যান জিন্নাহর সঙ্গে। সেই ছাত্রদের মধ্যে জামিল চৌধুরী নিজেও উপস্থিত ছিলেন। জিন্নাহ তাঁদের বলেন, পরদিনের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডের কথা। আসলে ১৬ আগস্ট ছিল গ্রেট ক্যালকাটা শুটিংয়ের শুরু এবং তিন দিনের মধ্যে মারা পড়ে ১০ হাজারের মতো মানুষ। তিনি বলেন, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে কী আমি জানতাম না, বুঝতাম না। তবে এর অর্থ যদি মানুষ খুন করা হয়, তবে এর চেয়ে ঘৃণ্য আর কিছু হতে পারে না।’

এরপর তিনি একে একে প্রত্যক্ষ করেন সাতচল্লিশের দেশভাগ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর। ’৪৩ সালে আক্ষরিক অর্থেই খাদ্যের প্রয়োজনে, কেবল বেঁচে থাকার জন্য কুমিল্লার সন্তান জামিল চৌধুরীকে কলকাতা নিবাসী হতে হয়। ’৪৮ সালে জিন্নাহর ভাষা সম্পর্কিত ঘোষণা ও এর প্রতিক্রিয়া বলতে গিয়ে, ভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

আলোচনায় জামিল চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি, সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সচেতন অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্তি ছিল। তাঁর ভাষ্যে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে গুলির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজার বিশেক মানুষের বিশাল মিছিলে তিনি অংশ নেন। শুরুতে মিছিলের শেষ ভাগে থাকলেও একসময় তিনি চলে আসেন পুরোভাগে এবং তাঁর পাশে থাকা শফিক নামের একজন তরুণকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন গ্রন্থ ও অন্য নানা সূত্রে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের যে ছবিটি আমরা দেখতে পাই, সেটি তাঁরই তোলা। তাঁর বন্ধু, বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলামের ক্যামেরা দিয়ে তিনিই ছবিটি তোলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিকের বাবাকে দিয়ে প্রথমবার শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। পরে আবার ২৫ ফেব্রুয়ারি আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে দিয়ে এর উদ্বোধন করানো হয়। কারণ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি চালানোর প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দুই উদ্বোধনীতেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৫৩ সালে পুনরায় নির্মিত শহীদ মিনারের স্থিরচিত্রও তিনি ক্যামেরায় ধারণ করেন। স্থিরচিত্রগুলো পাঠশালার আসরে অংশগ্রহণকারীরা দেখার সুযোগ পান।

জামিল চৌধুরীর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা পদার্থবিজ্ঞানে। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের সঙ্গে এমএসসি পাস করেন। আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ফিজিকসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে বেশ কিছুকাল (১৯৬৪-৭৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালক। আসলে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে। সত্তরের দশকের প্রায় শেষ ভাগ পর্যন্ত তিনি মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আলোচনায় আমরা জানতে পারি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নিলেও টেলিভিশনের জন্মের শুরু থেকে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা যেখানে সম্ভব, যতটা সম্ভব বাংলার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা পান মুনীর চৌধুরীর কাছ থেকে। কারণ, কাজকর্মে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক শব্দের পরিভাষা জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পাকিস্তান আমলে টেলিভিশনের কার্যক্রম শুরুর পরপরই জামিল চৌধুরীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে টেলিফোন বিলের চেক বাংলায় টেলিভিশন অফিস থেকে লেখা হয়। ফলে বাংলায় প্রথম ব্যাংক চেক লেখা ও বাংলায় লেখা চেকের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের কৃতিত্বের দাবিদার জামিল চৌধুরীর নেতৃত্বে তখনকার টেলিভিশন। তখন থেকে বাংলায় চেক লেখা পুরোপুরি চালু হয়ে যায় টেলিভিশনের কাজকর্মে।

আসরে উপস্থিতি
আসরে উপস্থিতি

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে শহীদ মিনারে তিনি গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যদের ডেকে শপথ করতে বলেন, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে যে নির্দেশ দেওয়া হয় সেটা মানব না। যে অনুষ্ঠান বাংলা ভাষার পক্ষে, বাংলা সংস্কৃতির পক্ষে, সেটাই মেনে চলব। সেদিন সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হয়নি এবং এরই ধারাবাহিকতায় সেদিন টেলিভিশনের সম্প্রচারের সমাপ্তিকালে পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শিত ও জাতীয় সংগীত বাজানো হয়নি। বারবার করে বাজানো হয় ফাহমিদা খাতুনের কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি।

উল্লেখ্য, ২৩ মার্চ টেলিভিশন ভবন পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানি সেনাবেষ্টিত ছিল এবং সেনারা টেলিভিশনের কেন্দ্রীয় টেলিফোন সংযোগের বাইরে সরাসরি সেনানিবাসের সঙ্গে টেলিফোন সংযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করেছিল। বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত না বাজালে অফিস থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হবে না। সেটি উপেক্ষা করেই সেদিন পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো ছাড়াই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে টেলিভিশন কার্যালয়ের প্রতিটি কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও কার্যকরভাবে চালু করেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমিত বাংলাকে উৎসাহিত ও প্রয়োগ করেন।

তিনি বলেন, সে সময় ড. ইউনূস (নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস) নিয়মিত পোস্টকার্ডে লিখে জানান দিতেন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা বানান সংশোধনের ব্যাপারে এবং তখন থেকেই তিনি বাংলা বানানের নিয়মের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অফিসের ফাইলপত্র থেকে সব কাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি প্রয়োগ, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রমিত বাংলায় কথা বলা ও লেখার ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতিকে সচেতনভাবে লালন করা ও তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস দেখা যায় তখনকার টেলিভিশনের কর্মকাণ্ড ও নানা অনুষ্ঠানে। আর এই ব্যাপারগুলোতে একক কৃতিত্বের দাবিদার তিনি নন এবং মোস্তফা মনোয়ার ও কলিম শরাফীসহ আরও অনেকের কথা উল্লেখ করে বলেন, সবার সহযোগিতাতেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। টেলিভিশনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পান বাংলা ভাষাকে বদলে দেওয়ার। এমন করে বদলে দেওয়া যাতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে তা এমনই দুর্বোধ্য হয় যে দোভাষীর প্রয়োজন পড়ে। বলা বাহুল্য, তিনি সেই নির্দেশনা পালন একেবারেই করেননি।

জামিল চৌধুরী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টেলিভিশনের একেবারে প্রথম সারির প্রগতিশীল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মেরে ফেলার তালিকা করা হয় এবং ৭ নভেম্বর তাঁদের মেরেও ফেলা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মনিরুল আলম, হিসাবরক্ষক আকমল খান ও প্রশাসন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ সিদ্দিক। তিনি তালিকার প্রথমে থাকা সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে সেদিন তাঁর প্রাণ রক্ষা হয়। কেউ একজন ফোন করে তাঁকে সতর্ক করেন। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনকে প্রকারান্তরে পাকিস্তান টেলিভিশনে রূপান্তর করা। তিনি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কাছে বারবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন তাঁদের বাঁচাতে। উচ্চপদস্থদের কেউই সহযোগিতা করেননি কিংবা করতে চাননি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যুরোর একজন পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি সত্তরের দশকের শেষ ভাগ থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত। আশির দশকের পুরোটাজুড়ে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জামিল চৌধুরী বাংলা ভাষা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পন্ন করেন। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর লেখা 'বানান ও উচ্চারণ' বইটি বের হয় ১৯৮৬ সালে, ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা সিরিজের অংশ হিসেবে। নিউক্লিয়ার ফিজিকসের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বাংলা ভাষার মূল নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ জন্মানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, মূলত টেলিভিশনের দায়িত্ব পালনের সময়ই তিনি বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ নিয়ে কাজ করার তাগিদ অনুভব করেন।

‘বানান ও উচ্চারণ’ বইটি প্রসঙ্গে বলেন, তিনি এতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা বানান ও উচ্চারণকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের সঙ্গে বাংলা ভাষার কোনো বিরোধ নেই বরং বাংলা ভাষার মতো এতটা বিজ্ঞানসম্মত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাষা পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এই ভাষায় বিজ্ঞানসম্মতভাবেই বলে দেওয়া সম্ভব কোন শব্দের কী বানান ও কী উচ্চারণ। অনেকে মনে করেন, বাংলা একটা বিদঘুটে ভাষা। এতে স শ ষ, ন ণ, জ য এসবের উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয় ও ভাষাকে জটিল করেছে। তিনি বলেন, আরবি ভাষায় তো এসবের উপস্থিতি আরও বেশি। সেসব নিয়ে আমরা তো প্রশ্ন তুলি না! বাংলার বেলায় কেন? বইটিতে ডায়াগ্রাম, চার্ট ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা বানানকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শহীদ লিপি নামে বাংলায় প্রথম সফটওয়্যারটি ১৯৮৪ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয়। সাইফুদ্দোহা শহীদ এটি তৈরি করেন। এই সফটওয়্যারটি যথেষ্ট পুরোনো হলেও এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন বলে বিবেচিত। এটির ব্যবহারে যুক্তবর্ণগুলো স্বচ্ছ থাকে। এটি এখনো বাংলা একাডেমির অনেক প্রকাশনায় ব্যবহৃত হয়।

তাঁর রচিত ও সম্পাদিত প্রতিটি অভিধানেই শহীদ লিপি সফটওয়্যারের প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই।

১৯৮৮ সালের ২৩-২৫ মার্চ ইউনেসকোর উদ্যোগে বাংলা বানান নিয়ে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এক কর্মশালায় জামিল চৌধুরী যুক্তবর্ণগুলো স্বচ্ছ করে আধুনিক করার প্রস্তাব করেন। তাঁর সেই প্রস্তাবনার সফল বাস্তবায়নের সুফল আমরা আজ দেখতে পাই বাংলা অভিধানগুলোতে। স্বচ্ছ যুক্তবর্ণ, বাংলা পড়া ও লেখাকে সহজ করেছে অনেকটা।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে জামিল চৌধুরী সম্পাদিত 'ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান' বের হয়। এটি গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা। এর সম্পাদনা পরিষদে তিনিসহ আরও ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক ও নরেন বিশ্বাস। সম্প্রচার ও গণমাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় প্রমিত বাংলা উচ্চারণের একটি নির্ভরশীল নির্দেশিকার অভাব প্রকটভাবে অনুভূত হলে এই অভাব পূরণের জন্য একটি ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অর্থাৎ জামিল চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সম্পাদনা পর্ষদ গঠন করা হয়। এর ফলে আমরা পাই ‘ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান’। এটি কেবল গণমাধ্যম ও সম্প্রচারে নিয়োজিত কর্মীদের নয়, সঠিক বাংলা উচ্চারণে আগ্রহী সবার জন্যই এটি একটি অত্যন্ত সহায়ক অভিধান।

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির সমন্বয়ের কাজটিও তাঁরই হাতে।

আসরে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে জামিল চৌধুরী
আসরে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে জামিল চৌধুরী

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ১৯৮৮-১৯৯১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে চাকরিজীবন থেকে অবসরে যান জামিল চৌধুরী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় স্কুলের পাঠ্যবইগুলোকে তিনি পুনঃ সম্পাদনা করেন। এ সময়ই তিনি সরাসরি নির্দেশের মাধ্যমে প্রত্যেক স্কুলে জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করেন। পাঠ্যবইয়ের প্রগতিবিরোধী টেক্সট সরিয়ে প্রগতিমুখী করার জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছে।

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায় 'বাংলা বানান অভিধান’। ২০০০ সালে তিনি বিশ্বভারতীর ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কাজ করেন রবীন্দ্রসাহিত্যে বানান নিয়ে। ২০০৯ সালে কলকাতার দেজ পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর 'শব্দসংকেত-বাংলা অভিধান’। বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'আধুনিক বাংলা অভিধান’। এই অভিধানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিটি ভুক্তিই মূল ভুক্তি, শব্দের ব্যাখ্যামূলক সংজ্ঞার্থ, প্রতিটি ভুক্তির উচ্চারণ ও ব্যুৎপত্তি, যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ লিপির ব্যবহার এবং বহুল ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অন্তর্ভুক্তি।

জামিল চৌধুরী ‘ছায়ানট' ও ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’–এর সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘকাল। তিনি বলেন, ’৭৫–এর পট পরিবর্তনের পর শুধু ভাষা নয়, আমাদের সংগীতও আক্রান্ত হয়। সংগীতের মাধ্যমে মানুষকে শেকড়মুখী করতে, ‘শ্রোতার আসর’ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেটি থেকে বাংলা গানের প্রথম সিডি তাঁর ও সমমনা সতীর্থদের উদ্যোগে তৈরি হয়। তিন খণ্ডের সিডিতে বাংলা গানের সামগ্রিক পরম্পরা ঠাঁই পেয়েছে দুই বাংলার উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের কণ্ঠে।

তিনি প্রমিত বাংলার তাত্ত্বিক দিকের ওপর তিনি আলোকপাত করেন পুরো আলোচনাজুড়ে। এতে স্থান পায় প্রমিত বাংলার উৎপত্তির ইতিহাস, এর রাজনীতিকরণ, সংকট, সম্ভাবনা ও চর্চা, অভিধানের কার্যকারিতা, প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়। তিনি বলেন, কার্যকর মিথস্ক্রিয়ার জন্য প্রমিত বাংলা বলা ও পৃথিবীর আর সব রাষ্ট্রের মতো লেখালেখির ক্ষেত্রেও আমাদের প্রমিত ভাষার কোনো বিকল্প নেই। অবিভক্ত বঙ্গদেশে বাংলার প্রমিত রূপ নির্ধারিত হয়। কিন্তু ’৭৫–এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শাসনক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রমিত বাংলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে ও ইচ্ছাকৃতভাবে এর বিকৃতি ঘটিয়েছেন।

এখনো অনেক ব্যস্ততায় জামিল চৌধুরীর সময় কাটে। নিভৃতচারী এই মানুষটির সবটুকু সময়ই বরাদ্দ নানামুখী কাজে—অভিধানের সংযোজন, পরিমার্জন, আগ্রহের বিষয়ে গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে।

দ্বিতীয় পর্বে উপস্থিত সুধীদের সঙ্গে তিনি এক প্রাণবন্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে মিলিত হন।

কাজের দিনেও কর্মস্থল ও দূরদূরান্ত থেকে আসা আগ্রহী উপস্থিতি অখণ্ড মনোযোগে শ্রবণ করেন বহুমাত্রিক, ত্রিকালদর্শী, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব জামিল চৌধুরীর মূল্যবান কথোপকথন।