হাইফেন-তিন

ন্যান্তাহ্যালায় রিসোর্ট। সংগৃহীত
ন্যান্তাহ্যালায় রিসোর্ট। সংগৃহীত

হাইফেন চিহ্নটি কি আস্তে আস্তে বাংলাভাষা থেকে উঠে যাবে?
কথাটি ভাবায় ফিরোজকে। আকারে ড্যাশের থেকে প্রায় তিন ভাগের একভাগ। ছোট্ট এ যতি চিহ্নটি কেবল আমাদের বাংলাভাষাতেই যে আছে, তা কিন্তু নয়। প্রাচীনকাল থেকেই ইংরেজি ভাষাতেও প্রায় ১৬ হাজার শব্দে হাইফেন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তা আর টিকছে না। অক্সফোর্ড অভিধানের খুদে সংস্করণে ওই সবের বালাই-ই থাকছে না। অনলাইনে এই খবরটি পড়ে ফিরোজের মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের ভাষা থেকেও ধীরে ধীরে তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শব্দের মাঝে এই জিনিস নাকি মানুষজনের মনে অস্বস্তির বোধ জন্মায়। আশ্চর্য! সমাজের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও বদলে যায়, এটা সবাই মানে। সেটাই স্বাভাবিক। তবু ওই ক্ষুদ্র বিরাম চিহ্নটির প্রতি কী কারণে যেন ওর বেশ মায়া কাজ করে। কেন করে? আমাদের অনুভূতির মাত্রা যে কোথায় কোন মন-গলিতে ধেয়ে বেড়ায় তা বলা মুশকিল। এই যেমন হাইফেন বিষয়ক এই ব্যথা নিয়ে কারও না কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার সঙ্গে বলবে? দেশে থাকলে সে নিশ্চয়ই ইমরানকে ফোন করে বসত।
আজ ধীমানের গ্র্যাজুয়েশন পার্টিটা হলো না। সাধারণত সমাবর্তনের দিন বিকেলেই হয় গ্র্যাজুয়েশন পার্টি। নাহিয়া আর ধীমান একসঙ্গে তা উদ্‌যাপন করবে—সেটাই ওদের পরিকল্পনা। ফিরোজের ছোটো ভাই নওরোজ অরিগন থেকে এসে পৌঁছেছে বিকেলবেলায়। সেও একই হোটেলে উঠেছে। একাই এসেছে, বউকে আনেনি। এসেই বলে, নর্থ ক্যারোলাইনার ওয়েদারের কোনো তুলনা হয় না, দাদা। কেমন ঝলমলে রোদ্দুর। খুব একটা গরম নেই। আমাদের ওরেগনে তো সব সময় বৃষ্টি লেগেই আছে। মাঝে মাঝে ভাবি এদিককার কোথাও মুভ করব। কিন্তু শেষে গিয়ে আর হয়ে ওঠে না। বুঝি বয়স হয়ে যাচ্ছে। নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে করে না আজকাল।
দীপ্তির মেজভাই অবশ্য বউ বাচ্চা নিয়েই এসেছে। ওরা তো তেমন একটা দূরে থাকে না। মেরিল্যান্ড থেকে ড্রাইভ করেই এসেছে। কাছেই একটা হোটেলে আছে। সবাই একসঙ্গে ডিনার করল। মেলাক্ষণ বসে গল্প করে। রেস্টুরেন্টে বসে একটা কাণ্ড করল নওরোজ। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে পুরোনো সেই দিনের কথা গাইতে শুরু করে দিল। কোনো একজন এসে আবার ধীমানের হাতে একটা অ্যাকুস্টিক গিটার ধরিয়ে দেয়। সে অনায়াসে বাজিয়ে চলে। দীপ্তি আজ সন্ধ্যায় তার ঝিম ধরানো সেই গলা নামিয়ে এনেছিল। অনেক দিন পর ওর গান শুনল ফিরোজ। ওদের সঙ্গে আর সবাই যোগ দেয়। গান শেষে চারপাশে তালি আর হর্ষধ্বনি শুনতে পায়। যখন হোটেলের রুমে ফেরে তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।
এটা একটা ডিলাক্স হানিমুন সুইট। পাশাপাশি দুটো ঢাউস ঘর, লিভিং স্পেস, আর্টিফিশিয়াল ফায়ার প্লেস, পঞ্চাশ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন চকচকে এলইডি টিভি। ফ্রিজ ঠাসা রাজ্যের ড্রিঙ্কে। এটা ধীমানেরই কাণ্ড। ওদের সবাই তৈরি থাকলেও নাহিয়ার কোনো এক আত্মীয় নাকি এসে পৌঁছেনি। তাই সেলিব্রেশনের এই বিলম্ব। তাতে অবশ্য ওদের সমস্যা নেই। আজ না হয়ে কাল হলে পৃথিবীর কারও কোনো ক্ষতি হবে না। আমাদের পরিপার্শ্ব আমাদের সহনশীল হতে শেখায়। নাহিয়ার বাবা-মা কিন্তু ঠিকই এসেছেন। সকালের ইভেন্টে তো কথাও হলো। সোমবার ওরা সবাই মিলে যাবে নান্তাহ্যালা হোয়াইট ওয়াটার র‍্যাফটিং-এ। ১৮ জনের একটা বিশাল কটেজ ভাড়া করা হয়েছে। সবাই মিলে ওখানেই হবে মচ্ছব। ওখানেই রান্না, তারপর খাওয়া। প্রকৃতির কাছাকাছি পারিবারিক নিবিড়তায় কিছুটা সময় কাটাতে চায় ওরা। দুটো পরিবার একে অপরকে জানার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি হতে পারে? একেবারে নিপুণ কর্ম-পরিকল্পনা। ফিরোজের ভেবে বেশ অবাক লাগে, এই সেদিনের বাচ্চা ছেলেটা কী করে অমন সুশীল হয়ে উঠেছে! সে কী ওর মায়ের জিনের প্রভাব? নাকি নাহিয়াই এতে আলাদা ভূমিকা রেখেছে? এই জায়গায় এসে ওর ভাবনাটা একটু হোঁচট খায়। আচ্ছা, সব ভালোর উপযোগ কী অন্যরা, তার কী কিছুই নেই সেখানে? ভাবনাটাকে আর বাড়তে দেয় না সে। নাহিয়ার কথা ভাবে।
ওরা লক্ষ্ণৌর মানুষ। ওর পরিবার মূলত ডিস্টিলারি কেমিক্যালের ব্যবসা করে। তবে ইদানীং ওরা মূল্যবান পাথর রপ্তানিতেও বিনিয়োগ করছে। সে বাণিজ্যের রমরমা অবস্থার কারণে মুনাফার উদ্বৃত্ত ওরা আইটি সেক্টরে ঢালছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যাপ্তি ওদের কারবারেও প্রসার ঘটাচ্ছে-এটা নিশ্চিত। শুধু এটুকু শুনেই বলে দেওয়া যায়, নাহিয়ার পরিবার অত্যন্ত ধনাঢ্য। নাহিয়াই ওদের পরিবারের প্রথম মেয়ে যে কিনা একা একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসেছে। ওদের পরিবার আরও বেশি খুশি দুটো কারণে। একটি হলো, নাহিয়া কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েছে। সে ওখানে যাচ্ছে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। তার ইচ্ছে পরবর্তীতে পিএইচডি প্রোগ্রামও শেষ করার। ‘বৃহৎ দেশগুলোর অর্থনৈতিক উৎকর্ষের প্রধান শক্তি বৃহৎ জনশক্তির দেশের সঙ্গে সহাবস্থান’-এই বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করা। দ্বিতীয় আনন্দের কারণ হলো, নাহিয়া যে ছেলেটিকে তার চলার সাথি হিসেবে বেছে নিয়েছে, সে মোটেই আমেরিকান নয়। ও দিককারই একজন এবং সে মুসলমান।
ঠিক এখানে এসে ফিরোজের ভাবনাটা বিগড়ে যায়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে না। মানুষ কাছে আসবে তার ভালো লাগা, মূল্যবোধ কিংবা আনন্দের কারণ দেখে। সেখানে ধর্মের অবস্থানটা কতটুকু? সে এটাও ভাবে, ধীমান-নাহিয়া হয়তো এমনিতেই কাছে এসেছে। ওদের মাঝে ও সব কাজ করেনি। তবে আনন্দের বিষয় হলো, নাহিয়া পাকিস্তানি নয়। আর যাই মেনে নেওয়া যায় পাকিদের নিজ পরিবারে আনা যায় না। সেটা কি খানিকটা ব্রিটিশদের বেলাতেও কিছুটা খাটে না? সে ভাবে। ওর চাচাতো ভাই আরমান একজন স্কটিশ মেয়েকে বিয়ে করেছিল। যদিও স্কটিশ আর ব্রিটিশদের মাঝে বিস্তর ফারাক। একে ওপরের চোখের বালি। অনেকটা আমাদের দেশের নোয়াখালী-চট্টগ্রামের মানুষের সম্পর্কের মতোই। তবুও আরমান ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরস্পর জেনেছে সে এখন একা একাই থাকে। ওর স্কটিশ বউ অনেক আগেই ছেড়ে গেছে তাকে। ওদের একটি মেয়েও আছে। দোষ আরমানেরই বেশি, ওর যকৃতে সমস্যা ধরা পড়েছে। অনিয়মই তার কারণ। তবু ওদের বলয়ে আর ফেরা হয়নি তার। ওদের পরিবারের একটা গল্পও আছে।
ওর বাবা-চাচা দুই ভাই-ই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছিলেন। ময়েজ-ফয়েজ দুজনই সক্রিয় ছিলেন। পুলিশের গুলিতে ওর চাচা ময়েজুর রাহমান খোঁড়া হয়ে যান। সে পা নিয়েই তিনি বাংলাদেশ উত্থানের সব আন্দোলনে ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব যখন ডেকে পাঠালেন খুঁড়িয়ে পুড়িয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। ছোট ভাই হয়েও ওর বাবা ফয়েজুর রহমান ধরলেন পরিবারের হাল। চাকরির দিকে গেলেন না তিনি। শুরু করলেন ব্যবসা। যুদ্ধের পর শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভায় থাকার সম্ভাবনা থাকলেও চাচা বিনয়ের সঙ্গে তা এড়িয়ে গেলেন। তাজউদ্দীনের বিশেষ পছন্দের লোক ছিলেন তিনি। তাঁরই পীড়াপীড়িতেই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। আরমান বয়সে ফিরোজের প্রায় দশ বছরের ছোট। পঁচাত্তরের ডিসেম্বরে তিনি চলে যান লন্ডনে। আর ফেরেননি।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর ফিরোজকে তার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি পড়বি রে ব্যাটা? সব জায়গাতেই তো চান্স পাবি?
আমি অ্যানথ্রোপলজি পড়তে চাই, আব্বা। আর লেখক হতে চাই।
বাবা বকেননি তাকে। সংগ্রামী বাবাও সেদিন বলেছিলেন, তাতে কি তোর সংসার চলবে। ভাত জুটবে কপালে? তার চেয়ে বরং এমন কিছু কর যাতে পকেটে দুপয়সা আসে। ইঞ্জিনিয়ারিং কর গে যা।
বুয়েটে পড়েছে ঠিকই কিন্তু ওর মন সব সময় পড়ে থাকত শূন্য দিগন্তে। হাওয়ার গেরো দিতে দিতে। বাস্তুবিদ্যার কোনো কৌশলই সে ঠিকমতো ধরতে পারত না। তার ওপর এরশাদ সরকারের ঠেঙানিতে ঢাকা ছাড়া। কদিন বন্ধুর বাড়ি চট্টগ্রামে আত্মগোপন। সেখানেই দীপ্তির সঙ্গে পরিচয়। তখনকার বিকেলগুলোকে মোটেই অবসন্ন মনে হতো না তার। সোলসের ফরেস্ট হিলে গানটা তখন খুব শুনত সে। সময়টা অন্যরকম ছিল। দীপ্তির দাদা সূর্য সেনের অনুশীলন সমিতির একজন পাণ্ডা ছিলেন। এ ব্যাপারটিও তাকে পরিণতির দিকে ধাবিত করেছিল। তারপর কোনো মতে পাস করে রোডস অ্যান্ড হাই ওয়েজের চাকরি নিয়ে সোজা হালিশহর। ওদের ছোট্ট সংসার। ধীমান চলে এল চট করে। দুজন মানুষের মাঝে সে হয়ে গেল যেন যোগসূত্র, ‘হাইফেন’।
দীপ্তির এফসিপিএস পরীক্ষা দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। গাট্টি বোঁচকা বেঁধে আবার ঢাকায়। ঢাকায় ফিরেই যে কাজটি সে করেছিল, চাকরি ছেড়ে কনসালটিং আর ডিজাইনিংয়ের কাজ শুরু করে দেয়। পাশাপাশি লেখালিখি। শব্দের পাখি অভিমান করেনি। বরং মেলে দিয়েছিল তার স্বপ্নের পাখনা। দীপ্তির একের পর এক পরীক্ষায় পাস। এমডি, এফসিসি, এফআরসিপি ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর কথা শোনার বা বলার মতো ফুরসত কই। তারই কী ছিল? শুধু কী কথার অব্যাহতি? শরীরেও কী অমোঘ এক নিয়মে শুষ্কতা এসে যায়নি? তারই মৌন এক কথোপকথনে দুজন মানুষের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব! হয়তো সে কারণেই কিনা, সে খুঁজে নিয়েছে নিকটবর্তী কোনো তীর। তাই কী? কে জানে?
এই জায়গায় এসে ফিরোজ তার চিন্তার স্রোত থামিয়ে দেয়। সে তার মনোযোগ সরিয়ে শোনে দীপ্তি কী করছে। ও ঘরে এই মুহূর্তে সে তার বোন সুপ্তির সঙ্গে কথা বলছে। সুপ্তি সিডনির বাসিন্দা। ফিরোজ শোনে দীপ্তির আনন্দিত কণ্ঠস্বর।...জানিস না তো ধী কেমন একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে! একদম নায়িকা। সে অবশ্যি বাংলাদেশি না। লক্ষ্ণৌর। তাতে কি? নাহিয়া কিন্তু ধীর চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট। কর্নেলে মাস্টার্সের অফার পেয়েছে। ফুল স্কলারশিপ।...না না, ধী এখন কিছুদিন একটা কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করবে। তারপর দেখবে কি করা যায়। ওরা নিউইয়র্কে মুভ করবে।...নাহ, ওদের গ্র্যাজুয়েশন পার্টি আজ হয়নি। ওরা এক সঙ্গে করতে চেয়েছে। মেয়ের এক দাদা নাকি কাল এসে পৌঁছেনি। কী এক ভেজাল হয়েছে। একটু আগে ধী ফোন করে জানাল উনি এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং, কাল হবে পার্টিটা। ফিরে এসে জানাব তোকে, কেমন?...
ওদের দুজনের কেউ জানে না তাদের জন্য কী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে।


লক্ষ্ণৌ খাবারের জন্য বিখ্যাত। তারপরও একটা বিতর্ক রয়েই যায়। কোন খাবার বেশি মজাদার? পেট ভরে গেলেও মন ঠিক ভরে না! সেটা কি হায়দ্রাবাদি শাহি খাবার নাকি লক্ষ্ণৌর নবাবি খানা? নবাব ও শাহির সে বিবাদের আজও কোনো সুরাহা হয়নি। তবে লক্ষ্ণৌর কাবাব আসলেই লা-জবাব। খাবারের টেবিলে হরেক রকমের আয়োজন দেখেই তা মনে হয়। তারই সুঘ্রাণ চারপাশে হামলে পড়েছে।

আয়োজনটা এমন যে, দু-পক্ষই কিছু না কিছু রান্না করে আনবে। এমনিতে আমেরিকান খাবার তো থাকছেই। কারণ নাহিয়া আর ধীমানের বেশ কিছু এ দেশীয় বন্ধুবান্ধব থাকছে। ওরা কাছের একটা কটেজেই উঠেছে। যখন জেনেছে ডি-এন (ধীমান-নাহিয়ার নামের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ) ওদের পরিবারের লোকজন নিয়ে হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং করবে, ওরাও জুটে গেছে। দল বেঁধে ওয়াটার রাফটিংয়ের মজাই আলাদা। সকালে উঠেই ওসবের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওরা। সে বন্দোবস্ত যে এত ব্যাপক তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এয়ার পাম্প ব্যাগ, সেফটি রোপ, ওয়েট সুট, সাঁতারের পোশাক, রোদ চশমা, সান স্ক্রিন, ডাইভ সু, ক্যাপ, লাইফ জ্যাকেট, পানি নিরোধক কন্টেইনার, সেফটি পিন, শুকনো খাবার—কী নেই? প্রত্যেকের কাঁধে তাই একটি করে বেশ বড় সাইজের ব্যাগ। যখন দল বেঁধে বেরোচ্ছিল, দেখে মনে হয় যেন কোনো অভিযাত্রীর দল। মোট দুটো দলে ভাগ হয়ে রাফটিংয়ে নেমেছে ওরা। একটিতে ধীমান আরেকটিতে নাহিয়া রয়েছে। বাতাসে ফুলানো হালকা নৌকাগুলোই আসলে রাফটস। খরস্রোতা পানিতে এগুলো দিয়েই ভেসে বেড়াতে হয়।
রাফটিং শেষে আজ ওদের বন্ধুদের সবার দাওয়াত এখানে। ওদের জন্য তো আমাদের ওদিককার খাবার ঠিক যুৎ​সই হবে না। যদিও ধীমান ফিরোজকে বলেছে, দেখো ওরা আমাদের খাবারই বেশি খাবে। যেকোনো নতুন কিছু ট্রাই করতে আমেরিকানদের জুড়ি নাই। আর আম্মুর হাতের গরুর মাংস খেলে তো পাগল হয়ে যাবে। হা–হা–হা।
খাবারের ফর্দ দেখে ফিরোজ একটু অবাকই হয়। শিক কাবাব, বটি কাবাব, রুমালি রুটি, কোর্মা, কালিয়া, দাম বিরিয়ানি সবই নাকি ওদের ঐতিহ্যবাহী খাবার! দাম বিরিয়ানি যে আসলে আমাদের কাচ্চি বিরিয়ানি—সেটাও মোটামুটি বোঝা যায়। সব খাবারই অল্প তাপে দম দিয়ে রান্না করা নাকি ওদের আবিষ্কার! এত যে আমরা এই সব খাবার নিয়ে উদ্‌যাপন করি, সবই তাহলে ধার করা। অন্যের রান্না ঘরের ভেসে আসা সুঘ্রাণে আমরা আমাদের টেবিল সাজাই। আশ্চর্য।
সামান্য কিছু পদের রান্না করার কথা থাকলেও নবাবি খাবারের ঠেলায় টেবিলে জায়গাই হয় না। দীপ্তিও বেশ কিছু পদ রান্না করেছে। সে রেঁধেছে ইলিশ পোলাও, ইলিশের ঝালকারি, ইলিশের দোপেঁয়াজা, ঝরঝরে সাদা পোলাও, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, মুরগির রোস্ট, ভাত, লইট্টা শুঁটকি, কচুর লতি আর চট্টগ্রামের বিখ্যাত মেজবানির টকটকে লাল গরুর মাংস। শুঁটকি দীপ্তি দেশ থেকেই নিয়ে এসেছিল। আর সব এখান থেকেই বাজার করা। এখানে সবই পাওয়া যায়। ধীমান আর ওর মা র‍্য-লেতে গিয়ে বাজার করে নিয়ে এসেছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ওদের ননদ-ভাবির তৈরি করা মিষ্টি। দীপ্তির আর তার ভাবি আনিকা বেশ কিছু পদের দুর্দান্ত মিষ্টি বানিয়েছে। এ জিনিসে নবাবরা ধারে কাছেও আসতে পারেনি। তাই ডেজার্ট অংশে বাংলাদেশে এগিয়ে থাকল—ফিরোজ ভাবে।
গত পরশু সন্ধ্যায় গ্র্যাজুয়েশন পার্টিটা টপ অব দ্য হিল নামের একটি রেস্টুরেন্টে করেছে ওরা। রেস্তোরাঁটি আসলে ছাদের মতো জায়গায়, একপাশে খোলা। মে মাসের ঝিরিঝিরি বাতাসে মন ভরে যায়। বেশ পরিপাটি, সবকিছুই নিয়মে বাঁধা। আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত। নির্ধারিত খাবার, নির্ধারিত বসার জায়গা। খাবার আগে ছোটখাটো বক্তব্য।
ফিরোজ দেখেছে ওদের দলে একজন বেশ বয়স্ক মতোন লোক যুক্ত হয়েছেন। হাই-হ্যালো ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি সেদিন। অশীতিপরের চেহারা দেখে মনে হয়, বেশ ক্লান্ত। জেটল্যাগ বেশ ভালো ভোগাচ্ছে, বোঝা যায়। উনি নাহিয়ার বাবার ছোট চাচা।
আজ খেতে খেতে ধীমানের বন্ধুদের কথা শুনছিল ফিরোজ। খানিক আগেই ওরা ফিরেছে। এখন সবাই পাশের টেবিলে একসঙ্গে বসে হাপুস হুপুস খাচ্ছে। নাহিয়া বেশ মজা করে ওদের বলছে, দেখো, ডি অনেক ভাগ্যবান। আর আমার কপালে নিষেধাজ্ঞা।
কি রকম? কি রকম!
এই যেমন ডি যেখান থেকে এসেছে তার প্রথম তিনটা অক্ষর লক্ষ্য করো। বি-এ-এন। মানে ব্যান। এর অর্থ তো তা-ই, নাকি? আর আমি যেখান থেকে এসেছি তার প্রথম অক্ষরগুলো লক্ষ্য করো, এল ইউ সি কে, লাক। পুরোটা হলো লাক! তার মানে কি দাঁড়ায়? হি হি হি।
এখানে এসে ধীমান বলে, ওয়েল, মাইন ইজ অ্যা কান্ট্রি, অ্যান্ড ইয়ারস ইজ অ্যা সিটি। নট অ্যা গুড কম্পারিজন অ্যাট অল, মাই ডিয়ার।
ওই হলো, ক্রিকেট খেলায় আমি তো তোমাদের ওই নামটাই দেখি সব সময়।
না, এক হলো না, নাহিয়া। বাংলাদেশ একটা দেশ আর লক্ষ্ণৌ একটা শহর। এক হয় কি করে!
হেই, হোয়াই সো সিরিয়াস। আই অ্যাম জাস্ট মেসিং উইথ ইউ। আমি আগেও দেখেছি দেশের কথা আসলেই তুমি কেমন যেন শক্ত হয়ে যাও।

ন্যান্তাহ্যালায় রিসোর্ট। সংগৃহীত
ন্যান্তাহ্যালায় রিসোর্ট। সংগৃহীত

যখন ডেজার্ট নিচ্ছে, ফিরোজের মনে হলো আজ অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছে সে। স্পেশালি, দীপ্তির হাতের শুঁটকি আর গরুর মাংস। অনেক দিন পর অমনটা রাঁধল ও। যদিও এ বিষয়ে তার একটা মতামত আছে। শুঁটকি আর গরুর মাংস একই বেলায় খাওয়া ঠিক নয়। বেশি খাওয়া হয়ে যায়। এই আজ যেমন হলো। কিন্তু মিষ্টির পর্বটা তো আর বাদ দেওয়া যায় না। ডেজার্টের প্লেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বসে সে। সামান্য গল্পগুজব করার জন্য। ভদ্রলোক বেশ ভালো ইংরেজি বলেন। যদিও কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে উর্দু বা হিন্দি এসে যায়। ফিরোজ তবু ঠিকই বুঝে নেয়।
আংকেল, আসতে আপনার দেরি হলো কেন? রাস্তায় অসুবিধা হয়েছে কিছু?
আর বলো না বাবা। আমাদের নামেই যত ফ্যাসাদ।
কি রকম?
এই যেমন আমার নামের মধ্যে ইবনে আছে। তো হয়ে গেল লাফড়া। ভিসা দেওয়ার আগে মেলা হুজ্জুত। আমার বায়োমেট্রিক না কি যেন ছাই করতে পাঠাল। তাতেই সময় লেগে গেল। তাতেও কি শেষ হলো? আসার সময় নিউইয়র্কেও আরেক ঝামেলা। ব্যাটারা প্রায় সারা দিন বসিয়ে রেখেছে আমাকে। বসে থাকতে থাকতে আমার পাছা ব্যথা হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার কারও সঙ্গে কিন্তু এমনটা করে না। যত নকশা কেবল আমাদের সঙ্গেই।
কেন আপনিও তো ওখানকারই মানুষ, তাই না?
আমি ওখানকার হব কেন। আমি তো করাচির মানুষ। ভালো কথা আপনার বিবি কিন্তু দারুণ গুলাব জাম বানায়, একদাম বেহতেরিন!
ফিরোজ দেখে ভদ্রলোক প্রথম কালোজাম মিষ্টিটি শেষ করে দ্বিতীয়টি খাওয়ার জন্য সেখানে চামচ ডুবিয়েছেন। আর তারটি অর্ধেক খাওয়া। বাকিটুকু খাওয়ার আগে সে কিছুটা কম্পিত গলায় জানতে চায়, করাচির মানুষ মানে? আপনারা না লক্ষ্ণৌর বাসিন্দা?
উত্তরে বৃদ্ধ যা শোনালেন তা মোটামুটি এই রকম—সালিম শরাফের তিন পুত্র ও চার কন্যা। মেয়েদের সবাই করাচিতেই থাকেন। সালিম শরাফ পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর তিন ছেলের মাঝে ইনি, নাদিম ইবেনে শরাফ সর্ব কনিষ্ঠ। ছেলেদের কেউই ঠিক চাকরিতে যায়নি। আর দুই ভাই এজাজ ইবনে শরাফ মেঝ-নাহিয়ার দাদা ও হাফিজ ইবনে শরাফ লক্ষ্ণৌতে তাঁদের নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। সে কারবার বেশ ভালো জমে উঠলে গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। দেশ ভাগ হয়ে যায়। সেসময়ে ওরা তাই ওখানেই রয়ে যান। আর পাকিস্তান ফেরেননি। নাদিম তখন অনেক ছোট।
যদিও ভাইয়েরা ওখানেই পাকাপাকি কিন্তু ওদের সম্পর্ক-বিয়ে ইত্যাদি কিন্তু এ দেশের সঙ্গে আজও যুক্ত। ধীমান ও নাহিয়াও সে অর্থে একই বলয়ে। বাংলাদেশ তো আসলে একই মুলুক, যেন আজও দুই ভাই।
ফিরোজ শোনে নাদিম শরাফ বলে চলছেন, একটা কথা জানেন? নাইন্টিন ফিফটিজে আমার বাবার পোস্টিং কিন্তু ঢাকায় ছিল। সে সময়ের পুলিশ বিভাগের দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ফিফটি থ্রিতে করাচি ফিরে আসেন। তার ঠিক দুই বছর পর তিনি পুলিশের কাজে ইস্তফা দেন। শেষের দিকে তাঁকে আমি বেশ চুপচাপ থাকতে দেখতাম। প্রায়ই একা বন্ধ ঘরে বসে থাকতেন। কিয়া বাত হেইন, আপকা গুলাব জাম আভিতাক খাতাম নেহি হুয়া?
ফিরোজ সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলে, এক্সকিউজ মি। আই উইল বি ব্যাক শর্টলি।
একটা খোলা জায়গায় বেশ কিছু কাঠের টেবিল পাতা। তারই পাশে খাবার রান্না কিংবা গরম করার জন্য বার্নার আছে। এদিকটায় খোলা, নিচে পরিষ্কার পানির লেক। মে মাসের অপরাহ্ণের চমৎকার বাতাসে চারপাশ জুড়িয়ে যাচ্ছে। খাবার টেবিলে সবাই বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সবাইকেই বেশ আনন্দিত ও সুখী বলে মনে হয়। কেবল ফিরোজের মনেই ঝড় বয়ে যায়।
সত্যিই যদি তিনি তখন ঢাকায় পুলিশে ছিলেন তবে তো বায়ান্নতেও ছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে যে গুলি ছোড়া হয়েছিল তাতে কী তবে তিনিও শামিল ছিলেন? তারই অগ্নিকণা কি এতটা কাল ওদের পরিবার বয়ে যাচ্ছে? কেন সালিম শরাফ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন? শেষ বয়সে কেনই বা বিমর্ষ থাকতেন? সে কি অনুশোচনা থেকে? ফিরোজ আর ভাবতে পারে না। হাতের কাগজের বাটিতে তখনো তার আধ খাওয়া কালোজামটি পড়ে আছে।
দীপ্তি আর ফিরোজ বসে আছে ওদের বারান্দায়।
কটেজের প্রত্যেকটি ঘরের লাগোয়া একটি করে ছোট বারান্দা রয়েছে। এখানে বসে লেকের প্রায় পুরোটা দেখা যায়, তাই ওদের বারান্দাটা একটু স্পেশাল। দীপ্তি দেখে, সামান্য দূরে গিয়ে লেকটা ঘন গাছের আড়ালে বাঁক নিয়েছে। ওপাশের কিছুই ঠিকমতো দেখা যায় না।
নওরোজ খানিক আগে চলে গেছে। আজই ওর ছুটি শেষ। বিকেলের ফ্লাইটে তাই চলে গেছে। বলে গেছে হাতে ছুটি থাকলে যেন ঘুরে যায় তারা।

ন্যান্তাহ্যালায় হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং। সংগৃহীত
ন্যান্তাহ্যালায় হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং। সংগৃহীত

দুপুরের খাবারের পর প্রায় সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। ফিরোজ সেই কখন থেকেই বারান্দায় বসে আছে। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই। সে অভ্যাস দীপ্তিরও নেই। তবু বিছানায় এই সময়টা গড়াগড়ি করতে ভালো লাগে। তারপর একসময় বাইরে আসে সে। দেখে ফিরোজ একটা বই পড়ছে। আসার পর থেকেই দেখছে সে ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। লেখক জিয়া হায়দার রহমান নামের কে একজন যেন। নাম দেখে তো বাঙালি বলেই মনে হয়। এত বড় ইংরেজি বই লিখে বসে আছে! অপাঙ্গে সে দেখে নেয় ফিরোজ এখন এক শ আটানব্বই পাতায় আছে। বারান্দার রেলিঙে এসে দাঁড়ায় সে। দেখে, দূরে বেশ নিচে ধীমান আর নাহিয়া। হাতে হাত ধরে লেকটার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। ধীমান কী যেন বলল আর অমনি নাহিয়া হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। একবার একটা পাথর পার হওয়ার সময় প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ধীমান ঝট করে ওকে ধরে ফেলে। দীপ্তি দেখে, ওরা যেন থেমে কী কথা বলে কিছুক্ষণ। তারপর দেখে ধীমান দ্রুত ওর গায়ের টিশার্ট খুলে ফেলেছে। এখন সে শুধু শর্টস পরে আছে। ওর আদুরে সুঠাম শরীরের পেশিগুলো এখান থেকেও স্পষ্ট। সেদিকে তাকিয়ে দীপ্তির মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি জাগে, ও কি সত্যিই তার ছেলে? কেমন তড় তড় করে বড় হয়ে গেল!
এবার নাহিয়ার পালা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে এদিক সেদিক তাকায়। ওরা যেন অস্বস্তিতে না পড়ে, তাই দীপ্তি একটু আড়ালে চলে আসে। দেখে, নাহিয়াও তার গায়ের পাতলা শেমিজটা খুলে ফেলেছে। বিকেলের সূর্যের তির্যক কমলা আলো ওর শরীরে ঠিকরে পড়ে। তবে তা মুহূর্তের জন্যই। ঝপাৎ করে সে লাফিয়ে পড়ে পানিতে। যেন উদ্বেলিত সোনালি কোনো মাছ এইমাত্র পানিতে ঝাঁপ দিল। ওদের কোনো বন্ধুবান্ধবকে পাশে দেখা যায়নি। শুধুই ওরা দুজন। দীপ্তি দেখে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ওরা আরও দূরে চলে যাচ্ছে। তারপর একসময় বাঁকের ওপাশে চলে যায়। ওদের আর দেখা যায় না।
একটু পিছিয়ে এসে আড় চোখে দেখে ফিরোজ এখনো একই পাতায় স্থির। খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখে সেও রেলিঙের ফাঁকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও একটি নাম না জানা পাখি থেকে থেকে ডাকছে। ঘুঘুর ডাকের মতো সে আওয়াজ চারপাশকে আরও বেশি নিথর করে দেয়। পাশে বসতে বসতে কী যেন ভেবে সে একটা হাত ফিরোজের কাঁধে রাখে। ওর দিকে ফিরে ফিরোজ যেন নিজের মনেই ফিশফিশ করে বলে, আমাদের হাইফেনটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। (শেষ)

(লেখক যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার অরেঞ্জবার্গপ্রবাসী)