অনিশ্চয়তায় সাইপ্রাসে থাকা বাংলাদেশি শরণার্থীরা

প্রতীকী ছবি

ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝে ছোট একটি দেশ সাইপ্রাস। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত এ দ্বীপ দেশটি ভৌগোলিকভাবে এশিয়ার অংশ হলেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সাইপ্রাস ইউরোপের অংশ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সাইপ্রাসেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না হলেও সব মিলিয়ে দেশটিতে ছয় থেকে সাত হাজারের মতো বাংলাদেশি বসবাস করেন। একসময় ভারত এবং মালয়েশিয়ার মতো উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেকে সাইপ্রাসে পাড়ি জমাতেন। বিশেষ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে হসপিটালিটি কিংবা ট্যুরিজমে সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সাইপ্রাস অনেকের কাছে এক পছন্দের গন্তব্য ছিল। নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী সময় থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশিরা আসতে শুরু করেন। এমনকি বর্তমানে দেশটিতে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্টুডেন্ট ভিসার মাধ্যমে সাইপ্রাসে প্রবেশ করেছিলেন। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

বর্তমানে সাইপ্রাস গ্রিক সাইপ্রাস এবং তুর্কি সাইপ্রাস নামের দুটি অংশে বিভক্ত, যদিও আন্তর্জাতিকভাবে সমগ্র সাইপ্রাসকে অভিন্ন দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৪ সালে জাতীয়তাবাদী গ্রিক সাইপ্রিয়টরা গ্রিসের সামরিকজান্তার সহায়তায় একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। তুরস্ক এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বহুপক্ষীয় সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় এবং দ্বীপটির উত্তরাঞ্চল আক্রমণ করে। যুদ্ধবিরতির পরও তুর্কি বাহিনী সেখানে থেকে যায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় দেশটির এ বিভাজন। বর্তমানে তাই দ্বীপটির উত্তরাংশ তুর্কি সাইপ্রাস বা নর্থ সাইপ্রাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অন্যদিকে দ্বীপটির দক্ষিণাংশে গ্রিকভাষী মানুষের সংখ্যা বেশি, তাই একে গ্রিক সাইপ্রাস নামে অভিহিত করা হয়।

অতীতে সহজে বৈধ ভিসায় সাইপ্রাসে আসা সম্ভব হলেও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য সাইপ্রাসের ভিসাপ্রাপ্তির বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সাইপ্রাস বিশেষত গ্রিক সাইপ্রাসে পা রাখছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নর্থ সাইপ্রাস থেকে অবৈধভাবে গ্রিক সাইপ্রাসে অনুপ্রবেশকারী।

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বৈধ ভিসায় নর্থ সাইপ্রাসে আসার সুযোগ সে অর্থে নেই, মূলত এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে তাঁদের বাংলাদেশ থেকে নর্থ সাইপ্রাসে পাঠানো হয়। আর এ পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে একশ্রেণির চক্র, যেখানে প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য।

তুলনামূলকভাবে নর্থ সাইপ্রাসে জীবনযাত্রার মান গ্রিক সাইপ্রাসের তুলনায় বেশ পিছিয়ে, নর্থ সাইপ্রাস যেহেতু সম্পূর্ণভাবে তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল, তাই সেখানে মুদ্রা হিসেবে তুর্কি লিরা ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে গ্রিক সাইপ্রাস বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য এবং ২০০৭ সাল থেকে সেখানে সাইপ্রিয়োটিক পাউন্ডের বদলে জাতীয় মুদ্রা হিসেবে ইউরো গৃহীত হয়। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় নর্থ সাইপ্রাস এখনো অনেক পিছিয়ে গ্রিক সাইপ্রাসের তুলনায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউএস ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মুদ্রামানের অবনমন এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি তুরস্কের মতো নর্থ সাইপ্রাসের মানুষের জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে অনেক দেশের অধিবাসীদের মতো বাংলাদেশিদের অনেকে নর্থ সাইপ্রাস থেকে গ্রিক সাইপ্রাসে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।

আন্তর্জাতিকভাবে নর্থ সাইপ্রাস কিংবা গ্রিক সাইপ্রাস নামে আলাদাভাবে কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না থাকায় দুই সাইপ্রাসের মধ্যবর্তী স্থানের অনেক অংশই অরক্ষিত, এ কারণে অনেক সময় সহজে নর্থ সাইপ্রাস থেকে গ্রিক সাইপ্রাসে প্রবেশ করা যায়। এখানেও কাজ করে একটি শক্তিশালী চক্র, যারা কিছু অর্থের বিনিময়ে এসব অধিবাসীকে নর্থ সাইপ্রাস থেকে গ্রিক সাইপ্রাসে প্রবেশে সাহায্য করে। উল্লেখ্য, গ্রিক সাইপ্রাস থেকে সহজে নর্থ সাইপ্রাসে প্রবেশ করা সম্ভব হলেও নর্থ সাইপ্রাস থেকে গ্রিক সাইপ্রাসে বৈধভাবে সহজে প্রবেশ করা যায় না।

গ্রিক সাইপ্রাসে প্রবেশের পর অনুপ্রবেশকারীদের অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশের নাগরিক ছাড়া অন্য সব দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেকে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন, এভাবে হয়তোবা কালক্ষেপণ করা সম্ভব হয়, কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল কোনোভাবে নিজের অনুকূলে আনা সম্ভব হয় না। শেষ পর্যন্ত সাইপ্রাসের সরকার তাঁদের সবাইকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

সাইপ্রাস যেহেতু সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশ নয়, তাই সাইপ্রাস থেকে সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশে যাতায়াত করতে ভিসার প্রয়োজন হয়। অতীতে অনেকে চুক্তিবদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে সাইপ্রাস থেকে সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশে রেসিডেন্ট পারমিটের আবেদন করতেন, বর্তমানে সাইপ্রাসের সরকার এ বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করেছে। কেননা এসব চুক্তিবদ্ধ বিবাহের বেশির ভাগই ছিল নকল, যা পরবর্তী সময়ে দেশটির পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সাইপ্রাস সরকারের দেওয়া এক বিবৃতি অনুযায়ী, গত দুই বছরে সে দেশের পুলিশ অন্তত ৩ হাজার ৬০০টি এ রকম নকল বিবাহের কেস লিপিবদ্ধ করে। এমনকি গত জুলাই মাসে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লারনাকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ১১ জন বুলগেরিয়ান ও রোমানিয়ান মহিলাকে আটক করা হয়, যাঁদের এ ধরনের বিবাহের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল।

সাইপ্রাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে বিশাল দালাল চক্রের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, যারা সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে রেসিডেন্ট পারমিটের কথা বলে এ রকম চুক্তিবদ্ধ বিবাহের আয়োজন করে থাকে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অধিবাসীরা সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে সহজ শর্তে রেসিডেন্ট পারমিট পাওয়ার জন্য এ ধরনের চুক্তিবদ্ধ বিবাহের আশ্রয় নেন। সাইপ্রাসের পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শরণার্থীদের বিষয়ে দেশটির সরকারের বর্তমান সময়ের কঠোর পদক্ষেপের কারণে অনেক শরণার্থীও এভাবে সাইপ্রাস থেকে সেনজেনভুক্ত কোনো দেশে চলে যাওয়াকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেকে প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন।

সাইপ্রাসে প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এ কে নীরব খান জানান, দেশটির আইন অনুযায়ী যে কেউ বৈধভাবে একটানা সাইপ্রাসে বসবাস করলে সে দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারার কথা বলা হলেও বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। ইমিগ্রান্টদের জন্য তেমন একটা সুবিধা দেশটিতে নেই। চুক্তিবদ্ধ বিবাহের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সে দেশের সরকার বর্তমানে দক্ষিণ এশীয়দের বিবাহ স্থগিত করে রেখেছে। অন্যদিকে নর্থ সাইপ্রাস থেকে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের অনেকে এ ধরনের বিবাহের জন্য এক বছর আগেই দালাল শ্রেণিকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়ে রেখেছেন। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে একদিকে তাঁরা যেমন এ বিষয়ে অগ্রসর হতে পারছেন না, অন্যদিকে দালালদের থেকেও তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। পাওনা টাকা দাবি করতে গিয়ে অনেকে ইতিমধ্যে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ফলে একধরনের হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাঁদের জীবন।

নীরব খান আরও জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ সাইপ্রাস হয়ে গ্রিক সাইপ্রাসে আসা বাংলাদেশিরা কঠিন বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাঁদের ওপর দালাল চক্র জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দালালদের কেউ করছেন বাসার ব্যবসা, কেউ করছেন কাজ দেওয়ার নামে প্রতারণা, কেউ কেউ বিচুক্তিবদ্ধ বিয়ের কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। দালাল চক্রের হাত অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় যথার্থ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, ভারত এমনকি সাইপ্রাসের স্থানীয় অনেকে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে তিনি দাবি করেছেন, তাই সাইপ্রাসে আসার আগে সবাইকে তিনি যথার্থ সতর্কতা অবলম্বনে পরামর্শ দিয়েছেন।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।