অন্তর বাড়ি: যেখানে ফিরে যাওয়া যায় না

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার বিদায়ের দিনে
আমি একদম কাঁদিনি
নির্বাসন বলে কথা!
আমার সব ভালো লাগা, ভালোবাসার সকল চিহ্ন,
আমি জড়ো করেছি সাথে নেওয়ার দুই স্যুটকেসে!
বাবা–মা, আমার প্রিয় ছোট বোন
সকলে মিলে এগিয়ে দিচ্ছে কত কি—
বাবা ছোট্ট বোতলে সরিষার তেল
যত্ন করে খবরের কাগজ টেপ দিয়ে মুড়িয়ে হাতে দিয়ে বললেন,
আলুর ভর্তা খেতে চাইলে একটু সরিষার তেল না হলে হয় না!
এটা সাথে নে মা!
ছোট বোন জীবনানন্দ দাশ সমগ্র,
মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে, বুদ্ধদেব গুহের সবিনয় নিবেদন, হলুদ বসন্ত,
পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন, জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথের আহা! সূর্যবর্ত
সব জড়ো করেছে সুটকেসের পাশে।
আমি এক–এক করে
মনে করে করে সাথে নিচ্ছি
গানের সংগ্রহ— অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি, রবিশঙ্করের সেতার
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান
আরও কত কী!
নিচ্ছি প্রিয় কিছু শাড়ি!
কিছু জামদানি, তাঁত, কপালের টিপ, পায়ের আলতা।
কাঁদব? সময় কই?
যেতে হবে।
কবে ফিরে আসব, জানি না তো!
সাথে নিতে হবে আমার যা কিছু প্রিয়,
যা কিছু ভালোবাসার,
যা না হলেই নয়!

এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামল আমাদের
‘বন্ধুনিবাস’ পাড়ার মাঠ, ঘাট চত্বরজুড়ে।
আমার বাবা ফিস ফিস করে বললেন,
‘আমার মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আহা আকাশও কাঁদছে’
বাইরে তাকিয়ে দূরের লেকে বৃষ্টি
কী মনোমুগ্ধকর বৃষ্টি!
বুকটা এক মুহূর্তের জন্য হু হু করে উঠল
দেখতে পাব তো এমন বৃষ্টি আবার!
কান্নার যে দলা গলার কাছে আটকে আছে,
তা সহসা গিলে ফেললাম!
বৃষ্টি? বৃষ্টি মানেই আরও জ্যাম, ট্রাফিক
তার মানে আরও আগে বেরুতে হবে!
চোখের কোণে যে অশ্রু অচকিতে জমে গেছে, তা
দুহাতে উড়িয়ে দিলাম।
কাঁদিনি একদম।
আমার প্রিয় বন্ধু হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা বই
হাতে দিয়ে বলল, ‘প্লেনে পড়বি, মন ভালো করা বই,
হাসবি, একদম মন খারাপ করবি না কিন্তু।’
দুপুরে তাড়াহুড়ো করে মুচমুচে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে
মায়ের হাতের খিচুরি খেলাম।
তারপর—
আমার প্রিয় বারান্দা, প্রিয় ঘর, অসমাপ্ত বাড়ির ছাদ,
ছাদের অমীমাংসিত রডগুলো ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম
আমার বাবার ছোট্ট দোতলা বাড়ির নিরাপদ সিঁড়ি বেয়ে
অজানা পৃথিবীতে।
এভাবেই আমার যা কিছু, সব নিয়ে
উঠে গেলাম দেশান্তরের জাহাজে, অজ্ঞাতবাসে।
কী সাথে নিয়ে আসব,
তা ভাবতে ভাবতে
ফেলে এসেছি
আমার একলা বারান্দা।
যেখান থেকে দেখা যেত দূরের জলাশয়ে
ছোট্ট অর্ধডুবন্ত নৌকা
তাতে ঝঝমঝম বৃষ্টি।
ফেলে এসেছি
কবিতার সুখ–দুঃখ–কান্না
জীবনের যুক্তাক্ষর
আর বিরহের দীর্ঘশ্বাস।
তবু কাঁদিনি আমি।
মেয়েদের একদম কাঁদতে নেই।