আ–মরি বাংলা ভাষা

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: আবদুস সালাম

শুরুতে মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’ কাব্যটি স্মরণ করছি।
বঙ্গভাষা
শ্রী মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; -
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
‘ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!’
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
         
১.
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সিস্টার নিবেদিতার সখ্য বেশ নিবিড় ছিল। কবি চাইলেন তাঁর কন্যাদের কোনো একজনকে নিবেদিতা ইংরেজি ও মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। প্রস্তাবটি তিনি পেশ করলেন নিবেদিতার কাছে। নিবেদিতা কবিগুরুর অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে লিখলেন, ‘বাহির হইতে অন্য কোনো একটা শিক্ষা গিলাইয়া দিয়া লাভ কী? জাতিগত নৈপুণ্য ও ব্যক্তিগত বিশেষ ক্ষমতারূপে মানুষের যে জিনিসটি আছে, তাহাকে জাগাইয়া তোলাই যথার্থ শিক্ষা বলিয়া আমি মনে করি। বাঁধা নিয়মের বিদেশি শিক্ষার দ্বারা সেটাকে চাপা দেওয়া আমার কাছে ভালো মনে হয় না।’ ভাষা শিক্ষার ওপর নিবেদিতার এই যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ কবি আনন্দে মেনে নিয়েছিলেন।
গতকাল ছিল ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’। এ দিবসের কালে নিবেদিতা ও কবিগুরুর প্রসঙ্গটি আবার নাড়া দিচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি থেকে এবারের ভাষা দিবস ৬৯ বছরে পা দিল। এ আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিনটি (১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯) ধরলে এবারের উদযাপন ২১ বছর ছুঁলো। পৃথিবীতে ৪০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। মাতৃভাষা ব্যবহারের যে ক্রম সংখ্যাতাত্ত্বিকদের হাতে আছে, তাতে চীনের ১২৮ কোটির মধ্যেও ৪০ লাখ বাংলাভাষী রয়েছেন। ‘এথনোলগ’–এর ২০১৯ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলা ভাষার স্থান ৬ নম্বরে।  

২.
মুখের ভাষায় কথা বলার আবেগকে সহজে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনের একটি গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছে। বায়ান্নর শহীদত্বে সালাম বরকত–রফিক–জব্বারের মৃত্যু জয়ের পরোয়ানা আছে।

তেমনই আরেকটি গৌরবময় ভাষা আন্দোলন ঘটেছিল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। ভারতের আসামের শিলচরে সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন ১৪ জন ভাষাসৈনিক। এঁদের মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী ভাষাশহীদের উজ্জ্বল স্থানটি অধিকার করে আছেন ১৯ বছর বয়সী কমলা ভট্টাচার্য।

মায়ের ভাষায় কথা বলার যে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে, তার সুমহান ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।

৩.
একটি ভাষা শুরুতে আঞ্চলিকভাবে জন্ম নেয়। একটি অঞ্চলের জল-কাদার বৈশিষ্ট্যের মতোই সেই এলাকার কথ্য ভাষার তৈরি হওয়া ও বেড়ে ওঠা, তেমনই হয় তার শব্দভাণ্ডার, তেমনই হয় তার ব্যাকরণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো। এথেনলগের ২০১৮ পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষা প্রচলিত আছে। এই সব কটি ভাষাই জীবিত, অর্থাৎ এ ভাষাগুলো নিয়মিতভাবে দেশজুড়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বাংলা ভাষার উৎস সন্ধানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অধিকাংশ ভাষাবিদ মতামত দিয়েছেন যে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে মাগধী প্রাকৃত থেকে। এর উৎস সংস্কৃত নয়; সংস্কৃত ছিল সংস্কার করা ভাষা, কুলীনশ্রেণির মানুষের সাহিত্যচর্চার, ধর্মচর্চার ও লেখার ভাষা। সাধারণ মানুষ কথা বলত প্রাকৃত ভাষায়।

বাংলা ভাষা আদতে একটি মিশ্র ভাষা। এর গঠনে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার অবদান যেমন আছে, তেমনি আছে খেরওয়াল বা সাঁওতালিসহ বেশ কিছু মুণ্ডা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আজ থেকে শ খানেক বছর আগে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার জননী হিসেবে কেবল সংস্কৃত আর্য ভাষার দাবি নিয়ে যে কল্পতরুটি বেড়ে উঠছিল, সেই দাবিকে নস্যাৎ করার কাজটি হাতে নিয়েছিলেন।

ভাষা গঠিত হওয়ার কালে নানা কারণে নানা উৎস থেকে শব্দ গ্রহণ করে থাকে, কিন্তু তার মূল ভিত্তি খুঁজতে গেলে অপরিহার্য ধ্বনি উচ্চারণের প্রকৃতি, ছন্দের বৈশিষ্ট্য এবং বাক্য গঠনের বৈশিষ্ট্য। এ তিনটির নিরিখে বোঝা যায় মাগধী-প্রাকৃত-সাঁওতালি-মুন্ডা ভাষা বাংলা ভাষার আদি উৎস।

বর্তমানে প্রচলিত বাংলা ভাষার তিন রকমের ব্যবহার নিয়ে এ লেখাটি সাজানো—মাতৃভাষা, আঞ্চলিক ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা।

মাতৃভাষা

মানুষের প্রথম ভাষা হলো তার মাতৃভাষা। এ ভাষা তার মায়ের মুখে শুনে শুনে নিজের অজান্তেই একসময় বলতে শুরু করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত এই মাতৃভাষাটা তার এলাকায় প্রচলিত যে আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, তা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হলে শিশুটি সেই দেশের রাষ্ট্রভাষায় (যেটা সরকারিভাবে স্বীকৃত) বলতে, পড়তে ও লিখতে শুরু করে।

ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে প্রথমে মায়ের ভাষায় কথা শিখে পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অন্য একটি ভাষা (অথবা একই ভাষার স্ট্যান্ডার্ডাইজড রূপ) শেখা ও ব্যবহার করাকে বলে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’। যেমন ধরুন, কারও দেশের বাড়ি কুমিল্লা। জন্মাবধি তিনি কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে আসছেন, এরপর শিশুকালে যখন স্কুলে যেতে শুরু করলেন, তখনই শুদ্ধ বাংলায় পড়ালেখা শুরু হয়ে গেল—বাংলাদেশের বেশির ভাগ

শিশুর ক্ষেত্রে এই স্ট্যান্ডার্ড ভাষা শেখাটা হয়ে থাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’য়। তা ছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবে গেলে দেখতে পাবেন মাল্টি লিঙ্গুয়াল এডুকেশনের অন্তর্গত গারো, মারমা, চাকমা, সাদ্রী, এবং ত্রিপুরার ভাষা শিক্ষার পাঠ্যক্রম রয়েছে। এসব ভাষাভাষী তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় শিক্ষা লাভ করে থাকেন।

তাহলে বলা চলে, মায়ের মুখে অথবা বাবার মুখে অথবা যে ঘরে/এলাকায়/সমাজে শিশুটি জন্ম নেয়, সেখানকার প্রচলিত ভাষাই তার ঠোঁটে মায়ের ভাষা হয়ে ফুটে ওঠে।
আঞ্চলিক ভাষা

অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার প্রচলিত রূপগুলোই আঞ্চলিক ভাষা নাম পরিচিত। বাংলাদেশে এ রকম ৪১টি প্রকারভেদের সন্ধান রয়েছে। এ সব কটির মধ্যে চারটি প্রকারভেদ রয়েছে, যাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণমালা এবং ব্যাকরণপদ্ধতি বিদ্যমান। স্বয়ংসম্পূর্ণ এ চারটি ভাষা হলো বাংলা, সিলেটি, চাকমা এবং মৈতৈ। সিলটি মাত, চাঙমাহ বাচ, বাংলা ভাষা এবং মৈতৈ লন এ—এদের নিজস্ব বর্ণমালা ও স্বতন্ত্র ব্যাকরণ রয়েছে।

আবার বলছি, বাংলা ভাষায় কথা বলার পাশাপাশি এ দেশে আরও ৪০টি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন। ভাষাতত্ত্বের একধরনের হিসেবে এ ভ্যারাইটিগুলোকে বলা যেতে পারে ভার্নাকুলার বা আঞ্চলিক ভাষা, আবার অন্য ধরনের হিসেবে এগুলো ‘ভাষা’; এগুলো হলো সুনির্দষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত ‘মায়ের ভাষা’। এ প্রসঙ্গে বলা চলে, আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশি হলেও ভাষাগত দিক দিয়ে আমরা সবাই কিন্তু বাঙালি নয়। হ্যাঁ, বলা যায় যে ভাষার রাষ্ট্রীয় মানে পোশাকি রূপের কারণে আমরা বাংলাভাষী—বাংলা ভাষার বিশাল চাদর তলে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই বলা যায় সেটা, কিন্তু আঞ্চলিকতার হিসেবে বলা যায় যে আমরা কেউ চাটগাঁইয়া, কেউ ময়মনসিংগা, কেউ বরিশাইল্যা, কেউ সিলেটি ইত্যাদি।
রাষ্ট্রভাষা

একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা সে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ হেতু তৈরি হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক-আঞ্চলিক-রাজনৈতিক নিয়ামক বিবেচনা করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের হেতু বাংলা আমাদের ‘মাতৃভাষা’ হবে কি না, এ নিয়ে ছিল না। এ আন্দোলনটা পুরোপুরিই ছিল এই পূর্ব পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা’ কী হবে, সেই দাবি নিয়ে। ভাষা আন্দোলন যখন চলছিল, বলা হচ্ছিল: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’। এ কথা বলা হয়নি যে কেউ উর্দু ব্যবহার করতে পারবে না। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একমেবাদ্বিতীয়ম বাংলাকেই চাওয়া হয়েছিল।
তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকের ছেলেপেলেরা, যারা উর্দু ও ইংরেজি জানে না, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে ভাষাটি জানার অথবা না জানার কারণে তারা চাকরি পাবে অথবা বঞ্চিত হবে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার বিষয়টি ছিল তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। ‘বাংলা’ বলতে বাংলা ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট ভ্যারাইটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাই, সেটার চেয়ে বড় বিষয় ছিল ‘বাংলা’ হলেই চলবে; কোনোভাবেই রাষ্ট্রভাষাটা যেন ‘উর্দু’ হতে না পারে।

৪.
নিজের দেশের জন্য জাতীয়তাবোধ লালন করা এক জিনিস, আর সুনির্দিষ্ট একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে একত্মতাবোধ করা অন্য জিনিস। যে মাটিতে আমার জন্ম, যে মাটির ভাষা অনায়াসে মুখে চলে আসে, সে ভাষা হলো আমার আত্মার পরমাত্মীয়। ভাষাগত দিক থেকে বাংলাদেশের এই ৪১টি প্রকারভেদের কোনো না কোনোটির সঙ্গে আমরা সহজাতভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে থাকি।

এবার নিজের ভাষা প্রসঙ্গে বলছি। আমার নিজের বাংলা ভাষার ধরনটা কী—মানে সেটা তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ নাকি ‘অশুদ্ধ’ বাংলা, আর শুদ্ধ হলেও তা মাপার গজকাঠি কেমন হবে—এ নিয়ে আমার নিজের মনেই দ্বন্দ তৈরি হয়েছিল এককালে। এর কারণে আসি—আমার মায়ের আদি বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় আমার নানাভাই তাঁর পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। আমার মায়ের কথায় হালকা–পাতলা ওদিককার টান ছিল।

অন্যদিকে আমার আব্বুর বাড়ি সিলেটে। আব্বু আজীবন বাংলায় কথা বলত আমাদের সঙ্গে। আমার জন্ম ও বড় হওয়া ঢাকায়। আমি মোটামুটি ‘শুদ্ধ’ বাংলায় কথা বলি; ‘কথ্য’ বাংলা আমার মোটেও আসে না। ‘খাইসি, গেসি’ বাংলা আমাকে দিয়ে কস্মিন কালেও হয়নি; এ নিয়ে অনেক হাসাহাসি করেছে আমার বন্ধুরা। হাসবে না-ই বা কেন ওরা? আমি বলি ‘খেয়েছি’, ‘গিয়েছি’ ধরনের বাংলা। ছাপার অক্ষরে কথা শুনতে কার না হাসি পায়?

আমার যখন ৯ বছর বয়স, তখন সিলেটে চলে গেলাম। এক দশক ধরে সিলেটে থাকাকালীন সিলটি মাত শুনলাম, মনে মনে শিখলাম। এরপর বলতে শুরু করলাম ভাঙা ভাঙা, বিদঘুটে উচ্চারণে। যে স্কুলে পড়তাম, তা ছিল সিলেটের কুলীন স্কুল, সেখানে কোনো সিলেটি ভাষার চর্চা ছিল না। সবাই শুধু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলত।

আমার আত্মীয়স্বজনেরা সিলেটিতে কথা বলত, আর আমি উত্তর দিতাম বাংলায়। সেই রেওয়াজ এখনো চালু আছে। বলা বাহুল্য, আমার সিলেটি আত্মীয়-বন্ধুরা ব্যাপক বিনোদন পায় আমার সিলটি মাত শুনে।

আমার শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা। ওরা ‘খাইসি’ ‘গেসি’ বলা লোকজন। আমি শুনেছি, আমার প্রথম মেয়ের জন্মের পর আমার শাশুড়ি খুশি হয়ে তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, ‘ভালোই হইসে, তোর মেয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা কইব।’

আমার মতো অনেকেই যাদের মায়ের ভাষা ‘শুদ্ধ’ রকমের বাংলা, এ ভাষার কোনো ধরন তারা ধারণ করেছেন—এ নিয়ে আমার মতো তাদের মনে দ্বিধা থাকাটা হয়তো বিচিত্র নয়।

৫.
বাংলার ‘রাঢ়ী’ উপভাষাকে এ দেশের (এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের) কথ্য ভাষাগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যারাইটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তা ছাড়া বাংলা ভাষার বর্ণমালা এবং ব্যাকরণ থাকায় বিবেচনার অগ্রগণ্যে চলে আসে। বাংলা উপভাষার প্রমিতকরণের সময় কলকাতাকেন্দ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল। ভাষাতাত্ত্বিকেরা ও নীতিনির্ধারকেরা কলকাতা ও তৎসংলগ্ন এলাকার বোলচালকে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যারাইটি হিসেবে অগ্রে বিবেচনা করেছেন।

বাংলাদেশে ‘বঙ্গালি’ উপভাষা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এটি অধুনা বাংলাদেশের প্রধান উপভাষা। ঢাকা বিভাগ, ময়মনসিংহ বিভাগ, খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ, বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালী এবং ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আছে এই উপভাষার ব্যবহার। একটা দেশে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষাগুলোর চেয়ে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যারাইটি (যা কিনা আইন করে একটি দেশের রাষ্টীয় ভাষার মর্যাদা পায়) কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুটির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

বাংলাদেশে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুধু ‘প্রমিত বাংলা’ই ‘শুদ্ধ ভাষা’ (যেটা রাঢ়ী উপভাষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ) এ ধারণাটি পোষণ করা বিভ্রান্তিমূলক। যেমন ধরুন, সিলেটি ভাষাটাও একটি ‘শুদ্ধ ভাষা’। নিজস্ব বর্ণমালায় লেখা সিলেটের রয়েছে হাজার বছরের সাহিত্য, অনেকের কাছে বিষয়টি অজানা থাকলেও এর নমুনা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।

স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ‘ভাষা কী?’ এর সংজ্ঞা শিখতে গিয়ে মুখস্থ করেছিলাম, ‘আমরা যাহা বলিয়া মনের ভাব প্রকাশ করি, তাহাকে ভাষা বলে।’ এখানে জুড়ে দিচ্ছি, সব ভাষাই শুদ্ধ এবং পরিপূর্ণ। সে ভাষায় ব্যাকরণ আছি কি নেই, তার বর্ণমালা আছে কি নেই, তার আনুপাতিক বিবেচনার চেয়ে জরুরি হলো এটা বোঝা-সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের জন্য ভাষাই একমাত্র মাধ্যম, যা মনের ভাব পুরোপুরিভাবে মেলে ধরে আসছে। ভাষার পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার কোনো উপায়ই নেই।

৬.
মাতৃভাষা-আঞ্চলিক ভাষা-রাষ্ট্রভাষা—এ নিয়ে বাদানুবাদ থেকে সরে এসে বলছি, আমাদের কাছে বাংলার বিকল্প কখনোই অন্য কোনো ভাষা হতে পারে না। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের নিরতিশয় আবেগ এবং সর্বস্তরে এর প্রয়োগের পাশাপাশি আরেকটি জরুরি বিষয় রয়েছে, সেটি হলো আপনার-আমার প্রাত্যহিক অভ্যাসে বাংলাকে নিয়ে আসা। যেখানে একটি উপযুক্ত বাংলা শব্দ ব্যবহার করা যায়, একটি বাক্য ব্যবহার করা যায়, সেখানে বাঙালিমাত্রেই অভ্যাস করা দরকার অন্য ভাষা, যেমন হিন্দি অথবা ইংরেজি ব্যবহার না করে তা বাংলায় বলা। হিন্দি-ইংরেজি থেকে ধার করা শব্দ পরিহার করার ডাক এসেছে। শিশু বয়স থেকেই এ অভ্যাসে পরিশীলন আনতে সন্তানদের উৎসাহিত করার সময় এসেছে।
‘মোদের গরব মোদের আশা
আ–মরি বাংলা ভাষা’

*লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী