উত্তর মেসিডোনিয়ার গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল

গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালে কনেকে সাজানো হয় এভাবে।
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত প্রায় ৯ হাজার ৯২৮ বর্গমাইল আয়তনের ছোট্ট দেশটির নাম উত্তর মেসিডোনিয়া। প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশটি উত্তরে সার্বিয়া, পূর্বে বুলগেরিয়া, দক্ষিণে গ্রিস ও পশ্চিমে আলবেনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। এ ছাড়া উত্তর মেসিডোনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে কসোভো নামক একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল রয়েছে।

১৯৯১ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে উত্তর মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলকান উপদ্বীপের এ দেশটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র গ্রিস, বুলগেরিয়া ও আলবেনিয়ার সঙ্গে একাধিক বিবাদে জড়িয়েছে। গ্রিসের চাপে বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালে দেশটি তার নাম মেসিডোনিয়া থেকে পরিবর্তন করে ‘উত্তর মেসিডোনিয়া’ রাখে।

অপেক্ষাকৃতভাবে উত্তর মেসিডোনিয়া যেমন একটি অর্বাচীন রাষ্ট্র, ঠিক একইভাবে তাঁদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশও খুব বেশি দিনের নয়। অর্থনৈতিকভাবেও উত্তর মেসিডোনিয়া পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে, দেশটিতে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। বলা বাহুল্য, উত্তর মেসিডোনিয়া গোটা ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিবছর তাই ভাগ্যের সন্ধানে দেশটি থেকে অসংখ্য মানুষ উন্নত জীবনের আশায় বাইরের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। উত্তর মেসিডোনিয়ার পর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মেসিডোনিয়ানদের বসবাস অস্ট্রেলিয়াতে।

গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের অন্যতম প্রাণ উপিয়া নামের এ ফোয়ারা।
ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমার ইরেনা প্রোসহিচ ও তানিয়া মাশা নামের দুই নর্থ মেসিডোনিয়ান তরুণীর পরিচয় হয়। তাঁদের মাধ্যমে উত্তর মেসিডোনিয়া সম্পর্কে প্রথম জানার সুযোগ পাই। কয়েক দিন আগে ইরেনার সঙ্গে চ্যাট হচ্ছিল।

ইরেনা একসময় আমাকে বললেন, ‘রাকিব, তুমি যদি কোনো দিন নর্থ মেসিডোনিয়াতে বেড়াতে আসো, তবে কখনো কাউকে মেসিডোনিয়ার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন করবে না।’ আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, প্রত্যেক জাতির অতীত ইতিহাসে কোনো না কোনো বিষয় থাকে, যা সমগ্র জাতিসত্তার কাছে গৌরবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু আপনি এমনটি বলছেন কেন? ইরেনা বিষাদের সুরে বলে উঠলেন, ‘আমাদের অতীত ইতিহাসে এমন কোনো বিষয় নেই, যা সত্যি আমাদের আলাদাভাবে বিশ্বের বুকে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন একটা সুবিধাজনক পর্যায়ে নেই। প্রতিবেশী দেশ সার্বিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও আলবেনিয়া সব সময় আমাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে। মাঝেমধ্যে মনে হয় কেন উত্তর মেসিডোনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল?’
ইরেনার কথার তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন ভেঙে সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো ও কসোভো নামক সাতটি ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতার দাবিতে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, কসোভো ও ক্রোয়েশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

কিন্তু উত্তর মেসিডোনিয়া ছিল যুগোস্লাভিয়ার ইতিহাসে এমন কোনো রাষ্ট্র, যারা কোনো ধরনের যুদ্ধ ছাড়া সরাসরি গণভোটের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।

সার্বিয়া কিংবা ক্রোয়েশিয়া উত্তর মেসিডোনিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের পথে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। সে হিসেবে যুগোস্লাভিয়ার অধীনে থাকা অন্য দেশগুলোর তুলনায় উত্তর মেসিডোনিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কসোভো ছাড়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অধীনে থাকা অন্যান্য পাঁচটি দেশের তুলনায় উত্তর মেসিডোনিয়ার অর্থনীতি ও উন্নত অবকাঠামো—এ দুই দিক থেকে একেবারে পিছিয়ে। দেশটিতে দারিদ্র্যের হারও অনেক বেশি। বলকান উপদ্বীপের এ দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও চোখে পড়ার মতো। উত্তর মেসিডোনিয়ার সাধারণ নাগরিকদের একাংশ মনে করেন তাঁদের দেশের এ দৈন্য দশার জন্য আলবেনিয়ানরা দায়ী। যদিও দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান, কিন্তু তারপরও উত্তর মেসিডোনিয়ার এসব সাধারণ নাগরিক আলবেনিয়ানদের তাঁদের দেশের ভূমিপুত্র হিসেবে স্বীকার করতে চান না।

ইরেনার কাছ থেকে এত কিছু জানার পর আমার সত্যি খারাপ লাগছিল। চ্যাটে ব্যবহার করা প্রতিটি বাক্যের মধ্যে তিনি না বলা অনেক হতাশা লুকিয়ে রেখেছিলেন। হাজারো মানুষের সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ের ফলে একটা দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, আর উত্তর মেসিডোনিয়ার অধিবাসীরা তাঁদের অর্জিত স্বাধীনতাকে ছেড়ে দিতে চায়।

শীতকালে কয়েক ইঞ্চি পুরু বরফে ঢেকে যায় গ্যালিচনিকসহ আশপাশের গ্রামগুলো, এ কারণে বছরে কেবল জুলাই মাসে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়।
ছবি: সংগৃহীত

আমি নাছোড় বান্দা, আবারও বললাম, ‘ইরেনা, তুমি কি আমাকে অন্তত একটি ঐতিহ্যের কথা বলতে পারবে না, যেটা অন্যান্য দেশে নেই, কিন্তু তোমাদের দেশে আছে?’ অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনার পর জানালেন গ্যালিচনিক ওয়েডিং উৎসবের কথা।

পরবর্তী সময়ে তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি জানান, ‘উত্তর মেসিডোনিয়ানদের জাতীয় জীবনে উল্লেখ করার সামান্য যে কয়েকটি বিষয় রয়েছে; তাদের মধ্যে গ্যালিচনিক ওয়েডিং উৎসবের নাম সব সময় সবার ওপরে থাকে। কেননা, ইউরোপ মহাদেশের অন্য কোনো দেশে এ রকম জাঁকালোভাবে বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনের রীতি নেই।’ তানিয়া আরও বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিচনিক ওয়েডিং উৎসব আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিশ্বের বুকে আমাদের পরিচয়কে নতুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।’

অধীর আগ্রহ নিয়ে তাই তাঁদের কাছ থেকে গ্যালিচনিক ওয়েডিং উৎসব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। ইরেনা ও তানিয়া থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা অনুযায়ী লেখার পরবর্তী অংশকে সাজানোর চেষ্টা করছি।

উত্তর মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়ে থেকে ৭৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্ত্রা পর্বতের ঢালে একটি ছোট্ট গ্রাম গ্যালিচনিক। প্রতিবছরের জুলাইয়ে এ গ্রামে এক বিবাহ উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা বর্তমানে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। উত্তর মেসিডোনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী এবং বাইজেনটাইন সম্রাটদের হাত ধরে প্রতিবেশী দেশ গ্রিস, বুলগেরিয়া ও সার্বিয়ার মতো উত্তর মেসিডোনিয়াতেও অর্থোডক্স চার্চের বিস্তার ঘটেছে। অর্থোডক্স চার্চে ব্যবহৃত বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর ১২ জুলাইয়ে সেন্ট পিটারস ডে উদ্‌যাপন করা হয়।

সেন্ট পিটারস ডেকে সামনে রেখে নিকটবর্তী কোনো এক সপ্তাহে এ বিবাহ উৎসবের আয়োজন করা হয়। অতীতে পুরো পাঁচ দিনব্যাপী বিভিন্ন জাঁকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করা হতো গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল। বর্তমানে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের জন্য পাঁচ দিনের পরিবর্তে কেবল দুই দিন সময় নির্ধারণ করা হয়।

বরের মা কনেকে আপ্যায়ন করছেন।
ছবি: সংগৃহীত

সেন্ট পিটারস ডের কাছাকাছি কোনো এক সপ্তাহের শুক্রবারে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। উৎসবের মূল আয়োজন থাকে শনি ও রোববার ঘিরে।

১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতো গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল অফিশিয়াল রূপ লাভ করে। এর আগে ১৯৩৬ সালে প্রাপ্ত এক লিখিত বিবরণী থেকে প্রথম গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, গ্যালিচনিকের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহ উৎসব আয়োজনের রীতি কয়েক শ বছরের পুরোনো।

গ্যালিচনিকসহ গোটা ডোলনা রেকা অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীদের ‘মিয়াসিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। ধারণা করা হয়, তাঁরা উত্তর মেসিডোনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে পুরোনো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। জীবিকার সন্ধানে তাঁরা রাদিকা নদীর তীরে বসতি গড়ে তোলেন। কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন।

চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে উত্তর মেসিডোনিয়া অটোমানদের অধীনে আসে। প্রায় পাঁচ শ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে অটোমানদের শাসন স্থায়ী হয়। নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি অটোমানদের সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ মিয়াসিয়াদের মধ্যে প্রবেশ করে, যা গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালকে প্রভাবিত করে। অটোমান শাসনামলে মিয়াসিয়াদের অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, যাঁরা বর্তমানে টরবেশি নামে পরিচিত।

নববিবাহিত দম্পতির উদ্দেশে এভাবে নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোস্লাভিয়া ধীরে ধীরে শিল্পক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হতে থাকে। তাই উন্নত জীবনের আশায় গ্যালিচনিকে বসবাস করা বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ স্কোপিয়েসহ বিভিন্ন শহরতলিতে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে গ্যালিচনিক জনশূন্য হওয়ার উপক্রম হয়। তা ছাড়া উত্তর মেসিডোনিয়ার প্রধান শহরগুলো থেকে গ্যালিচনিকের যাতায়াতব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। এ কারণে এ গ্রামের বেশির ভাগ অধিবাসী যাঁরা গ্যালিচনিক থেকে অন্যত্র চলে যেতেন, তাঁদের মধ্যে নিজ গ্রামে ফিরে আসার জন্য তেমন একটা আগ্রহ দেখা যেত না। শীতকালে গ্যালিচনিকসহ আশপাশের গ্রামগুলো কয়েক ইঞ্চি পুরু বরফে ঢেকে যায়। তাই নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত গ্যালিচনিকে প্রবেশের মূল রাস্তাটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

একবিংশ শতাব্দীর এ যুগেও গ্যালিচনিকে খুব একটা উন্নয়নের ছাপ দেখা যায় না। আজকের দিনেও তাই গ্যালিচনিককে প্রত্যন্ত কোনো অজপাড়াগাঁয়ের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল কিছু বলা হবে না। বর্তমানে এ গ্রামে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের বসবাস রয়েছে।

ষাটের দশকে স্থানীয় গ্রামবাসীরা একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যাঁরা গ্যালিচনিক ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের আবার গ্রামমুখী করতে তাঁরা অফিশিয়ালি এ বিবাহ উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলেন। পাঁচ দিনের পরিবর্তে সমগ্র উৎসব আয়োজনের জন্য দুই দিনকে বেছে নিলেন। জুলাই মাসে উত্তর মেসিডোনিয়ার বেশির ভাগ অধিবাসী গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের সুযোগ পান। অন্যদিকে শনি ও রোববার উত্তর মেসিডোনিয়াতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অন্তত এ দুই দিন বেশির ভাগ মানুষের তেমন একটা কাজের চাপ থাকে না। এদিকে সেন্ট পিটারস ডে খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছেও পবিত্র দিন হিসেবে বিবেচিত হয়, এ কারণে এই দিন ঘিরে সরকারি ছুটিও থাকে। তাই সব মিলিয়ে তাঁরা সেন্ট পিটারস ডের কাছাকাছি কোনো এক সপ্তাহের শনি ও রোববারকে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের প্রধান দিনক্ষণ হিসেবে নির্ধারণ করলেন। গ্যালিচনিকে কেবল বছরের এ একটি সময়ে সব বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অতীতে ৪০ থেকে ৫০ দম্পতি গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতেন, বর্তমানে কেবল এক দম্পতিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। যেসব দম্পতি গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান, তাঁদের আগে থেকে আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। নির্দিষ্ট কিছু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আয়োজকেরা নির্ধারণ করেন একক দম্পতি হিসেবে কারা গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালে কেবল সেসব দম্পতিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, যাঁরা পারিবারিকভাবে গ্যালিচনিকের সঙ্গে সংযুক্ত, অর্থাৎ যাঁদের পূর্বপুরুষ কোনো এক সময় এ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বর কিংবা কনের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে পারিবারিকভাবে এ গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য এ নিয়ম শিথিলের বিষয়ে প্রস্তাব উঠেছে।
সব মিলিয়ে ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক রীতির আলোকে এ বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।

ফেস্টিভ্যাল শুরুর আগে বর ও তাঁর পরিবারের লোকজন মৃত আত্মীয়দের কবর পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এরপর তাঁরা কুমের বাড়িতে যান এবং কুমকেও বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কুমকে ইংরেজি ভাষায় দ্য বেস্টম্যান বলা হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন বিবাহ উৎসবে ‘উকিল বাবা’ নামক এক বিশেষ সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে।

নাচের পাশাপাশি ড্রামবাদকদের ড্রাম বাজানোর দৃশ্য।
ছবি: সংগৃহীত

কুম ও উকিল বাবার ভূমিকা কিছুটা কাছাকাছি ধরনের, যদিও আমাদের দেশে কনেরা উকিল বাবা নির্বাচন করেন, অন্যদিকে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালে কুম নির্বাচন করা হয় বরের পক্ষ থেকে। এরপর বর পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে আলাদা হয়ে যান। গ্যালিচনিক গ্রামে উপিয়া নামক এক ফোয়ারার উপস্থিতি রয়েছে। এ ফোয়ারার সামনে বরকে শেভ করে পরিষ্কার হতে হয়। শেভিংয়ের সময় বর চাইলে কাছের কোনো বন্ধুকে সঙ্গে রাখতে পারেন, কিন্তু কোনোভাবে তাঁর মা–বাবা কিংবা পরিবারের নিকটাত্মীয়রা এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেন না। অর্থাৎ বরকে এ সময় মা–বাবা থেকে আলাদা হয়ে যেতে হয়।

প্রায় ৫০ জনের বরযাত্রী নিয়ে বর এরপর কনের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাঁরা কনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। বরযাত্রীর মধ্য থেকে একজন পুরো যাত্রাপথে অন্যদের নেতৃত্ব দেন, যাকে ‘বায়রাক্টার’ বলা হয়।

বায়রাক্টারের হাতে উত্তর মেসিডোনিয়ার জাতীয় পতাকা শোভা পায়। বরযাত্রী কনের বাড়িতে পৌঁছালে বরের নিকটতম কোনো বন্ধু কনের মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তাঁদের থেকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চান। এ সময় কনের পরিবারের পক্ষ থেকে একজন এসে বায়রাক্টারের হাত থেকে জাতীয় পতাকা নিয়ে কনের বাড়ির জানালায় সেটিকে স্থাপন করেন।

কনের মা–বাবার অনুমতি সাপেক্ষে বরযাত্রী তাঁদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় কনে বিয়ে উপলক্ষে তাঁর হাতে পরিহিত আংটির মধ্য দিয়ে বরকে দেখার চেষ্টা করেন। বর কনের মা–বাবার উভয় হাতে চুমু দেন, কনের মা–বাবা বরের ঘাড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে দেন।

কনের বাড়ির সামনে টেবিল রাখা হয়, যেখানে বরযাত্রীর লোকেরা আসন গ্রহণ করেন। বরের মা কনের সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন এবং বিয়ে উপলক্ষে তাঁকে কিছু উপহার প্রদান করেন। কনে এ সময় বরের মায়ের দুই হাত চুম্বন করেন এবং তিনি বিয়ের পোশাক পরিধান করে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেন। বিয়ের সাজে সজ্জিত কনে বরের নিকটতম কোনো বন্ধুর মাধ্যমে বরযাত্রীর নিকট সংবাদ পাঠান যে তিনি চূড়ান্তভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসার জন্য সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে প্রস্তুত। কনে এরপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করেন। বায়রাক্টরের নির্দেশে এরপর কনেসহ বিয়ের অনুষ্ঠানে আগত একদল অতিথি বরের বাড়িতে যাত্রা শুরু করেন।

বায়রাক্টরের হাতে এ সময়ও উত্তর মেসিডোনিয়ার জাতীয় পতাকা শোভা পায়।
কনে যখন বরের বাড়িতে পৌঁছান, তখন তাঁকে দেখামাত্র বরের মা চালনি, কেক ও এক ঘড়া ওয়াইন দ্বারা নতুন বউকে বরণ করে নেন। বরের মা এ সময় তিনবার কনেকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করেন এবং উপহারের কেক দিয়ে তাঁর মাথায় আলতোভাবে চাপ দেন। বর তাঁর ঘোড়া থেকে নেমে আসেন এবং কনেকেও তিনি ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করেন।

ঐতিহ্যবাহী পোশাকে মেসিডোনিয়ান নারীরা।
ছবি: সংগৃহীত

বায়রাক্টর এরপর বর ও কনে উভয় পক্ষের লোকজনকে নিয়ে বরের বাড়ি থেকে গ্যালিচনিক গ্রামের নিকটবর্তী অর্থোডক্স চার্চের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। বরের মা এ সময় তাঁর হাতে কেটলি ও তুলসীপাতার তৈরি স্তবক রাখেন। বাড়ি থেকে চার্চের পথে রওনা দেওয়ার সময় তিনি বর ও কনেকে অন্য অতিথিদের লোকজনকে দম্পতি থেকে আলাদা করে দেন। চার্চের প্রবেশমুখে বর ও কনেকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য লালগালিচা বিছানো হয়। পাশাপাশি ওড়ানো হয় উত্তর মেসিডোনিয়ার জাতীয় পতাকা।

অর্থোডক্স চার্চ প্রদত্ত সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে বর ও কনেকে বিয়ে দেওয়া হয়। নববিবাহিত দম্পতির সম্মানে গ্যালিচনিক গ্রামে অবস্থিত উপিয়া নামক ফোয়ারাটার সামনে এক বিশাল ভোজসভার আয়োজন করা হয়।

উত্তর মেসিডোনিয়াসহ বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোতে রাকিয়া নামক একধরনের পানীয়ের প্রচলন রয়েছে। রাকিয়াতে অ্যালহোকলের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি, বিভিন্ন ধরনের আঙুর থেকে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় রাকিয়া। যেকোনো উৎসব কিংবা পার্বণে এ অঞ্চলের মানুষ রাকিয়া পান করে থাকেন।

গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যেও রাকিয়া পরিবেশনের রীতি রয়েছে। এমনকি বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর বর সবার প্রথমে রাকিয়া পান করেন। গ্রামে অবস্থিত সব কবরের ওপর রাকিয়া ছিটানো হয়। স্থানীয় জনসাধারণ বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমানো গ্যালিচনিক গ্রামের আদি অধিবাসীদের আত্মারা সেখান থেকে রাকিয়া পান করবেন এবং তাঁরাও উৎসবের আনন্দে শামিল হতে পারবেন।

ভোজসভা শেষে বরের বাবা ও বরপক্ষ থেকে নির্বাচিত কুম কনে ও আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে উপিয়ার দিকে যান। সেখান থেকে কনে পানি নিয়ে ঘড়া ভর্তি করেন। নববিবাহিত দম্পতির সম্মানে এরপর নাচের আয়োজন করা হয়। বর ও কনের মা এ সময় এক বিশেষ নৃত্য পরিবেশন করেন। একে বলা হয় এসভেকরভিনো বা মাদার–ইন-ল ড্যান্স। কনেকে নিজের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে নাচ পরিবেশন করতে হয়। এ ছাড়া উত্তর মেসিডোনিয়াতে টেসকোটো নামক একধরনের নাচের প্রচলন রয়েছে। ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে টেসকোটো নাচও পরিবেশন করা হয়।

নাচের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো যায়। ড্রামের পাশাপাশি কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্র জুরলা উত্তর মেসিডোনিয়ার বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে ব্যাপক জনপ্রিয়। গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালও এর ব্যতিক্রম নয়। অতীতে পুরো পাঁচ দিনজুড়ে এসব রীতিনীতি সম্পন্ন করার মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠানের ইতি টানা হতো, এখন মাত্র দুই দিনে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে দেওয়া হয়।

গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বর ও কনে থেকে শুরু করে বিয়ে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সব অতিথিকে লাল (ক্রিমসন) রঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে হয়। মেয়েদের ব্যবহৃত পোশাকটি প্রায় ২৫ কিলোগ্রাম ওজনের হয়ে থাকে, ৪৬টি ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে এ পোশাক তৈরি করা হয়। সাদা রঙের হাতাবিশিষ্ট এ ধরনের পোশাকে সুচের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। পুরুষেরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পাশাপাশি কালো রঙের জ্যাকেট ব্যবহার করেন এবং মাথায় হ্যাট পরিধান করেন। অন্যদিকে মেয়েরা সাদা কাপড়ের ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখেন।

ইন্টারনেটের কল্যাণে গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যালের কথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই জুলাই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক উত্তর মেসিডোনিয়াতে আসেন কেবল গ্যালিচনিক ওয়েডিং ফেস্টিভ্যাল দেখার জন্য। দেশটির সরকারের পাশাপাশি ইউনেসকোও বর্তমানে এ ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

* লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া