উৎসবের নাম হ্যালোইন

অল হ্যালো’স ইভ বা হ্যালোইন উৎসব খ্রিষ্টান দুনিয়ায় অন্যতম প্রধান উৎসব। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী এই উৎসব পালন করলেও উন্নত বিশ্বে এটি একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পরিণতি পেয়েছে।

ইউরোপ, আমেরিকাসহ ‌অন্যান্য উন্নত দেশে অক্টোবর মাস শুরু হলেই বিভিন্ন দোকানে হ্যালোইন উৎসবের জন্য একটা সাজসাজ ভাব শুরু হয়ে যায়। মিষ্টিকুমড়া থেকে শুরু করে কালো রঙের পোশাক, মাকড়সার জাল, ভূত সাজার মুখোশ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক আরও হরেক রকমের জিনিসপত্র বিক্রির ধুম পড়ে যায়।

৩১ অক্টোবরের আগেই যেসব বাড়ির লোকজন হ্যালোইন উৎসব পালন করে বাড়ির দরজার সামনে একটি বা দুটি, যার যেমন ইচ্ছা, আস্ত মিষ্টিকুমড়া রেখে দেয় এবং বাড়ির দরজা কৃত্রিম মাকড়সার জাল, কালো রঙের কৃত্রিম মাকড়সা, ভুতুড়ে মোমবাতি, মৃত মানুষের কৃত্রিম মাথার খুলি এবং আরও নানান রকমের ভীতিকর জিনিসপত্র দিয়ে বাড়ির সামনের দরজা সাজায় অথবা দরজার সামনে রেখে দেয়!
আর ৩১ অক্টোবর বিকেল থেকেই বাড়ির দরজার সামনে একটা ঝুড়ি বা ডালায় রেখে দেওয়া হয় চকলেট ও মিষ্টি–জাতীয় খাবার। বিকেল থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কালো ভূতের পোশাক বা হ্যালোইন ড্রেস পরে, ভুতুড়ে সাজে মুখ রাঙিয়ে বা ভুতুড়ে মুখোশ পরে বন্ধুদের সঙ্গে অথবা একজন অভিভাবকের সঙ্গে পাড়া–মহল্লায় ঘুরে ঘুরে এসব চকলেট সংগ্রহ করে এবং চমৎকার উৎসবের আমেজ পায় পুরো বিষয়টি। এ ছাড়া এ দিন বয়োজ্যেষ্ঠরাও প্রার্থনা, বিশেষ খাবারের আয়োজনসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু আচার–অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

একটি ২০শ শতকের আইরিশ হ্যালো'উইন মুখোশ
ছবি: উইকিপিড়িয়া

হ্যালোইন উৎসবের মূল সূতিকাগার আয়ারল্যান্ডে দিবসটিতে রীতিমতো সরকারি ছুটি থাকে। আমাদের দেশে ‘হ্যালোইন’ উৎসব এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় হয়নি। তবে বিশ্ব সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সহজলভ্যতার এই সময়ে আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও নির্মল আনন্দদায়ক উৎসবটি চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই।

কিন্তু একটা উৎসবকে কেন এমন সব অশুভ ভুতুড়ে প্রতীকের মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয়? এটা একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই। সব অগতির গতি ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলাম।

অল হ্যালো’স ইভ বা হ্যালোইন উৎসব মূলত মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে পালন করা হয়। এসব মৃত ব্যক্তির মধ্যে আছেন সাধু-সন্ত, কোনো ভালো কাজের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তি এবং বিশ্বাসীগণ। দিনটিকে আরও কিছু নামেও ডাকা হয়, যেমন ডে অব দ্য ডেড, অল সেইন্টস ডে, রিফরমেশন ডে।

স্ন্যাপ-অ্যাপল নাইট, আয়ারল্যান্ডে হ্যালোইন উৎসব, ড্যানিয়েল ম্যাকলাইস কর্তৃক ১৮৩৩ সালে অঙ্কিত
ছবি: উইকিপিড়িয়া

হ্যালোইন উদ্‌যাপনের পেছনে আরও একটা বিশ্বাস বা ধারণা কাজ করে এবং সেই ধারণাই অধিক যৌক্তিক বলে মনে হয়। আর তা হলো ফসল তোলার সঙ্গে এই উৎসবের একটি সম্পর্ক আছে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইউরোপে বিশেষত আয়ারল্যান্ডে ‘কেলটিক’ নামে এক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল এবং এই জনগোষ্ঠী ছিল মূলত কৃষিজীবী। এই জনগোষ্ঠীর ‘সামহাইন’ (Sow-win) বা সামার অ্যান্ড, যা মূলত অক্টোবর মাসের শেষ দিনেই উদ্‌যাপিত হতো এবং নভেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকে শীতের পরবর্তী ছয় মাস ডার্ক হাফ অব দ্য ইয়ার বা তমসাচ্ছন্ন বা অন্ধকার সময় হিসেবে গণ্য করত। শীতের দেশে অক্টোবর মাস হলো ফসল তোলার শেষ সময়। এরপর পরবর্তী ছয় মাস প্রচণ্ড ঠান্ডা আর বরফের কারণে ফসল রোপণ বা ফসল তোলার কোনো সুযোগ নেই।

এখনো শীতের দেশে অক্টোবর মাস শুরু হলেই শুরু হয় মেঘ আর বৃষ্টি, প্রায় সারা দিন সারা রাত বিরামহীনভাবে ঝরছে তো ঝরছেই! আর আজ থেকে দুই হাজার বছর আগের শীতের দেশের অবস্থা তো আমরা এখন চিন্তাও করতে পারি না। আজ থেকে ৩০–৪০ বছর আগে শীতকালে আমাদের দেশেও যেমন কনকনে ঠান্ডা পড়ত, এখন তার ছিটেফোঁটাও অনুভব করা যায় না। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আর বায়ুদূষণের করাল গ্রাসে দীর্ঘায়িত হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ আর দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড সেদিকেই যেতে বাধ্য করছে ধরিত্রীমাতাকে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে শীতকাল। তখন হয়তো শীতের দেশের মানুষের হ্যালোইন উৎসব পালনের উৎসাহেও ভাটা পড়বে। হারিয়ে যাবে শিশুদের নির্মল আনন্দ উপভোগের একটি দিন।

হ্যালোইন পোশাকে শিশুরা
ছবি: পমা

দীর্ঘ শীতকালের কারণেই শীতের দেশে গ্রীষ্মের কদর অপরিসীম। এমনকি এই করোনাকালের দুঃসময়েও যেন শীতের দেশের মানুষ সামারকে বিনা উদ্‌যাপনে চলে যেত দিতে নারাজ। তাই যত দিন সামার ছিল করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে দলে দলে মানুষ পার্কে আর লেকের পাড়ে উৎসবে মেতে থেকেছে।

শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এরই মধ্যে কোনো কোনো দেশ হ্যালোইন উদ্‌যাপনে, বিশেষত শিশুদের পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ট্রিক বা ট্রিট বা চকলেট সংগ্রহের আনন্দে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো এই নিষেধাজ্ঞা আরও দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, সামনে ডিসেম্বর। আসছে বিশ্বের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস বা বড়দিন।

মাত্র কয়েক দিন আগেই বাঙালি হিন্দুসম্প্রদায়ের সর্বজনীন প্রধানতম উৎসব দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়ে গেল। জানি না করোনাকালে এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুসম্প্রদায় এ উৎসব যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছে কি না!

উৎসবের রাতে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শিশুদের চকলেট সংগ্রহ অভিযান
ছবি: পমা

বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, কে জানে। আমাদের সবার প্রার্থনা, সবার কামনা এই দুর্যোগময় সময়ের অবসান হোক, পৃথিবী করোনামুক্ত হোক, সুদিন ফিরে আসুক সবার জীবনে। বিশ্বের সব শিশুর জীবন নিরাপদ হোক, হাসি–আনন্দে ভরে উঠুক। উৎসব, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার হৃদয়ে। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

লেখক: আইনজীবী, সাবেক উপপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড