ও চাঁদ তুমি সাথে থেকো

পিপিই পরে হাসপাতালে রোগীর সেবা করছেন লেখকের মতো অন্য চিকিৎসকেরাও
ছবি: সংগৃহীত

শীতকালটা এসেই গেল অভিশপ্ত ২০২০–তে। আগেই শুনেছি, আঁচ করেছি এ সময়টা কঠিন হবে পার করা। তবু মনে আশা ছিল হয়তো...কিন্তু না, করোনাকালীন কঠিন দিনগুলো ঠিকই শুরু হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ কফির কাপটা শুধু বড়ই হচ্ছে কিন্তু শক্তি কমে আসছে। হাসপাতালে মাস্ক পরে দৌড়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে দম ফুরিয়ে আসছে সহজে কিন্তু হাঁটলে পুরো রাত থাকলেও কাজ শেষ হবে না। এত এত অসুস্থ রোগী, মারা যাচ্ছেন তবু একা একা। হাসপাতালের ভিজিটর আসতে পারছেন না। কেউ কেউ নিজের আপনজনকে একা মরতে দিতে চান না। মরফিন দিয়ে অক্সিজেন রিকয়ারমেন্ট কমিয়ে এনে রোগী হসপিস কেয়ার (বাসায় থাকবেন ব্যথা–বেদনা কমানোর ব্যবস্থা করে যাতে জীবনের শেষ সময়ে কষ্ট পেয়ে মারা না যান) পাঠাতে হচ্ছে। ৮ ঘণ্টার কাজ ১২–১৩ ঘণ্টাতেও শেষ হচ্ছে না। অসুস্থ হচ্ছেন ডাক্তার নার্সরাও। ৭ দিন এমন কাজের পর থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের দিন অফ ছিল। আমার ছেলেটা আসবে শনিবার, দেখা হবে। অতি সামান্য রান্নার আয়োজন করব, শুরুটা করেছি কিছুটা।

গত শুক্রবার বেলা একটা থেকে রাত চারটা পর্যন্ত কাজ। সকালে শুনলাম সোমবার কয়েকজন অসুস্থ থাকাতে ২৪ ঘণ্টা কাভার করতে হবে। শুনেই বললাম, প্লিজ, রাতটা শেষ করো। আমার মনে হয় না এত কঠিন একটা সপ্তাহ যাওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা কাজ আমি পারব (এ কথা গত ১১.৫ বছরে কোনো দিন বলিনি, কারণ আমার কাজটা আমার অসম্ভব প্রিয় স্বপ্নের জগৎ। এ কাজের জন্য জীবন বাজি রাখতেও সমস্যা নেই আমার।) বলে অবাক হলাম এ রকম লাগছে কেন? দুপুরে কাজ শুরু করলাম, রাত ১২টা পর্যন্ত গেল কোনো রকম, ডায়েট এনার্জি কোক, কফি কত কাপ খেলাম হিসাব নেই। তারপর কেমন যেন ক্লান্ত হতে থাকলাম। একেকটা কোভিড রোগী দেখে হাত ধুতে ধুতে মনে মনে গান গাইলাম, বাবুর সঙ্গে লাঞ্চ খাব পরদিন। চিন্তা করলাম কিন্তু ক্লান্তি দূর হলো না। রাত তিনটার দিকে শেষ রোগী দেখে এসে চার্ট করে অর্ডার শেষ করে মনে হলো ঘোরের মধ্যে আছি।

পৌনে ৪টার দিকে এক বন্ধুকে পেজার দিলাম (১৫ মিনিট আগে এবং জীবনে প্রথম), হাসপাতালের ডাক্তারদের রুমে যাওয়ার সাহস হলো না, কয়েক ঘণ্টায়ও উঠতে পারব না। সারা জীবন দেখেছি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে কখনো ঘুম আসে না আমার। নিলাম চান্স। বের হয়ে গেলাম আধা ঘণ্টা দূরে বাসার পথে। আমি জীবনে অ্যালকোহলসহ কোনো নেশাদ্রব্য খাইনি, কোনো দিন নারকোটিকস চেষ্টা করিনি স্পোর্টস ইনজুরিতেও। শুধু মনে হলো, নেশার ঘোরে এমনটাই কি লাগে সবার? কী বাজে অনুভূতি। ব্যস্ত ফ্রি ওয়ে ফাঁকা, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। যেদিকে যে রাস্তায় যাই, চাঁদ অভয় দিয়ে আলো করে সাথে থাকল। বাসায় পৌঁছালাম। ৫ ঘণ্টা পর চোখ খুলে দেখলাম মায়াবী চাঁদ চলে গিয়ে ঝকমকে সূর্য হাসছে।

দুপুরে বাবু এল, খেলাম মা বেটা। ক্লান্তি অনেকটাই কেটেছে। কোভিড ১৯ মহামারি প্রাণঘাতী, একটু সাবধানে থাকুন সবাই। আমরা টিকা পাব আগামী মাসের মাঝামাঝি আশা করছি। মাত্র কয়েকটা মাস, বাসায় থেকে, মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে আসুন সবাই সবার জীবন বাঁচাই। বান্ধবী ডা. নোভামনির সাথে কথা হচ্ছিল আজকে। ওর কারণে এ লেখাটা লেখা। গত ৮ মাসে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি সবাই। আর কয়েকটা মাস কষ্ট করি। আমরা পারব সবাই সবার জীবন বাঁচাতে। আর একজন ফ্রন্ট লাইনারের একটা রাত তুলে ধরলাম এ কারণে। যাতে সবাই একটু বুঝুন আমাদের শক্তি শেষ হয়ে আসছে কিন্তু।

আমি কাজ করি আমেরিকার একটা হাসপাতালে। পেশেন্ট থাকার জায়গার সংকট আছে, প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছেন কিন্তু টিকা আসছে।

ফাইজার কোম্পানির ভ্যাকসিন শতকরা ৯৫ ভাগ কার্যকর, ১৪ ডিসেম্বর নাগাদ ৬.৪ মিলিয়ন টিকা যাবে আমেরিকার সব স্টেটে স্বাস্থ্যকর্মী এবং নার্সিংহোমের বাসিন্দাদের জন্য। দুটো ডোজে দেবে এই ভ্যাকসিন ওরা, প্রথম ডোজের ২৮ দিন পর থেকে ইমিউনিটি আসবে ওরা বলছে। ২২ ডিসেম্বরে আসছে মডার্না কোম্পানির টিকা। জার্মানির বায়োএনটেকের টিকাও আসছে একই রকম সম্ভাবনা নিয়ে। তারপর তারা শেয়ার করবে পুরো দুনিয়ার সাথে এবং তাদের প্রেজিকশন, ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ৫০ বিলিয়ন লোক ভ্যাক্সিনেটেড হবেন। পৃথিবী বদলে গেছে চিরতরে এ মহামারিতে। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখি সবাই মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব মেনে আর হাত ধুয়ে বা স্যানিটাইজ করে। আমরা পারব।