করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে ডেটানির্ভর ব্যবস্থাপনা

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী সাধারণ জীবনযাপনে বিশাল বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। শুধু গত ১০ অক্টোবরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক দিনেই পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রায় ৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশ্বের উচ্চ থেকে নিম্ন সব রকমের আয়ের দেশ এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত এই মহামারি সম্পর্কে আমাদের সার্বিক জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। প্রায় প্রতিদিনই নতুন তথ্য আসছে এবং সে অনুযায়ী প্রতিটি দেশের সরকারকে তাদের পলিসি পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় মহামারি-সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ঠিকমতো সংগ্রহ করা এবং বিশ্লেষণ করা প্রতিটি দেশের সরকারের জন্যই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, এপিডেমিওলজিস্ট, ডেটা সায়েন্টিস্ট, ইকোনমিস্ট এবং নীতিনির্ধারকেরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এই কর্মযজ্ঞের মূল ভিত্তি হলো করোনা ভাইরাসের দ্বারা সাধারণের ওপর যে প্রভাব, তার সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

তথ্যভিত্তিক মহামারি নিয়ন্ত্রণের সফলতা অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাইওয়ান। চীনের সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তারা প্রত্যেক নাগরিকের ভ্রমণের তথ্য অনুযায়ী কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রত্যেক মানুষকে সবার থেকে আলাদা করে চিকিৎসা দিয়েছে। আর এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তারা সঠিকভাবে তথ্য জোগাড় এবং এর বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়েছে। যার দরুন আজ পর্যন্ত তাইওয়ানের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা মাত্র ৫১৭ এবং মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৭। মূলত তাইওয়ানের তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মহামারি ব্যবস্থাপনার সফলতা এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিগ ডেটার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত সুবিধাসম্পন্ন প্রায় সব দেশেই ডেটানির্ভর বিশ্লেষণ অনুযায়ী মহামারি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে। অবশ্য সংক্রমণের সময়, মহামারি নিয়ন্ত্রণে অবকাঠামোগত পরিস্থিতি, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সাধারণের ব্যবহারযোগ্যতা প্রভৃতির কারণে পৃথিবীর সব দেশ একইভাবে এই প্রক্রিয়া থেকে সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি।  

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ঠিক তখন থেকেই সরকারের আইসিটি বিভাগ এবং এটুআই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে আসছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে সে সময় ডেটা এনালিটিকস টাস্কফোর্স গঠিত হয়। এতে দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রবাসে কর্তব্যরত বিজ্ঞানীরাও সদস্য হিসেবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন। বাংলাদেশে কোভিডসংক্রান্ত যেসব অনলাইন সার্ভিস রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সেলফ স্ক্রিনিং টেস্ট সার্ভিস: লাইভ করোনা টেস্ট। একই ধরনের ডেটা সংগ্রহের জন্য ফেসবুক বট ও ভাইবার বট এবং একটি অ্যানালিটিক্যাল ড্যাশবোর্ড নির্মাণ করা হয়। এই সাইটটি সাধারণ মানুষ কয়েকটি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জানতে পারেন তাঁর কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে কি না। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই স্ক্রিনিং টেস্ট গ্রহণ করেছেন। এই ডেটা সবার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রেখে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা সারা দেশের মানুষের বিভিন্ন শারীরিক রোগ সম্পর্কে আমাদের একটি বিশদ ধারণা প্রদান করতে পারে। আমরা মনে করি ভবিষ্যতে এই ডেটা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লাইভ করোনা টেস্ট থেকে প্রাপ্ত ডেটা থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন রোগীর ভৌগোলিক বণ্টন থেকে এপ্রিল মাসেই ধারণা করা সম্ভব হয় যে বাংলাদেশের কোন স্থানে করোনার সম্ভাব্য হটস্পট রয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের জেলা শহরগুলোতে সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত। কিন্তু এর বাইরে দেশের অন্যান্য আরও কোনো স্থানে করোনার প্রকোপ দেখা দিতে পারে, তারও একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের গবেষণায় উঠে আসে যে জেলা শহরগুলোর সঙ্গে যে এলাকার সড়কপথে যোগাযোগ বেশি সেখানে করোনার হটস্পট পাওয়ার সম্ভাব্যতা বেশি। প্রাপ্ত ডেটার ভিত্তিতে এই হটস্পটগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। অতএব ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের সেকন্ড ওয়েভ এলে বা অন্য কোনো মহামারি দেখা দিলে এখনকার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে লকডাউনের পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকে প্রথম থেকেই লকডাউনের আওতায় নিয়ে এসে ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে।

এ ছাড়া কোনো এলাকার মানুষ যদি আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ বা শারীরিক সমস্যা অন্যদের থেকে বেশি রিপোর্ট করেন, সেটিও এই ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব। লাইভ করোনা টেস্টে বিভিন্ন জেলা থেকে রিপোর্টকৃত লক্ষণের ভৌগোলিক বণ্টন দেখানোর পাশাপাশি দুটি জেলার মধ্যে পারস্পরিক তুলনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতির একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্তের সঠিক ব্যবহার ভবিষ্যতের চিকিৎসাব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। যেমন এমন একটি এলাকার মানুষদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো পূর্ব পরিকল্পনার ভিত্তিতে সেখানে যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। লাইভ করোনা টেস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। করোনার লক্ষণগুলোর মধ্যে গলাব্যথা প্রায় সব বয়সের মানুষের মাঝেই দেখা যায়। শুকনো কাশি এবং জ্বর ২১ বছরের ঊর্ধ্বে সব থেকে বেশি পরিলক্ষিত হয়। আবার পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা কম বয়সীদের তুলনায় মাংসপেশিতে বেশি ব্যথা অনুভব করেন। অন্যদিকে পঞ্চাশোর্ধ্বদের মাঝে ডায়াবেটিস সব থেকে বেশি এবং উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা তুলনামূলক কম পরিলক্ষিত হয়। যেখানে একুশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সীদের মাঝে অন্য যেকোনো রোগের তুলনায় উচ্চ রক্তচাপ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। এই পরিসংখ্যান বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনেক কার্যকর হবে বলেই আমরা মনে করি।

Mcc Ltd

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় পরিলক্ষিত কোভিড-১৯-এর বিভিন্ন লক্ষণগুলোর টাইম সিরিজ এনালাইসিস আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনো এলাকায় কোভিডের লক্ষণ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা বুঝতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া কোনো একটি সময়ে যদি হঠাৎ করে কোনো একটি রোগের লক্ষণ বেশি দেখা যায়, তবে পরবর্তী বছরগুলোতে আগে থেকেই জনসাধারণকে সচেতন করা যাবে। এ কারণে করোনা সম্পর্কে আমাদের ভীতি চলে গেলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লাইভ করোনা টেস্টের আরও ব্যবহারের বৃদ্ধি ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশের নাগরিকদেরও দায়িত্ব তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা, ঝুঁকি প্রভৃতি বুঝতে এই ভার্চ্যুয়াল সাইটটি ব্যবহার করা। কারণ যত বেশি ডেটা অ্যাগ্রিগেট করা সম্ভব হবে, দেশের করোনা সম্পর্কে আরও বিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারব। যা করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ বা নতুন কোনো মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি কাজ।

  • লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক