করোনাকালে প্রবাসীর বাবা দিবস

পঞ্জিকার পাতা ঘুরে এ বছরে এসেছে বাবা দিবস। সন্তানের প্রতি বাবার অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসা, ত্যাগ–তিতিক্ষার খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতা ভরে উঠেছে। অনেকেরই বাবা জীবিত আছেন, আবার অনেকের বাবাই গত হয়েছেন, কিন্তু রয়ে গেছেন সন্তানের স্মৃতিতে।

বাবা বিষয়ে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। যাই হোক করোনার এই সময়ে বাবা দিবসটা অনেকের কাছেই বড্ড দুঃখের, কারণ এই করোনা তাঁদের কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে তাঁদের প্রাণপ্রিয় বাবাকে। যে বাবাকে পাশে নিয়ে কেক কেটে বা হুল্লোড় করে বাবা দিবস পালন করার কথা ছিল, সেই বাবা আজ আশ্রয় নিয়েছেন ছবির ফ্রেমে।

আজ এমনই দুজন বাবার গল্প বলব। প্রবাসে আমরা একে একে জীবনের সবকিছু অর্জন করলেও সব সময়ই যে জিনিসটা খুবই অনুভব করি, সেটা হচ্ছে দেশে গুরুজনের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা। তাই প্রবাসী প্রথম প্রজন্ম সব সময়ই বোবাকান্না করে চলে দেশে ফেলে আসা স্বজনদের জন্য, বিশেষ করে লুকিয়ে অশ্রু মোছেন দেশে ফেলে আসা মা–বাবার জন্য। অনেকেই চেষ্টা করেন মা–বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখার। আবার অনেকেই নিয়ে আসতে না পারলেও কিছুদিনের জন্য হলেও বেড়াতে নিয়ে আসেন। আর তা–ও না পারলে অন্তত প্রতিবছর নিজেরা দেশে গিয়ে বাবা–মাকে দেখে আসেন। তাঁদের স্নেহের স্পর্শে খুঁজে নেন প্রিয়জনের ওম। বর্তমান বিশ্বে মা–বাবাকে চাইলেই দেখা যায়, কথা বলা যায় কিন্তু তাদের মায়াময় স্পর্শ পাওয়া যায় না। সামান্য একটা স্পর্শ যে মানুষের দুঃখকে কতখানি লাঘব করতে পারে, সেটা প্রবাসীমাত্রই আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝি।

বিদেশে আসার পর আমার গিন্নি প্রায় প্রতিদিনই আমার শ্বশুর–শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতেন এবং কান্না করতেন। সময়ের পরিক্রমায় কান্নার পরিমাণটা কমে এলেও দীর্ঘশ্বাস কিন্তু থেমে নেই। প্রতিবার তাঁদের সঙ্গে কথার শেষ করে বুকে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে আসে মনের অজান্তেই। আমরাও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁদের আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারিনি। আর করোনার কারণে তাঁদের কাছে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিচিত কারও মা-বাবা তাঁদের কাছে বেড়াতে এলে আমরা সব সময়ই তাঁদের একটা দিনের জন্য হলেও আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতে বলতাম। গুরুজনদের সান্নিধ্যে আমরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পেতাম দেশে ফেলে আসা স্বজনদের ছোঁয়া আর আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম ফিরে যেত শিকড়ের কাছে।

আমার গিন্নির ক্যাম্পাসের বান্ধবী প্রণতি। তাঁরাও অস্ট্রেলিয়া থাকেন, আমাদের বাসার কাছেরই একটা সাবার্বে। ২০১৭ সালে তাঁদের মা-বাবা এবং ছোট ভাই তাঁদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁদের আসার খবরে প্রণতির পাশাপাশি আমরাও খুশি হয়েছিলাম। কারণ, বহুদিন পর কোনো অভিভাবকদের দেখা পাওয়া যাবে। উনারা অস্ট্রেলিয়া এসে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। প্রণতির বাবা সুবোধ কাকুর সঙ্গে এর আগে থেকেই ফেসবুকে যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি আমাদের সবাইকেই একেবারে নামে চিনতেন। ফেসবুকে আমরা যেকোনো কিছু পোস্ট করলেই তিনি এসে সবার আগে প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্য দিতেন। এভাবেই তিনি আমাদের কন্যা তাহিয়া এবং পুত্র রায়ানকে নিজের নাতি–নাতনির মতোই স্নেহ করতেন।

আমিও কাকাবাবুর পোস্টগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তিনি অফিসের কাজের জন্য বিভিন্ন জেলায় গেলেই সেসব জায়গার ছবি তুলে পোস্ট করতেন। সেগুলো আমার খুবই ভালো লাগত। তাই তাঁর কাছে আবদার করে রেখেছিলাম, দেশে গেলে তাঁর সঙ্গে ঘুরব কিছুদিন। এ ছাড়া প্রণতির ছোট ভাই প্রীতমের সঙ্গেও ফেসবুকে যোগাযোগ ছিল।

প্রীতম বাংলাদেশে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আমিও জীবনের একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে এমন একটি কোম্পানিতে চাকরি করেছি। আর আমাদের অনেক বন্ধু বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানিতে চাকরি করত বা এখনো করে। সেদিক দিয়েও প্রীতমের সঙ্গে একটা আত্মিক টান অনুভব করতাম। একসময় গ্রামীণফোন বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি তৈরি করল। আমি আবদার করাতে প্রীতম আমাদের তিনজনের জন্য সেই জার্সি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো এখনো আমরা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। বাংলাদেশের খেলা থাকলেই আমরা সেগুলো পরে খেলা দেখি। আবার ছেলে ও মেয়েটা স্কুলের ‘জার্সি ডে’তে সেই জার্সি পরে এখনো স্কুলে যায়।

অবশেষে একদিন সন্ধ্যার সময় তাঁরা আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। এসেই তাহিয়া ও রায়ানকে কাছে ডেকে নিয়ে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এ যেন জীবনের পরম আদরের ধনকে কাছে পাওয়া। তাহিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাসার ওয়াই–ফাইয়ের পাসওয়ার্ড কী? ও যখন পাসওয়ার্ডটা বলল, তখন তিনি খুবই খুশি হলেন। এরপর তাঁদের নানা–নাতনির গল্প শুরু হলো। দেখে মনে হবে তাদের এই গল্প যেন আর কখনই শেষ হবে না। ছোট্ট রায়ান মাঝেমধ্যে এসে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। এরপর তাঁদের নিয়ে গেলাম আমাদের বাসার পাশের মিন্টো টেম্পলে। সেখানে যেয়ে পূজা সেরে কাকাবাবু অনেক ছবি তুলে নিলেন আর আমাকে বললেন, তোমাদের এখানকার মন্দিরগুলো অনেক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। কাকাবাবুরও আমার মতো ছবি তোলার উৎসাহ ছিল। যেকোনো জায়গায় গেলে সেখানকার অনেক ছবি তুলতেন।

এরপর রাতের খাওয়া শেষ করে শ্যালক প্রীতমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমাদের বাসার পাশের সবার্ব কেন্টলিনের উদ্দেশে। কেন্টলিন সবার্বটা জর্জেস নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। নদীর দুই পাশেই ঘন বন। তার মধ্যে দিয়েই আছে পায়ে হাঁটার (বুশ ওয়াক) পথ, সাইকেল চালানোর পথ এবং মোটরবাইক চালানোর পথ। গাড়ি চালিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে রাস্তা শেষ হয়ে যায়। সেখানে গাড়ি পার্ক করে অন্য কাজগুলো শুরু করতে হয়। আমরা রাস্তার শেষ প্রান্তে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদমামা উঁকি দিচ্ছেন। গোলাকৃতি জায়গাটার চারদিকেই বন। তাই আমাদের মাথার ওপরে শুধু এক টুকরা গোলাকার আকাশ দেখা যাচ্ছিল। প্রীতম বেশ কিছু ছবি তুলে নিল। এরপর বাসায় ফিরে এলাম আমরা। এর কিছুক্ষণ পর তাঁরা ফিরে গেলেন।

এটাই ছিল কাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। এরপর একসময় তাঁরা দেশে ফিরে গেলেন কিন্তু আমার কখনো মনে হতো না যে তাঁরা আমাদের থেকে দূরে আছেন। কারণ কাকাবাবু ফেসবুকে প্রচণ্ড অ্যাকটিভ ছিলেন এবং আমাদের প্রতিটি কাজকর্মে নজর রাখতেন। এভাবেই সময় বয়ে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে পরিকল্পনা করছিলাম ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে কাকাবাবুর সঙ্গে অন্তত একটা ট্যুর দেওয়ার। সেই মোতাবেক আমাদের টিকিটও করা ছিল আগাম, কিন্তু করোনা এসে সব ভেস্তে দিল। কাকাবাবুকে অফিসের কাজেই বাসার বাইরে যেতে হতো। তাই এর মধ্যেই একসময় তিনি করোনায় আক্রান্ত হলেন। তিনি আমার দেখা অন্যতম একজন জীবনযোদ্ধা ছিলেন। কারণ, তাঁর হৃদযন্ত্রের হাজারো সমস্যাকে কেয়ার না করেই তিনি জীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন। আমরা তাই এবারও ভেবেছিলাম, তিনি করোনাকেও জয় করে আবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন কিন্তু এবার তিনি আর ফিরলেন না। চলে গেলেন মহাকালের পথে।

প্রবাসীর বাবা দিবস মানেই একটা দীর্ঘশ্বাসের নাম। কারণ, বাবাকে ছুঁয়ে দেখতে পারেন না। কিন্তু জীবিত থাকলে অন্তত কথা বলা যায়, তাঁকে দেখা যায়। করোনার জন্য আমাদের অনেকেই তাঁদের বাবাকে হারিয়েছেন। তাই এখন তাঁদের জন্য বাবা দিবস মানে বোবা কান্নার দিবস। বাবার অন্য সন্তানেরাও হয়তো কান্না করেন কিন্তু প্রবাসীদের সঙ্গে তাঁদের তফাত হলো প্রবাসীরা তাঁদের বাবাদের শেষ সময়ে উপস্থিত থাকতে না পারার কারণে মনের মধ্যে একটি ক্ষত বয়ে নিয়ে চলেন বাকি জীবনটা। এরপর তাই যতবারই তাঁদের জীবনে বাবা দিবস আসে, ততবারই মনের মধ্যে একটা হাহাকার কাজ করে।

*লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া