করোনায় ভালো নেই পর্তুগালের প্রবাসী কর্মজীবীরা

পর্তুগালে ১ কোটি মানুষের বসবাস, করোনা মহামারির প্রকোপে গত সেপ্টেম্বর মাসেও চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৫৪ হাজার ৭৬৯ জন কর্মজীবী, যদিও করোনার সংক্রমণ হওয়ার পর গড়ে ৫০ হাজারের মতো কর্মী প্রতি মাসে চাকরি হারাচ্ছেন। তবে সব মিলিয়ে বর্তমানে ৪ লাখ ১০ হাজার ১৭৪ জন কর্মহীন আছেন, যা প্রায় দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

প্রতিদিনই পর্তুগালে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে একটি একটি করে মানুষ বাড়ছে। বিষয়টা সবারই জানা, পর্তুগাল ইমিগ্র্যান্ট-অধ্যুষিত দেশ, খুব সহজেই পর্তুগালে বসবাসের সুযোগ পাওয়া যায়, যা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সরকারি হিসাব অনুযায়ী (অসমর্থিত) সূত্রে জানা যায়, পর্তুগালে বর্তমানে ১৭ থেকে ১৮ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন। তবে এদের অনেকেই নাগরিকত্ব লাভ করে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সঠিক হিসাব করলে ৭ থেকে ৮ হাজার বাংলাদেশি সক্রিয়ভাবে এ দেশে বসবাস করছেন এবং এঁদের বেশির ভাগই দুই বছরের মধ্যে পর্তুগালে প্রবেশ করেছেন।

আমাদের এসব প্রবাসী বাংলাদেশিরা পর্যটন-অধ্যুষিত পর্তুগালে সাধারণত পর্যটন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ কাজ করে থাকেন। গত মার্চে পর্তুগালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে এবং পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে পট পরিবর্তন না হওয়ায় ধীরে ধীরে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের দোকানপাট ছাড়া।

এর ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা চাকরি হারাতে শুরু করেন। যাঁরা নিয়মিতভাবে বসবাস করছেন, তাঁরা সরকারি সহযোগিতা পেলেও যাঁরা নতুন এসেছেন, এখন পর্যন্ত নিয়মিত হতে পারেননি, তাঁদের জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কেননা একদিকে অস্থায়ী চাকরির চুক্তি, অপরদিকে সোশ্যাল সিকিউরিটি সহায়তা পাওয়ার অনুপযুক্ত হাওয়ায় তাঁদের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, নতুন আসা বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশি ভাষা ও কাজের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে বাংলাদেশের মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কম বেতনে চাকরি করেন। এ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী সেবা বা বিক্রয় না থাকায় শিক্ষানবিশদের স্বল্প বেতনাদি পরিশোধ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে চাকরি বজায় থাকলেও আয় নেই বললেই চলে।

দুজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তাঁরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের জুন মাসে এসেছেন। প্রথম চার মাস বাংলাদেশি মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় একটি পর্তুগিজ রেস্তোরাঁয় কাজ পান। কিন্তু এক মাস পরই তাঁকে চাকরি হারাতে হয়েছে। এরপর কাজ পাননি। বাংলাদেশে পরিবারকে কোনো সহযোগিতা করতে পারছেন না বরং পরিবার তাঁর জন্য টাকা পাঠাচ্ছে।

মইনুদ্দিন (ছদ্মনাম) ২০১৭ সালে পর্তুগালে বসবাসের জন্য রেসিডেন্ট কার্ড পেয়েছেন। স্থানীয় একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে কাজ করে আসছেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছেন। সরকার থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন তবে তিন জনের পরিবারের জন্য তা খুবই অপ্রতুল, কেননা করোনায় সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে স্ত্রী-সন্তানের রেসিডেন্ট কার্ড না করতে পারায় তিনি বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আবুল হোসেন (ছদ্মনাম) নামের অপর আর একজন ২০১৮ সালে পর্তুগালের অস্থায়ী নাগরিকত্ব পেয়ে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে এসেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে গর্ভবতী স্ত্রীকে পর্তুগালে আনার অনুমোদন পেয়েছিলেন। করোনার কারণে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনতে পারেননি সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে। স্বপ্ন ছিল সন্তান প্রসবের সময় স্ত্রীর পাশে থাকবেন, সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে কোলে তুলে নেবেন। গত আগস্টে মাসে কন্যাসন্তানের বাবা হন তিনি। সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে কোলে তুলে নিতে পারলেন না এবং আয় কমে যাওয়ায় সন্তানকে ইচ্ছানুযায়ী উপহারসামগ্রী দিতে পারেননি। তা ছাড়া স্বপ্ন ছিল সন্তান পর্তুগালে জন্মগ্রহণ করে এ দেশের নাগরিকত্ব লাভ করবে।

অনেকে বহুদিন বাংলাদেশের যেতে পারেননি নানা কারণে। যখন এ বছর চিন্তা করেছেন যাবেন, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পাবেন, এর মধ্যে করোনার হানায় কেউ কেউ ফেরার অনিশ্চয়তায় জন্মভূমিতে পা রাখতে পারছেন না। আবার কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে দিশেহারা। খালি হাত নিয়ে কীভাবে যাবেন প্রিয়জনের কাছে। আবার কেউ কেউ টিকিট খরচের টাকাটা বেকার অবস্থায় খরচ করে ফেলেছেন।

অস্থায়ী নাগরিকত্ব পাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা কিছুটা ভালো থাকলেও খুব বেশি অসুবিধায় আছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা। পর্তুগিজ সরকার বিভিন্ন সহযোগিতা কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সব সময় অপ্রতুলই হয়।

সব প্রবাসীর মতো পর্তুগালপ্রবাসীদেরও একই স্বপ্ন, মাতৃভূমি বাংলাদেশে অবস্থিত প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, প্রিয়জনের সব স্বপ্ন পূরণ করা। কর্মহীন হয়ে পড়ায় বা আয় কমে যাওয়ায় এই কাজগুলো সম্পন্ন করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে বা কোনো ক্ষেত্রে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া মহামারির এক ধরনের মৃত্যুভীতি প্রিয় মানুষগুলোর শেষ আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা ও যেন কুরে কুরে খাচ্ছে। এ যেন এক ভিন্ন অনুভূতি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে যিনি আছেন তিনি একমাত্র বোঝেন প্রবাসীর এই বুকের আকুতি। ভালো থাকুক মা মাটি এবং দেশ।