কোরিয়ান গ্রামে এক দিন

পিএইচডি করতে এসে যান্ত্রিক জীবনে অবসর খুঁজে পাওয়া অনেকটাই কঠিন। এমনিতেই গবেষণার চরম চাপে জীবনের দফারফা, সঙ্গে জুটেছে করোনার এই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের করোনা প্রতিরোধে কঠোর সব নিয়মকানুন!
চান্দ্র নববর্ষ কোরিয়ানদের ভাষায় সল্লাল, এদের ঐতিহ্যবাহী পার্বণের মাঝে অন্যতম। এবারের চার দিনব্যাপী এই ছুটিতে তেমন কোনো প্ল্যানই ছিল না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে অধিকাংশ পার্ক কিংবা ট্যুরিস্ট স্পট বন্ধ। হঠাৎই মনে হলো, ছোটকালে বাংলাদেশের গ্রামের কাদামাটির সংস্পর্শে বড় হওয়া এই আমার প্রায় কয়েক বছরের কোরিয়ান জীবনে এখনো কোনো কোরিয়ান গ্রামে যাওয়া হয়নি। বুসানের মতো আধুনিক শহরের পরতে আধুনিক কোরিয়ার অবিশ্বাস্য উন্নয়ন দৃশ্যমান, কিন্তু গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি। দেখা হয়নি এদের গ্রামীণ সুবিধা কিংবা জীবনযাপন।

চার দিনের এই ছুটিতে কোরিয়ান গ্রামের অভিজ্ঞতা নিতে ছুটলাম বুসান থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার দূরের সিটি গোয়াংজুতে। বাংলাদেশে আমার কর্মস্থল হাবিপ্রবির ফুড সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক শক্তিচন্দ্র মণ্ডল এখানে গবেষণাকাজে আছেন। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় গবেষণা করছেন তিতাস পাল। তিতাস পালের ব্যক্তিগত গাড়িতে আমরা গোয়াংজু সিটি থেকে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার দূরে দামিয়ংয়ের সুবুক-মিয়ং এলাকায় গেলাম। করোনা থেকে দূরে শান্ত ও সুন্দর একটি নিভৃত পল্লি এটি। ফল-ফসলের জন্য এই এলাকাকে দক্ষিণ কোরিয়ার শস্যভান্ডারও বলা হয়! কয়েক মাস ধরে বয়ে চলা শীতের ভয়াবহতা প্রকৃতিতে এখনো পুরোমাত্রায় দৃশ্যমান। শীতের এই শেষ সময়ে প্রকৃতি তাই অনেকটাই ধূসর! গ্রিনহাউসগুলোর অভ্যন্তরে কৃষিকাজের প্রস্তুতি পুরোদস্তুর শুরু হয়েছে। গত মৌসুমে কেটে ফেলা ধানগাছের গোড়া এখনো দৃশ্যমান! দক্ষিণ কোরিয়ার পুরো দেশের সুষম উন্নয়ন এখানেও দৃশ্যমান। প্রকৃতিকে তার মতো রেখে তাকে ঘিরে কত সুন্দর পরিকল্পনা! গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলছে ছোট্ট একটি নদী। অথচ তাকে নিয়ে কী সুন্দর পরিকল্পনা।

নদীর পাড়ে আর্টিফিশিয়াল বনায়ন করে তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট একটি রাস্তা। কৃত্রিমভাবে লাগানো এই বাঁশঝাড়যুক্ত রাস্তাকে দেখলে এটি যেন প্রিয় মাতৃভূমি অনন্যসুন্দর বাংলাদেশ! এই রাস্তা শুধু সাইক্লিং ও হাঁটাহাঁটির জন্য উন্মুক্ত! এই রাস্তাতেও মার্কিং দিয়ে কি সুন্দর ল্যান করে দেওয়া রয়েছে, যেখানে আপনি নিয়ম মেনেই চলতে পারেন। অনন্যসুন্দর রাস্তাটির একটি অংশ আরেকটি রাস্তার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে রয়েছে একটি পার্কিং এরিয়া। অনেকেই অনেক দূর থেকে এসে গাড়ি পার্কিং করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরছেন। প্রকৃতির কী সুন্দর ব্যবহার। ছোট্ট নদীটিতে পানকৌড়ি জাতীয় অসংখ্য পাখির আনাগোনা। তারা ব্যস্ত মাছ শিকারে। কিছু দূরের ছিমছাম বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসছে মোরগ-মুরগির ডাক! অথচ নাগরিক সুবিধার কোনো কমতি নেই এখানে। নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি কিছুটা পরপর সাইনবোর্ডে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসহ যেকোনো সমস্যায় পড়লে কোনো নম্বরে ফোন দিতে হবে! গ্রামের অধিকাংশ মানুষই অবসরে কিংবা বয়োবৃদ্ধ যাঁরা প্রকৃতির নিবিড় কোলে থেকে যেন ন্যূনতম বিপদেও সব রকম সুবিধার কাছাকাছি থাকেন, তার চেষ্টার কোন কমতি নেই এখানে!

গ্রাম, আহা গ্রাম! আমাদের মতো প্রকৃতির অফুরন্ত আশীর্বাদ এরা পায়নি। সবুজাভ আর উর্বরা বাংলাদেশের মাটিতে যেন সোনা ফলে, যার গ্রামগুলোয় প্রকৃতির সৌন্দর্য খেলা করে, নদীতে পাওয়া যায় অসংখ্য মাছ অথচ প্রকৃতির প্রতি কতটা নিষ্ঠুর আমরা। উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রতিনিয়ত মিশিয়ে যাচ্ছি বিষাক্ত সব বর্জ্য। সঙ্গে দেশের সৌন্দর্য আমাদের নানা রকম পাখিসহ শীতকালীন অতিথি পাখিদের দিয়ে অনেকের ডাইনিং টেবিল ভরে ফেলছি! পৃথিবীতে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন খুব বেশি দিনের না, তবে এদের পরিকল্পিত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি বড় বড় শহর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত! সঙ্গে গ্রামকে গ্রামের মতোই রেখে দিয়েছে, একে শহর বানানোর চেষ্টা না করে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভ্যালু-এডিশন করার সঙ্গে সঙ্গে মানবকল্যাণে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা দৃশ্যমান!

*লেখক: বিকাশ রায়, গবেষক, বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সহকারী অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।