কয়েক ঘণ্টার ইস্তাম্বুলে

এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে ছুটি কাটাতে আসি। পরিকল্পনা ছিল দু-তিন মাস পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কাটিয়ে পুনরায় ফিরে আসব প্রিয় কাজের জায়গায়। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী; কিন্তু তত দিনে করোনাভাইরাস সমগ্র দুনিয়া পরিভ্রমণ করে দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ ও ভারতে থাবা বিস্তার করে। মার্চ মাসের শুরুতে মোটামুটি সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে সামনে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। কারণ তত দিনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ লকডাউনে চলে গেছে।

গ্র্যান্ড বাজার, ইস্তাম্বুল
ছবি: লেখক

শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশ ছাড়তে পারি। তার আগে অবশ্য করোনা টেস্ট করে রিপোর্ট নিতে হয়ে। সেটা আরেক প্রস্থ ঝক্কির। যাহোক, সবার নেগেটিভ রিপোর্ট স্বস্তি মেলে। এবার এয়ারপোর্টে বেশ কড়াকড়ি লক্ষ করা গেল। বিশেষ করে সবকিছু বারবার চেক এবং সিকিউরিটি বেশ কড়া মনে হলো। ব্যাগেজ বুকিং ও বোর্ডিং পাস নিতে অগ্রাধিকার না পেলেও বিমানে ওঠার সময় যাঁদের সঙ্গে শিশু আছে, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইউরোপ তথা পর্তুগালে এটি একটি সাধারণ বিষয় যদিও।

গ্র্যান্ড বাজার, ইস্তাম্বুল
ছবি: লেখক

করোনায় বিমানযাত্রায় বেশ কিছু পরিবর্তন এবং কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিমানে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ সামগ্রী ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এত সব বিধিনিষেধ এবং নিয়মকানুনে সাড়ে আট ঘণ্টার যাত্রা আরও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। আগের দুই রাতের নিদ্রাহীনতার ফলে বিশাল একটা সময় ঘুমিয়ে কাটালাম। টার্কিশ এয়ারলাইনসে আমাদের ট্রানজিট ছিল ১৯ ঘণ্টার বেশি। তাই ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ইস্তাম্বুল শহর বেড়ানোর পরিকল্পনা করি। যাঁদের ইউরোপের রেসিডেন্ট পারমিট বা সেনজেন ভিসা আছে, তাঁরা চাইলে মাত্র ৬০ ডলার খরচ করে ১০ মিনিটে ই-ভিসা নিতে পারেন।

আমি আগেই সবার আবেদন সম্পন্ন করে রেখেছি, শুধু টাকা পরিশোধ করিনি। কারণ, আমি নিশ্চিত নই যে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে দেবে কি না। তাই বিমান থেকে নেমে ই-ভিসা তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করি। জানানো হয়, শহরে প্রবেশে কোনো বাধা নেই। আগে করা আবেদনের রেফারেন্স নম্বর দিলে মাত্র দুই মিনিটে আমাদের ভিসা ফি পরিশোধ সাপেক্ষে ই-ভিসা প্রদান করে। আমরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আসি এবং খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তা সমাপ্ত করে। এলাকার এক ছোট ভাই আগে থেকে আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছিল। পরের কয়েক ঘণ্টা সে-ই আমাদের গাইড।

হায়া সোফিয়া
ছবি: লেখক

নতুন এই এয়ারপোর্ট থেকে ইস্তাম্বুল সিটি সেন্টারের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার এবং ট্যাক্সিতে সময় নেয় এক ঘণ্টার কিছু বেশি আর ভাড়া পড়ে ২০ ইউরোর কাছাকাছি। আমাদের হাতে সময় মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তাই কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ কী কী দেখা যেতে পারে, তার একটা পরিকল্পনা করতে বলি। সে জানায়, আমাদের বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে নিয়ে যাবে এবং আমরা যেখানে অবস্থান করব, তার খুব কাছাকাছি। ইস্তাম্বুল সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোনো। তা ছাড়া ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করা অবস্থায় এই শহরের প্রাচীন অনেক ঘটনাপ্রবাহ পড়তে হয়েছে পাঠ্যক্রমে।

তখন থেকে এই শহরকে জানার এবং দেখার আগ্রহ ছিল। তাই এবার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে একটি হোটেলে উঠি। তিন তারকা মানের সেই হোটেলে কাপল একটি রুম নিলাম ৩০ ইউরো দিয়ে। ইউরোপ তথা পর্তুগালের তুলনায় যা বেশ সস্তা বটে! হাতে তেমন একটা সময় নেই, তাই স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে তুরস্কের একটি ঐতিহ্যবাহী পদ দিয়ে লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ি। খাবার ছিল খুবই সুস্বাদু।

তুরস্কের বিখ্যাত বুয়ুক মাজিদিয়ে
ছবি: লেখক

শুরুতেই আমরা যাই ইউরোপ তথা তুরস্কের অন্যতম প্রাচীন ও বড় বাজার ‘গ্রান্ড বাজার’-এর দিকে। প্রায় ছয় শ বছরের পুরোনো এই বাজারে চার হাজারের বেশি দোকান রয়েছে এবং দিনে গড়ে আড়াই থেকে চার লাখ পর্যটক এখানে পরিদর্শন বা কেনাকাটা করতে আসেন। বড় বড় গলির মধ্যে বাহারি সব দোকানের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। দোকানগুলোর সাজসজ্জা ও আভিজাত্যে বোঝা যাচ্ছে, ক্রেতা আকর্ষণে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে নেই।

আমরা বেশ খানিকটা সময় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়েই। যদিও পছন্দের বেশ কিছু জিনিসপত্র চোখে পড়েছে কিন্তু করোনাকালের বিধিনিষেধের ফলে মালামাল বহন সম্ভব নয়, তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও কিছুই নিতে পারিনি। তাই পরবর্তী গন্তব্যের দিকে রওনা হই। সেখান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে রয়েছে সময়ের আলোচিত স্থাপনা বাইজেনটাইন স্থাপত্যশিল্পের অপরূপ নিদর্শন হায়া সোফিয়া, যা কিছুদিন আগে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত এই নান্দনিক স্থাপনাটির প্রায় এক হাজার বছর ধরে সুপরিচিতি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গির্জা হিসেবে। ১৪৫৩ সালে তৎকালীন কনস্টানটিনোপলের পতনের পর এটিকে প্রথম মসজিদে রূপান্তর করা হয়, যা পরবর্তী এক হাজার বছর অব্যাহত ছিল। কিন্তু ১৯২৩ সালের দিকে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। সেই থেকে বিগত এক শ বছর এটি এভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি আদালতের বিশেষ আদেশে এই স্থাপনাকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করা হয়, যা বিশ্বজুড়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত এই নান্দনিক স্থাপনাটির প্রায় এক হাজার বছর ধরে সুপরিচিতি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গির্জা হিসেবে। ১৪৫৩ সালে তৎকালীন কনস্টানটিনোপলের পতনের পর এটিকে প্রথম মসজিদে রূপান্তর করা হয়, যা পরবর্তী এক হাজার বছর অব্যাহত ছিল। কিন্তু ১৯২৩ সালের দিকে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। সেই থেকে বিগত এক শ বছর এটি এভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।

হায়া সোফিয়ার ঠিক পেছনে অবস্থিত ছয় মিনারবিশিষ্ট ব্লু মস্ক। এটিও ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক ও প্রাচীন একটি মসজিদ, যা হাজারো পর্যটক এবং মুসল্লির ভিড়ে মুখর থাকে। নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন চারপাশের পরিবেশ, যার এক প্রান্তে হায়া সোফিয়া ও অন্য প্রান্তে ব্লু মস্ক অবস্থিত। প্রতিটি মসজিদে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা ইবাদতের ব্যবস্থা রয়েছে। হায়া সোফিয়ায় আমরা সবাই আসরের নামাজ আদায় করি।

ইস্তাম্বুল শহর অনেকটা আমার প্রিয় শহর লিসবনের মতো। উঁচু-নিচু পাহাড়ি সৌন্দর্য, যা সহজে যে কারও মন ভালো করে তুলতে পারে। ইস্তাম্বুল এসেছেন অথচ বসফরাস প্রণালিতে ভ্রমণ করেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূলত এই প্রণালি এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশকে বিভক্ত করেছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই প্রণালিতে ছোট-বড় জাহাজ ও নৌযানে করে এক পাশে এশিয়া এবং অন্য পাশে ইউরোপের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।

ঐতিহাসিক হায়া সোফিয়া মসজিদের সামনে সপরিবারে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ইস্তাম্বুলের ইউরোপ অংশের রাস্তাঘাট, চলাফেরা, যোগাযোগ, গণপরিবহনসহ সবকিছু ইউরোপের সঙ্গে ব্যাপক মিল রয়েছে। এই শহরটির প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে একসময়ের বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের তরতাজা ইতিহাস। সমগ্র শহরটি আমার কাছে মসজিদের নগরী মনে হয়েছে; যেখানেই চোখ যায়, কোনো না কোনো মসজিদ চোখে পড়েছে। শত বছর আগের শাসকদের ইসলামি সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দেয় এই শহর।