চীনা বন্ধু ও কিছু সুন্দর মুহূর্ত

করোনার সময় সব মিলিয়ে চার মাসের মতো বাসায় ছিলাম। বলতে পারি সময়টা সুসময়ই ছিল। এতটা সময় আগে কখনো পরিবারকে একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে জন্য বাচ্চাটাও অনেক খুশি ছিল। পাহাড়ে ঘেরা সুনিবিড় একরকম গ্রাম্য পরিবেশে ফুজো শহরের শেষ প্রান্তেই আমাদের বসবাস। আমাদের বাসাটা বেশ বড়সড় আর খোলামেলা। দুই বেডরুম, ড্রয়িংরুম, আলাদা কিচেনসহ দুপাশে বড় বড় দুই বারান্দা। তাই ওই চার মাসে একঘেয়েমি জিনিসটা বুঝতে পারিনি।

আমরা সবাই যেদিন পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনায় গিয়েছিলাম
ছবি: সংগৃহীত

পরিবার নিয়ে আসার পর খুব আনন্দের সঙ্গেই আমাদের সময় পার হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় ল্যাবে পার করার পর ই-বাইক (ব্যাটারি চালিত স্কুটি, ফুজোতে খুব জনপ্রিয়) নিয়ে বের হতাম বিভিন্ন পার্ক, সুপার মল আর অচেনা জায়গায়। এটা ছিল আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। করোনার সতর্কতা জারি হওয়ার পর আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। শুধুই ভাবতাম, আর হয়তো বেঁচে দেশে ফিরতে পারব না। মা-বাবাসহ সব আত্মীয়স্বজন বারবার ফোন করে দেশে ফিরতে বলেছিল। মা খুব কান্নাকাটি করত। দিনে কয়েকবার ভিডিও কলে কথা হতো, সব বুঝিয়ে বলতাম। তারপরও কাদের থেকে কী শুনে এসে আবার কল করে কান্না করত। দেশে ফেরার ব্যাপারে আমি কিছুটা সম্মতি দিলেও আমার স্ত্রী কখনো রাজি হয়নি। সে তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। সে বলত, মৃত্যু হলে এখানেই মরব কিন্তু বাচ্চা নিয়ে পথে বেরিয়ে এই দুঃসময়ে আরও ভোগান্তির স্বীকার হতে চাই না। এখন ভাবি, তার সিদ্ধান্ত হয়তো ঠিকই ছিল।

এখানে আসার পরে বেশ কয়েকটা চীনা পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। স্বভাবতই চীনারা ইংরেজিতে খুব দুর্বল, তাই অনেক চীনা বন্ধু এগিয়ে এলেও আমরা তাদের ভাষা না বুঝে পিছিয়ে যাই। আমরা যে কমিউনিটিতে থাকি, সেখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষই আমাদের দেখে অনেক খুশি হয়। তারা সব সময় তাদের ভাষায় আমাদের প্রশংসা করে। বিশেষ করে বাচ্চাকে সবাই অনেক আদর করে। খুব অল্পস্বল্প চাইনিজ বলতে–বুঝতে পারায় তাদের কথায় একটু-আধটু হাই–হ্যালো বলে বিদায় নিই।

পাহাড়ি ঝরনায় আনন্দঘন মুহূর্ত।
ছবি: সংগৃহীত
জেসিকাদের বাসায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রণে সবার সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

একদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে পরিচিত হয় এক পরিবারের সঙ্গে। তাদেরও প্রায় অন্তুর (আমার মেয়ের নাম) বয়সী একটা মেয়ে আছে। জেসিকার (অন্তুর বান্ধবীর নাম) মা খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারে। তাই জেসিকাও ইংরেজিতে পটু। জেসিকা আর অন্তু এত ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে যে তারা একে অপরকে না দেখলে থাকতে পারে না। প্রতিদিনই তারা একাধিকবার সাক্ষাৎ করে, খেলা করে। তাদের দুজনের খেলার ভেতর শোভা পায় মান-অভিমান, আদর-ভালোবাসা, রাগ-বিদ্বেষ, সবই। বৃষ্টির কারণে বের হতে না পারলে একে অপরের বাসায় যায়। অন্তু-জেসিকার যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদের দুরন্তপনাকে কোনো নিষেধ হার মানাতে পারে না।

তারা আমাদের অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছে। নতুন নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য আমাদের অফার করে। প্রায়ই বলে, তারা এখানে পিকনিক করবে, ওখানে বারবিকিউ করবে। কিন্তু প্রথম প্রথম আমরা অতটা রাজি হতাম না। কী সব রান্নাবান্না করবে এই ভয়ে, কারণ তারা তো সবকিছুই খায়। বারবার বলায় প্রথম দিন মনের বিরুদ্ধে তাদের নিমন্ত্রণে বাসায় গিয়ে দেখি, জেসিকার মা ইন্টারনেট ঘেঁটে মসলা কিনেছে। সব মেনু স্পাইসি করেই রান্না করেছে। আমরা মাছ পছন্দ করি, এটা একদিন কথার ছলে শুনে নিয়ে আমাদের মতো করে মাছ কেটে রান্না করেছে। সেদিন ওদের বাসায় গিয়ে বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। তাঁরা এখানকার আশপাশের ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। তাঁদের ভেতর একজন ডাক্তারও আছেন।

অন্তু ও জেসিকার খেলা
ছবি: লেখক

করোনার ভয়াবহ দিনগুলোয় তারা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খোঁজ নিয়েছে। তাদের কথা ছিল যেকোনো সমস্যা যেন তাদের বলি, তারা আমাদের সাহায্য করবে। একদিন আমার স্ত্রী সামান্য অসুস্থ (গ্যাস্ট্রিকের জন্য হালকা বুকে ব্যথা) বোধ করছিল। আমি ডাক্তার বন্ধুটার উইচ্যাটে (চীনাদের যোগাযোগের জনপ্রিয় সামাজিক অ্যাপ) বলা মাত্রই আমাকে উদ্বিগ্নের কারণ নেই জানিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় এসে দুই ধরনের ওষুধ দিয়ে গেছে। আমি কিছুতেই টাকা নেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি।

বর্তমানে তারা আমাদের প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহান্তে কাছাকাছি কিছু সুন্দর জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। করোনার কারণে আমাদের ঘোরাফেরায় ইন্টারন্যাশনাল কলেজের কিছুটা বাধ্যবাধকতা থাকায় আমরা দূরে যেতে চাই না। পরিস্থিতি ভালো হলে তারা আমাদের তাদের হোমটাউন বেইজিং, শিয়ামেনসহ আরও কিছু প্রদেশে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছে।

গত মাসে বাইরে ঘুরতে গিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অফার করেছিল। বন্ধুত্বের খাতিরে ‘না’ করতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম, আজ আর রেহাই নেই। আজ হয়তো অক্টোপাস না হলে শামুকের সুপ খাইয়েই ছাড়বে। কেননা, আমাদের কাছে না শুনে তারা নিজেই সেদিন খাবারের অর্ডার করেছিল। ওয়েটার একে একে ১৫ তেকে ১৬ রকমের মেনু টেবিলে দিল। সত্যিই আমরা সেদিনের মেনুগুলো দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সব কটি মেনু ছিল মাছ, ডিম আর সবজির। অনেক মজার আর স্পাইসি। তারা ঠিকমতো খেতে পারেনি স্পাইসির জন্য, কিন্তু আমরা সেদিন পেটপুরে খেয়েছিলাম।

অন্তু ও তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কমিউনিটিতে খেলার মুহূর্ত
ছবি: লেখক

এখানে আসার পরে বাচ্চাটাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হতো, না জানি কার সঙ্গে মিশবে? একা একা থাকতে থাকতে সে আবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে। এখন মেয়ে আমার বলে, সে চীন ছেড়ে আর দেশে যাবে না। সে নাকি জেসিকাকে সঙ্গে নিয়ে দেশে কয়েক দিন ঘুরে আবার চীন আসবে। ওর এসব কথা শুনে এখন অনেক হাসি পায়। জেসিকা ছাড়াও তার আরও কয়েকজন ভালো বন্ধু আছে। তারা ইংরেজি না জানলেও প্রতিদিন খেলতে গিয়ে অন্তুর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলে তাদের খেলার পূর্ণতা পায় না।

প্রায় এক মাস আগে ঘণ্টাখানেকের জন্য পরিচিত হয় এক চীনা আন্টির সঙ্গে। এরপর উইচ্যাটের প্রোফাইল পিকচারে বাচ্চার ছবি দেখে প্রায়ই আমাকে মেসেজ পাঠায় মেয়েকে দেখবেন বলে। বারবার তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। সেদিন উইচ্যাটের মোমেন্টে বাচ্চার দুটি ছবি শেয়ার করার পর থেকেই ওনার কয়েকবার কল। পরে আমি কল কেটে দিয়ে চীনা ভাষায় ট্রান্সলেট করে লিখি, ‘আন্টি, আপনি টাইপ করেন, তাহলে আমি বুঝে নেব। আমি তো চীনা ভাষায় কথা বলতে পারি না।’ তাঁর আজ জোর আবদার, অন্তুকে দেখবেন এবং আমাদের ডিনার করাবেন। উনি আজ কোনো বিধিনিষেধই মানবেন না।

পরে একদিন আমাদের নিয়ে অন্য একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

গেলাম সন্ধ্যায়। অন্তুকে পেয়ে উনি বেশ খুশি। নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। আর অন্তুও ক্ষণিকের জন্য ঠাম্মি ও দিদুনের অভাব পূরণ করে নিল। আমরা গিয়ে বলছিলাম, কিছু খাব না। তাতে উনি খুবই মন খারাপ করেছিলেন। পরে নিজেদের পছন্দমতো সবজি, চিকেন, ব্রেড নিয়ে সেগুলো বারবিকিউ করেছিলাম। আমাদের খাওয়াতে পেরে আন্টি অনেক খুশি। আমরাও খুবই মজা করে খাবারগুলো খেয়েছিলাম।

সীমাবদ্ধ মানবজীবনে চলার পথে ক্ষণিকের জন্য প্রতিদিন পরিচিত হচ্ছি নিত্যনতুন জায়গা, কালচার ও মানুষের সঙ্গে। একদিন এদের ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজের কর্মক্ষেত্রে, আবার সবকিছুকে অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। হয়তো চাপা পড়ে যাবে এখানকার সব স্মৃতি। সবকিছু চিন্তা করলে সত্যিই যেন মায়া লাগে এই ফুজো সিটি ছেড়ে যেতে।

লেখক: পিএইচডি ফেলো, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন