টেস্ট রেজাল্ট আজও আসেনি, আবার অপেক্ষা

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসক ও তাঁর পরিবার করোনায় আক্রান্ত। সে কথাই তিনি লিখছেন। আজ পড়ুন ২৩ তম পর্ব।

আমাদের করোনা ২য় সপ্তাহে খারাপ হয়েছিল। আমার বরের ২য় সপ্তাহ চলছে। এই ভালো, এই মন্দের টানাটানি বেচারাকে বেশ কাহিল করে ফেলেছে। আর যদিও আমার সিম্পটম আগের চেয়ে ভালো তবে কফটা বেড়ে গেছে। কিছু করতেও ভালো লাগে না। নিজের ওপর জোর খাঁটিয়ে করি।

সকালে নাশতা করতে কেউ স্পেশাল কিছু চায় না। আমার নরমালি এক কাপ চা বা কফি লাগে। দু’কাপ বানালাম দুজনের জন্য।

তারপর মনে হলো আমি নাশতা বানানোর জন্য সবকিছু গতকাল রেডি করেছিলাম যা সকালে ভুলে গেছি। মনে পড়তেই বানাতে যেয়ে উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। কে জানবে পুরির বদলে আলু পরোটা খাচ্ছ? লাঞ্চ বলে চালিয়ে দেব।

রেডি হতে দেখে আজ মেয়ে সঙ্গে যাবে বলছে। এই ঘোরাঘুরির সময়টাই আমাদের এক সাথে কাটানো বেষ্ট সময়! সি ইজ এক্সপেন্সিভ! তবে আজ ঘোরাঘুরির সঙ্গে মনে হল বাজারটা করা দরকার- গত কয়েক দিন মার বাসার পাঠানো খাবার খাচ্ছে। আমি জানি ও কিছু বলবে না, তবে এরা ফ্রেশ খাবার পেলে খুশি হয়। বাসায় ফিরে রান্না করতেই ডিনার টাইম- ছেলে বাসমতির চাল পেয়ে বলছে, মা ফ্রাইড চিকেন হলে ভালো হতো! এই ছেলে যে খাবারের ব্যাপারে বলতে পারে, জানা ছিল না। হাসছি আমি।

আমাদের রিপিট টেস্ট রেজাল্ট আজ আসে নি। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, স্ট্যাটাস জানতে।

আমরা আসলে বরাবার বিকেলে রাতের খাবার খেয়ে নিই। এটা দশকের পর দশক ধরে চলছে। সন্ধ্যায় বাচ্চাদের ঘুম বা তাদের সঙ্গে কিছুটা পারসোনাল টাইম কাটানো আমার অভ্যাস। এ সময় আমি সহজে কোনো আউটিং রাখি না। রাত নয়টার মাঝে বাচ্চারা ঘুমায় আর আমরাও রাত জাগি না। তবে যেহেতু স্কুল ছুটি, এরা একটু বড়ও হয়েছে- সুযোগ নিচ্ছে। বাচ্চাদের ঘুমটা আমি খেয়াল রাখি ৮-১০ ঘণ্টা না হলে, এরা খিটখিটে থাকে আর এদের স্কুল টাইম অনেক বড়। ভাতঘুম কি সেটা এরা জানে না। আবার ঘুম না হলে কনসেনট্রেশন করার সমস্যা- এরা নিজেরাও বুঝে। এ সময় রেয়ারলি আমার বাসায় কাউকে আসতে বলি। হ্যাঁ, ভীষণ বোরিং লাইফ। তবে আমাদের জন্য ঠিক আছে।

এদিকে আমার ভাইয়ের কাজে তার সহকর্মী করোনায় এক্সপোজ - ভীষণ ভয় পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় কোভিড কেস বাড়ছে। ভয় পাওয়ারই কথা, বাসায় তার ছোট বাচ্চা। যদিও ও লো রিস্ক তবুও, টেস্ট করিয়ে এসেছে- নেগেটিভ, স্বস্তিদায়ক। তবে! তবেটা হচ্ছে, টু আরলি টেস্ট! টু আরলি করলে এমনিতেও নেগেটিভ হবে, কারণ করোনার সিম্পটম না হলে হয়তো রেজাল্ট পজিটিভ নাও আসতে পারে। ১-২ সপ্তাহ লাগে সিম্পটম দেখা দিতে! সিম্পটম একটু হেভি হলেই পজিটিভ রেজাল্ট আসে। তবে ওর সেকেন্ডহ্যান্ড এক্সপোজার - এমনিতেও ভয়ের কিছু নেই।
মাস্ক, মাস্ক আর মাস্ক- এর বিকল্প নেই।

যেমন ট্রাম্প বলেছে, আমেরিকা টেস্ট বেশি করাচ্ছে তাই পজিটিভ বেশি। কথা এক দিকে সত্য! টেস্ট না করালে জানা যেত না এত মানুষ পজিটিভ। কারণ পজিটিভ হলেও টেস্ট না করলে তো কোন পজিটিভ রেজাল্ট নাই। আর কমিটমেন্ট এবং জবাবদিহি! এখানে তো কেও মনগড়া রিপোর্ট দিতে পারবে না। সেগুলো আবার খাতায় নয়, কম্পিউটার ডেটাবেইসে চলে যায়- দু নম্বরি করার চান্স নাই- যেটা বিভিন্ন দেশে হয়েছে, আমি দেশগুলোর নাম না নিই! ভূতের মুখে রাম নাম!

এদিক দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঠিক বলেছে- দেশে সংক্রমণ কম, মানুষ টেস্ট করাতে আগ্রহী নয়। টেস্ট অপ্রতুল, সেটা কেউ স্বীকার করবে না। পরীক্ষা দামি সেটাও নয়। তবে হ্যাঁ এখানকার মতো দিনে লাখ লাখ টেস্ট হলে, আর সেগুলোর সত্যিকার রেজাল্ট দিলে (অনেক জায়গায় যেমন টাকা নিয়ে স্যাম্পল নিয়েছে, সে স্যাম্পল ড্রেনে ফেলে দিয়ে, ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে-জনগণের পয়সা গেছে, দুর্গতিও হয়েছে) সত্যিকারের চিত্র বোঝা যেত।

যেমন আমার যেদিন পজিটিভ হলো, সেদিন ১০ বছরের এক বাচ্চাকে কোভিড পজিটিভ ডিক্লেয়ার করে এলাম। কোভিড আমাদের আশপাশে সবারই হচ্ছে, কারও সিম্পটম মাইল্ড, কারও সিভিয়ার, যারা টেস্ট করাচ্ছে না তারা ভাবছে সর্দি কাশি, ভালো যে বেশির ভাগই ভালো হয়ে যাচ্ছে। তবে যারা বিভিন্ন কারণে আগে থেকেই সিক, তারা সাফার বেশি করছে- স্পেশালি হার্টের সমস্যা, কিডনি এবং ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস নরমালি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, এরপর কোভিড হলে তো কথাই নেই। আর আমরা ভাবি বাচ্চাদের হয় না, গরিবের হয় না-বড়লোকের অসুখ! না ভাই এবং বোনেরা-কোভিড সদ্য ভূমিষ্ঠ থেকে শতবর্ষী কাউকে ছাড়ে না। ভাইরাস ধনী গরিব বুঝে না- সবার হয়।

আজ একটি সিক্রেট বলি, যদিও বেশির ভাগ লোকের কাশি, শ্বাসকষ্ট হয় করোনায় সময়ে, তবে কোভিড এজমার রোগী যারা নিয়মিত ওষুধ খেয়ে কন্ট্রোলে থাকেন, তাদের অত ঝামেলা করে না। ওই যে বললাম, যারা নিয়মিত ঔষুধ খেয়ে কন্ট্রোলে থাকে, শুধু তারা। তবে এটা ভেবে খুশি হওয়ার কারণ নেই যে আমার এজমা আছে, তাহলে আমি সেফ। না, আপনি সেফ নন। এজমার বহু ক্যাটাগরি আছে, সেই হিসেবে নিয়মিত এলার্জিস্ট, পালমোনোলজিস্ট এবং আপনার রেগুলার ইন্টারনাল মেডিসিনের ডাক্তারদের নিয়ম কড়ায়-গন্ডায় মেনে চললেই হয়তো আপনি সেফ।

লেখক
লেখক

ডায়াবেটিস নিয়ে যেহেতু বলেই ফেলেছি, খোলাসা করে বলি। ডায়াবেটিস নরমালি আপনাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে দেয়। আর আমরা হাভাতে। আসলে হবে, মাছে ভাতে বাঙাল। খাবার কম দেখলে চোখে পানি আসে। ভাত না পেলে কাঁদি। মিষ্টি কেউ খেতে না দিলে তাকে অসুর ভাবি, পাষাণ ভাবি। আর হাঁটা চলা? কাজ? সেসব করবে ছোটলোক, দাসী বাদি। তাই তো বড়লোক বাঙালের প্রতি ঘরে আনকনট্রোল্ড ডায়াবেটিস।

আমরা খুশি মনে বেশি ভাত খাই, ভালোবেসে এক হাতা ভাত বেশি খাই, সঙ্গে মুড়ি, বিস্কুট নাশতায়। দুধ চা চিনি দিয়ে শরবত বানাই সঙ্গে দুটো মিষ্টি না হলেও চলে না। প্রতিদিন যে আধা ঘণ্টা ব্যায়াম বা দ্রুত হাটতে যাওয়ার কথা তা ভুলে যাই। অথবা ওজন বেড়ে হাঁটুর ব্যথায় হাটতেও পারেন না। আবার হাটতে ইচ্ছাও নাই। এদিকে আপনার শরীরে খাবার হজম করার ইনসুলিন নেই- বোঝাতে পেরেছি? আপনি নিজেই আপনাকে সাহায্য করছেন না। ডায়াবেটিসের মতো খারাপ রোগ হয় না। তবে একটু সচেতন হলে, অবশ্যই এটি আপনি কন্ট্রোল করতে পারেন। এটা এক দুই দিনের ব্যাপার নয়, যত দিন বাঁচবেন তত দিনের ব্যাপার-এটাও আমাদের কেউ বলে না। আজ জানলেন তো? তাহলে প্রতিদিন খাবার কন্ট্রোল করুন এবং হাঁটুন।

ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হাই কোলেস্টেরল- এর প্রতিটির জন্য জিহ্বা সংযত রাখতে হবে আজীবন। সঙ্গে এক্সারসাইজ-একটু ওলট পালট হলেই কিডনি হারাবেন- প্রতিটিই এক্সপেন্সিভ- মানে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, আর সারা জীবন থাকে। আমাদের আবার জিহ্বা সংযত নয়, খাবারের ক্ষেত্রে এবং মানুষের নামে গিবতের ক্ষেত্রেও-দুটোই পরিহার করুন। হাঁটতে যান প্রতিদিন, নিজের কাজ নিজে করুন। এসব রোগ কন্ট্রোলে থাকবে সঙ্গে শরীরটাও ঝড় ঝড়ে থাকবে। এক চামচের বেশি ভাত নয়। একটির বেশি দুইটি রুটি নয় আর এর সঙ্গে আলু ভর্তাও নয়।

অনেকেই ভাবেন আমেরিকায় তাহলে কেন এত মানুষ মারা যাচ্ছে? তারা তো বেষ্ট চিকিৎসা পায়! কথা সত্য। এখানে চিকিৎসা সেবার বদৌলতে এমন সব মানুষ আমাদের আশে পাশে হেঁটে বেড়ায়, যাদের বেঁচে থাকারই কথা নয়- কোভিড তাদের জীবনে শেষ আঘাত হানছে। আর এখানের জনগণও আমাদের মতই- অনেকেই অনেক কিছুই কন্ট্রোলে রাখে না- তাদের ওপর কোভিডের আক্রমণে কারও কিছু করার থাকে না। তারা তাদের বেষ্ট চিকিৎসাই পাচ্ছে। আর এই মৃত মানুষের সংখ্যা কেউ অন্যান্য দেশের মতো উনিশ বিশ করতে পারে না বলেই, সত্যিকার নম্বর প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে- এক লাখ ৬০ হাজার পেরিয়ে গেছে।

আসুন আমরা আমাদের কর্তব্য করি, হয়তো একদিন আমরাও মাথা উঁচু করে এসব দেশের কাতারে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মঞ্চে হেঁটে বেড়াব। দুনিয়া আমাদের উদাহরণ হিসেবে নেবে- না দুর্নীতিতে নয়, সততায়, সহমর্মিতায়, মানবিকতায় আর সুচিকিৎসায়। তত দিন আমি আপনি বেঁচে থাকলে ভালো, নয়তো পরবর্তী প্রজন্মই না হয় গর্ব করবে।

তবে শেষ করার আগে বলছি, আপনার হাত যদি নোংরা না হয়, তবে ১৫ মিনিট পরপর স্যানিটাইজার ব্যাবহার করবেন না। যদি হাত নোংরা হয়, তবে যে কোনো সাবান পানি ব্যবহার করে, হাত ধুয়ে ফেলুন। স্যানিটাইজার শুধু বাধ্য না হলে ব্যবহার করবেন না। চলবে...