ডিজিটালে যুবসমাজ ও পরীক্ষার দুঃস্বপ্ন

১.
বিশ্বব্যাপী করোনায় পর্যুদস্ত জনজীবন—সব দেশে, সব জায়গায়। শিক্ষা, অর্থনীতি, আর দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে এখন ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা। উন্নত বিশ্বে সুন্দর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আর পর্যাপ্ত মজুত থাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে অনেকটা সামাল দিয়ে বিপদেও ভেঙে পড়ছে না। নিত্যনতুন উপায় খুঁজে করোনার কশাঘাতে ভেঙে যাওয়া নাজুক পরিস্থিতির উন্নতি করা হচ্ছে। মহামারির এই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয়ের খবরে মাথা হেঁট হয়ে আসে। প্রচারমাধ্যম ভরা সেসব খবরে। সিলেটে স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে সদ্যবিবাহিতাকে কলেজে নিয়ে গণধর্ষণ, নোয়াখালীতে মধ্যবয়সী এক মাকে তাঁর নিজ বাড়িতে ছেলের বয়সী কুলাঙ্গারেরা বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে তা ফেসবুকে ছড়ায়। ভার্চ্যুয়াল জগতের এই ফেসবুক আসক্তি ক্ষতির কারণ হলেও অন্যান্য অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় রাখতে সব প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে নতুন খবর এল এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা ছাড়াই সবাই পাস। এতে কারও হয়েছে পৌষ মাস, কারও বা সর্বনাশ।    

২.
পরিচিত মানুষ। নাম ভুলু (ছদ্মনাম)। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জীবনের কথা, পথচলার কথা, অভিজ্ঞতার কথা। আগামীর স্বপ্নের কথাও। করোনাকালের এই সময়ে পরীক্ষা ছাড়াই ২০২০ সালের এইচএসসিতে শতভাগ পাসের খবরে ভুলু ফিরে যান নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে। সেদিনও যদি এমন হতো! ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া সেসব কঠিন স্মৃতিতে তিনি। মন দিয়ে তাঁর গল্প শুনি। খারাপ ছাত্র তিনি ছিলেন না। নামকরা স্কুল থেকে এসএসসিতে ভালো ফল করে জেলা শহরের সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে যথারীতি প্রথম বর্ষের ফলের জন্যও খুশি। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে আর লেখাপড়া হয়নি। প্রায় শূন্য। এইচএসসি ফাইনালের আগে টেস্ট পরীক্ষায় দুঃখজনকভাবে তাই খুবই শোচনীয় অবস্থা।

শোচনীয় সেই অবস্থায় ভুলু দিশেহারা। অনেক বন্ধুহারাও। চারদিক থেকে সবার হতাশাজনক মন্তব্য আসে। বিদ্রূপের হাসিও ছিল কারও কারও মুখে—কী শিক্ষক, কী সহপাঠী। সবাই না যদিও, তবে কেউ কেউ। হতাশার কথায় সুবুদ্ধির উদয় হতে পারে, কিন্তু বিদ্রূপের কারণে জেগে ওঠার দৃঢ়তা। ভীষণ জিদ চেপে যায়। মাত্র তিন মাস পর এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলে শোচনীয় অবস্থা হলেও শিক্ষকদের অনুরোধ করে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষা বোর্ডের ফর্মে নাম লেখাতে পায়। কিছুটা স্বস্তি সেখানেই, অন্তত পরীক্ষা দেওয়া যাবে।

অতল সাগরে ডুবে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তার টনক নড়ে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাতে সময় মাত্র তিন মাস। প্রচুর পড়া। ডু অর ডাই। লড়াই করো, নয়তো শেষ। অনেকটা, চিকন রশির ওপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হওয়া। পিছলে পড়লেই জীবনের গল্প শেষ। প্রচণ্ড হতাশাকে পেছনে ফেলে, দিনরাতের সীমাহীন অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে বরণ করে নেন তিনি। স্বল্প সময়ে প্রথম বর্ষের পড়া রিভিশন করে, আর দ্বিতীয় বর্ষের সবকিছু নতুন করে পড়ে বুঝা। সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি। কঠিন, খুবই কঠিন। বিধাতা তার প্রার্থনা শুনেছিলেন। যথাসময়ে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সন্তোষজনক ফলাফল হয়। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি তাঁকে, কীভাবে সম্ভব? উত্তর আসে, দৃঢ়সংকল্প আর কঠোর পরিশ্রম। সঙ্গে যদি কারও মোটিভেশনাল কথা পাওয়া যায়। উৎসাহ আর সাহস দেওয়ার কেউ। কৃতজ্ঞতা জানালেন সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তিনজন আত্মীয়কে, যারা তখন সাহস জুগিয়েছিলেন। দুজন সহপাঠী বন্ধুকেও স্মরণ করল, অত্যন্ত বিপদেও এই বন্ধুরা অগাধ আস্থা রেখেছিল বলে। তবে পরীক্ষার সেই দুঃস্বপ্ন নাকি আজও তাড়া করে। রাতের ঘুমে। মাঝেমধ্যে। মহাবিপদে পড়ে সঠিক পথে ফিরে এসেছিলেন ভুলু, পাঠকের জন্য তাই তাঁর গল্প আপাতত এতটুকুই।

৩.
বাস্তবের সেই গল্প ছেড়ে বর্তমান ডিজিটাল সময়ের করুণ কাহিনিতে নজর পড়ে। ডিজিটালের এই যুগে যুবসমাজের কেউ কেউ অল্প বয়সেই শিক্ষা থেকে ঝরে যাচ্ছে। হয়তো তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের গল্পগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে এভাবে। শিক্ষার আলো থেকে নিকষ কালো অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এই তরুণেরা অনেক ভালো ছাত্রছাত্রী। আফসোস! জেনে খুব কষ্ট লাগে। মা–বাবার অসচেতনতা, আজকের সহজলভ্য স্মার্টফোন, অপ্রয়োজনীয় ইন্টারনেটের ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুকে আসক্তি, চ্যাটিং, আর ইউটিউব ভিডিওতে নেশার চোখ ছাড়াও সমাজ ও দেশ দায়ী। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তি নষ্ট রাজনীতি, মাদক আর ড্রাগের ছোবল তো আছেই।

স্বচক্ষে দেখা একটি ঘটনা। ২০০২ সাল। মাস্টার্সের পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করতে ইন্টারনেট ব্যবহার কিছুটা শিখেছি। নিজের স্মার্টফোন আর কম্পিউটার না থাকায় বিদেশের প্রফেসরদের লিখতে ঢাকায় সাইবার ক্যাফেতে যাওয়া হতো কখনো। সেদিন বলধা গার্ডেনের কাছাকাছি এক সাইবার ক্যাফেতে ইন্টারনেটে ই–মেইল পড়ছি। পাশের দুই কম্পিউটারে অন্তত চারজন স্কুলবয়সী ছাত্র ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। হঠাৎই কী যেন কপি করতে সাহায্য চাইল। গিয়ে দেখি তারা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নোংরা ভিডিও দেখছে। সেগুলোই তারা কপি করতে চায়। মুহূর্তেই ফিরে আসি সমাজের এই অধঃপতন দেখে।

৪.
সামাজিক অবক্ষয় আর অধঃপতনের অনেক কারণ। অভিভাবকের অসচেতনতা, সুশিক্ষার অভাব, লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি, সুবিচারের অভাব, লোভ-লালসা মুখ্য। সন্তানদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে বড় করার পাশাপাশি পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা আর আদর্শের শিক্ষা সবার আগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশিক্ষা, যোগ্যতার মূল্যায়ন, আর যোগ্য শিক্ষকের খুব দরকার। লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিকে শিক্ষাঙ্গনে আশ্রয় না দিয়ে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষা ও গবেষণামুখী করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যায়ের সুবিচার না পাওয়া আর বিচারহীনতা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। সব লোভ-লালসাকে সুশিক্ষা আর সুবিচার দিয়ে দমন করে সুন্দর সমাজ ও দেশ গঠন করা যায়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। গভীরভাবে ভাবুন। সময় এখনই।
লেখক: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (জৈব রসায়ন), টরন্টো, কানাডা।