ধন্যবাদের দিন-ভালোবাসার দিন

পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেকোনো দিবস পালনের কথা শুনলেই খানিকটা আদিখ্যেতা মনে হয়। কখনো খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, লোকদেখানো, কিংবা মিডিয়ায় খ্যাতি পাওয়া, এ–জাতীয় নানাবিধ বিষয়ের সঙ্গে দিবস উদ্‌যাপনের একটা যোগসূত্র থাকে বৈকি! তাই দিবস শুনলেই কিঞ্চিৎ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করি নিজের অজান্তেই। তবে নানা রঙের দিবসের নানাবিধ মাহাত্ম্য রয়েছে, এ নিশ্চিত। আমরা যদি তার ইতিহাস ঘেঁটে দেখি, তবে এতটাও অপছন্দের কোনো কারণ নেই। তেমনই এক দিবস হলো ‘থ্যাংস গিভিং ডে’—ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস।

দিবস নিয়ে কিছু কথা বলার আগেই এই দিবসে নিবেদিত একজন আমেরিকান গীতিকবি রাফি কাভুকিয়ানের জনপ্রিয় একটি গীতিকাব্যের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি এখানে—
‘ধন্যবাদ দিতে চাই, এই সুন্দর সূর্য এবং আকাশ দিয়েছ তাই,
দিয়েছ মেঘমালা আকাশের উঁচু সীমানায়।
যেখানে বাতাসেরা কানে কানে কথা কয়,
ধন্যবাদ তোমায়, বসন্তের পাখিরা ডানা মেলে ওড়ে, মিষ্টি সুরে গান গায়।
চন্দ্রালোকিত রাত দিয়েছ, দিয়েছ উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ,
মনের আঁধার দূর করে দিয়েছ হৃদয়ে প্রেমকুঞ্জ।  
নীল ঊর্মীমালার সাগর দিয়েছ, দিয়েছ তৃষ্ণার জল।
এই মাটি, এই বন-বনানী সব দিয়ে করেছ ঋণী, করেছ ধন্য,
দিয়েছ সবই, সুন্দর জীবনের জন্য।
হে মহান ধরিত্রী শুধু দিয়েই গেছ অবিরল,
কৃতজ্ঞ চিত্তে নতজানু তাই, তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।’

জনপ্রিয় এ গান (ইংরেজি ভার্সন) শিশুরা স্কুলে গেয়ে থাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবসের শ্রদ্ধা জানাতে। প্রশ্ন হচ্ছে, কাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং কেনইবা এই ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য এত বিশেষ আয়োজন। গীতিকাব্যের প্রতিটি চরণ খেয়াল করলেই দেখা যায়, এই ধন্যবাদ দেওয়া হচ্ছে ধরিত্রীকে, এই সুন্দর পৃথিবীকে। মানবজীবন প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে মাতৃপ্রকৃতির কাছে। প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর এ রেওয়াজ মূলত উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই এ সমাজে প্রাচীনকাল থেকে চালু রয়েছে। এটি একাধারে যেমন ধর্মীয় উৎসব, তেমনি সামাজিক উৎসবও। হেমন্তের শেষ সপ্তাহে ফসল তোলাকে ঘিরে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো এক বর্ণিল উৎসবে মেতে উঠত। প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং আসন্ন নিদারুণ শীতের প্রকোপে জীবনের জন্য সাহায্য প্রার্থনাই ছিল এই উৎসবের মূলমন্ত্র। ১৯৫৮ সাল থেকে এটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ধার্য হয় এবং অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আবহাওয়ার কথা ভেবেই।

১৭৬১ সালের ইন্ডিয়ান অ্যাক্টের বদৌলতে ব্রিটিশদের আগ্রাসী শোষণ ও রাজত্ব কায়েমের সনদ হাতে পেয়ে কানাডার মূল ভূখণ্ডের নৃগোষ্ঠীদের ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল বনবাসে। আক্ষরিক অর্থেই সেটা ছিল গহিন জঙ্গল, তাই তাকে নির্বাসনদণ্ড বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। যাদের হাজার বছরের পদচারণে এই বরফশীতল ভূখণ্ডটি প্রকৃতির আদিমতম কন্যারূপে লালিত-পালিত হয়ে এসেছিল, যারা এর ওপরে প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল এই মাটিকে ভালোবেসেই, ব্রিটিশ অধিকৃত কানাডার মূল ভূমি থেকে তাদের উৎখাত করা হয়েছিল গহিন অরণ্যে।

প্রায় ৫৫০টি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষাসহ জীবনও ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছিল তখন। যাদের জংলি আখ্যা দিয়ে আভিজাত্যের নীল রক্তধারী রাজরাজারা কেড়ে নিয়েছিল জীবনের ভেতর থেকে প্রাণ; সেই বর্বর জাতিরাও কখনো–সখনো শেখাতে পারে আমাদের অনন্য জীবনদর্শন! দিতে পারে মানবিক মহৎ উপলব্ধি, জীবন ও জগতের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু উচ্চতর বোধ, যা ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবসের মূল সুরের মধ্যেই খানিকটা নিহিত।

আদিতে উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল সৃষ্টিকর্তা, তথা ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া আদায় হলেও নানা সংযোজন–বিয়োজনের পর এখনো এর মূল সুর বিচ্যুত হয়নি ততটা। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার কানাডার মতো একটি বহু জাতিক-বহু সাংস্কৃতিক দেশে মহোৎসবে এ দিবস উদ্‌যাপিত হয় সম্পূর্ণ ধর্মীয় বাতাবরণের বাইরে এসে। মহান মানবজন্মের জন্য এবং জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সব ভৌত-অভৌত উপাদান দিয়ে এই বসুন্ধরাকে আমাদের জীবনযাপন-ধারণের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় আজও সানন্দে, যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক সুমিষ্ট বীজের বপন এবং ক্রমাগত পরিচর্যার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়।

উৎসবকে ঘিরে ব্যক্তি সপরিবারে-সবান্ধবে উন্নত রাত্রিভোজের আয়োজন করা হয়। আদিবাসীদের জঙ্গলের জীবনে বৃহৎ পরিসরে সান্ধ্যভোজে টার্কিই (বনমোরগ) ছিল সহজপ্রাপ্য, যা আগুনে ঝলসে ডিনারের আয়োজন হতো তখনকার সময়ে। তাই আজও ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবসের মূল মেন্যু টার্কি রোস্ট, সঙ্গে অবশ্যই পাম্পকিন পাই, কর্ন স্যুপ এবং ম্যাশ পটেটো। অর্থাৎ হেমন্তের উৎপাদিত কৃষিপণ্যই খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় ছিল মূল আকর্ষণ। সঙ্গে আদিবাসী নৃত্য, ড্রামসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল তাঁদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির নিগূঢ় প্রকাশ।

আজকের সময়েও স্কুল-কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিন উপলক্ষে আলোচনা সভা, ভিডিও প্রদর্শন, ছবি অঙ্কন, গল্প লিখনসহ বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস উদ্‌যাপনের মূল মন্ত্র যতটা না ধর্মের, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি হলো শিশুদের বড়দের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি, নিজ ধর্ম এবং মাতৃপ্রকৃতির প্রতি বিনয়ী হতে, কৃতজ্ঞ হতে এবং যত্নবান হতে শেখানো। সর্বোপরি শিশুর জীবনযাপনে চারপাশের প্রতিবেশের প্রতি মমতা এবং সহবৎ তৈরিতে উদ্দীপ্ত করা। হাজার বছর আগে এই জংলি মানুষেরা যে সংস্কৃতির সূচনা করে গিয়েছিল এ মাটিতে, আজ এত বছর পরে আমাদের শ্বেত সুপ্রিমেসির কাছেও তা শিক্ষণীয় হয়ে আছে এবং উত্তরোত্তর এটি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে।

আমাদের দৃষ্টিতে আদিবাসীরা বনে–জঙ্গলে জন্তুর মতো জীবন যাপন করলেও তাদের পারিবারিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে সুদৃঢ় বন্ধন, ওদের সমৃদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও গোষ্ঠীবদ্ধ যে জীবনাচরণ, মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে নারীর উচ্চ মর্যাদা তথা প্রকৃতিকে মাতৃস্বরূপ সম্মান করার যে শিক্ষা, তা আমাদের বোধে এক অনন্য আলোর জন্ম দেয়।
আদিবাসী সমাজে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসের মূল ভিত্তি হলো প্রকৃতি, যে প্রকৃতি ওদের কাছে মাতৃস্বরূপ! গর্ভধারিণীর মতোই এই প্রকৃতির পূজা করে তারা; এই বসুন্ধরাই উপহার দিয়েছে পরম মানবজীবন। চাঁদ হলো মাতামহী, সে রাতের আকাশের মতো মানবজীবনের সব কলুষতা দূর করে আলোকোজ্জ্বল করে তোলে প্রিয় বসুন্ধরাকে।

বাতাস হলো মাতামহ, যে কিনা সৃষ্টির সব প্রাণের শ্বাস-প্রশ্বাসের মূল মন্ত্র, সে হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে জীবন। সূর্য হলো মায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র, যার কাজ হলো মায়ের সব সন্তানের দেখভাল করা, শীতার্তকে তাপ, অন্ধজনে আলো বিলানো; আলো-উত্তাপ এই দুইই নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণ করে সূর্যদেব, যাতে সব প্রাণ বাঁচে নব আনন্দে। মাকে ঘিরে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকায় ধরিত্রীমাতা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ। কী অপার বিস্ময়ে আমি এই ধর্মবোধ অবলোকন করি! যা অহিংস, অনিন্দনীয়! যেখানে হিংস্রতা নেই, আছে অগাধ প্রেম, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নেই, আছে মানবতা, আছে প্রকৃতির সব জীবের জন্য অফুরান ভালোবাসা। মানবজীবন আলোকিত করার জন্য এর চেয়ে বেশি আলো কে ধরতে পারে আর?

অথচ আজকের পৃথিবী সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও আমাদের মতো ভদ্রস্থ সমাজের লোকজন, দেশে দেশে যে রক্তারক্তি, যে হিংসার বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছি, যে কালোয় পৃথিবীর আকাশ-বাতাস দূষিত করছি, আজ ধরিত্রীই আমাদের হাতে হচ্ছে লুণ্ঠিত, ভূপাতিত। সর্বনাশ করছি আকাশ-বাতাস, সমুদ্র-সুপেয় জল! আজ আর মানুষের হাতে কোনো কিছুই নিরাপদ নয়, নয় মানুষ কিংবা আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী! আজ সেই আদিম অসভ্য জংলিদেরই বড় দরকার! ওরাই প্রকৃত মানুষ!
আসুন আজ লালন সাঁইয়ের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলি—
‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, (ভবে)
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তাঁর,
নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল
সর্বস্থলে একই এক জল
...একা মোর সাঁই ফেরে সর্বদাই
মানুষ মিশিয়া হয় বিধান তাঁর।
লালন সাঁই কয়, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ চারদিকে আজ সোনার মানুষের বড় আকাল। আজ এই উৎসবে আসুন সবাই মিলে নিবেদিত হই পরমানন্দে, পরম কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায়। জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসি শুধু মানুষেরে।

* টরন্টো, কানাডা