নরসুন্দর ও নীল পাখি

ড্যানজেল ওয়াশিংটন
ফাইল ছবি

বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা ও দুই–দুইবার একাডেমিক অ্যাওয়ার্ডজয়ী অভিনেতা ড্যানজেল ওয়াশিংটনের একটা উক্তি পড়ছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে একটা নাপিতের সঙ্গে যদি আপনার সখ্য থাকে, তাহলে আগে–পরে যখনই হোক একসময় আপনার চুল কাটা হয়েই যাবে।

আমেরিকাতে আসার পর ছাত্রাবস্থায় নাপিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। টম নামের এক নাপিতের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বটে। তবে চুল কাটার খরচ কমে তো নাই বরং আরও বেড়ে গিয়েছিল। কারণ, পরিচিতজনকে কখনো কম বকশিশ বা টিপস দেওয়া যায় না। ফ্রি তো দূরের কথা। তা ছাড়া দুনিয়াতে ফ্রি বা মাগনা বলে কিছুই নেই। এমনকি মাগনা দিতে চাইলেও তার ভেতরে ঘটনা থাকে। ছোটবেলায় দেখতাম ঢাকার অনেক পান-সুপারির দোকানে লেখা থাকত—

‘মাগনা বা বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না,
বাকি দেওয়া বড় কষ্ট, বাকিতে হয় বন্ধুত্ব নষ্ট’।

যাহোক, চুল আর বাড়ির আঙিনায় ঘাস কাটার ব্যাপারে টাকা খরচ করতে আমার ঘোর আপত্তি। কারণ, এই দুটোই দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং গ্রীষ্মকালীন সময়ে এই দুটি ছাঁটাই করা আমার জন্য সময় ও খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার। সুতরাং খামাখা খরচ কেন? প্রয়োজন হলে ওই খরচগুলো দিয়ে সিনেমা দেখাও ভালো। কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যে যেতে হয়।

বছর কয়েক আগে সস্তা নাপিতের দোকান খুঁজতে খুঁজতে মিনিয়াপলিশ শহরের উপকণ্ঠে এক নতুন বারবার স্কুল বা নরসুন্দর বিদ্যালয়ের খোঁজ পাই। অনেকেই নরসুন্দর শব্দ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয়। এর অর্থ নাপিত। বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে আছে চুল, দাড়ি প্রভৃতি কেটে মানুষকে সুন্দর বা রূপবান করে যে ব্যক্তি সেই নরসুন্দর। বাংলা ভাষায় কিছু কিছু শব্দ আছে যা কিনা শুধু নর বা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। এই একুশ শতাব্দীতেও নারী বা নারীরা এই দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। যেমন নরপিশাচ সেই যে আকৃতিতে নর প্রকৃতিতে পিশাচ। আবার নরপশু হচ্ছে পশুহৃদয়–বিশিষ্ট পুরুষ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাইস্কুলে পড়ার সময় দেখতে সুদর্শন আমার এক বন্ধু ছিল। তাকে আমরা নরসুন্দর বলে ডাকতাম। নাম শুনলে সে খুব খুশি হতো, কারণ সে নামের অর্থ জানত না। তখন বিটিভিতে সারা দিন এরশাদ আর বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের খবর প্রচার হয়। সেই সময়ে বন্ধুর একটা বিজ্ঞাপন বিটিটিতে দেখাত। চা–পাতার বিজ্ঞাপন। একবার নরসুন্দরদের অর্থ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলাম যে ব্যক্তি নর বা পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বা সুদর্শন, তাকেই বলা হয় নরসুন্দর। আর যে ব্যক্তি নর বা পুরুষদের মধ্যে উত্তম তাকে বলে নরোত্তম।

প্রথম কয়েক মাস সে এই নাম শুনে খুবই খুশি। হঠাৎ এক সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় রাগান্বিত হয়ে এসে সে সবাইকে শাসিয়ে দিল কেউ যেন আর তাকে নরসুন্দর নামে না ডাকে। সেই থেকে ওই নামের মৃত্যু হলো।

যাহোক, আমি গেলাম মিনিয়াপোলিশ শহরের সেই নরসুন্দর বিদ্যালয়ে চুল কাটাতে। বিশাল ভবনজুড়ে তাদের আয়োজন। মূলত শিক্ষানবিশ নরসুন্দরেরা এখানে কাজ করে। দুই বছর পর্যন্ত এখানে কাজ শিখে যার যার মতো লাইসেন্স নিয়ে নিজ নিজ চুল কাটার ব্যবসায় নিয়োজিত হয়। ভেতরে বাফে বা যা ইচ্ছা তাই খাও ধরনের কাজ কারবার। অর্থাৎ যে যেভাবেই চুল কাটুক না কেন, রেট বা মূল্য এক।

দোকানে অসংখ্য নরসুন্দর কাজ করছে বা শিখছে। ফ্রন্ট ডেস্কে বসে আছেন টাকাপয়সা আর কাস্টমার দেখভাল করা খালাম্মা টাইপের দুই মহিলা। ওই দুই মহিলাই বিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা। তারাই বেচাকেনার হিসাব রাখেন। নরসুন্দরদের কারও হাতে, গলায়, কপালে, ঘাড়ে রংবেরঙের ট্যাটু। কেউ হাতে যিশু বা এঞ্জেল কবুতর নিয়ে বসে আছে। কারও ঘাড়ে সূর্য উঠছে। একজনের হাফপ্যান্ট পরা। তার পায়ে আবার কঙ্কাল বা শয়তানের চিহ্ন। সেই কঙ্কালের ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ, মুখে অট্টহাসি। মোটকথা ওই চুল কাটার আস্তানায় গেলে মানবদেহের চামড়ায় আঁকা যেকোনো ধরনের শিল্পকলার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার সিরিয়াল আসার পর একজন এসে নিয়ে গেল তার চেয়ার বা চেম্বারে। ছবি দেখিয়ে বললাম কোন স্টাইল বা কাট পছন্দ করি। চুল কাটার সময় কথাচ্ছলে জানলাম যে সে প্রতিদিন মেনকাটো নামের এক শহর থেকে কাজে আসে। এক পথের দূরত্ব প্রায় ৮০ মাইল। অর্থাৎ প্রতিদিন দেড় শ মাইলের ওপর ড্রাইভ করতে হয় কাজে যাতায়াতের জন্য। ওখানে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম স্ত্রী আইনজীবী। এ কথা শুনে আমার মাথায় নতুন বাংলা সিনেমার নাম মনে পড়ল নাপিতের বউ কেন উকিল? স্বামী-স্ত্রীর এ ধরনের পেশাভিত্তিক সংমিশ্রণ বাস্তব জীবনে শুধু আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বে সম্ভব। আমাদের দেশেও মাঝে মাঝে ঘটে। তবে সেগুলো ‘রঙিন রূপবান’ বা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ টাইপের ছবিতে।

নরসুন্দর অনর্গল কথা বলে যায়। আমি উত্তর দিই কি দিই না। তার কথায় আমার হালকা ঘুম পায়। মৃদুস্বরে সিলিং থেকে জেমস ব্রাউনের ‘ইটস এ ম্যান ওয়ার্ল্ড’ গান ভেসে আসে। গানের কথার সঙ্গে সেলুনের পরিবেশের বেশ মিল আছে। সব কর্মী পুরুষ। শিল্পী নিজেও পুরুষ আবার সে নিজেই বলছে আমরা একটা পুরুষের পৃথিবীতে বাস করি। কিন্তু নারী ছাড়া কিছুই হতো না, কিছুই হয় না। এই পৃথিবী আসলেই এক অদ্ভুত জায়গা।
‘বসত আমার নরের দুনিয়ায়
নারী ছাড়া কিছুই না যায়
নর বানাইল বাহন আর বাত্তি
মুক্তি পাইতে অন্ধকার রাত্তি।
নর বানাইল বাড়িগাড়ি
হইত না কিছুই যদি না থাকিত নারী...’।

লোকটির নাম ডেভ ডেলস্টেন। তার দুই হাতজুড়ে নীল রঙে আঁকা বিভিন্ন ডিজাইনের ট্যাটু। এক হাতে একটা নীল রঙের পাখি। জানতে চাইলাম পাখির নিচে এত কিছু কী লেখা। সে জানাল, ওটা ব্লুবার্ড নামের একটা কবিতা। কিন্তু কবিতাটি একটু অন্য রকম। আমার নাকি ভালো না-ও লাগতে পারে।
-অন্য রকম মানে? জানতে চাই।
-ব্লুবার্ড কবিতাটি চার্লস বুকোভস্কির লেখা। এতে বেশ কিছু শব্দ আছে যা মনে হতে পারে অশালীন। তাই বললাম, তোমার ভালো না–ও লাগতে পারে। বলল, সুযোগ পেলে পড়ে নিয়ো।
মনে উৎসাহ থেকে গেল যে কী এমন কবিতা যে একটা মানুষ তার নিজের চামড়ার ভেতর স্থায়ীভাবে লিখে রেখেছে।

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

বাসায় এসে অনুসন্ধান করে ব্লুবার্ড কবিতাটি পড়লাম। আসলেই অন্য রকম কবিতা। কবি চার্লস বুকোভস্কি তাঁর মনের গভীর আবেগকে একটা ব্লুবার্ড বা নীল পাখির সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্বীকার করেছেন যে হৃদয় বা আবেগ থেকে তাঁর ইচ্ছাশক্তি কখনোই চতুর বা শক্তিশালী হতে পারে না। কিন্তু সেই সত্যটিকে তিনি সব সময় গোপন রাখেন। কাউকে কখনোই তা বুঝতে দেন না।

আবেগ আর মনের ইচ্ছা—এ দুটিকে তিনি ভিন্ন সত্তা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলতে চেয়েছেন কে আসলে বেশি শক্তিশালী। মানুষের ইচ্ছা না আবেগ? আবেগের কারাগারে মনুষ্য জীবন বন্দী। যেমনটি নীল পাখি সোনার খাঁচায়। মানুষ আবেগের কাছে কখনো হেরে যেতে চায় না। ইচ্ছাশক্তি এসে শাসিয়ে দিয়ে বলে যে কখনো সে যেন পালিয়ে না যায় বা পালতে চেষ্টা না করে। তার স্থান বন্দিশালায়।
কবিতাটি অনুবাদ করলে হয়তো এমনটিই হতো:
আমার হৃদয় গভীরে আছে নীল এক পাখি
চলে যেতে চায় তবুও শিকল দিয়ে রাখি
আমি বলি থাকো একা
কেউ যেন কখনো না পায় দেখা
বের হতে চাও তুমি থাকো বড় আশায়
তোমায় ঢেকে রাখি সিগারেট
আর হুইস্কির নেশায়
আমার হৃদয়ে বাস করে এক নীল ময়ূরী
কখনো জানে না তা রাস্তার বেশ্যা, দোকানি আর নৈশপ্রহরী।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মাঝেমধ্যেই সেই নীল পাখি খাঁচা থেকে বের হতে চায়। তখন তিনি নীল পাখিকে সিগারেটের ধোঁয়া আর হুইস্কি দিয়ে স্নান করিয়ে আবার খাঁচায় ভরে রাখেন।
কখনো–সখনো সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন নীল পাখিকে খাঁচা থেকে বের করেন। দুজনের মধ্যে যৎসামান্য গানও হয়। তিনি পাখির দুঃখ বুঝতে পারেন। সান্ত্বনার স্বরে বলেন, পাখি যেন নিজেকে একাকী না ভাবে। কারণ, তিনি সার্বক্ষণিক আছেন তার সঙ্গে। তবে সে যেন খুব চালাকি করে খাঁচা থেকে পালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস না দেখায়। তিনি পাখিটিকে পুরোপুরি মরতে দেননি আবার পরিপূর্ণভাবে বাঁচিয়েও রাখেননি। তাদের নিজেদের মধ্যে একসঙ্গে ঘুমানোর একটা গোপন সন্ধি রয়েছে। কবি বলেছেন যে আবেগ মানুষকে কাঁদাতে পারে সেটাই যথেষ্ট। তবে তিনি নিজে কখনো কাঁদেন না। নীল পাখির কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন সে কখনো কাঁদে কি না।

চুল কাটা শেষ হলে আমি রাস্তায় নেমে আসি। গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করি। গ্রীষ্মের নীল আকাশে পুঞ্জীভূত সাদা মেঘের আনাগোনা। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের নিচ দিয়ে অনেকগুলো নীল পাখি উড়ে চলে যায় দিগন্তে। কী আশ্চর্য! সবগুলো পাখিই নীল। আমি দেখি সমস্ত আকাশ ভরা আবেগ মেঘ হয়ে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই নীল আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এখনই বৃষ্টি নামবে।
আমি আকাশের আবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত গাড়ি চালাই।

*জামাল সৈয়দ, মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র