নীল জলের বন্দী গুয়াম

তথাকথিত আধিপত্যবাদী মানবসভ্যতার অত্যাচারে পৃথিবী, প্রকৃতি অনেক বেশি ক্লান্ত; তাই পৃথিবীর এই আক্রোশ। অদৃশ্য জীবাণু কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্ব, কেড়ে নিয়েছে জীবন। এখনো জানা নেই ঠিক কবে শেষ হবে এই অসুস্থ মৃত্যু–উৎসব।

জাহাজ থেকে গুয়াম শহর ও সমুদ্রসৈকত
ছবি: লেখক

অস্থিতিশীল পৃথিবীতে তবু থেমে নেই মানুষে মানুষে সংঘাত, থেমে নেই আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে আধুনিক মারণাস্ত্রের মহড়া। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলগুলোর কিছু খবর চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে, ‘উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগরে বাড়ছে মার্কিন সামরিক রণতরির আধিপত্য’, ‘গুয়াম দ্বীপে হামলার হুমকি দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া’ কিংবা ‘ট্রাম্প ও কিম, চীনের মাথা ঝিম।’

আধিপত্যবাদে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকা মার্কিনদের দখলে প্রশান্ত মহাসাগরের সামরিক নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু খ্যাত মিসাইল হামলার হুমকিতে থাকা সেই গুয়াম দ্বীপটি সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

স্থানীয় এজেন্টের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

জাহাজে চাকরির কারণে ২০১৬ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে গুয়াম নামের দ্বীপটির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয় আমার। অল্প পরিসরে হলেও চাকরিজীবনে পাওয়া এই দুর্লভ সুযোগকে খুব ভালো করেই কাজে লাগাই আমি। ইউক্রেনিয়ান চিফ অফিসারের সঙ্গে মিলে পরে ঘুরতে আসার পরিকল্পনাও করে ফেলি মনে মনে।

জাপান থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে, আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিখ্যাত ২০৯ বর্গমাইলের এই ছোট্ট দ্বীপে ঘুরে যেতে হবে আমাদের জাহাজকে। খবরটা পাওয়ামাত্র একটা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে ফেলি ইউএস কোস্টগার্ড ইন্সপেকশন প্রস্তুতি, গুয়াম সম্পর্কে জানা, ক্যামেরা চার্জ ইত্যাদি।

জাপান থেকে আড়াই হাজার (২ হাজার ৬০৫) কিলোমিটার দক্ষিণে, অস্ট্রেলিয়া থেকে সাড়ে চার হাজার (৪ হাজার ৪৪৭) কিলোমিটার উত্তরে, ফিলিপাইন থেকে আড়াই হাজার (২ হাজার ৪৯৬) কিলোমিটার পর্বে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ১১ হাজার (১১ হাজার ৪৯৬) কিলোমিটারের মতো পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে মারিয়ানা দ্বীপগুলোর মধ্যে গুয়াম অন্যতম। এখানকার আদি অধিবাসী হলো চামোরো নামক জনগোষ্ঠী। তারা প্রায় ৪ হাজার বছর আগে এখানে বসতি স্থাপন করে বলে জানা যায়। গুয়াম ভ্রমণ করেন প্রথম ইউরোপীয় পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান।

ইউএস কোস্টগার্ডের সাদা সাবমেরিন
ছবি: লেখক

পরে ১৮৯৮ সালে স্পানিশদের কাছ থেকে মার্কিনরা দ্বীপটি দখল করে নেয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণের পর গুয়ামকে জাপানিরা দখল করে নেয়। আড়াই বছর গুয়াম জাপানিদের দখলে থাকে। জাপান সামরিক অভ্যুত্থান থেকে দ্বীপটি পুনরুদ্ধারের জন্য ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে। সেই থেকে দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের অধীন। গুয়াম একটি নির্বাচিত গভর্নর এবং একটি ১৫ সদস্যের আইনসভা দ্বারা শাসিত, যার সদস্যরা সিনেটর হিসেবে পরিচিত হন। মার্কিন কোস্টগার্ড বেস, মার্কিন নৌবাহিনী বেস, এন্ডারসেন এয়ার ফোর্স বেস, অপেরা হারবার গুয়ামকে করে তুলেছে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন আধিপত্যের কেন্দ্রস্থল।

গুয়ামের জলসীমায় আমাদের জাহাজ প্রবেশ করতেই একটা সাদা রঙের সাবমেরিন আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। পাইলটের অনুমতি নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করে ফেলি ওই মুহূর্তটা। সামরিক নৌবহরে পরিপূর্ণ পোর্ট এলাকা। এর মধ্যে আছে জাপান ও আমেরিকা থেকে ভ্রমণপ্রিয় যাত্রীদের পরিবহনকারী দুটি বিলাসবহুল জাহাজ। ইউএস কোস্টগার্ড ইন্সপেকশনের ধকল গেল জাহাজ পোর্টে ভিড়তেই সবার প্রচেষ্টায় ও ক্যাপ্টেনের সুদক্ষ পরিচালনায়, কোনোরকম খুঁত (Nil deficiency) ছাড়াই পরিদর্শনের সার্টিফিকেট মিলে গেল। রীতিমতো পার্টির আমেজ।

স্থানীয়দের সংস্কৃতি
ছবি: লেখক

ক্যাপ্টেনের নির্দেশনায় গুয়ামের স্থানীয় খাবার কেনার উদ্দেশ্যে এজেন্টের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। প্রায় দেড় লোখ বাসিন্দার (১ লাখ ৬২ হাজার ৭৪২) এই দ্বীপটিতে রয়েছে অনেক কিছুই। ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য দৃষ্টিনন্দন কিছু জায়গা। নীল সমুদ্র, সবুজ পাহাড়, জানা–অজানা বৃক্ষরাজি। ডিউটি ফ্রি ডিজাইনের কেনাকাটা আউটলেট, মাইক্রোনেশিয়া মল, গুয়াম প্রিমিয়ার আউটলেট, আগারা শপিং সেন্টার এবং বিশ্বের অন্যতম কে–মার্ট কেনাকাটার জন্য উত্তম। একটা ফুডকোর্টে কিছু খাবারের অর্ডার করে এগিয়ে যাই গুয়ামের প্রাণকেন্দ্রের দিকে। প্রাণকেন্দ্র রাজধানীর নাম হাগাত্না (আগে আগানা নামে পরিচিত ছিল)।

গুয়ামের অর্থনীতি মূলত পর্যটননির্ভর। শপিংমলের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল একদল স্থানীয় নৃত্যশিল্পী। বিচিত্র সব পোশাক পরে গানের তালে তালে নেচে চলেছে। পোশাকগুলো গাছের পাতা, ডাল দিয়ে তৈরি, অনেকটা পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের মতো। প্রথমে ইতস্তত করে, পরে ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম তাঁদের। গুয়ামের বিশেষ কিছু চকলেট কিনতে ভুল করিনি। কেনাকাটা শেষে ফেরার পালা। ফেরার পথে পড়ে ‘ওয়ার ইন দ্য প্যাসিফিক’ জাতীয় ঐতিহাসিক পার্ক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ার ইন দ্য প্যাসিফিক’ পার্ক
ছবি: লেখক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানে প্রতিষ্ঠিত এই পার্ক। পার্কের পাড়ে সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষিত এলাকা ও নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত। নোনাপানিতে শরীর ভিজিয়ে কেউ শুয়ে বই পড়ছে, কেউ চড়া রোদে শরীর পুড়িয়ে নিচ্ছে; কেউ আবার কায়াকিংয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ নানা ভঙ্গিতে ক্যামেরায় পোজ দিয়ে যাচ্ছে।

গুয়াম–ভ্রমণের স্মৃতি আজও মনের পাতায় অমলিন। গুয়াম দ্বীপে হামলার হুমকি দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া! খবর শুনে খুব খারাপ লাগল। সংঘাতের, যুদ্ধের বিভীষিকার সাক্ষী হয়ে আছে জাপানের হিরোশিমা। অনেক ইতিহাস বুকে ধরে জেগে আছে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপটি। চাই না, গুয়াম নতুন কোনো ইতিহাসের সাক্ষী হোক!