নেট দুনিয়ার ‘ভাইরাল’ ব্যাধি

ফেসবুকের কল্যাণে দুনিয়াব্যাপী ‘ভাইরাল’ শব্দটি ব্যাপক ব্যবহার ও প্রচারে আজ এত বেশি চর্চার স্থান পেয়েছে যে তার উৎপত্তির স্থল মেডিকেল টার্মেও সেভাবে চর্চার সুযোগ নেই। জনকল্যাণ, জনস্বার্থ বা উপকারের দিক থেকে কাজে আসে এমন কৌতূহল নিবারণের মতো ইতিবাচক কোনো বিষয় না হলেও যেনতেন একটি তুচ্ছ কিংবা নেতিবাচক বিষয় নিমেষেই ভাইরাল হয়ে নেট দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষের নজর কাড়ছে এবং দিনের পর দিন এমন একটি গুরুত্বহীন বিষয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চর্চায় স্থান পাচ্ছে। সহজ উদাহরণে হিরো আলমকেই টানা যেতে পারে।
পটেনশিয়ালিটির দিক থেকে তাঁর বা তাঁদের মতো উজবুকদের সমাজে গুরুত্ব কতটুকু, তা আমার মতো নির্বোধের মাথায় আসে না। অথচ দুনিয়ায় অর্থহীন এরাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আজ। আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই এখন হয়ে গেছে সবচেয়ে গুরুত্বহীন ও অপাঙ্‌ক্তেয়।

এত কথার অবতারণা করতে হলো অতি সম্প্রতি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। শ্রীলঙ্কার ইয়োহানি ডি সিলভা নামের এক অষ্টাদশী গায়িকার সিংহলি ভাষায় গাওয়া ‘… মানিকে মাগে হিতে’ শিরোনামের গানটি নেট দুনিয়ায় রাতারাতি ভাইরাল হতেই আট কোটি দর্শকশ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়, যার অগ্রযাত্রা চলছে অব্যাহতভাবে। শেয়ার, কমেন্ট ও বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কোরিওগ্রাফিসহ রিমেক কত হয়েছে এবং হয়েই চলছে, তার ইয়াত্তা নেই। বাংলাদেশের কৌতূহলী সমাজেও এর কী ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, তা–ও লক্ষণীয়।

না আছে এ গানের কোনো সুললিত কণ্ঠ, না আছে দৃষ্টি ও মন জুড়ানোর মতো এর কোনো নান্দিনক উপস্থাপনা, তবুও তার আবেদন অপরিসীম। যুগ ও কালের বিবর্তনের সঙ্গে মানুষের রুচি, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়, তা স্বাভাবিক ও শাশ্বত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে কথা এসে যায়, বিবর্তন-পরিবর্তন হয় উৎকর্ষের। মানুষ সেটাকেই গ্রহণ করে। মানুষ অধোগতির বিবর্তনকে গ্রহণ করে না। কিন্তু বর্তমানের গতি উল্টো পথে। অসুন্দরটাই এখন সুন্দর। সুন্দরটাই অসুন্দর।

মানুষের হালফ্যাশন—ছেঁড়া প্যান্ট, উদাম শরীর, উশকোখুশকো অপরিপাটি অবয়ব, পরিচ্ছদ, এলোচুল, গালভরা দাড়ি। যা ছিল একসময় অমার্জিত, অভব্য, অসুস্থ মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। আজ তা হালফ্যাশন ও বিবর্তিত মননের ইতিবাচক ছবি এবং সেই সঙ্গে ব্যাপকভাবে সমাদৃত, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এক জীবনাচারের নতুন রূপ। এখান থেকে সুস্থ–সুন্দর, রুচি, মনন-মানবিকতা, নান্দনিকতা, সৌম্য–সভ্য রূপ, বোধ-দর্শন পালিয়ে গেছে। তারই শূন্য জায়গায় অসুন্দর এসে জায়গা করে নিয়েছে। তাই অর্থহীন, অশিষ্ট অপাঙ্‌ক্তেয় বিষয়গুলো আজ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সে কারণেই ইয়োহানিরা রাতারাতি দুনিয়াব্যাপী ভাইরাল হয়।

ভাইরাল হয় না কেবল শিশুকাল থেকে ‘হরিহর আত্মা’–এর মতো আজন্মকালের মুসলিম বন্ধুর বিয়োগব্যথায় কাতর ও তাঁর জানাজায় অংশ নিয়ে বিলাপ করা নোয়াখালীর সুধীর দাশের বিরল ঘটনাটি। হিন্দু–মুসলিমের বন্ধুত্বের এমন বিরল নজির, যা শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা দুনিয়ার মানবগোষ্ঠীর কাছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’ এই দর্শনটিকে আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারত, সেই নৈতিক, মানবিক ও সহমর্মী অনুভূতির জায়গায় আজ মানুষ নেই, আর তাই এভাবে এই মর্মস্পর্শী দৃশ্যটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভাইরাল হয়নি। মানুষ মানুষের জন্য—এই সত্য জীবনবোধের জায়গায় ফিরে আসুক মানুষ।