প্রতিবন্ধকতা নয়, খুঁজতে হবে প্রতিকার-২

তাসনিম জায়সী।

প্রায় দেড়  বছর আগে ‘প্রতিবন্ধকতা নয়, খুঁজতে হবে প্রতিকার’ শিরোনামে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। যেখানে আমার হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মেয়েটির চড়াই-উতরাই জীবনের গল্প কিছুটা তুলে ধরেছিলাম। আজ তারই রেশ ধরে আমি আবার লিখতে বসলাম তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু গল্প নিয়ে। সন্তানের ভালো কোনো কিছু অর্জনের কথা কমবেশি সব বাবা-মায়েরই গল্প করতে ইচ্ছা করে; আর যদি সে হয় আবার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান (প্রতিবন্ধী)।

আমার মেয়েটি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ানে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে পড়ছে। আর তার সবচেয়ে বড় গল্পের কথা হলো, সে ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ানের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের বর্তমান প্রেসিডেন্ট (মে ২০২১ থেকে চলতি)। এই নির্বাচন হয়েছিল গত মার্চে। এ নির্বাচনে জয়লাভ করা তার এ প্রতিকূল জীবনের বড় অর্জনের একটি। সে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ইউনিভার্সিটির আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাকে প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে। বর্তমানে এই ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং গ্র্যাজুয়েট মিলে সর্বমোট ২৬ হাজারের মতো শিক্ষার্থী আছে। তার এ অবস্থান প্রাপ্তির জন্য তাকে দিন দিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শক্ত ভিত গড়ে তুলতে হয়েছে। এর আগে তাকে বিভিন্ন কার্যক্রম এবং প্রতিযোগিতায় সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাকে সাফল্য দেখাতে হয়েছে। তার ভেতরে প্রতিকূলতাকে অনুকূলে আনার জন্য নিজেকে দৃঢ় মানসিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। তাকে এই নির্বাচনের ক্রান্তিলগ্নে নিজের কোর্সের পড়ালেখার পাশাপাশি নির্বাচনের কতশত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিজেকে অসম্ভব রকমের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। তা ছাড়া স্থানীয় টিভিতে, নিউজ পেপারে, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক ও বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সময় দিতে হয়েছে। এদিকে মহামারি কোভিডের মানসিক চাপ তো আছেই।

নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হলো। ইতিমধ্যে মেয়েটি তার বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলল। আমি এবং ওর বাবা এখানে বাংলাদেশি ছাত্রদের ভোট চেয়ে বাংলাদেশি গ্রুপে (SK-bd) ই-মেইল দিলাম। তা ছাড়া টেলিফোনে আমাদের পরিচিত বা অপরিচিত সব বাংলাদেশির সঙ্গে ভোটের ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে কথা বলি। এমনকি আমার বিদেশি সহকর্মীদের অনুরোধ করি তাদের ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ানে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়ে, বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের ভোটগুলো আমার মেয়েটিকে দেওয়ার জন্য।

ভোট যখন অতি সন্নিকটে, তখন সে একদিন বলল, ‘মা, এ নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে আমাকে ৩টি কঠিন বাধাকে পেরিয়ে আসতে হবে। যেমন:
১. আমি Female
২. আমি Immigrant Canadian
৩. আমি Disabled
আমার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীর জয়লাভ করার সহজ উপায়। যেমন:
১. সে Male
২. সে White Canadian/ সাস্কাচেওয়ানের বাসিন্দা
৩. সে Able Person
অনেক মিটিং, ই-মেইল, পোস্টার তৈরি, অ্যাজেন্ডা লেখা, সেই সঙ্গে নিজের পড়ালেখা, পরীক্ষা ইত্যাদি নিয়ে এক ভীষণ রকমের ব্যস্ততার মধ্যে তাকে সময় কাটাতে হয়েছে। দিনের শেষে মেয়েটিকে দেখতে অনেক পেরেশান লাগত। সে কখনো কখনো আমার গা ঘেঁষে বসে মলিন মুখে বলত, ‘মা, আমি আর পারছি না। আমি কি ভুল করলাম প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে? মা, আমি কি আসলেই জিততে পারব?’ ওর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বরাবরের মতোই আমার উৎসাহদায়ক উত্তর থাকত, ‘ইনশা আল্লাহ, আমি জানি, তুমি পারবে। তোমার মতো এত বড় গুণমান আর কোনো প্রতিযোগী আমি তো দেখি না। বড় কিছু প্রাপ্তিতে বড় সংগ্রাম করা লাগে। নিজেকে শক্ত রাখো।’

আরও পড়ুন

অবশেষে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের দিনটি এল। মেয়েটি আমার সব কঠিনকে অতিক্রম করে অনেক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করল। এ ভোটের মাধ্যমে সে ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ানে একটা রেকর্ড তৈরি করল। এযাবৎকালের মধ্যে সে-ই একমাত্র ইমিগ্র্যান্ট নারী হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ানের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো। আর সে-ই একমাত্র হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রেসিডেন্ট। তার পদটি আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মতোই, তবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমুক্ত। তা ছাড়া এই প্রেসিডেন্ট পদকে ইউনিভার্সিটির একজন চাকরিজীবীর মতোই বার্ষিক বেতন-ভাতা হিসেবে সম্মানিত করা হয়ে থাকে।

এখন আমার মেয়েটি তার নিয়মিত লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির সব ছাত্র, শিক্ষক এবং প্রশাসনের সঙ্গে নানা ধরনের ইভেন্ট, প্রোগ্রাম, মিটিং, বক্তৃতা, আলোচনা-পর্যালোচনা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। আমার মেয়ের জীবনের এ সফলতা, যেটা তাকে নিয়ে আমার কল্পনার জগতের বাইরের কোনো কিছু পাওয়া বলে মনে করি। তবে তাকে নিয়ে এটা আমার মনের গহিনের ইচ্ছার জগতের ভেতরের কিছু পাওয়া। আমি মনে করি, যেটা সম্ভব হয়েছে আমার মেয়েটির একান্ত প্রচেষ্টার পাশাপাশি তার অসীম মানসিক শক্তি। যেটা তার প্রতিকূল চলার পথে ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনার অভিজ্ঞতালব্ধ সংগ্রামী শক্তি।

আমার মেয়েটি চায় না যে আমি তার কৃতিত্বগুলো সামাজিক মাধ্যমে লিখি। সে মনে করে, এগুলো পড়ে কেউ হয়তো মনে কষ্ট পেতে পারে। তার ধারণা, এ লেখা পড়ে যদি কোনো প্রতিবন্ধী সন্তানের মা-বাবা এ ভেবে কষ্ট পান যে তাঁদের সন্তান তো তেমন কিছুই করতে পারেনি। আবার অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো প্রতিবন্ধী সন্তান মনে কষ্ট পায় এ ভেবে যে তার মা-বাবা তো বেশি কিছুই করেনি তার জন্য। আমার মেয়ের অর্জিত প্রাপ্তি দেখে আমাদের কষ্টের জীবনে কিছুটা স্বস্তি আসে। আর ভাবি, দুনিয়ার সব প্রতিবন্ধী সন্তানের যদি আমার মেয়ের মতো বা তার চেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ থাকত বা করতে পারত, হয়তো তাদের মনের কষ্টটা কিছুটা হলেও দূর হতো।

তার এই চিন্তা আমাকেও ভাবিয়ে তোলে। একবার মনে করি লিখব মেয়েটিকে নিয়ে, আবার ভাবি লিখব না। পরে চিন্তা করে দেখলাম, একজন মা-বাবা হিসেবে সবাই আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানদের সামনে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকি। ভাবলাম, এর তো একটি ভালো দিকও আছে; যেমন কেউ না কেউ লেখাটি পড়ে তাঁদের সন্তানকে সাহস জোগাবেন সামনে এগিয়ে যেতে। হয়তোবা কেউ না কেউ লেখাটি পড়ে সমাজে যারা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ আছে, তাদের জন্য ভালো কিছু করার ব্যাপারে সচেতন হবেন।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানেরা চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হয়, যেটা চলে আসছে আজীবন ধরে। এ বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে আমাদের সমাজে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য পূর্ণ অধিকার না দেওয়ার বিশাল অনিয়ম গড়ে উঠেছে। আর এ বৈষম্যে ভরা সামাজিক কাঠামোতে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পায় সেগুলো শ্রেণিবিন্যাস করলে দাঁড়াবে এমন—
প্রথম: পুরুষ
দ্বিতীয়: নারী
তৃতীয়: প্রতিবন্ধী পুরুষ
চতুর্থ: প্রতিবন্ধী নারী
এটা সত্য যে মা-বাবাসহ আমাদের সমাজের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের সুস্থ এবং সুন্দর জীবনের পথ নির্দেশনার সব চেয়ে বড় ধারক ও বাহক হতে। আমরা যার যার অবস্থানে থেকে আমাদের সমাজে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের জন্য ছোট-বড় যতটুকু সম্ভব, অবদান রাখতে পারি। আমরাই পারি তাদের উপযুক্ত সম্মান করতে, জীবনে আশা জাগাতে এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করার মাধ্যমে তাদের সমাজে আর ১০ জন সাধারণ মানুষের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের সমাজের এ বিভাজনকে আমাদেরই ভাঙতে হবে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের চলার পথে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সন্তানদের জীবনে মীনা কার্টুনের এই গানকে উপজীব্য করে তাদের সুস্থভাবে গড়ে তোলার প্রয়াস করি।
আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে
আমি বড় হই,
সকলের ভালোবাসা নিয়ে
আমার দুচোখে অনেক স্বপ্ন থাকে
আমি পড়ালেখা শিখতে চাই।
যদি চার দেয়ালের মাঝে
কাটে সারা জীবন
তাহলে থাকব, শুধু বোঝা হয়ে
শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে, মুক্তি দেবে... ।