প্রবাসীর বোবা কান্না-৩

মা–বাবার সঙ্গে মিশু ও মিকি
ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়া আসার এক সপ্তাহের মাথায় প্রথম আলোয় একটা লেখা লিখেছিলাম ‘প্রিয়জনের ওম’ শিরোনামে। সেখানে বলতে চেয়েছিলাম, দূর পরবাসের জীবনে স্বচ্ছলতা থাকলেও প্রিয়জনদের স্নেহের পরশ নেই। প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে দেখা ও কথা হলেও একটু আলতো স্পর্শ আমরা বুভুক্ষের মতো খুঁজে ফিরি। ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে আমাদের। এর মধ্যেই অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি, যাঁরা আর কখনোই আমাদের জীবনে ফিরে আসবেন না। কিন্তু সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকার কারণে স্বভাবতই তাঁদের অন্তিম মুহূর্তে পাশে উপস্থিত থাকতে পারিনি।

হারানো মানুষের তালিকায় একেবারে পরিবারের নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষক পর্যন্ত আছেন। আমার জীবনে মা–বাবার পরই আমার বন্ধুবান্ধব আর শিক্ষকদের স্থান। তাঁরাই আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছেন। তাই তাঁদের হারানো আমার জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কলেজের পোদ্দার স্যার, শিরীন ম্যাডাম মারা গেলে প্রথম আলোয় আবার ‘প্রবাসীর বোবা কান্না’ ও ‘মায়ার বাঁধন’ শিরোনামে আরও দুটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে বলতে চেয়েছিলাম, প্রবাসীরা আত্মীয়স্বজন হারিয়ে শত কষ্ট পেলেও তাঁদের কান্নাটা কেউই দেখতে পান না। মনের গভীরেই চলে সেই বোবা কান্না।

এরপর আমাদের তখনকার বাড়িওয়ালা নাজমুল ভাই অসুস্থ হলে আরও একটা লেখা লিখেছিলাম ‘প্রবাসীর বোবা কান্না-দুই’। অবশ্য ওনাকে বাড়িওয়ালা না বলে প্রতিবেশী বলাই শ্রেয়। কারণ, উনি কখনো অন্যদের কাছে আমাদের ভাড়াটিয়া বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন না। বলতেন, আমরা ওনার প্রতিবেশী। সেই প্রথম হাতে–কলমে জানলাম, মানুষকে আসলে কীভাবে সম্মান দিতে হয়। সৃষ্টিকর্তার রহমতে নাজমুল ভাই এখন ভালো আছেন। দেশে আত্মীয়–পরিজন ফেলে আসা আমাদের জীবনে স্থানীয় অভিভাবকের জায়গা নিয়ে আছেন। উনি অবশ্য আমাদের মতোই আরও অনেকের স্থানীয় অভিভাবক। আসলে প্রবাসে বিপদে–আপদে সবাই সবার পাশে এসে দাঁড়ান।

তবে করোনাকালে এসে প্রিয়জন হারানোর তালিকাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। এ তালিকায় সরাসরি পরিচিত মানুষ যেমন আছেন, তেমনি এমন মানুষ আছেন যাঁদের সন্তানসন্ততি প্রবাসে আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাই খুব কাছ থেকে তাঁদের বোবা কান্নাগুলো দেখেছি। সেই অশ্রুর দাগ অবশ্য শুকিয়ে যায়নি এবং আমার বিশ্বাস, যত দিন ওনারা বেঁচে থাকবেন, তত দিন একটা আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকবেন যে প্রিয়জনের অন্তিম মুহূর্তে তাঁদের পাশে উপস্থিত থাকতে পারেননি। আবার অনেকে উপস্থিত থাকতে পারলেও এমন মনে হবে যে যদি দেশে থাকতাম, তাহলে হয়তোবা সেবা–শুশ্রূষা করে প্রিয়জনদের ভালো করে ফেলতে পারতাম।

মায়ের সঙ্গে ফাহিমা
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন নাজমুল ভাইয়ের ছোট ছেলে সজীবের শ্বাশুড়ি। নাজমুল ভাই ও ওনার ছেলে—দুজনকেই ভাই বলে সম্বোধন করি। তাই নাজমুল ভাইয়েরা যেমন আত্মার আত্মীয়, তেমনি ওনার ছেলেরাও প্রবাসে একান্ত আপনজন। সজীবের স্ত্রী ফাহিমা সিলেটের মেয়ে। সর্বদা হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসেন এবং আশপাশের সবাইকে খুশি দেখতে পছন্দ করেন। তখনো ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। ওনারা থাকতেন দোতলায় আর আমরা নিচতলায়। হঠাৎ একদিন শুনি, কেউ একজন ফোনে কথা বলছেন এবং একটু পরপর ‘অয় অয়’ করছেন। সিলেটের ভাষা সম্বন্ধে ধারণা থাকায় তখন আমি আমার গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, নাজমুল ভাইদের বাসায় কি সিলেটের কেউ এসেছেন? উত্তরে গিন্নি বলল, ওনাদের ছোট ছেলের বউ ফাহিমাদের দেশের বাড়ি সিলেটে। এরপর দিনে দিনে ওনাদের সঙ্গে একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে।

প্রবাসে সবাই দেশের স্মৃতিময় গল্পগুলো করে। আমরাও নিজেরা নিজেদের গল্পগুলো বলতাম আর চেষ্টা করতাম দেশে ফেলে আসা দুরন্ত শৈশব–কৈশোরের আনন্দের ছিটেফোঁটা হলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে ফিরিয়ে আনতে। সেই চেষ্টা থেকেই আমরা বাসার সামনের খোলা জায়গায় ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে চড়ুইভাতি করেছি, বৃষ্টি এলে দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভিজেছি, পাইন গাছের খোলা জোগাড় করে দেশের সুপারি গাছের খোলার মতো করে বাচ্চাদের বসিয়ে সারা বাসা টেনে নিয়ে বেড়িয়েছি। এসব পাগলামিই ফাহিমা দেশে তার মায়ের সঙ্গে কথা হলে বলতেন। তাই ওনার মা ওনাদের পাশাপাশি আমাদেরও চিনতেন। ওনার মায়ের সঙ্গে কখনো কথা হয়নি, কিন্তু ফাহিমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পুরোপুরি চিনে ফেলেছিলাম। ফাহিমা অনেকবার বলেছেন, ভাইয়া, দেশে গেলে আমাদের বাসায় কিন্তু যেতে হবে। আমি বলতাম, অবশ্যই অন্তত আপনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। আমি কেন জানি পৃথিবীর সব মায়ের মধ্যেই নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পাই। আসলে মায়েদের অকৃত্রিম আদর অতুলনীয়। সেই হাসিখুশি মানুষটা করোনায় আক্রান্ত হলেন।

আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, উনি সুস্থ–সমর্থ মানুষ, করোনা ওনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা সবাই ওনার আশু রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতে থাকলাম। এরপর কয়েক দিনের গ্যাপে হঠাৎ একদিন গিন্নি বাসায় এসে বলল, ফাহিমার মা আমাদের ছেড়ে অনন্ত অসীমে পাড়ি দিয়েছেন। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এরপর ভয়ে আর ওনাদের বাসামুখী হইনি দীর্ঘদিন। কারণ, আমি মানুষকে সান্ত্বনা দিতে পারি না। উল্টো নিজেই আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। ফাহিমা অনেক শক্ত মনের মেয়ে, কিন্তু কোনো মানুষ যতই শক্ত মনের হোক না কেন, মা–বাবা হারানোর ক্ষতটা কেউই আর সারা জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারে না। বেশ অনেক দিন পর ফাহিমার সঙ্গে দেখা হলো একদিন। আমি পারতপক্ষে কথা বলছিলাম না। কারণ, বেশি কথা বললেই যদি ওনার মায়ের প্রসঙ্গ চলে আসে। সেই কদিনে ফাহিমার বয়স মনে হলো প্রায় ১০ বছর বেড়ে গেছে। চোখের নিচে কালি, মুখের মধ্যে একটা গভীর দুঃখভারাক্রান্ত ভাব। আমি জানি, ফাহিমা ঠিকই তাঁর মায়ের জন্য বোবা কান্না করেন।

বাবার সঙ্গে রুপা সাহা
ছবি: সংগৃহীত

এরপর মারা গেলেন রুপা বৌদির বাবা। বিজয়দা, রুপা বৌদি, ওনাদের সন্তান এলভিরা ও রেনোর আমাদের পারিবারিক আত্মীয়। সেভাবেই ওনাদের পরিবারের মানুষজনও আমাদের একান্ত আপনজন। রুপা বৌদির মা অসুস্থ থাকাতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু করোনার কারণে আর ফিরতে পারছিলেন না। ইতিমধ্যে রুপা বৌদির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু করোনার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়। অবশেষে হাসপাতালে ভর্তি হন কাকাবাবু। একটু ভালো বোধ করার পর উনি জোর করেই হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসেন এবং সেই দিন রাতেই পরপারে পাড়ি জমান। এই খবর আমি পাই রুপা বৌদির কাছ থেকে। কারণ, কাকাবাবু অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আমি ফলোআপ করতাম। রুপা বৌদিও ভীষণ হাসিখুশি মানুষ। সবাইকে সব সময় মাতিয়ে রাখেন। আমি বলতাম, আমি হচ্ছি ভাই আর রুপা বৌদি হচ্ছেন আমার যমজ বোন। কারণ, আমরা দুজন একই ব্যাচের।

এরপর কাকাবাবুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য আয়োজন চলতে থাকল। একদিন সকালে বিজয়দা ফোন দিয়ে বললেন, ইয়াকুব ভাই, বাবার শ্রাদ্ধ করার জন্য কলাপাতা লাগবে, রুপা বলল আপনাকে ফোন দিতে। আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। আমি আমাদের এক প্রতিবেশীর বাসায় কলাগাছ দেখে সেই বাসায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। কেউ উত্তর দিল না, তাই নিজে থেকেই একটা কলাপাতা কেটে নিয়ে রুপা বৌদিদের দিয়ে এলাম। রুপা বৌদিকে দেখেও ভীষণ মায়া লাগছিল। বারবার কাকাবাবুর কথা বলছিলেন। কাকাবাবু মারা যাওয়ার পর অনেক অচেনা–অজানা মানুষ ওনাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। রুপা বৌদি বললেন, উনি এমনই ছিলেন, একেবারে চুপচাপ, কারও উপকার করবেন কিন্তু কাকপক্ষীও সেটা টের পাবে না। রাস্তার কুকুরের জন্য নিজ হাতে ভাত রান্না করে খাইয়ে বেড়াতেন কাকাবাবু। তাই ওনাকে দেখলেই সারা পাড়ার কুকুর পিছু নিত। এগুলো বলছিলেন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। আমি শুধু ভাবছিলাম, এই প্রবাসজীবন আসলে আমাদের কী দিয়েছে আর কী কেড়ে নিয়েছে।

আগের এই দুজন মানুষকে আমি সরাসরি চিনতাম না, তবু ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম। কারণ, দেশে আমাদেরও মা–বাবা আছেন। অতিসম্প্রতি মারা গেছেন মিশু শ্যালিকার বাবা। ওনার মা–বাবা দুজনকেই সরাসরি চিনি। সিডনি আসার পর ওনাদের সঙ্গে পরিচয়। পুরোপুরি আধুনিক ও চমৎকার দুজন মানুষ। অতি সহজেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ওনাদের আছে। খালাম্মা আমাকে দেখেই এমনভাবে আলাপ শুরু করতেন যেন আমি ওনার নিজের জামাতা এবং আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। খালুজানকে একবারই সালাম দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। খালুজান ও খালাম্মার পরিচয়ের গল্প শুনেছি মিশু শ্যালিকার কাছে। সেখান থেকেই জেনেছি, দুজনই হরিহর আত্মা। আমি একজন মেয়ের বাবা হিসেবে এখন জানি, বাংলাদেশে চার–চারটি মেয়েকে বড় করে তোলা কত বড় গুরুদায়িত্ব তার অভিভাবকদের জন্য। খালুজান সেই কাজ খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

হঠাৎ একদিন শুনি খালাম্মা ও খালুজান দুজনই করোনায় আক্রান্ত। খালাম্মা সুস্থ হয়ে গেছেন, কিন্তু খালুজানের অবস্থা অপরিবর্তিত। মিশু দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। করোনার সময়ে দেশে যাওয়ার অনেক ঝক্কি, তবু উনি হাল ছাড়েননি এবং শেষ পর্যন্ত ওনারা দুই বোন দেশে যেতে পারলেন। এরপর একদিন হঠাৎ শুনি, ওনার বাবাও অনন্তকালের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন। ওনাকে দেওয়ার মতো সান্ত্বনার কোনো ভাষা আমি আজও খুঁজে পাইনি। ওনাদের জীবনে ভাই ও বাবা—দুজনের আসনেই ছিলেন ওনাদের বাবা। তাই খালুজানের প্রতি ওনাদের ভালোবাসার গভীরতাটা সহজেই অনুমান করা যায়। ওনাদের আমি সরাসরি দেখতে পাচ্ছি না বা কথা হচ্ছে না। কিন্তু আমি জানি, ওনারা ঠিক কতটা মুষড়ে পড়েছেন। হয়তোবা ওনাদের মনে হচ্ছে আরও আগে দেশে গিয়ে সেবা–শুশ্রূষা করলে ওনাদের বাবা হয়তোবা ভালো হয়ে যেতেন। এখন সারা জীবন এ আক্ষেপ মিশু বয়ে বেড়াবেন।

এভাবেই প্রবাসজীবন আমাদের থেকে আত্মীয়–পরিজনের ‘ওম’ কেড়ে নিচ্ছে একে একে। প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বড় হচ্ছে আত্মীয়–পরিজনের ভালোবাসাহীন এক পরিবেশে। এতে ওরা হয়তোবা জীবনে অনেক সফল হবে, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ওদের মানসিক বিকাশ পুরোপুরি হবে না। ওরা কখনোই আত্মীয়–পরিজন হারানোর বেদনা আমাদের মতো করে অনুভব করবে না। আর আমরা যারা প্রথম প্রজন্ম, ‘বোবা কান্না’ করে যাব দেশে হারানো পরিজনের জন্য। একটা কান্নার ঢেলা গলার কাছে আটকে যাবে আমাদের। এর পরিবর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস হয়তোবা বুক থেকে বেরিয়ে যাবে। সেটা শুধু আমরাই অনুভব করতে পারব।

*মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া