বাবার শূন্যদৃষ্টি আর মায়ের কান্না

সাস্কাতুন শহর
সাস্কাতুন শহর

শ্যামলীর বাড়ির জানালার পাশে বেশ কয়েক বছর আগের লাগানো হাসনাহেনা গাছে ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। কেমন পাগল পাগল হাওয়ায় গন্ধরা সব মাতাল হয়ে আছে। কিন্তু আমার মন ভালো নেই। সেদিন আমি খুব রেগে ছিলাম এজাজের ওপর। দুজনের তুমুল ঝগড়া। আমার ভীষণ কষ্ট লাগছিল। সংসারটাকে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে ভাবছিলাম কী কী করলে ওকে ভালো মতো শায়েস্তা করা যায়।
হঠাৎ টের পেলাম অন্ধকারে এজাজ এসে জড়িয়ে ধরেছে। বলল, আর কত রাগ করে থাকবে? কণ্ঠ নরম, ঝগড়ার সময়কার মতো কণ্ঠ নয়। মুখে হাসি।
আমি ওকে পাত্তা দিলাম না। আমার বুকের গভীরে কষ্ট। অভিমান গলায় আটকে যাওয়া কাটার মতো ছটফট করছিল। আমি ঝটকা মেরে ওর হাত সরিয়ে দিলাম। মনে মনে বললাম, তুমি একটা বেহায়া। এত সহজে আমি আজ রাগ কমাব না।
আর রাগ কর না প্লিজ। রাগ করেই তো জীবনটা পার করে দিলে। আমি সরি। নাও কানাডার ভিসা পাওয়া গেছে। এবার একটু হাসো। বলল এজাজ। তারপর আমার চোখের সামনে পাসপোর্টের ভিসা লাগানো পাতাটা মেলে ধরল। আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না কি করব। আমার রাগটা আগের মতো দীর্ঘস্থায়ী করব নাকি পাসপোর্টটা ছুঁয়ে দিয়ে হাসি দিয়ে ফেলব। ভেতরটা আনন্দে উচ্ছ্বসিত, কত আকাঙ্ক্ষিত এই ভিসা আমার জন্য।

রাতের সাস্কাতুন
রাতের সাস্কাতুন


ইংলিশ ছবি দেখে দেখে আমার ওসব তুষার ঝরা রাস্তায় খুব হাঁটতে ইচ্ছে করত। একবার অফিস থেকে এজাজকে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হলো কানাডায়। ফিরে আসার পর সে গল্প আর শেষ হয় না। তারপরই কানাডাতে স্কিল ভিসাতে আমরা অ্যাপ্লাই করলাম। আজ আমার সামনে সেই কাঙ্ক্ষিত ভিসা।
আমি নিজের অজান্তেই উঠে বসলাম। আমার চোখে আনন্দের ঝিলিক। আমি ভিসা লাগানো পাতাগুলো দেখতে লাগলাম আগ্রহ নিয়ে। চিঠিটা অনেকবার পড়লাম। ও মাই গড! আমরা ইমিগ্রান্ট হয়ে কানাডায় ঢুকছি। আমার কণ্ঠে উত্তেজনা। এজাজের দিকে তাকালাম। চার মাস সময়। এর মধ্যেই কানাডায় ঢুকতে হবে।
কিছুক্ষণ আগের প্রচণ্ড রকম ঝগড়াটা ভুলে গেছি। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছি। আমি অনবরত কথা বলতে থাকলাম। টিকিট কাটতে হবে, ফার্নিচার, গাড়ি সবই তো বিক্রি করতে হবে, বাড়ি ভাড়া দিতে হবে ইত্যাদি। এজাজ আমার সব কথাতেই মাথা নাড়ছে আর হাসছে। ওই মুহূর্তে আমার গোঁফওয়ালা বরটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ মনে হলো।

আচ্ছা, আচ্ছা বুঝলাম। চিন্তা কর না সব করে ফেলব। তুমি কালকেই চাকরিতে রিজাইন দাও, বলল এজাজ।
আমি দৌড়ে গেলাম ফোনটার কাছে। আমার বাবার বাড়িতে এক্ষুনি জানাতে হবে। আব্বা ফোন ধরলেন। সব শুনে বললেন, ভালো কথা। তার কণ্ঠ নিরুত্তাপ। আব্বার কাছ থেকে তেমন সাড়া পেলাম না। উত্তেজনায় তখন মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে জানাতে হবে, বন্ধুদের জানাতে হবে। অবশ্য আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। এজাজের মোবাইলের বদৌলতে সবাই ততক্ষণে জেনে গেছে আমরা কানাডা চলে যাচ্ছি।
এবার সমস্যা হয়ে দাঁড়াল টাকা। এজেন্সিকে দিতে হবে তিন লাখ, প্লেন ভাড়া আড়াই লাখ। এ ছাড়া সঙ্গে করে নিতে হবে টাকা। অর্থাৎ সব মিলে প্রায় লাখ বিশেক টাকা। এজাজ তার বিভিন্ন আত্মীয়র কাছে ধার চেয়ে এক পয়সাও পেল না। ওর করুণ মুখ দেখে আমার সারা জীবনের সঞ্চয় ১৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙালাম।
গাড়ি, ফার্নিচার, ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া, শপিং সব প্রায় শেষ। তখন হঠাৎ করে একদিন আবার বিশাল অনিশ্চয়তার ঘোলা জলে আটকে গেলাম। এজাজ যেদিন টিকিট কিনে বাড়ি ফিরল তখন বাড়ির দারোয়ান কাশেম এজাজকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। চিঠিটা ইউনিসেফের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। ওরা এজাজকে ৭৫ হাজার টাকা দেবে। অন্যান্য সুবিধাদিসহ বেতন প্রায় ৮৫ হাজার টাকা। সেদিন সারা রাত আমার ঘুম হলো না। পাকা হিসাবরক্ষকের মতো হিসাব কষতে লাগলাম। নিজের ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকি। ড্রাইভারের বেতন, দারোয়ান, কাজের লোক সবকিছু মিলে মাসে ২৫ হাজার টাকা আমার মাসিক খরচ। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। সুতি শাড়ি, মাটির গয়না, গুঁড়ো মাছ, বইমেলা, চাদনী চকে শপিং—এই আমার জীবন। এর চেয়ে বেশি টাকা কেমন করে খরচ করতে হয় তাই আমি জানি না। এজাজের বেতন থেকেই আমি ৫০ হাজার টাকা জমাতে পারব। আমার চাকরির বেতন তো বাদই দিলাম। বিছানা থেকে উঠে পায়চারি করতে লাগলাম। এত টাকা কোন কোন খাতে খরচ করা যায় বুঝতে পারছিলাম না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কানাডায় যাব না। সকালের দিকে এজাজ অবাক হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসল। কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, কি হয়েছে তোমার?
আমি ওর বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার দুই চোখে পানি। এজাজকে বললাম আমি কানাডায় যেতে চাই না। এত ভালো চাকরি। আমিও তো চাকরি করি। কী দরকার কানাডায় গিয়ে। আমি আমার ফ্যামিলি ছাড়া থাকতে পারব না
কি বলছ তুমি? ওর কণ্ঠে বিরক্তি। আমি তখনো কাঁদছি।
এজাজ চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, টিকিট কাটা হয়ে গেছে, গাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে, ভাড়াটে উঠবে ২৭ তারিখে। ইমোশন দিয়ে সংসার চলে না। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে বাথরুমে ঢুকল।
আমার মেয়েরও তখন ঘুম ভেঙে গেছে। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আধো গলায় বলল, আম্মু তোমার কি হয়েছে?
আমি বললাম, তুমি কানাডায় যেতে চাও নানা ভাইয়াকে ছেড়ে?
সে মাথা নাড়ল। মেয়েও কিছু না বুঝেই কাঁদতে থাকল।
বাথরুম থেকে এজাজ এসে কঠিন কণ্ঠে জানিয়ে দিল, সে দুই নৌকায় পা রাখতে চায় না। কানাডায় যাবে সিদ্ধান্ত এটাই।
আমরা মা–মেয়ে সেদিন রাতে বাবার বাড়ি চলে গেলাম। আব্বা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। মুখটা ভীষণ মলিন।
আমি কাছে গিয়ে বসতেই বললেন, মাগো তুমি কেন কানাডায় যাবে? এ দেশে কীসের অভাব তোমার? নিজের ফ্ল্যাটে থাকো, তোমারা দুজনেই চাকরি কর। যারা এ দেশে কিছু করতে পারবে না তারা যাবে বিদেশ।
আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে। ভেতরের রুমে আম্মার কোলে রোদেলা। আম্মা অবিরাম কেঁদেই চলেছেন। ছোট্ট মেয়েটি নানুর চোখের পানি তার আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে। আমার হাতে ইউনিসেফের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দলা পাকাচ্ছে। আমি আর বলতে পারলাম না, আমি সত্যি যেতে চাই না আব্বা। কান্নায় আমার কণ্ঠ রুদ্ধ। আকাশে তখন মেঘেরাও থমকে দাঁড়াল, বাতাসে কান্নার শব্দ। আমার বাবা-মার হাহাকারে আকাশ-বাতাস, গাছপালা সবকিছু ভারী হয়ে গেল। তবুও এজাজের মন গলল না।
সেদিন ছিল ২০০৬ সালের এপ্রিলের ছয় তারিখ। একটা মাইক্রোবাসে সব মালপত্র ওঠানো হচ্ছে। আব্বা মাইক্রোবাসের পেছনে কেমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আম্মা জানালার পাশে আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছছেন। ১৮ বছর পর আমার মেয়েটি আমার বাবার পরিবারে একমাত্র শিশু। তাদের কলিজার টুকরা। কলিজার ভেতর থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আমরা ছুটে চলছি অজানা ও অনিশ্চয়তার গন্তব্যে। আমরা তিনজন গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছুটে চলল বিমানবন্দরের দিকে। পেছনে রইল বাবার শূন্য দৃষ্টি আর মার অসহায় কান্না।