বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু

সপরিবার জিনিয়া।ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ছেলেমেয়ের মধ্যে রক্তের সম্পর্কগুলোকে ছাড়া অন্য সব সম্পর্ককেই এখন সন্দেহের চোখেই দেখা হয়। চাচাতো, ফুপাতো, মামাতো, খালাতো ভাইবোন, বেয়াই-বেয়াইন, দেবর-ভাবি, শ্যালিকা–দুলাভাইয়ের মতো এমন মধুর সম্পর্কগুলোয় এখন সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। আমি ঠিক জানি না কীভাবে এই পবিত্র সম্পর্কগুলোয় সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। তবে যতদূর মনে হয়, হিন্দি ও বাংলা সিরিয়ালগুলোর প্রভাবে এমনটা হতে পারে। আগেকার দিনে নতুন করে আত্মীয়তা করার আগে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে বিবেচনায় রাখা হতো সম্মান দেখিয়ে। এতে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হতো না কিন্তু এখনকার সমাজে আগের সম্পর্ক, পরের সম্পর্ক মিলিয়ে এমন একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যায় যে কোনটা আসল সম্পর্ক, সেটা নির্ণয় করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। আর যেকোনো ছেলেমেয়ের মেলামেশাকে সরাসরি সন্দেহের চোখে দেখা হয়, যদি না তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। বাংলাদেশে ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও বিরল কারণ লোকজনের সমালোচনার জবাবে বা যেকোনো কারণেই হোক বন্ধুত্বটা একসময় পরিণয়ে রূপ নেয়। তাই সন্দেহটা দিনে দিনে আরও বেশি ঘনীভূত হয়। আর ছেলেমেয়ের মধ্যে যদি কোনো একজন বা দুজনই বিবাহিত হন, তাহলে তো আরও অনেক রসালো গল্প তৈরি হয়। একটা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছাড়াও যে বন্ধুত্বের মতো খাঁটি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, আমাদের সমাজব্যবস্থা সেটা মেনে নিতে নারাজ।

আমার জীবনে এত দূর আসার পেছনে বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য। একেবারে সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আমিনুর থেকে শুরু করে প্রত্যেক বন্ধু আমার জীবনে কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখে চলেছেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমার কোনো বান্ধবী ছিল না কারণ আমি সত্যিকার অর্থেই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না। পরিবারে মা ছাড়া আর কোনো মেয়ে ছিল না, তাই হয়তোবা আমার মধ্যে একধরনের জড়তা কাজ করত। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পরিচয় হয় বন্ধু জিনিয়ার সঙ্গে, যে এখনো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। আমার মেয়েবন্ধু বলতে এই একজনই যে আমার আদ্যোপান্ত সবকিছুই জানে। আমার আচরণের সামান্য পরিবর্তনেও ও বলে দিতে পারে আমার মনের মধ্যে কী ভাবনা খেলা করছে। আমি যেকোনো বিপদে সবার আগে ওর শরণাপন্ন হতাম। সত্যি কথা বলতে এই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থেকে এখনো শরণাপন্ন হই। ইতিমধ্যেই ওর বিয়ে হয়েছে আর সেই সংসার আলো করে এসেছে রাজপুত্র আর রাজকন্যা কিন্তু আমাদের দুজনের আত্মিকতা এখনো অটুট আছে এবং আমি নিশ্চিত বাকি জীবনটাও অটুট থাকবে।

ফেসবুকের একেবারে জন্মলগ্ন থেকে এটা ব্যবহার করি সাগর ভাইয়ের অসিলায়। সেই সময় আমি সাগর ভাইকে ইয়াহু মেইলে সালাম দিতাম আর তিনি ফিরতি মেইলে আমার সালামের উত্তর দিতেন। সাগর ভাই ছিলেন বন্ধু শিশিরের যতটা না বড় ভাই, তার চেয়ে ছিলেন আমাদের বন্ধু মহলের অভিভাবক। একদিন সাগর ভাই ফেসবুকের লিংক দিয়ে বললেন, এখানে একটা অ্যাকাউন্ট করো, তাহলে আর আমাদের এত কষ্ট করতে হবে না। আমি একটা অ্যাকাউন্ট তৈরি করলাম। শুরুতে আমি সাগর ভাইয়ের ওয়ালে লিখতে গিয়ে প্রায়ই নিজের ওয়ালে লিখতাম। পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তখনো ফেসবুকের প্রতি মোহ বা নেশা তৈরি হয়নি। একবার আমার বুয়েটের রুমমেট তৌহিদ জিজ্ঞেস করেছিল, ফেসবুক জিনিসটা আসলে কী? উত্তরে আমি বলেছিলাম, বন্ধুহীন মানুষদের বন্ধু খুঁজে পাওয়ার জায়গা। দেশে থাকতে ফেসবুকে তেমন একটা বসা হতো না। সংসারের কাজ সামলে বাকি সময় ব্যয় করতাম বই পড়ে, মুভি দেখে আর ঘুরে বেড়িয়ে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর ফেসবুক একেবারে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেল। দেশে মানুষের সঙ্গে সহজে এবং সুলভে যোগাযোগ করার জন্য ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারের কোনো বিকল্প নেই। আর বিদেশের মাটিতে বসে দেশের যেকোনো কিছুর সংস্পর্শ পাওয়ার একটা জানালাও হচ্ছে ফেসবুক। প্রতিনিয়ত দেশকে মিস করার ঘায়ে কিছুটা প্রলেপ লাগে এতে করে। এভাবেই একসময় ফেসবুকের প্রতি মোহ তৈরি হয়ে গেল।

সপরিবার পূবরী পারমিতা বোস।
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকের বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধাও অবশ্য আছে। অনেক পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি, পেয়েছি অনেক অজানা–অচেনা বন্ধুর সন্ধানও। তাদের অনেকের সঙ্গেই সরাসরি কোনো পরিচয় নেই কিন্তু ফেসবুকে বা মেসেঞ্জারে কথা হয় প্রায়ই। আমার নীতি হচ্ছে কারও সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি হলে তার সম্পর্কে জানা কারণ এক–একজন মানুষ আমার কাছে এক–একটা নতুন বই। নতুন বই পড়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি একজন নতুন মানুষের জীবন থেকেই অনেক কিছুই জানা যায়। অবশ্য অনেকেই আমার এই আগ্রহটাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন। অনেকেই জিজ্ঞেস করে বসেন এর পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? সত্যি কথা বলতে আমার আসলে কোনো গোপন অভিসন্ধি থাকে না। এভাবেই অনেক নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে আবার অনেকেই মতের মিল না হওয়ায় আমাকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদও দিয়েছেন কিন্তু আমি কখনোই কাউকে পারতপক্ষে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিই না কারণ প্রত্যেকের জীবন থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে। সবচেয়ে বড় কথা আমি সেই মানুষটাকে আনফ্রেন্ড করলেই কিন্তু সেই এই পৃথিবী থেকে উবে যাচ্ছে না, তাই আমি তাদের আমার বন্ধুতালিকায় রেখে দিই। এতে একদিকে যেমন ভিন্নমতের একজন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়, তেমনি নিজের সহ্যশক্তিও বহুলাংশে বেড়ে যায়।

ফেসবুকের অসিলাতেই কোনো একদিন বন্ধু পূরবীকে হয়তোবা রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। একসময় ও সেটা এক্সেপ্টও করল। এরপর থেকেই আমাদের বন্ধুত্বটা দিনে দিনে আরও পোক্ততা পেয়েছে। আসলে মানসিকতার মিল থাকলে এবং একে অপরের মতামতকে সম্মান করলে যেকোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের এই সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হচ্ছে আমাদের দুজনের আলোকিত এবং বর্ণিল শৈশব ও কৈশোর। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায় কিন্তু ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরের এক বনেদি পরিবারে। বাবা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাই সংসারে তেমন একটা সময় দিতে পারতেন না। পূরবী বেড়ে উঠেছিল ওর মায়ের শাসন এবং আদরে। সেই সময় মফস্বল শহরগুলোতে এখনকার মতো সভ্যতার এত ছোঁয়া লাগেনি। তাই দাদা বা নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে আর আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর খেলাধুলার সব উপকরণের মধ্যেও ছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। আমাদের দুজনের গল্পের মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে এটা। আমরা যে বিষয় নিয়েই গল্প শুরু করি না কেন, আমাদের গল্প গিয়ে থামে আমাদের শৈশবে যেখানে আমরা ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে কখনো দাঁড়িয়াবান্ধা খেলছি, আবার কখনোবা কারও গাছ থেকে আমি চুরি করছি। আবার দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি বাড়ির পাশের পুকুরে।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার একটা দুষ্ট ক্ষত হচ্ছে বড় হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিজেদের যথাসম্ভব ভদ্র ও মার্জিত ভাবতে এবং সেই মোতাবেক চলতে শুরু করি। আমার একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত লাগে যে বাংলাদেশই মনে হয় পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ, যেখানে ধনী ও গরিবের জীবনযাত্রার পাশাপাশি ভাষাতেও বৈষম্য বিদ্যমান। এ ছাড়া আছে রুচির বৈষম্য। গ্রামের মানুষেরা যেসব শিল্পীর গান শুনে শহরে তারা মোটামুটি অপাঙক্তেয়। একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী আছেন যাঁরা বাংলাদেশের সব শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, তারই একজন এন্ড্রু কিশোর। আমাদের গল্পে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য থেকে শুরু করে আসে জীবনযাত্রা। আমাদের শৈশবের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন মুজিব পরদেশী। আমি নিশ্চিত আমাদের প্রজন্মের অনেকেই তাঁর গান শুনেছেন কিন্তু এখন আর সেটা ভদ্রসমাজে বলেন না সম্মান হারানোর ভয়ে কিন্তু আমরা দুজন একেবারে জোর গলায় সেটা বলি এবং প্রচারও করি। এ ছাড়া গ্রামীণ অনেক খাবার আছে যেগুলো শুধু গ্রামের গরিব মানুষরাই খেত। আমাদের দুজনেরই সৌভাগ্য হয়েছে তেমন সব খাবারের স্বাদ নেওয়ার এবং এখনো সেগুলো নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমি যেমন বলি পূজার সময় কলা দিয়ে মাখানো আতপ চালের ভোগের গল্প, ঠিক তেমনিও বলে মিলাদের শেষে শিন্নি হিসেবে দেয়া বাতাসার গল্প। এভাবেই আমাদের গল্পগুলো হয় খুবই উপভোগ্য।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায়ই শুধু নিজের শিাকড়কে অস্বীকার করার ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ নেই। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এসেও আমরা সেই ক্ষুদ্রতা থেকে বের হতে পারিনি যদিও এখানে বাংলাদেশের মেথরশ্রেণির (অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় প্লাম্বার) দৈনন্দিন আয় সবচেয়ে বেশি। বিদেশে এসে সবাই রাতারাতি এমন সব গল্প ফাঁদেন, যেন তাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সন্তান, না হয় সেনাপ্রধানের সন্তান। যাহোক এটা বাংলাদেশের বহু বছরের জীবনচর্চার অংশ, তাই দেশ বদলালেও এই খাসলত বদলায়নি। আশা করি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে একটা সাম্যের বাংলাদেশি কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। পূরবী আর আমি এগুলো নিয়ে আলোচনা করি আর হাসি। আর আছে বাংলাদেশের মতোই দলাদলি ও গলাগলি। আমি বলি সিডনিতে যদি দুজন বাংলাদেশি থাকেন, তাহলে সংগঠন তৈরি হবে তিনটা। প্রত্যেকের আলাদা সংগঠন আর দুজনের মিলিত আরেকটা সংগঠন এবং প্রতিনিয়ত সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের দ্বন্দ্ব। জানি না কবে আমরা এর থেকে বের হতে পারব। কাকতালীয়ভাবে আমি ঠিক তেমনই একটা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম আর পূরবী জড়িত ছিল সেই সংগঠনটার বিপরীত শক্তির সঙ্গে। এটা নিয়ে আমাদের মাঝেমধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়েছে বেশ কবার কিন্তু প্রতিবারই ও মানসিক পরিপক্বতার পরিচয় দিয়ে আলোচনাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি খুব দ্রুতই মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং আগেপিছে না ভেবে তাদের কথামতো কাজ করি। এতে অনেকের সঙ্গেই আমার সরাসরি শত্রুতা না থাকলেও এখন অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলেন।

সপরিবার সাগর।
ছবি: সংগৃহীত

এমনই অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব টিকে আছে। আমি ওকে মামা বলে সম্বোধন করি আর পূরবীও আমাকে মামা ডাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে পূরবী ও মামুন ভাইয়ের সন্তান পৃথিবীকেও আমি মামাই ডাকি। মামুন ভাই আমার দেখা অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ। নিজে ছেলে বলেই জানি যে নিজের সংসার স্ত্রী নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ধরনের জটিলতা থাকে। সংসারে আমরা স্বামী–স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু একে অপরের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করি না। মামুন ভাই পূরবীর সবচেয়ে ভালো বন্ধু তারপর স্বামী তাই ওদের বোঝাপড়াটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। পৃথিবী দুর্দান্ত ছবি আঁকে এবং ছবি একে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছে। আমি ওর ছবির দারুণ ভক্ত বিশেষ করে ওর ছবির বিষয়বস্তু আমাকে ভাবায়। বিভিন্ন উপলক্ষে ফেসবুক পোস্টে আমি ওর আঁকা ছবি ব্যবহার করি। আর ও ছবির সঙ্গে কিছু কথা লেখে, যেটা খুবই মিলে যায় তখনকার বাস্তবতা ও ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে। পৃথিবী যে শুধু ছবি আঁকাতেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছে, ব্যাপারটা এমন না। পাশাপাশি ও দারুণ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা পৃথিবী এখনো বাংলাদেশ দেখেনি আর অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা ওর সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তবুও মায়ের চেষ্টায় ও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে। এ ছাড়া লেখাপড়ায়ও সে ভালো। গত বছর সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে একটা স্বনামধন্য সিলেকটিভ স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

বাংলাদেশিদের মধ্যে গল্প মানেই পরচর্চা আর নিজের এবং নিজের পরিবারের অর্জন নিয়ে বড়াই করা কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার আর পূরবীর গল্পে কখনো এগুলো আসে না। যদিবা কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে চলে আসে, আমরা সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাই। আমাদের আলোচনাতে বরং আমাদের শৈশব–কৈশোরের আচারের পাশাপাশি আসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গল্প, আসে বাংলাদেশের সংগীত থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য। আমি ওর কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি অনেক লেখকের নাম। আমরা এক–একটা বই পড়ি আর তার ভাবনাগুলো শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখি করি তার কড়া সমালোচক হচ্ছে পূরবী। আমার লেখার শব্দচয়ন থেকে শুরু করে বাক্যের গঠন—সবকিছুতেই আছে ওর কড়া নজরদারি। ওর যেহেতু আউট বই পড়াশোনার অভ্যাস আছে, তাই ওর উপদেশগুলো আমার লেখার মানকে সব সময়ই শাণিত করে।

শুরুতেই যে কথাটা বলছিলাম বাংলাদেশের সমাজে যেমন ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকে সহজভাবে নেয় না, ঠিক তেমনি প্রবাসের বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও এটাকে দেখা হয় অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে। আমাদের নিয়ে তাই অনেকেই আমাদের পেছনে অনেক কথাবার্তা বলেন কিন্তু আমরা কেয়ার করি না কারণ আমরা জানি আমাদের সম্পর্কের মাত্রা কতটা। আমাদের দুজনেরই আছে আলাদা সংসার এবং দায়িত্ব এবং আমরা সুচারুভাবে সেটা পালন করার পর আমাদের বন্ধুত্বকে সময় দিই, তার আগে নয়। পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান প্রতিটা সম্পর্কেরই আসলে আছে একটা আলাদা মাত্রা এবং সৌন্দর্য। আমরা যদি একটু সাবধান থেকে সম্পর্কের মাত্রাটা অতিক্রম না করি এবং পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকি, তাহলেই কেবল সম্পর্কের সৌন্দর্যটা আমাদের কাছে ধরা দেয়। আর আমার মতে বন্ধুত্বই হচ্ছে পৃথিবীর বুকে একমাত্র পরিপূর্ণ সম্পর্ক, যেখানে এমন অনেক কথা শেয়ার করা যায়, যেটা অতি আপনজনের সঙ্গেও আমরা শেয়ার করতে পারি না। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, যেখানে একজন মানুষের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও হয়ে ওঠে আমাদের একান্ত আপনজন। আর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে বন্ধুত্বটা হয় অনেক বেশি পরিষ্কার ও পরোপকারী। বন্ধুত্বের জয় হোক। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব নিঃস্বার্থ পরোপকারী বন্ধুরা।