ভেরিফায়েড উইচ্যাট

উইচ্যাট

শৈশব থেকেই জ্যাকি চ্যানের চলচ্চিত্রের খুব ভক্ত ছিলাম। এটা আমাকে চীন এবং চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। জ্যাকি চ্যানের কণ্ঠে অভিনীত কুংফু পান্ডা এবং এর ধারাবাহিক পর্বগুলো দেখার পর আমার আগ্রহ আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, আমি একদিন চীনে যাব।
হুনান প্রদেশের চাংশা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়। দিন দিন আমি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। এটি আমার জীবনে ভারসাম্য নিয়ে আসে এবং উপলব্ধি করি যে চীনে পড়াশোনা আমার পাওয়া উপহারগুলোর মধ্যে একটি চমকপ্রদ। যদিও চাংশায় শুরুতে আমাকে অনেক বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিছু অভিজ্ঞতা এখনো স্মৃতিতে ভাসে।

‘জাতীয় দিবসের ছুটি’ চলার সময়ে আমি প্রথম চীনে আসি। ওই সময়ে স্বাভাবিকভাবে ক্যানটিন, দোকানপাট এবং রেস্তোরাঁ সবকিছু বন্ধ থাকে। নতুন পরিবেশে এটা আমাকে কিছুটা বিব্রত করেছিল। পরিবারের ছোট ছেলে হিসেবে সবার আহ্লাদের। তাই চীনে পরিবারকে খুব মিস করতাম। ওই সময় আমি শুধু ভাবতাম যে আমি কোনোভাবেই সেখানে থাকতে পারব না এবং আমাকে হয়তো দেশে ফিরে আসতে হবে। তবে আমার স্বদেশি এবং অন্য শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। কেউ কেউ তো মাঝেমধ্যে আমার জন্য সুস্বাদু খাবার বানিয়ে নিয়ে আসত। আমি কখনোই ভাবিনি যে আমি এমন একটা চমৎকার আন্তর্জাতিক পরিবারের সদস্য হব, যেখানে নানা দেশের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা করছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় একদল বিদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে মাঠে খেলতে যেতাম। সেখানে আমাদের অনেক চীনা লোকের সঙ্গে দেখা হতো। এভাবে আমি অনেক চীনা বন্ধু পেয়ে যাই।

এক সপ্তাহের মধ্যে আমি চীনা খাদ্যসংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে বাইরে যাই। শিমেনের (পশ্চিম গেট) রাস্তার ধারের স্টলে স্টিংকি তাও ফু দেখে আমি অবাক হয়ে যাই যে আমি এগুলো ইন্টারনেটে কত দেখেছি। তবে সেদিন তাও ফুর স্বাদ নেওয়ার মতো আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। পরের দিন, কিছু কেনার জন্য স্কুলের শিমেনে যাই। আমি একটি স্টলে একজন পুরুষ ও নারীকে কিছু তাও ফু পণ্য সরবরাহ করতে দেখি। স্টলে গিয়ে আমার অনুবাদক যন্ত্র ব্যবহার করে আমি একটি পানির পাত্র চাই। দোকানি আমাকে অভিবাদন জানিয়ে জবাব দেন যে এই জিনিসগুলো কেবল তাও ফু ব্যবহারকারীর জন্য। এটি আমাকে হতাশ করেছিল যে অনলাইন থেকে কেনার জন্য আমার কাছে তখনো কোনো ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম ছিল না। লোকটি ব্যাংক কার্ড যুক্ত করে উইচ্যাট এবং আলিপে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আমাকে শিখিয়ে দেন। তিনি আমার চীনদেশীয় ভাই, যার নাম লিও। তাঁর সাহচর্য চীনে আমার জীবন নাটকীয়ভাবে বদলে দেয়।

চীনে বেশির ভাগ জিনিস অনলাইনভিত্তিক। যেখানে উইচ্যাট ছাড়াই জীবন একরকম অসুবিধার বলা চলে। কারণ, প্রতিটি পদক্ষেপে যেমন অর্থ আদান-প্রদান, জিপিএস নেভিগেশন, সামাজিক জীবন ইত্যাদির জন্য উইচ্যাট প্রয়োজন। কিন্তু সিম কার্ড না থাকায় আমি উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট তখনো খুলতে পারিনি।

ওখানে আমাদের প্রায় আধা ঘণ্টা কথা হয়। তাঁর বান্ধবী ইংরেজিতে কথা বলা জানত না। তবে তিনি লিওর মতো বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে অতি আগ্রহী ছিলেন। এ জন্য লিও দোভাষী হিসেবে মতবিনিময় করছিলেন। আমি জানতাম যে চীনারা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ, তবে কখনো ভাবেনি যে তারা এতটা অমায়িক। আমার সমস্ত নতুন অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে আলোচনা করি, এমনকি সেই দুঃখের দিনগুলোর কথাও। তারা আমার প্রতি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হতে পরামর্শও দেয়। এমনকি আমার অবসর সময়ে তারা আমাকে পুরো শহর ঘুরে দেখানোর কথা জানায়। লিও বেজায় খুশি ছিল যে ছয় বছর পরের সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারছে। আমিও খুশি ছিলাম যে তারা আমার প্রতি এতটা সদয় এবং সহানুভূতিশীল দেখে।

আমাদের শিক্ষাবর্ষ ‘জাতীয় দিবসের ছুটির’ পরে শুরু হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে আমি নিজে থেকে সবকিছু শিখতে শুরু করি। যদিও কোনো নতুন পরিস্থিতিতে এটা এতটা সহজ ছিল না। বিদেশে আসার আগে আমি জীবনের বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কে সীমিতই সচেতন ছিলাম। তাই নিজেকে আরও ভালোভাবে জানা এবং ভিন্ন সংস্কৃতি বোঝা এবং সেগুলোকে সামঞ্জস্য করে চলতে শেখা আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল।

সিম কার্ড কেনা এবং উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার পর দ্রুত আমি ‘CSUST 2018’ গ্রুপে যোগদানের চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের স্কুলের সব অফিশিয়াল তথ্য গ্রুপটির মাধ্যমে জানা যায়। তবে গ্রুপটির সদস্যসংখ্যা এরই মধ্যে শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। গ্রুপের আইন অনুসারে, আমি আর গ্রুপটিতে যোগ দিতে পারিনি। আমার অ্যাকাউন্ট যাচাই করার একমাত্র উপায় ছিল আমার উইচ্যাটের সঙ্গে যুক্ত একটি বৈধ চাইনিজ ব্যাংক কার্ড। নতুন অভিবাসন অনুমতিপত্র না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনো ব্যাংক কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারব না। এর জন্য, আমাকে এক্স-২ ভিসা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সন্ধ্যায় ভলিবল খেলতে আমাদের স্কুল লাইব্রেরির পাশের খেলার মাঠে যেতাম। স্কুলের স্টেডিয়ামটি সেখানেই অবস্থিত। প্রচুর চীনা ও বিদেশি শিক্ষার্থীকে বার্ষিক প্রোগ্রামের জন্য সেখানে রিহার্সেল করতে দেখতাম। সব সাংস্কৃতিক দলকে সংঘবদ্ধ করে রাখতে বিভিন্ন দেশের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে একটি গ্রুপ রয়েছে। যাচাই করা উইচ্যাট আইডি না থাকায় আমি সেই গ্রুপেও যোগ দিতে পারছিলাম না, ‘সিএসইউএসটি’-এর প্রধান গ্রুপের মতো। গ্রুপটি মূলত এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি, যারা নানামুখী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ফলে আমি একটি ব্যাংক কার্ডের গুরুত্ব অনুভব করছিলাম।
মঙ্গলবার আমাদের কেবল সকালবেলা ক্লাস থাকত। তাই লিও এবং তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে আমি প্রথমবারের মতো শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে বের হই। গাড়িতে লিও এবং তাঁর বান্ধবী আমাকে চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে বলছিল। মাঝেমধ্যে লিও দোভাষী হিসেবে ব্যাখ্যা করছিলেন। অরেঞ্জ আইল্যান্ড ঘুরে দেখার পর আমরা একটি রেস্তোরাঁয় গেলাম। এটি শিয়াং নদীর পূর্ব পাশে ছিল। রেস্তোরাঁটির ছাদ থেকে একদিকে ইউয়েলু পর্বত, অন্যদিকে চাংশার সর্বোচ্চ ভবন আইএফএস টাওয়ার দেখা যাচ্ছিল। আমি চাইনিজ খাবার এবং চারপাশের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আমি সব সময় বিচিত্র খাবারের আস্বাদন নিতে পছন্দ করি। চীনের মতো সমৃদ্ধ খাদ্যসংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ সর্বদা দুর্দান্ত। হাজার বছরের পুরোনো ডিমসহ আমরা আরও কিছু মুখরোচক খাবার খেলাম। লিওর কারণে প্রচুর বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের স্বাদ নিতে পেরেছি।

বিদেশের মাটিতে আমি জীবনে ভারসাম্য নিয়ে আসতে চেষ্টা করছিলাম, তবে কখনোই ভাবিনি যে ওই সময়টাতে অপ্রত্যাশিত কিছু অপেক্ষা করছে। চীনে যাওয়া দ্বিতীয় সপ্তাহের মাথায় চাচাকে হারাই। ঘটনাটি ছিল ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। লিও ও তাঁর বান্ধবী পরের দিন আমাকে ডিনারের জন্য বলেছিল। আমি আর আমার রুমমেট এসব নিয়ে কথা বলছিলাম। সে তাদের প্রশংসা করছিল যে তারা আমার খুব দেখাশোনা করছে। হঠাৎ করে বরাবরের মতো আমার বোনের একটি টেক্সট বার্তা পেলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন দিই। ফোনের অন্য পাশে চুপ করে রইল। রুমের সামনে একটি জরুরি বহির্গমন পথ ছিল। আমি সেখানে গিয়ে সিঁড়িতে বসলাম। ফোনের এক পাশে কাঁদতে শুরু করলাম এবং সে অন্যদিকে। বাংলাদেশি কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাকে সেই অবস্থায় দেখতে পায়। তারা জিজ্ঞাসা করছিল, কী হয়েছে। আমি তাদের জবাব দিতে পারছিলাম না। আমি বোনের বার্তা তাদের দেখাই। কিন্তু সিলেটি ভাষায় লিখিত বার্তা তারা পড়তে পারেনি। তবু তারা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সেদিন রাতে আমি মোটেও ঘুমাতে পারিনি।

পরদিন আমি ভাঙা মন নিয়ে ক্লাসে যাই তবে পড়ায় মন বসাতে পারিনি। বিকেলে আগাম ছুটি চেয়ে ডরমিটরিতে ফিরি। ঘুমানোর সময় ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। ক্লাস অনেক আগে শেষ হয়েছে কিন্তু কল ধরছি না। তাই লিও বান্ধবীসহ আমাদের ডরমিটরিতে আসেন। চাচার শোকসংবাদ শুনে তাঁরা হতবাক হয়ে যান। বাবা-মা আমাকে ওই সময় ফোন দেন। লিও আমার বাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁকে আশ্বস্ত করে যেন তাঁরা চিন্তা না করেন।

সেই সময় থেকে তাঁরা সত্যিই আমার প্রতি আরও বেশি সদয় হয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে এক মাসের মধ্যেই ব্যাংক, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, রেলস্টেশন এবং অন্য জায়গাগুলো যেখানে আমি যেতে পারি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। চাংশার কিছু বিখ্যাত পথ খাবারের জায়গাগুলোতেও আমি তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। যার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা পোত্‌জি স্ট্রিট, যা উয়ি বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত। দিন বা রাত—এটি সর্বদা ব্যস্ত থাকে। তবে আমার মতে নানমেনকু ফুড স্ট্রিট চাংশায় সস্তার পথ খাবারের জন্য বেশ ভালো। এখানে দুর্গন্ধময় তাও ফু, কউ’উই চিংড়ি এবং মসলাদার হাঁসের মাংস খুব সাধারণ খাবার। তবে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে এবং দীর্ঘ সময় আড্ডা দিতে ওয়েন মিয়াও পিং ফুড স্ট্রিট বিখ্যাত। কারণ, এখানে অন্যান্য জায়গার মতো ভিড় নেই।

চাংশা ইকোলজিক্যাল পার্ক আমাদের স্কুলের কাছেই। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন প্রাণীদের নিয়ে এসে রাখা হয়েছে। চাংশায় আসার পরপরই পান্ডা দেখার জন্য চিড়িয়াখানাটি দেখতে যাওয়া আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিল। আমি সেখানে অনেক প্রজাতির বানর দেখেছি, যা আমি এর আগে দেশেও দেখিনি। চীনা বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি যে একবার ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ সেখানে আনা হয়েছিল। এ কারণেই বাঘ আসার পর অনেকেই বাংলাদেশকে চেনে। চিড়িয়াখানায় গিয়ে আমি সাইবেরিয়ান বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বাঘ দেখতে পাই, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে আমাদের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ খুঁজে পাইনি।

আমি যখন ব্যাংক কার্ড পাই, তখন মাস পেরিয়ে গেছে। এটি ছিল ব্যস্ত এবং চীনা জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি দিন। ওই দিন ছিল শুক্রবার যখন আমি ব্যাংকে ব্যাংক কার্ড খুলতে যাই। সেদিন আমাদের চার ঘণ্টার মাত্র একটি ক্লাস ছিল এবং এটি আমাদের চীনা ভাষার শিক্ষকের অসুস্থতার কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। আমি ব্যাংকে যাই। আমি যখন ব্যাংকে ঢুকি তখন তারা জানায় যে তারা কিছু ফাইল পেয়েছে এবং তারা দিনে তিনটির বেশি অ্যাকাউন্ট খোলে না। এটি আমাকে হতাশ করেছিল। তবে তারা একই ব্যাংকের আর একটি শাখার পরামর্শ দিয়েছিল এবং আমি কীভাবে সেখানে যেতে পারে। তবে প্রথম দিকে হওয়ায় চীনা মানচিত্র ব্যবহার করা আমার পক্ষে সেখানে যাওয়া কিছুটা কঠিন ছিল।

আমি এক ঘণ্টা পর অন্য একটি শাখায় যাই। পারস্পরিক বোধগম্যতার অভাবে আমি তাদের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি মূলত চীনা ভাষায় কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, বিশেষত যখন ক্যাম্পাসের বাইরে। তারা আমাকে সাহায্য করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিদেশি হিসেবে তারা আমার জন্য কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেনি। সব দিকনির্দেশ দেখিয়ে তারাও আমাকে প্রধান শাখায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এটি আমাকে আরও হতাশ করেছিল। আমার শৈশব থেকেই, যদি আমি কোনো কিছুর প্রতি আমার জেদ তৈরি হয়, তবে আমি এটিকে যেভাবেই হোক শেষ করি। সুতরাং আমি হাল ছাড়িনি।
আমার মানসিক শক্তি বাড়িয়ে আমি আবার বাস এবং মেট্রো দিয়ে যাত্রা শুরু করি। আমি আমার একঘেয়েমি দূর করতে ভিডিও দেখছিলাম। আমার ফোনে পর্যাপ্ত পরিমাণ চার্জ ছিল না। এমনকি আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি পাওয়ার ব্যাংকটিও সঙ্গে নিইনি। মধ্যাহ্নভোজের সময় আমি সেখানে পৌঁছাই। ব্যাংকটি খুঁজে পেতে আমার প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমি একটি ব্যাংক কার্ড খোলার জন্য আমার কাগজপত্রগুলো সেখানে জমা দিই। তারাও তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেখানেও আমার এক ঘণ্টা ব্যয় হয়, তবে শেষ পর্যন্ত কাজটা সফল হয়নি। আমি আশাহীন হয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে পড়ি।

তখন আমি কিছুটা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম। দুপুরের খাবারের জন্য একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। চীনে একজন নবাগত হিসেবে চপস্টিকের সঙ্গে আমাকে তখনো লড়াই করতে হচ্ছিল। কিছু লোক অবাক হয়ে চপস্টিকের সঙ্গে আমার যুদ্ধাবস্থা দেখছিল। আমি অবসর সময়ে সাধারণত চীনা লোকদের সঙ্গে চা বা কফি পান করতে এবং তাদের কাছ থেকে চীনা শেখার জন্য পুরো বিকেল একটি রেস্তোরাঁয় কাটিয়ে দিতে পারি। তাড়াহুড়ো থাকায় তখন আর রেস্তোরাঁয় এটি উপভোগ্য হয়নি।

খাবার শেষে আবার আমি অন্য ব্যাংকের সন্ধানে বের হই। কিন্তু ‘সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না’, সময় খুব দ্রুতই পার হচ্ছিল। আমি ব্যাংকের সন্ধানে অনেক সময় ব্যয় করেছি। ফোনটিও তখন বন্ধ। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আমি লোকদের কাছে সাহায্যের জন্য যাই। কিন্তু আমি তাদের বুঝতে পারি না। আমি আমার স্কুল থেকে অনেক দূরে ছিলাম। আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। আমার শুধু কাঁদতে বাকি তখন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এমন নাজুক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কেবল পুলিশই আমাকে সহায়তা করতে পারে। আমি পুলিশ বক্সের সন্ধানে এগিয়ে গেলাম। ২০ মিনিট পর খুঁজে পেলাম। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের কেউই ইংরেজি বলতে পারেন না। সুতরাং আমি তাঁদের সঙ্গে একটি কথাও বলতে পারিনি। ‘মানবহৃদয়ে আশার বাণী চিরন্তন’। অন্য কোনো পুলিশ বক্সের সন্ধানে আমি আবার হাঁটা শুরু করি।

ভাগ্যক্রমে ৫ মিনিট হাঁটার পর একটি টহলরত দল খুঁজে পাই। তারা রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। হাত নেড়ে আমি তাদের ইশারা দিই। তারা আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। তাঁদের দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। তাঁরা আমাকে নিকটতম ব্যাংকে নিয়ে যান, তখন প্রায় ৩টা ৪০ বাজে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক যত্নসহকারে সেবা দিলেন। আমার ফোনটি চার্জে দিয়ে তিনি আমার জন্য কাগজপত্র পূরণ করতে শুরু করেন। আমি যখন ফোনটি চালু করলাম, তখন আমার কাছে একটি নিশ্চিতকরণ বার্তা পাঠানো হয়েছিল। অবশেষে ব্যাংক কার্ডটি হাতে পাই।

অতঃপর আমি সিএসইউএসটি অফিশিয়াল এবং সাংস্কৃতিক গ্রুপে শতাধিক সদস্যের সঙ্গে যুক্ত হই। সাংস্কৃতিক গ্রুপে স্বদেশি ভাইয়ের কাছ থেকে দুর্গন্ধময় তাও ফু খাওয়ার চ্যালেঞ্জ পাই। সুতরাং আমি আমার চীনা বন্ধুদের সঙ্গে এর স্বাদ নিতে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। পরের দিন আমরা তাও ফু খেতে শিমেনে যাই। এটি বাইরে মচমচে হলেও ভেতরে নরম এবং খুব সুস্বাদু। আমার কিছু বন্ধু এটার তীব্র গন্ধের কারণে চিৎকার করতে শুরু করে। তখন আমার উপলব্ধি হলো যে আমি চীন এবং চীনা সংস্কৃতির গভীর মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি।

বিদেশে পড়াশোনা আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকা একসময় এত সহজ ছিল না। আমার মতে শিয়াং নদীর দুই তীরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে চাংশা একটি বিশ্বজনীন শহর; অর্থাৎ এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক কিছু রয়েছে, যাতে সে নিজেকে জড়িত করতে পারে। চীন প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং এই প্রদেশে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। এ জন্য চাংশাকে আধুনিক চীনের জন্মস্থান বলা যেতে পারে। শিয়াং নদীর মাঝখানে একটি বিশাল দ্বীপ রয়েছে। কমলাবাগানের প্রাচুর্যের কারণে একে ‘অরেঞ্জ দ্বীপ’ বলা হয়।

বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কয়েক বছর ধরে হুনানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। সুতরাং যেকোনো বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় দিবসে, আমরা সবাই একত্র হয়ে দিবসটি উদ্‌যাপন করি; বিশেষত পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি। এভাবে অন্য বাংলাদেশিদের মতো অরেঞ্জ আইল্যান্ড আমার কাছেও প্রিয় জায়গা হয়ে ওঠে, যেখানে আমরা প্রায়ই ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য যাই। দিনে দিনে চাংশা আমার ভালো লাগার নগরী এবং আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে ওঠে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অটোমেশন, চাংশা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাংশা, হুনান, চীন