মন খারাপের ক্ষণ

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

মাঝেমধ্যে কেন যেন মন খারাপ হয়ে যায়! মন খারাপের কোনো কারণ নেই! ভালোবাসার ঘর! প্রেমিক স্বামী, আদরের বাচ্চাকাচ্চার খুনসুটিতেও কেন যেন মন আটকে থাকে না মাঝেমধ্যেই। মন যে কোথায় পালায় সে দিনগুলোতে! কোথায় পালাতে চায় সুমনা বুঝতেও পারে না। এত ভালোবাসার মধ্যেও সে খুঁজে বেড়ায় তাকে, যে সুমনাকে কোনো দিনও ভালোবাসেনি।

সুমনা ভুলে যায়, ওর ভালোবাসা একতরফাই ছিল। না, চাইতে সে শেখেনি কখনো। ভালোবাসা কি চেয়েচিন্তে হয়? ভালো না বাসলে কি সে ভালোবাসা আদায় করা যায়?

এই যে কার জন্য হুটহাট ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের পানি ঝরছে! সে কি কখনো জানবে? কখনো তার এ ভালোবাসার সম্মানটা করবে? না জানতে পারবে, না সম্মান করবে, না তার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো দিন একবারও বলবে, সুমনাকে সে ভালোবেসেছিল! কোনো দিনও সে সুমনার চোখের জল মুছে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখবে? ভালোই তো কখনো বাসেনি! কিছু আশা করাই বাতুলতা!

তারপরও সুমনা উদাস ক্ষণে মনের ভুলেই নিজেকে আবিষ্কার করে চোখের জলের প্লাবনে! ওর কষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। জীবনে সুখের জন্য যা যা দরকার, তার সবই আপাত তার আছে! অথচ সুখটাই নেই! কী যে সুখের অসুখে সুমনা অহর্নিশ পুড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ জানে না! সুমনা কাউকে বলতেও পারে না! কী বলবে সে?

এটাই কি সুখের অসুখ? সুখে থাকলে ভূতে কিলায়—একেই কি বলে! দুঃখ বিলাস কি এরই নাম? সব থাকতেও সেই যে রঙিন স্বপ্ন...সেই স্বপ্নই নেই? এর নাম কি ভালোবাসা? এর নাম কি নিজেকে ঠকানো? নাকি সবাইকে ঠকাচ্ছে সুমনা নিজের অজান্তেই? নিজে সুখী হওয়ার সব উপকরণ নিয়েও সুখী হতে না পারাকে কী বলে? বাগধারা পড়েছিল ছেলেবেলায়...না এমন কোনো বাগধারার সঙ্গে পরিচয় নেই সুমনার। জীবনের সব সুখের মধ্যে থেকেও সুখ খুঁজে বেড়ানোর মানেটাও ওর কাছেই ঠিক পরিষ্কার নয়! কী চায় ও? এমন না যে স্বামীকে সে ভালোবাসে না। স্বামীকে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে। সংসার করে মন দিয়েই। প্রতিটি কর্তব্য পালন করে নিষ্ঠার সঙ্গে।

স্বামী–সন্তান নিয়ে আপাত ভীষণ সুখের সংসার তার। সেই ব্যস্ত সুখের সংসারে কারও জন্য দুফোঁটা চোখের পানি ফেলার সময় বের করাও বিলাসিতারই নামান্তর! তবে সে কি বিলাসী? দুঃখ বিলাসী? তবে কেন সে প্রায়ই নিজেকে আবিষ্কার করে অকারণ চোখ ভরা জলে?

সেই ছোটবেলার দুদিনের খেলার সাথি কেন তার মনে হাহাকার এনে দেয়? তার সঙ্গে দুদিনের পরিচয় বৈ নয়। তারা একে অন্যের হবে বলে কথাও দেয়নি। দেওয়ার সময়ই হয়নি। তবুও সেই খেলার ক্ষণে ছুঁয়ে দেওয়া, সেই চুলের গন্ধ...সুমনাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনমনা করে দেয়! কী যেন নেই হঠাৎ করেই মনে হয়! সেই কী নেই, ও কিন্তু খোঁজে না। খুঁজতে চায় ও না। শুধু সেসব ক্ষণে খুঁজে পায় হঠাৎ করেই তার দুচোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে! যেন না চাইতেই চাতক বৃষ্টি! সুমনা চায় না, সত্যিই চায় না এভাবে হঠাৎ শ্রাবণের বৃষ্টিতে চোখ–মুখ ভেজাতে—অথচ কী অসহায়ভাবে আবিষ্কার করে...ও কাঁদছে! আকুল হয়ে কাঁদছে! কেন কাঁদছে, তা ঠিক পরিষ্কার নয় সুমনার কাছে! কান্নাগুলোতে শব্দ হয় না, অথচ সুমনা জানে সে ভীষণ কান্নার চিৎকার, সুমনা নিঃশব্দে গিলে ফেলছে! কী ভীষণ কষ্ট, সে কষ্ট গিলে ফেলার...সুমনা ছাড়া আর কেউ জানেও না! জানবেও না কোনো দিন!

প্রথম আলো ফাইল ছবি

কে জানে সে কত বড় হয়েছে আজ! কে জানে সে কি কোনো দিনও সুমনার চুলের গন্ধ পেয়েছিল? কে জানে সে খেলার ক্ষণে ছোঁয়া তাকেও আন্দোলিত করেছিল কি না! কে জানে সুমনা তার মনে কোনো রেখাপাত কখনোই করেছিল কি না! হয়তো করেনি। করেনি বলেই ভালোবাসাটাও আসলে হয়নি। কিশোরী মনে শুধু দাগ কেটে গেছে।

প্রথম কারও ছোঁয়া! সুমনা জানেও না সে আজ কোথায়! নিশ্চয়ই তারও সংসার হয়েছে! নিশ্চয়ই তার সুমনাকে ভাবার মতো সময় বা কারণ নেই! হওয়ার কথাও নয়! দুদিনের বন্ধু! না তাকে পুরো চেনে সুমনা, না সে জানে সুমনার মনের কথা! তারপরও সুমনার একটিবার সেই কিশোরটিকে দেখতে ইচ্ছা হয় এত বছর পরে! সে নিশ্চয়ই আজও কিশোরটি নেই! খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে হয়—তার সুখী সংসার! জানতে ইচ্ছে হয় তার চুলে কি সেই মাদকতা আজও আছে, না বুড়িয়ে গেছে! সেই হাসি? লাজুক হাসি? হয়তো নেই। কিছুই নেই। কিছুই জানে না সুমনা। তারপরও জানতে কী ভীষণ ইচ্ছা হয়!

ভালো কি সুমনা বাসে তাকে? সে–ও কি সম্ভব? তার সুখের সংসার! সে কী করে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে? নাকি সে ভ্রম! ভাতঘুমের যে শান্তি বিলাস, এ–ও তার মতো সুখ বিলাস সুমনার ব্যস্ত জীবনে? সুমনা বিভ্রান্ত হয়ে যায়! জীবন কেন এভাবে খেলছে তাকে নিয়ে? সুমনা তো সহজ–সরল একটি জীবন চেয়েছিল। সেই সহজ হিসাবের জীবনে সে আজ কারও স্ত্রী, প্রেয়সী, কারও মা, কারও দুচোখের মণি! কত শত সম্পর্কের বেড়াজাল তার! এরা তার জন্য জীবনও দিতে পারে! তবে, তবে এ কী চলে সুমনার মনে? কেন? কেন এই মনের তামাশা সুমনার সঙ্গে?

এ চোখের জলের নাম কী তাহলে? কেন এ চোখের জল? সুমনা জানে ভালো করেই এ চোখের জলের একটি একটি বিন্দুর মূল্য! সে অমূল্য চোখের জলের একটি বিন্দুর দাম দেওয়ার সামর্থ্য বা মূল্য বোঝার ক্ষমতাও হয়তো সেদিনের সে কিশোরটির নেই! সুমনা তারপরও জানতে চায়, কেন এ চোখের জল? চোখের জলের কারণ! তার সার্থকতা!

জানে কোনো মানেই নেই! তারপরও সে হাহাকারের কান্না থামাতে পারে না—সে অক্ষমতায় নিজের ওপর রাগ হয়, আর সে রাগে সে আরও কাঁদে!

এর নাম কি ভালোবাসা? ভালোবাসা কি এমন হয়? শুধুই কাঁদায়? অথচ ফেইরিটেলে পড়ে বড় হয়েছে...‘অতঃপর তারা সুখেশান্তিতে বসবাস করতে লাগল’। সে তো কোনো দিনই তার ছিল না, কোনো দিনই তার হতে পারবে না। আজ সুমনাও অন্য কারও, সুখী তো সে–ও! এ কি ভালোবাসা না মনের দোটানা? নাকি অল্প বয়সে প্রচণ্ড ভালোবেসে না পাওয়ার হতাশা? নাকি শুধুই ভ্রম? কবে সুমনা এর উত্তর পাবে? না, কোনো দিনও জানা হবে না? সুমনা জানে, কিশোরটি তাকে কোনো দিনও ভালোবাসেনি। সুমনার একতরফা দুদিনের ভালোবাসা কী ভীষণ টোল তুলে যাচ্ছে তার ওপর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর! টোল তুলতে তুলতে সুমনাকে নীরবে নিঃস্ব করে দিচ্ছে! সুমনা মন খারাপের ক্ষণগুলো ভুলে যেতে চায়! কেন মন খারাপ তা বোঝে না? কেন সুমনাকে দুদণ্ড শান্তি দেয় না?